TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

‘আগামীর কবিতা কিছু নন-প্যারালাল ইনডেক্স’ পর্ব: সাত | রাহুল গাঙ্গুলী


পর্ব: সাত


আধূনিকতাবাদীরা ফ্যাক্টরগুলোকে একটা ডাইমেনশন বা মাত্রায় রেখে জন্ম দিয়েছিলেন ইজম বা মতবাদ। এখনো অনেকেই বলেন ডাইমেনশন ছাড়া কি কিছু হয়, অর্থাৎ ডাইমেনশন লেস = অসীম একথায় বিশ্বাস করেন না। সায়েন্স কিন্তু বহু আগেই একথার মান্যতা দিয়েছে। কয়েকটা উদাহরণ নেওয়া যেতেই পারে:

যেমন আলট্রাসনিক ও ইনফ্রাসনিক সাউন্ড। মানুষের কান 20 Hz 20kHz কম্পাংকের ভিতর শব্দ শুনতে পায়। অর্থাৎ ২০ কিলো হার্তজের উপর (আলট্রাসনিক সাউন্ড) এবং ২০ হার্তজের নীচে (ইনফ্রাসনিক) শব্দ শোনা যায় না। এটা গেলো ডাইমেনশন। কিন্তু এটাকে যদি এভাবে দেখা যায় যে ২০ হার্তজের নীচে কোনো লিমিট নেই আবার ২০ কিলো হার্ত্জের উপর কোনো লিমিট নেই তাহলে। বীজগাণিতিক ইক্যুয়েশন কষলে
limit tends to 20 Hz tends to 20kHz
সায়েন্স নিজেই কিন্তু অসীমকে মান্যতা দিচ্ছে। যেখানে না আছে লোয়ার লিমিট, না আছে আপার লিমিট। তাই লোয়ার লিমিটে যেমন (-১/০) তেমনিই আপার লিমিটে (১/০) এক অত্যাশ্চর্য দিক। মাঝে থাকছে শূন্যর দুটি পর্যায় (-০) ও (+০)।

কিছুকাল আগে শব্দ নিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা হয়। একটা কল্যাণীতে ও অপরটি হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। কল্যাণী এগ্রিকালচারালে পরীক্ষাটি হয় প্রাণের শব্দের প্রভাব নিয়ে। প্রথমে গাছ, তারপর গিনিপিগ,  তারপর খরগোশ, তারপর গরু ইত্যাদি। গবেষণায় বেশ কিছু আশানুরূপ তথ্য বেরিয়ে আসে। যেমন মানুষের কিছু ক্রনিক রোগ যেমন অম্বল, হৃদযন্ত্রের অসুখ, লিভার সমস্যা কিছু বিশেষ রাগ-রাগিনী রোজ একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে শুনলে উপশম সম্ভব। তেমনিই মা গরু দুধ দেওয়ার সময় কিছু বিশেষ রাগ-রাগিনী শুনলে উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে যায়। গুজরাট ও পাঞ্জাবের ডেয়ারিগুলিতে পরে তার ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এখবরটা সেই সময় বাংলা সুর-সংগীতের একটা পত্রিকা (সম্ভবত একমাত্র) ‘সারেগামাপা’তে প্রকাশিত হয়।

হাভার্ড ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা ছিল নাভিমূল থেকে বেরিয়ে আসা ওম শব্দের উপর এবং এটি যে শাঁখ বাজানোর শব্দের সাথে মিশ্রণে ক্যান্সার নিরাময়ে অনেকটাই ছাপ রাখতে পারবে, তা নানাভাবে প্রমাণিত হয়। খবরটি ‘ইন্ডিয়ান সায়েন্স জার্নাল’, ‘দ্যি মর্নিং হেরাল্ড’ ছাড়াও ভারতীয় আরেকটি সংগীত পত্রিকা ‘রক স্ট্রিট জার্নাল’ যা ব্যাঙ্গালোর থেকে প্রকাশিত সেখানে দুটো বৈদিক রক মেটাল ব্যান্ড: রুদ্রা (সিংহলি) ও রুদ্রাগ্নী (ভারত) এদের ইন্টার্ভিউতে প্রকাশ পায়।

কথা হচ্ছে ডাইমেনশন বাঁধা থাকলে কি পরীক্ষাগুলো হতো। এখানেই চলে আসে i-চিন্তন ও জিরো বাউন্ডারি।
একটা ঘটনার সাথে নেটওয়ার্ক তৈরি ভিন্ন মাত্রার। যেমন কোনো একটি ব্যাঙ্ক ডাকাতি। টিভিতে দেখলে অনুভূতি একরকম, খবরের কাগজে পড়লে অনুভূতি আলাদা, আবার নিজে প্রত্যক্ষদর্শী হলে অনুভূতি আলাদা। ঘটনাটা এক তবে অনুভূতি আলাদা কেন?

এখানেও সেই চিন্তন ও তার নেটওয়ার্ক। ডাইরেক্ট, ইনডাইরেক্ট ও অল্টারনেট নেটওয়ার্ক। যা কখনো মাত্রিক, কখনো বহুমাত্রিক, কখনো অতিমাত্রিক বা মাত্রাহীন। জিরো বাউন্ডারির চিন্তন আসছে এখানেই। অর্থাৎ চিন্তন একটা মাত্রাহীন চেইন রিঅ্যাকশন।
হয়তো বোঝায় ভুল হতে পারে, হয়তো বা আত্তীকরণ বা উপলব্ধিতেও। তবু চিন্তন চলবে চার্জড পার্টিকেল্সগুলোর স্রোতের মতো। চার্জড কণা একারণেই যেকোনো নেটওয়ার্ক তা মহাজাগতিক হোক বা জাগতিক বা অতিজাগতিক হোক, চার্জড কণা ছাড়া শরীরের অস্তিত্ব নেই। আর চার্জড কণাদের চেইন রিঅ্যাকশন হলো মাত্রাহীন ক্রমাগত চলতে থাকা চলমান প্রসেস।

জিরো বাউন্ডারি হোক বা i-চিন্তন হোক। চলতে থাকুক, আলোচিত হোক, আলোড়িত হোক। আসুন আরো কিছু নতুন অভিমুখকে আমরা জানি।
কবিতায় সাধারনত: আমরা কিছু ইমেজ দেখতে পছন্দ করি এবং ধ্বনিগত মানকে মান্যতা দিই। কিন্তু এর বাইরে কি কিছু নেই : ধরা যাক শব্দের প্রতিস্থাপনে শব্দ বা জিরো ইমেজ বা ইমেজের বহু বিস্তার ইত্যাদি। যদি ছন্দকেই মানেন, তাহলে বলবো প্রকৃতির সবকিছুতেই ছন্দ আছে, আছে ছন্দ ভাঙার ছন্দ : বেশিরভাগটাই অন্ত্যমিল ছাড়াই। এসব কথা নিয়েই নিচের দুটি উদাহরণ :


ম্যাথামেটিকাল কনসেপ্টে দুটো জায়গা আছে। একটা হলো ফাইনিট বা সীমাবদ্ধ এবং আরেকটি হলো ইনফাইনিট। যেকোনো জিওমেট্রিক কনসেপ্টেও সেটা প্রযোজ্য। এখন বহুস্তরীয় কবিতার জায়গাতেও এটা আছে। বর্তমানে দেশে বিদেশে কিন্তু বিরাট কাজ হচ্ছে এই সীমাহীন ডাইমেনশন নিয়ে। লিমিট শূন্য থেকে অসীম একে প্রুফ করার জন্য নানান এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে, আর এটাই উত্তর-অধুনান্তিক যুগ বা (পোস্ট পোস্টমর্ডান) কাল পেরিয়ে বর্তমান সময়ের ব্যাপকতর বৈশিষ্ট্য। আর প্রভাত চৌধুরি (কবিতা পাক্ষিক সম্পাদক) এই আপডেটেশন-এর কথাই বলেন। নিচের লেখাটি এই ম্যাথামেটিকাল বিবর্তন নিয়ে লেখা।


২৭/০৬/১৭ : ২১-৫৭ আওয়ার
-------------------------------------

আলগা শব্দগুলোকে চিনে ফেললেই
ফেলে যাওয়া সাবেক চকখড়ি মাখা ক্ল্যাপস্টিক
মমিদের গান জমে মাদাম তুসোর জাদুঘরে
সময়ভরের ফোটন কণারা বানিয়ে নেয় পাসপোর্ট
ওয়ার্ডরোবে যে চুম্বকত্বহীন ম্যাগনেট রাখা ছিলো
যুদ্ধের আগেই সন্ধিপাতার মৌ- সাক্ষরে
স্রেফ ১টা বিবর্তিত ইস্পাতের ফলা
জামা। জুতো। দাঁড়ি। কমা। নুনফোটা প্যারিস
পুরোটাই হ্যাঙারে ঝুলছে। ঝুলছে হ্যাঙার
সকলেই বেশ (পাইনাপেল+আপেল) মজার ছলে
মাকড়সার ল্যাটিন নামের বাংলা প্রতিশব্দ ভাবছি


উপরের কবিতায় দেখুন : ১ম দুলাইনে একটা টাইমফ্রেম ও তার বিবর্তন দেখানো হয়েছে। যদি টাইমফ্রেমটি একটা অরবিট বা কক্ষপথ হয়, তাকে ঘিরে আবর্তিত ও বিবর্তিত হচ্ছে সবকিছু। পরের লাইনে কিভাবে সেই বিবর্তনবাদের ইতিহাস। পরের লাইনে সেই অরবিটের ভর কিভাবে সংকুচিত হয়ে ডাইমেনশন বা মাত্রা পরিবর্তন করছে। এরপরের লাইনে আবার মাত্রার অসীমে পৌঁছানোর সংকেত, যেখানে ম্যাগনেটটি চুম্বকত্ব হারিয়ে বিরুদ্ধ গতি আদায় করছে ওয়ার্ডরোব থেকে। ওয়ার্ডরোব এখানে একটা অবস্থান। পরের লাইনে সেই বিরুদ্ধ গতির প্রয়োগ হচ্ছে : বিবর্তিত ইস্পাতের ফলায়। এরপর জিরোজিরো শূন্যস্থান, অর্থাৎ এক দশা বা phase থেকে আরেক দশায় যাওয়ার difference

এরপর দেখুন দৈনন্দিন ব্যবহারের কয়েকটি জিনিস, তার নিজস্ব দৃশ্যকল্প বা imagery এফেক্ট। পরের লাইনে তারা ঝুলছে। অর্থাৎ সময়ের পেন্ডুলাম ঝুলছে একটা বিন্দুগত জায়গা থেকে। পরের লাইনে দেখুন দোলকের ভিতর গচ্ছিত শক্তির জমা হওয়া।পাইনাপেল + আপেল : এখানে যদি ভাবা যায় : π +  না + আপেল + আপেল = π + না + (আপেল)২, তাহলে মাত্রার পরিবর্তন এবং দশারও পরিবর্তন : মজার ছলে। মাকড়সার ল্যাটিন নামের বাংলা প্রতিশব্দ, এখানে সেই চলমানতা যা আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনের উপলব্ধি, যা সময়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এবং ভাঙে এবং নতুন করে গড়ে উঠতে থাকে।

পুরোকবিতাটি এবার বিরুদ্ধ গতিতে পড়ুন, মানে শেষ লাইনটাকে আগে পড়ে, ১ম লাইনটা পড়ুন সবার শেষে। দেখা যাবে অন্য অবস্থানে চলে গেছে কবিতাটি। যদিও বহুস্তরীয় কবিতার ভাবানুবাদ বা ভাবসম্প্রসারন হয় না (এটাও আমাদের সামন্ততান্ত্রিক অবশেষ)। কাজেই বহুরকমভাবে ও বহুকোণ থেকে কবিতাটা ভাবা যেতেই পারে

২) এবার আসি পরবর্তী উদাহরণে:

নিচের চিত্রটি দেখুন

একটা শূন্যের ভিতর ব এবং তার ছায়া, যারা শূন্যটির সাথে একটি বন্ডিং ফর্ম করে আছে। আমরা বলতেই পারি : ব + ০ = b + O = BOW। অর্থাৎ শূন্য থেকে একটি ধনুক, তির ছোঁড়ার আগের মুহূর্তে। তিরটি এখানে সময়ের সূচক, যদিও এখানে জানা নেই তিরটির টার্গেট কি, সেকি টার্গেটে যাবে না কি অসীমে মুক্ত হবে। অর্থাৎ একটি শব্দ বা বলা ভালো অক্ষর শূন্য পরবর্তী ডিজিটে গতিপ্রাপ্ত হচ্ছে, আবার শূন্যে ফিরে আসছে। সেই শূন্য কিন্তু অসীম।

এবার শেষ করবো কিছু কথা দিয়ে। ভাষার বিবর্তন বা কবিতার বিবর্তন নিয়ে ভাবলে, পাঠকের বিবর্তনটিকেও মাথায় রাখতে হবে। যেমন লেখনীকে আমরা চাইবো সৎ হোক, তেমনিই সেকথা পাঠকের ক্ষেত্রেও আসবে।

পদ্মফুলের রাজনীতিবিদ উদার কবিতা লেখেন, আবার বাবরি মসজিদ হনন করেন। অথচো আমরা ধন্য ধন্য করি।

সেনানায়ক কবিতায় হ্যাভস নট বলছেন, আমরা ফিদা। অথচো তিনিই ফেক এনকাউন্টার করছেন।

আসলে পাঠক কি আদৌ বোঝেন : সততা আর জনপ্রিয়তার পার্থক্য?

তর্ক কোথায় হয়। সকলেই তো মিডিয়া হাইপ চাইছে। তবে বিবেককে পরিকল্পিতভাবে খুন করতে পাঠকই পারেন, আর তিনিই সাহিত্যিককে সেই পাঠ শেখান।
কথার যুক্তিতে একটাই প্রমাণ দেবো : বাঙালীর প্রতিভায় নোবেল একটাই, তাও আবার চুরি হয়ে গেছে।

যাইহোক বন্ধুরা, শেষ করবো একটা প্রশ্ন দিয়ে : এই ডিজিটাল সময়পর্বে আমরা যদি সময়ের প্রকৃতিই না বুঝি, তার দায়ভাগ কে নেবে?


                            [সমাপ্ত]


• পর্ব: এক পড়তে এই লেখাটির উপর স্পর্শ/ক্লিক করুন
• পর্ব: দুই পড়তে এই লেখাটির উপর স্পর্শ/ক্লিক করুন
• পর্ব: তিন পড়তে এই লেখাটির উপর স্পর্শ/ক্লিক করুন
• পর্ব: চার পড়তে এই লেখাটির উপর স্পর্শ/ক্লিক করুন
• পর্ব: পাঁচ পড়তে এই লেখাটির উপর স্পর্শ/ক্লিক করুন
• পর্ব: ছয় পড়তে এই লেখাটির উপর স্পর্শ/ক্লিক করুন



রাহুল গাঙ্গুলী। কবি। জন্ম তারিখ: ১০ই আগস্ট ১৯৮১, দুর্গাপুর, পশ্চিম বঙ্গে।
পেশা: সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।
কিছু কথা : কোনো মহাপুরুষ হয়ে দেওয়ালে ঝুলবার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, নিজেকে আবিষ্কার তথা সময়কে আবিষ্কারের ভিতর দিয়েই যোগ ও যাপন। ভালোবাসা, প্রেম, ঘৃণা বা প্রতিবাদ ~ সময় তথা নিজের কাছে : যে কোনো সৎ সূক্ষ্ম অথবা স্থূল প্রশ্ন করার অধিকার এবং নিজের কাছেই সমাধান, সেই বিশ্বাস নিয়ে দীর্ঘ চিন্তনের প্রতিফলনে লিখে যাওয়া অনুরণিত কবিতা
প্রকাশিত গ্রন্থ:
নো ম্যানস্ ল্যান্ড’ (কবিতা পাক্ষিক) ২০১৭, ‘ব্যক্তিগত জরায়ু থেকে’ (ঐহিক) ২০১৮, ‘খাদ্য - খাদক - খাদ্য’ [অনলাইন বই] (ফেরারি) ২০১৮, ‘১ মুঠো জলীয় দূরত্ব ভেঙ্গে’ (টার্মিনার্স) ২০১৮,
কবিতাবিহীন মুহূর্তগুলো’ (তাবিক) ২০১৯,
পরিত্যক্ত ০|র খোঁজে’ (ঘোড়াউত্রা) ২০২০।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ