TopTime

আজ ২৬ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কবিতা নির্মাণ: নেপথ্যে ১টি গাণিতিক মডেলের চেতনা | দ্বিতীয় পর্ব | রাহুল গাঙ্গুলী


দ্বিতীয় পর্ব:

গণিত নিয়ে আমরা সকলেই কমবেশি চর্চা করেছি। খুব উঁচুস্তরের কথা না বললেও, গণিত বিষয়টি কী; তার সাধারণ উদ্দেশ্য কী; তার সাধারণ প্রয়োগ কীভাবে হতে পারে; ইত্যাদি বিভিন্ন সাধারণ পর্যায়ের একটা প্রাথমিক ধারণা আমাদের সকলেরই আছে। যদিও, এই বাঁধাগতের চর্চায় গণিতের নেপথ্যে থাকা দর্শন বা বলা ভালো লজিক’টির প্রতি লালনপালন করার মানসিকতা আমাদের মধ্যে কম। যে কারণে, সভ্যতা বিকাশের ইতিহাসে আমরা ছোটোবেলা থেকে যতোটা আগুন ও চাকা আবিষ্কারের প্রতি মনোযোগ দিয়ে থাকি; শূন্য বা গুহাচিত্র সম্পর্কে বিস্ময়টা কম। এমনকি, ছোটোবেলায় একদম প্রাথমিক অবস্থায় ~ আমরা যখোন সংখ্যা ও যোগ/বিয়োগ/গুণ/ভাগ প্রভৃতি শিখি; গণিতের ইতিহাস আমরা কেউই পড়ি না। সেকারণেই হয়তো আমরা গণিতের নিয়মানুবর্তিতা শিখি, তাঁর নেপথ্যে থাকা প্রকৃত ধারণা নয়। আর এটা আমাদের আবহমান চলতে থাকা দুর্বলতা; একথা না মানতে চাইলেও সত্যি। আর এটা গভীর দুঃখেরও। এই কথাটা একারণেই বললাম: গাণিতিক ভাষা হলো, ডিজিটাল একটি ভাষা (যেরকম যেকোনো ভাষা প্রকাশ করতে প্রয়োজন হয় একটি অভ্যস্ত মাধ্যমের); কিন্তু এর নেপথ্যে থাকা ধারণাটি হলো শাশ্বত এবং এটা একারণেই যে ~ যেকোনো ঘটনার সৃষ্টি থেকে বিবর্তন’কে, এই ধারণা-প্রক্রিয়াটি’র দ্বারা যোগাযোগ স্থাপনের মধ্যে দিয়ে ব্যাখ্যা সম্ভব। এই ব্যখাগুলির অন্তর্গত যেসকলের প্রয়োগ ঘটেছে ~ সেগুলি ফলিত, অবশিষ্ট যা: প্রকল্পনা বা প্রাক-প্রকল্পনা বা অদৃশ্য। যেরকম ‘শূন্য’ মানেই কিছু নেই নয়; ত্যামোনই ‘অদৃশ্য’ মানেই কিছু নেই সেখানে তা নয়। যদিও এসবের (কিছু নেই) প্রায় সবটাই বিমূর্ত; তবুও গাণিতিক ভাষায় তার মূর্তরূপ ঘটানো সম্ভব এবং তা হচ্ছেও। য্যামোন ধরা যাক: গত এক ঘণ্টায় ক’ফোঁটা বৃষ্টি পড়লো, এটি বিমূর্ত। কিন্তু কতটা বৃষ্টি হলো, এটি পরিমাপযোগ্য। এখানে, ‘পরিমাপ’ বিষয়টি ~ বিমূর্ততার মূর্তরূপ। এটাই হলো প্রাথমিক স্তরের গাণিতিক লজিক। আর, যেকোনো বিষয়ের ট্যাগকৃত বা অন্তর্গত যেকোনো ঘটনা; য্যামোন চিকিৎসাবিজ্ঞান/ইতিহাস/ভূগোল/মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি সবকিছুরই বিমূর্তরূপ’কে এই গাণিতিক ধারণার প্রয়োগে মূর্ত ও অভ্যস্ত মাধ্যমে রূপান্তরিত করা সম্ভব। সাহিত্য ও শিল্প বিষয়টিও এর বাইরে নয়। বরং সভ্যতার দৈনন্দিন জীবনের চালিকাশক্তির পেছনে থাকা, প্রতিটা প্রযুক্তির নেপথ্যে গাণিতিক ধারণা রয়েছে। অতি-উৎসাহী পাঠক যদি একথার আরো গভীরে প্রবেশ করতে চান ~ অনলাইন ‘মুজনাই’ পত্রিকায় লেখা একটি প্রবন্ধের শুরুর পর্বগুলি পড়ে দেখতে পারেন, শিরোনাম “আন্তর্জাতিক কবিতার বাঁক বদল”।

কিছুসময় আগে, একটি ফেবু পোস্ট এখানে আরেকবার প্রয়োজনীয় মনে করেই দিলাম। শিরোনামটি ছিলো “বাঙালি কবিতা-আঁতেলদের প্রতি খোলা বক্তব্য”:

১ + ১ = ২
১ = ২ – ১

এটি গণিতের ১টি সহজবোধ্য স্পষ্ট লজিক। আসুন এই লজিকটিকে নিয়ে, ১টা কবিতা লেখার প্রচেষ্টা করা যাক।

##

পাখি + পাখি = বাসা
একলা পাখি = বাসা - পাখি
বাসা + পাখি ≠ একাকী ভালোবাসাবাসি
                    → অস্পষ্ট সমীকরণ

##

আপনারা বলতেই পারেন ~ এখানে কবিতা কোথায়, এটা স্রেফ সমীকরণ। আচ্ছা, একথা যদি মেনে নিই, তাহলে একে কবিতা বানানোর চেষ্টা করা যাক।

###

ডালে এসে বসলো পাখি।
বসলো      আরো একজন
ভালোবাসাবাসি
তারা বানালো বাসা
তারপর          একটি পাখি উড়ে গেলো
অবশিষ্ট পাখিটা এখন একা। বড্ড একা
যেভাবে        অস্পষ্ট সমীকরণ। একাকী

##

এখন দ্বিতীয় অংশটি কবিতাগোছের কিছুর দিকে কি এগোলো? অতএব, গোছাগোছা শব্দের অলংকার ব্যবহার করলেই কি তা কবিতা? যেখানে, কবিতার গঠন & মননে → কাব্য/অতিকাব্য/কাব্যময়োতা/কাব্যহীনতা ~ নানাবিধ বিষয় থাকছে।

একটু ভেবে দেখুন: এখানে কিন্তু আলোচিত গোটা বিষয়টিই ‘নির্মিত কবিতা’; যা আগে বলেছি অটোমেটিক রাইটিং-এর পাশাপাশি। এবার, যখনই এখানে অনুসন্ধান উদ্দেশ্যে উদ্ভাবনী প্রয়োগ ঘটানো হবে ~ সম্পূর্ণ সৃজনশীল বিষয়টি প্রবেশ করে যাবে তৃতীয় ধারার কবিতায়। আর এই তৃতীয় ধারাতেই এটাও বলা যায় যে, “গাণিতিক ধারাণাই যেকোনো মূর্তরূপকে, বিমূর্তরূপে নিয়ে যেতে পারে”। এই বিমূর্ততা হলো এমন একটি শূন্যস্তর, যেখানে শূন্য কোনো সাংখ্যিক শুরু নয়; সে অসীম এবং নিরাকার। উদাহরণ হিসেবে সকলের অতি-পরিচিত একটি তুলনামূলক সমীকরণ দ্যাখানোই যথেষ্ট: (শূন্য/সংখ্যা = শূন্য) & (সংখ্যা/শূন্য = অসীম)। এখানে কি ‘শূন্য’ সেই বিশেষ অন্তর্বর্তী মাধ্যম নয় ~ যা জানা এবং অজানার অন্তর্বর্তী সেতু। যাইহোক, এরকমই গাণিতিক মডেল তৈরি করে, আরো দুটি কবিতা নির্মিতি এখানে দেখবো আমরা। এই জায়গায় বলে রাখি, প্রাথমিক কাঠামোটি দ্বিতীয় ধারার মাধ্যমে ঘটলেও, এখানকার চূড়ান্ত পরিণামটি কিন্তু দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ধারার মাঝামাঝি বা বলা ভালো, দ্বিতীয় ধারার কাঠামোটি তৃতীয় ধারার অভিমুখিন। অতএব পাঠক, আসুন সকলে প্রবেশ করি নির্মিত কবিতা’র কেন্দ্রাতিগ অঞ্চলে।

১) প্রথম যে কবিতা নির্মাণ দেখবো ~ এর ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হবে জ্যামিতিক একটি বিষয়: অনুরূপ ত্রিভুজের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত আনুপাতিক সমীকরণ। আমরা জানি অনুরূপ ত্রিভুজ হলো এমন দুটি ত্রিভুজ যাদের তিনটি কোণের মান এক এবং দুটি ত্রিভুজের তিনটি বাহুর অনুপাত এক। নিচের ছবিটি দেখলে, আরো ভালোভাবে অনুভব করা যাবে নিচের ছবিতে দুটি ত্রিভুজ রয়েছে; যাঁরা পরস্পর একে অপরের অনুরূপ। প্রথম ত্রিভুজের তিনটি বাহু যদি “a”, “b” এবং “c” হয় & দ্বিতীয় ত্রিভুজের তিনটি বাহু যদি যথাক্রমে “d”, “e” এবং “f” হয় ~ জ্যামিতিক অনুপাতের সূত্রানুযায়ী (a/b = d/e) আমরা ভাবতেই পারি।
     

এবার আরেকটি ছবি আমরা দেখি; যেখানে (a/b = d/e) সমীকরণটি থেকে আমরা a, b, d, e চারটি বাহুমানের প্রত্যেকটির নিজস্ব ফলাফল নির্ণয় করে নিতে পারি সহজেই। দেখুন ছবিটি:


এটা হলো গাণিতিক মডেল। এবার এই মূল সমীকরণটি ভেঙে চারটি সমীকরণ’কে ব্যবহার করে আমরা কবিতার প্রাথমিক কাঠামোটি নির্মিত করবো। এর জন্য আমরা যা করবো তা হলো ত্রিভুজদুটির বাহুর কাব্যমান বা poetrical value নির্ণয়ের মাধ্যমে। য্যামন:

              a = ভেঙে যাচ্ছে
              b = গড়ে উঠছে
              d = সরে যাচ্ছে
              e = কাছে আসছে

আসুন এবার কবিতা নির্মাণ দেখা যাক:
প্রথম সমীকরণ:   
 
                                   bd               d
                           a = --------- = b (-------)
                                     e                e

                                               সরে যাচ্ছে
  ভেঙে যাচ্ছে = গড়ে উঠছে ( ------------------- )
                                              কাছে আসছে

এরকমই, পরবর্তী সমীকরণ:

                                   ae               e
                           b = --------- = a (-------)
                                     d                d

                                             কাছে আসছে
  গড়ে উঠছে = ভেঙে যাচ্ছে ( ------------------- )
                                                সরে যাচ্ছে

এভাবেই আরো দুটি সমীকরণ আমরা গাণিতিক ধারণায় কাব্যমান সহযোগে, কবিতার প্রাথমিক কাঠামো নির্মিত করা হলো। এটা গ্যালো, দ্বিতীয় পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত (অর্থাৎ, স্বয়ংক্রিয় লেখনের বিপরীত নির্মিত কবিতা’র ধারণা)। এবার আমরা তৃতীয় পর্যায়ে যাবো।

তৃতীয় পর্যায়ের হিউম্যান টাচ দিয়ে, যেটা করা হলো: প্রথমেই, ‘=’ এই সমান চিহ্নটির মান ধরা হলো ‘চাঁদ’; আবার কিছু শব্দকে দেওয়া হলো সংহত রূপ; য্যামন ‘ভেঙে যাচ্ছে’ এর পরিবর্তে ‘ভাঙছে’ বা ‘কাছে আসছে’ এর পরিবর্তে ‘কাছাকাছি’ শব্দার্থের প্রয়োগ এবং চিহ্ন প্রয়োগ করে সিনট্যাক্স বা দ্যোতনা’র ভ্যারিয়েশন আনা হলো; য্যামোন '⊙' চিহ্নটিকে আলোর কেন্দ্রাতিগ/অবস্থিত সময়-বলয় বা গতিশীলতার সময়-বৃত্ত/মহাপৃথিবী ইত্যাদি নানান ভাষায় ভাবা যায়। এবার দেখা যাক কবিতার চূড়ান্ত রূপটি:

১।
ভাঙছে          { চাঁদ }
                         ||
                                              সরে যাচ্ছে ☞
                    গড়ে উঠছে    (-----------------------)
                                             ☜ কাছাকাছি

২।
গড়ে উঠছে        { চাঁদ }
                             ||
                                            ☜ কাছাকাছি
                       ভাঙছে       (------------------------)
                                              সরে যাচ্ছে ☞

৩।
সরে যাচ্ছে           { চাঁদ }
                               ||
                                                    ভাঙছে ⊗
                        কাছাকাছি      (---------------------)
                                                ⊙ গড়ে উঠছে

৪।
কাছাকাছি          { চাঁদ }
                              ||
                                              ⊙ গড়ে উঠছে
                     সরে যাচ্ছে       (----------------------)
                                                    ভাঙছে ⊗

এখানে “||” চিহ্নটিকে কেউ একটা গাণিতিক বন্ধনরূপে ব্যবহারকৃত ভাবতে পারেন; যেরকম বিভিন্ন প্রকার বন্ধনের মাধ্যমে, পদার্থের রাসায়নিক রূপটি অবিকল থাকে; আবার কেউ গণিতের ফলিতো রূপটির নেপথ্যে থাকা লজিকানুযায়ীও ভাবতে পারেন। উভয়ক্ষেত্রেই দ্যোতনা ভিন্ন ভিন্নরকম। এইভাবে, বর্তমান রূপটির আরো বিবর্তন করাই যায়। মনে রাখা ভালো, তৃতীয় ধারায় অবস্থানকারী যেকোনো রূপই সাম্য অভিমুখী; নিজেকে সাম্যে পৌঁছে ফেলার স্থিতিশীলতা নয়। প্রসঙ্গত; এইভাবে কবিতা নির্মাণের উৎসটি সম্পর্কে এখানে বলা উচিৎ।

আমরা জানি জাপানী হাইকু-কবিতায় জনপ্রিয় নাম বাশো। বাশো’র কিছু হাইকু কবিতার গাণিতিক সমীকরণ ফর্মে ভাষান্তর বা ট্রান্সফর্মেশন দেখি হঠাৎ। এবং এটি করেছিলেন/করছেন আরেক আন্তর্জাতিক কবি কাজমিয়ের মাসালাঙ্কা; যিনি গণিত ধারায় কবিতা লেখনকে, আন্তর্জাতিক মাধ্যমে যে-কজন বিশেষ মাত্রা দিয়েছেন, সেই সকল অন্যতম কবিদের একজন। ওনার সাথে কথোপকথনেই এই অনুরূপ ত্রিভুজের জ্যামিতিক সূত্রানুযায়ী কাজটি জানতে পারি। এটি ওনারই ভাবনা প্রসূত এবং গাণিতিক ভাষান্তরের খুবই প্রাথমিক রূপ। ওপরের দুটি ছবিও, ওনারই গণিত-কবিতা বিষয়ক ব্লগ থেকে সংগৃহীত। যদিও, এই প্রকারের কাজটি নিয়ে উনি অনেকদূর এগিয়েছেন। সেসব অবশ্য পাঠকের কাছে কিছুটা জটিল ভাবনার ফল মনে হতে পারে ভেবেই লিখলাম না। তবে এখানে যে কবিতাটিকে নির্মিত করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে; সেটি ব্যক্তিগত ভাবনায়।

২) দ্বিতীয় যে উদাহরণটি আমরা দেখতে চলেছি, তার প্রাথমিক কাঠামো নির্মাণের জন্য প্রাথমিকভাবে একটি ডিজিটাল বা সাংখ্যিক রাশির প্যালেনড্রোমিক কাঠামো ঠিক করতে হবে। প্যালেনড্রোম হলো যেকোনো বাক্যের/শব্দের সেই রূপ-বিন্যাস; যার বাঁদিক থেকে পড়লে যে রূপ, সেই একই রূপ ডানদিক থেকে পড়লেও পাওয়া যাবে। যেরকম উদাহরণ হিসেবে আমরা ‘সরেস’ শব্দটিকে প্যালিনড্রোমিক শব্দ হিসেবে দেখতে পারি, কারণ অক্ষরগুলির সজ্জা/বিন্যাস এমনই, যে উভয় দিক থেকে পড়লে শব্দটার একই রূপ পাওয়া যায়; সেরকমই বাক্যের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি হতে পারে, তখন এটিকে প্যালেনড্রোমিক বাক্য বলাই যায়। অতএব আসুন, সর্বপ্রথম আমরা সাংখ্যিকভাবে প্যালেনড্রোমিক বিন্যাস করার চেষ্টা করি। নিচের সাংখ্যিক সজ্জাটি দেখলেই এটা বোঝা যাবে।

                 3 0 1 2 3 2 1 0 3
                    2 0 1 2 1 0 2
                       1 0 1 0 1
                          1 0 1
                             1
                             0

আমরা এই প্যালেনড্রোমিক সজ্জাটির অর্ধেকটি এখানে দেখলাম। নিচের অংশটি ঠিক উপরের অংশের বিপ্রতীপভাবে করাই যায়। অনেকটা একটি আরেকটির আয়না প্রতিফলন-এর মতো ভাবাই যায়। এবার, আমরা যেটা করবো ~ প্রতিটা সংখ্যার একেকটি ভিন্নভিন্ন কাব্যমান বা poetrical value ধরে নেবো। এবং তারপর চেষ্টা করবো এই সাংখ্যিক মডেলটিকে কবিতার প্রাথমিক কাঠামোয় রূপান্তরিত করতে। কাব্যমানগুলিকে ধরে নেওয়া হলো, অনেকটা এরকম:

0 = আকাশ
1 = রাস্তা
2 = বরফ
3 = ছায়া

এবারে কাব্যমান প্রয়োগ করে, কবিতার প্রাথমিক কাঠামোটির নির্মাণ করা যাক, আসুন:
ছায়া আকাশ রাস্তা বরফ ছায়া বরফ রাস্তা আকাশ ছায়া

   বরফ আকাশ রাস্তা বরফ রাস্তা আকাশ বরফ
              রাস্তা আকাশ রাস্তা আকাশ রাস্তা
                       রাস্তা আকাশ রাস্তা
                             রাস্তা
                           আকাশ

উপরের অংশটি হলো মোটামুটি একটা প্রাথমিক কাঠামো। এবার হিউম্যান টাচ। এখানে প্রয়োগ করা হলো ওইলিপো (OULIPO) বা উলিপো কবিতা-টেকনিকের নেপথ্যে থাকা লজিক। প্রসঙ্গতো, এখানে ওইলিপো বা উলিপো কবিতা-টেকনিক নিয়ে ২/৪টি কথা বলা প্রয়োজন; যাতে বিষয়টি আরো সহজবোধ্য হয়। উলিপো হলো কবিতা ও গণিতের একটি বিশেষ মেলবন্ধনকারী স্তর। যেখানে কবিতা একটি বিশেষ গঠনে অবস্থানকালে, গাণিতিক ফর্মুলা প্রয়োগে পরিবর্তিত হয়। এবং এই পর্যায়টি অসীমান্তিক। অর্থাৎ সমাপ্তিহীন। বিভিন্ন প্রকারের ফর্মুলার ভিতর, সবচেয়ে জনপ্রিয় ফর্মুলাটি হলো “n+7” যেখানে একজন লেখক কোনো পূর্বগঠিত কবিতায় ~ কবিতাটির বিশেষ্যকে (n), অভিধানে থাকা সেই বিশেষ্যটির সপ্তম বিশেষ্যে পরিবর্তিত করে বাক্যের সিনট্যাক্স বা দ্যোতনা’র পরিবর্তন ঘটায়। এই টেকনিকটি মূলতঃ সফটওয়্যার প্রোগ্রামিং নির্ভর; এবং আবিষ্কর্তা ১৯৬০ সালে ফরাসী গণিতবিদ ফ্রান্সিস দে লিওন্নেইস এবং লেখক রেমন্ড কোয়েনইউ। বিশেষ্যের এই পরিবর্তনটি যে শুধুই মূল শব্দের সাথে সবসময় সাযুজ্য রেখে হবে নয়; সম্পূর্ণ ভিন্ন শব্দার্থের প্রয়োগও ঘটবে। আরো একটি ওইলিপো ঘরানার জনপ্রিয় টেকনিক হলো ‘স্নো-বল’ ফর্মুলা; কিন্তু বিষয়ান্তর হবার কারণে, তা এখানে বলা নিষ্প্রয়োজন। অতি-উৎসাহী পাঠক, ইন্টারনেটের দুনিয়ায় OULIPO সার্চ করে দেখতে পারেন ~ শুধুু যে বিষয়টি জানা যাবে, তাই নয়; কিছু সফটওয়্যার প্রোগ্রামও সহজে উপলব্ধ। এই বিষয়টি আমি প্রথম জানতে পারি, কবিবন্ধু অর্জুন রাজেন্দ্রন-এর তৈরি করা গ্রুপ দি কোরান্টাইন ট্রেন (The Quarantine Train) দ্বারা আয়োজিত একটি ওয়ার্কশপের সেশনে। গ্রুপটি কিছু ভারতীয় কবির, কবিতা চর্চার গ্রুপ।

যাইহোক, এখানে যে কবিতা নির্মিতি আমরা করছি, তাতে কেবলমাত্র বিভিন্ন শব্দার্থগুলির চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে, নতুন শব্দার্থকে রিপ্লেস বা প্রতিস্থাপন করে বসানো হয়েছে। য্যামন, ‘বরফ’ শব্দার্থটিকে ‘গলে’ বা ‘রাস্তা’ শব্দার্থটিকে ‘যোগাযোগ’ বা ‘যোগাযোগ’ শব্দার্থ থেকে ‘বলয়’, ইত্যাদি। এবার বেশ কয়েকটি স্যাম্পল বা নমুনা থেকে, মোটামুটিভাবে চূড়ান্ত রূপটিকে নিচে রাখা হলো।

   ছায়া ০ গলি গলে } মুখ { শীত গলি ০ ছায়া
   বরফ আকাশ পথ } ওম { রাস্তা ০ বরফ
               ০ পথ } যোগাযোগ { পথ ০
                       রাস্তা } ০ { রাস্তা
                            || রাস্তা ||
                          || আকাশ ||
                  ﹌ ﹌ ﹌ || ﹌ ﹌ ﹌
                         || আকাশ ||
                           || বলয় ||
                       পথ } ০ { গলি
    বরফ ০ পথ } যোগাযোগ { রাস্তা ০ বরফ
       শীত আকাশ পথ } ওম { রাস্তা ০ শীত
ছায়া ০ গলি গলে } মুখ { শীত গলি আকাশ ছায়া

আরো কিছু বক্তব্য এখানে পরিষ্কার করা প্রয়োজন। এখানে রাখা সম্ভাব্য চূড়ান্তরূপটি কিন্তু হঠাৎ করেই আসেনি; এসেছে একাধিক নমুনা থেকে পছন্দসই অপশন বেছে নিয়ে। অর্থাৎ, আরো কিছু নমুনা নির্মিতির ভিতর প্রিয় পাঠক অনুশীলনের মাধ্যমে, আরো কিছু অগ্রবর্তী পছন্দসই রূপ আনতেই পারেন। তবে OULIPO নিয়ে বাংলা কবিতায় আরো অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে; আর বাংলায় এরকম কোনো সফটওয়্যার প্রোগ্রামিং যেদিন পুরোপুরিভাবে তৈরি হয়ে সহজে উপলব্ধ হবে, সেদিন আরো বিভিন্ন ধারনায় নির্মিত কবিতার দরজা খুলে যাবে। তবে এখানে যে কথাটি গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো প্রযুক্তি একটা প্রাথমিক সরল রূপরেখা তৈরি করে দিতে পারে। কিন্তু কাব্যমান বা poetrical value চয়ন থেকে তার উপযুক্ত রূপায়নের মাধ্যমেই সৃজনশক্তি ও আবিষ্কার। বরং আরো বলা যেতে পারে, তৃতীয় ধারায় অবস্থানকালীন অতিচেতনার প্লাজমাবস্থায় যেকোনো অক্ষর/চিহ্ন/শব্দ ~ তার চিরায়ত গতিশীলতা ছেড়ে নিরাকার অভিমুখী; ফলতঃ তার পূর্বনির্ধারিত অর্থ, নতুন প্রয়োগে নতুন অর্থ সৃষ্টি করবে। অতএব নির্মিত কবিতায় প্রয়োগটি হবে সৃজনশীলতার ভিন্নতায় একাধিক আবিষ্কৃত কবিতা। এবার যদি, ওপরের দুটি উদাহরণ ছাড়াও ‘অমাবস্যা’ সম্পর্কিত একটি পঙক্তিকে এভাবে লেখা যায়:

“   √(আপেল) = চাঁদ-০ তলপেট
                      ∝
              নৈশব্দ-বুদবুদ
গায়ে লেগে আছে      সাবানগুঁড়ো  ”

প্রিয় পাঠক কি বিস্মিত হবেন। যেখানে, আপেলটির অস্তিত্ব বর্গের হারে কমতে কমতে, নিরাকার অভিমুখীন; আবার ‘চাঁদশূন্য তলপেট’ অমাবস্যা শব্দার্থের চরিত্রের মতোই নিরাকার অবস্থানেরই সমান। ‘নৈশব্দ-বুদবুদ’ বা শেষ লাইনটিও আরেকটি নিরাকার অবস্থানের সমান্তরাল অভিমুখ। অর্থাৎ দুটি নিরাকার অবস্থানের মাঝে প্রকাশযোগ্য মূর্তরূপ; যা যেকোনো মুহূর্তেই উভয়মুখী। অনেকে বলেন, এরকম চিহ্ন সংক্রান্ত বিভিন্ন কবিতাই গাণিতিক মূল ধারার; তাঁদের জন্য একটি লাইন ও তার খানিক বিস্তার। আসলে গণিত নিজেই এতোটাই সুবিস্তৃত, যাঁকে ভয় না পেলে/দূরে না ঠেলে দিলে: বিস্ময়ের আনন্দ পাওয়া যায় অপরিসীম। গণিত অন্তর্গত বিভিন্ন প্রকারের জঁর নিয়ে চিন্তাভাবনা করাই যায়, হতেই পারে: সে ফলিত গণিতের পথে হাঁটা চরিত্র নয়, বরং নিজেই বৃহৎ হাইপোথেসিস বা প্রকল্পণা।

পরিশেষে সমাপ্তির আগে আরো কয়েকটি কথা না জানালেই নয়: তা হলো স্বয়ংক্রিয় হোক বা নির্মিতি; সৃজন এবং অনুসন্ধান ব্যতিরেকে ভিন্নস্বাদের আনন্দ পাওয়া কঠিন। এবার আসি কিছু মানুষের বিশেষ ভালোবাসার কথায়; যাঁদের চিন্তাভাবনা ও কবিতা বিষয়ক কাজ আমাকে এই লেখাটি লেখার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। যার মধ্যে প্রথমেই বলবো দিল্লীতে কর্মরত পীযূষকান্তি বিশ্বাসের কথা ~ যিনি এই মুহূর্তে, নিজের চূড়ান্ত কর্মব্যস্ততার মাঝেও বাংলা কবিতায় সফটওয়্যার প্রোগ্রামিং নিয়ে কাজ করছেন; দ্বিতীয়ত বাঁকুড়ানিবাসী অনিন্দ্য রায়’র কথা ~ যিনি শুধু গাণিতিক মূল ধারার কবিতা নয়, কবিতার বিভিন্ন ফর্ম নিয়ে গবেষণা করছেন এবং আমরা প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছি; আর তৃতীয়ত কৌরব পত্রিকার শঙ্কর লাহিড়ী’র কথা ~ যাঁর ব্রহ্মাণ্ড ও মহাকাশ বিষয়ক দৈনন্দিন পোস্ট করা তথ্য এবং কবিতার ওপর করা বিভিন্ন তথ্যচিত্রগুলি সমৃদ্ধ করে আমায়। এসব ছাড়াও, সবার ওপর থাকবেন বারীণ ঘোষাল ~ যাঁর ‘অতিচেতনা’ সংক্রান্ত লেখাগুলি না থাকলে হয়তো এই লেখাটির স্পার্ক মস্তিষ্কে জন্মাতই না। এছাড়াও, নেপথ্যে রয়েছেন বহু ভালোবাসার মানুষ; যাঁদের প্রশ্ন এবং মেনে না নেওয়া, চিন্তার খাবার জুগিয়েছে। যাইহোক, এবার আলোচনা চলুক/সমালোচনা চলুক/চর্চা চলুক/অনুশীলন চলুক।

                        [সমাপ্ত]

  প্রথম পর্ব পড়তে এই লেখাটির উপর ক্লিক করুন 


 এই লেখকের অন্যান্য লেখা: 
• পরীক্ষামূলক কবিতা: দু’চারটে ব্যক্তিগত নোটস | রাহুল গাঙ্গুলী
• ‘আগামীর কবিতা কিছু নন-প্যারালাল ইনডেক্স’ পর্ব: এক | রাহুল গাঙ্গুলী
• ‘আগামীর কবিতা কিছু নন-প্যারালাল ইনডেক্স’ পর্ব: দুই | রাহুল গাঙ্গুলী
• ‘আগামীর কবিতা কিছু নন-প্যারালাল ইনডেক্স’ পর্ব: তিন | রাহুল গাঙ্গুলী
• ‘আগামীর কবিতা কিছু নন-প্যারালাল ইনডেক্স’ পর্ব: চার | রাহুল গাঙ্গুলী
• ‘আগামীর কবিতা কিছু নন-প্যারালাল ইনডেক্স’ পর্ব: পাঁচ | রাহুল গাঙ্গুলী
• ‘আগামীর কবিতা কিছু নন-প্যারালাল ইনডেক্স’ পর্ব: ছয় | রাহুল গাঙ্গুলী
• ‘আগামীর কবিতা কিছু নন-প্যারালাল ইনডেক্স’ পর্ব: সাত | রাহুল গাঙ্গুলী


রাহুল গাঙ্গুলী। কবি ও প্রাবন্ধিক। জন্ম: ১০ই আগস্ট ১৯৮১, দুর্গাপুর, পশ্চিমবঙ্গে। পেশা: সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। কিছু কথা: কোনো মহাপুরুষ হয়ে দেওয়ালে ঝুলবার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, নিজেকে আবিষ্কার তথা সময়কে আবিষ্কারের ভিতর দিয়েই যোগ ও যাপন। ভালোবাসা, প্রেম, ঘৃণা বা প্রতিবাদ ~ সময় তথা নিজের কাছে : যে কোনো সৎ সূক্ষ্ম অথবা স্থূল প্রশ্ন করার অধিকার এবং নিজের কাছেই সমাধান, সেই বিশ্বাস নিয়ে দীর্ঘ চিন্তনের প্রতিফলনে লিখে যাওয়া অনুরণিত কবিতা। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘নো ম্যানস্ ল্যান্ড’ (কবিতা পাক্ষিক) ২০১৭, ‘ব্যক্তিগত জরায়ু থেকে’ (ঐহিক) ২০১৮, ‘খাদ্য-খাদক-খাদ্য’ [অনলাইন বই] (ফেরারি) ২০১৮, ‘১ মুঠো জলীয় দূরত্ব ভেঙে’ (টার্মিনার্স) ২০১৮, ‘কবিতাবিহীন মুহূর্তগুলো’ (তাবিক) ২০১৯, ‘পরিত্যক্ত ০|র খোঁজে’ (ঘোড়াউত্রা) ২০২০।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. ভাবনাচিন্তা শাণিত হোক আরও

    শানু চৌধুরী

    উত্তরমুছুন
  2. সমৃদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছি। কবিতা নিয়ে সারাবিশ্বে কত কাণ্ড। অথচ আমরা কোথায় পড়ে আছি কে জানে। এই লেখা পড়ে খুব কিছু যে উপলদ্ধি করেছি তা নয়, তবে নতুন ভুবনটিকে চিনতে পেরেছি। রাহুলদা আরও আপতেট করে চলুক বাংলা কবিতাকে।

    উত্তরমুছুন
  3. অবশ্যই এটা ইনফিউশনের যুগ। গণিতের সঙ্গে কবিতা মেলানোর চেষ্টা খুব ভালো। একমাত্র গণিতবিদ পাঠক ও কবি তৈরি হয়ে যাবে ভবিষ্যতে। তারাই এইসব কবিতার সমঝদার হবে। আমি কখনো বলতে পারি না রে 'গণিতকবিতা' ইজ ইকোয়াল টু আঙুর ফল টক।

    উত্তরমুছুন

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।