TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

‘আগামীর কবিতা কিছু নন-প্যারালাল ইনডেক্স’ পর্ব: এক | রাহুল গাঙ্গুলী


পর্ব: ১

কবিতা কী? উত্তরে যদি বলি, এটা এমন একটা সমীকরণ ~ যার সাংখ্যিক মান কোনো দুধপোষা ঢ্যাঁরশ ধ্রুবক না হয়ে অসীম। যদি সমীকরণটি এমন হয়: (অনুভূতি + চিন্তন + উপলব্ধি + নলেজ = প্রকাশ)। কেমন হবে? না কি সেই তথাকথিত সামন্ততান্ত্রিক পদ্যবাদ ~ একটু রোমাঞ্চ, একটু শিরশিরানি, একটু এলোমেলো কবিতাআবেগ ___ ব্লা ব্লা ব্লা

আদিম মানুষ যখন প্রথম আবিষ্কার করতে চাইলো, তা ছিলো একে অপরের সাথে এবং প্রকৃতির সাথে কমিউনিকেশন। এমন একটা সংযোজিত যোগাযোগব্যবস্থা, যার কম্পাংক এখনকার কথা বলার কম্পাংকের চেয়ে অনেকটাই উঁচু মানের, তাকে বোঝা গেলেও শোনা যায় না। এই এলোমেলো অবস্থানেই ঘটলো তিনটি বিস্ময় ~

(১) নিজেকে সুরক্ষিত নিরাপত্তা দেওয়ার সন্ধানে আবিষ্কৃত হলো আর্কিটেকচার
(২) সে প্রকৃতির সাথে সহ-অধ্যয়নে কথা বলতে পারলো (আওয়াজ করতে শিখলো বিভিন্ন মাত্রার। কম্পাঙ্কের ব্যবহার করলো আপন গতিতে)।
(৩) বর্তমান পরিস্থিতিকে সে প্রকাশ করলো গুহাচিত্রের মাধ্যমে (অর্থাৎ, সে বুঝতে চেষ্টা করলো সময়ের কনসেপ্ট)।

কিন্তু ইতিহাসে এর জায়গা হয় নি। বরং মানবসভ্যতার ইতিহাসের শুরুটা হয় আগুন ও চাকার আবিষ্কার দিয়ে। যেটা লিখে গেছেন কিছু এলিট ইতিহাসবিদ। যাইহোক ~ এরপর ঘটলো ক্রমানুযায়ী আরো তিনটি আবিষ্কার: চিহ্ন → অংক (পরিমাপ) → ভাষা। আমরা, যারা অল্পবিস্তর মিশরীয় সভ্যতা বা বৈদিক সভ্যতা নিয়ে জানি, সেখানে দেখেছি বিভিন্ন লিপির ব্যবহার। যার অনেকটাই কিন্তু আজও অনাবিষ্কৃত। এখন প্রশ্ন করতেই পারেন পাঠক ~ কবিতা নিয়ে লিখতে বসে, হঠাৎ এসব ইতিহাসের কাসুন্দি কেন? উত্তরে বলবো, যে কোনো আবিষ্কার পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো। যদি কবিতাকে আবিষ্কার করতে হয় (সমস্ত সৎ শিল্পই তো একটা আবিষ্কার, যার ভিতর দিয়ে নিজেকেও চেনাজানা যায়), এটাই প্রসেস।


কবিতা ও কবিতা নয়

১. শুরুর কিছু আগে থেকে:

কোনো কিছু লিখবার আগে লেখাটি অগ্রজ কবি দীপঙ্করদাকে উৎস্বর্গ করছি। ওনার শূন্যকাল অনেককেই ভাবনা শুরু করতে শিখিয়েছে। আজ ওনার শরীরটা পুড়ে ছাই হলো। তাই একটি উক্তি দিয়েই শুরু করছি— “দার্শনিক সময়ের কৃষ্ণগহ্বরে হারায়, দর্শন নয়। কারণ তা শুধু সময়ের ব্যাখা করে নয়, অসীম শূন্যতার পরবর্তী স্তরটিকে আবিষ্কার করার চেস্টা করে।”

কবিত না অকবিতা— দ্বন্দ্বটা বহুপ্রাচীন। অনেকেই বলেন কবির এক্সপ্লেনেশনের দায়বদ্ধতা নেই। ব্যক্তিগত ভাবে আমি এর বিরোধী। তবে একটি জায়গায় সহমত— একটি জলভর্তি কলসিতে যদি আরো জল ঢালা যায়— এফেক্ট কী? অথবা একটি ফুটো কলসিতে জল ঢাললেই বা কি হবে? পাঠককুল বিচার করুন (লিঙ্গ প্রভেদ নাই বা করলাম — পুরুষ লিঙ্গ অহেতুক পিছনের চামড়া গরম করবেন না। নারী লিঙ্গ আত্তিকৃত হন।)

সুতরাং যারা লেখাটি পড়া শুরু করছেন— তারা কোনো গবেষণাধর্মী লেখার আশা করবেন না। বলা যেতে পারে এটি একটি এক্সপ্ল্যানেটারি নোটস। তাই সেভাবেই চিন্তন আঘাতের জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকুন।।


২. শুরুর কথা:

আজ জানুয়ারি ২০১৭। এ-সময়ে দাঁড়িয়ে চলুন নিজেরা কী বুঝি কবিতা নিয়ে একবার দেখে নেওয়া যাক। নিজেকে বা আরো ১০ জনকে প্রশ্ন করা যাক— কবিতা কী?

সাধারনতঃ আমরা যা যা উত্তরে পাব তা অনেকটা এমন—

• কবিতা মনের আবেগের বহিঃপ্রকাশ— তার সঙ্ঘবদ্ধ রূপ।
• কবিতা একটি ছন্দ একটি সুর— যা মনকে পিয়ানোর তালে আন্দোলিত করে।
• কবিতা গভীরতর মননের প্রকাশ— কিন্তু সকলের জন্য নয়।
সবই ঠিক। কিন্তু এর পরেও আরো কিছু আছে— বিয়ন্ড হরাইজন।

এই সময়ে যে বিভাজনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হোলো—
• সিলেবাসের কবিতা।
• সিলেবাসের বাইরের কবিতা।।

কিন্তু কেন এজাতীয় বিভাজন?

একটি কথা উল্লেখযোগ্য— যে কোনো শিল্পের এক্সট্রীম ভার্শন শেষপর্যন্ত রাষ্ট্র ও সমাজ চালিকা সিস্টেমের বিরুদ্ধে যায়। একবার ইতিহাসে চোখ রাখুন— দেখা যায় বিপ্লব বা প্রতিবিপ্লবে শিল্প ও শিল্পী প্রাইম টার্গেট। হয় এলিমিনেশন না হয় টিকিয়ে রাখ। আর এখানেই সভ্যতার ভাঁওতাবাজি চোখে পড়ে।

ইতিহাসের স্বীকৃতি মানুষের আগুন ও চাকা আবিষ্কারের থেকে। ইউরোপিয়ান ইতিহাস তাকে বড়ো মুখ করে বলে শহরভিত্তিক ইতিহাস। যদি তাই হয়— গ্রাম ভিত্তিক ইতিহাস কাকে বলে?

মানুষ প্রজন্মের বয়স ও সভ্যতার ইতিহাসের বয়স— দুটিকে তুলনা করলে বিভাজন মারাত্মকভাবে চোখে পড়ে। প্রিয় অগ্রজ কবি বন্ধু কবিতাডিহি পত্রিকার সম্পাদক অনিন্দ্য-দাকে বলেছিলাম “হয়তো ইতিহাস কখনো সময়কে প্রশ্ন করতে শেখেনি।”


৩. শিল্পের সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা:

সায়েন্টিফিকালি বোঝা দরকার শিল্প কিভাবে? কারণ সাহিত্য বা বিশেষত কবিতা বৃহৎ শিল্পের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভাগ। আমার চোখ যা দেখছে তা মস্তিষ্কে একটা রেসোনান্স বা অনুরণন সৃষ্টি করছে। তার প্রতিফলনে তৈরি হচ্ছে সংকেত— যা গেঁথে যাচ্ছে অবচেতনে। হয়তো সচেতন তার কিছু সংকেত পাচ্ছে। এখন, গুরুমস্তিষ্কের কম্পন যদি পাঠকের মস্তিষ্কে কোনো কম্পন সৃষ্টি করে তা পাঠকে আাকর্ষিত করে। যে-কারণে যুক্তাক্ষর একটি চূড়ান্ত আকর্ষণের বিষয়। অথবা ততোটাই নতুন শব্দ যা অভিধান বিরুদ্ধ।

কিন্তু এখানে যদি শব্দ বা শব্দচেতন জটিল হয় শিল্পীর দায়বদ্ধতা নেই। আমরা ভুলে যাই আমাদের চিন্তন ও মননের কোনো লিনিয়ার ডাইমেনশন নেই।


৪. কবি ও পাঠকের ঘনিষ্ঠ আত্মিকতা:

কবির দেখার দৃষ্টিও সাধারণের থেকে আলাদা— একথা অনস্বীকার্য। কিন্তু কেন? দুজনেই তো একটা একই দৃশ্য দেখছে।

আসলে তরঙ্গ ও সংকেত এক। কিন্তু শিল্পচেতনা সেই ঘটনাকে বিশ্লেষন করছে— ফলতঃ তার প্রকাশ আলাদা। এটা ঘটছে তার অজান্তেই।

তাই ফুল দেখলে কবি বলেন “প্রিয়ার গর্ভে চাঁদ”, পাঠক বলেন ফুল ফুলই।

পৃথিবীর সেরা কবিকে যদি প্রশ্ন করা হয়— কেন কবিতা। কোথায় কবিতা। উত্তর দিতে পারবেন না।

পাঠক বলেন জটিল।

তাই শিল্পক্ষেত্রে কবির অ্যাকসেপ্টেন্স যতটা চূড়ান্ত ততটাই নগন্য।গল্পকার যেহেতু ব্যাখ্যা দিচ্ছেন— এখানে তিনি এগিয়ে। তবুও সভ্যতা ও সমাজকে কাউন্টার করার সাহস কবির বেশী।

আর ঠিক এ জায়গাতেই এগিয়ে দর্শনগত রূপ ও বিভাজন।

একটি উদাহরণ নেওয়া যাক।

কেউ ভাবুন— পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে অথবা সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে, এই ভৌগলিক ত্বত্তের সাথে একজন কৃষকের সম্পর্ক কি? তিনি তো শুধু চাষ করবেন। তাহলে?

উত্তরটি তখনই সফল যদি সেই কৃষক বন্ধু ছায়ার প্রয়োগ বোঝেন। আলো-ছায়ার প্রয়োগ কিন্তু কৃষিকাজে গুরুত্বপূর্ণ। এই আনুমানিকতায় কৃষক বুঝতে চান ভূগোল কী এবং কেন?

দুটি বিষয় আসছে এখান থেকে— শিল্প ও দর্শনে প্রকৃতির ভূমিকা ও তার প্রয়োগগত দিক।।


৫. কবিতায় অশ্লীলতা ও শ্লীলতা:

শিল্পে শ্লীল-অশ্লীলতার দ্বন্দ্ব বহুদিনের। বহুভাবেই ও বহুজায়গাতেই প্রমাণিত শিল্পে অশ্লীলতা বলে কিছু নেই। কিন্তু প্রয়োগগতভাবে তা যদি যথার্থ না হয় বা তা শিকড়কে এক্সপ্লয়েট করতে চায়— সেটা ঠিক নয়। যা দেখছি— সেটা কিন্তু অধিকাংশটাই সাব-অলটার্ন। আমি সকলকে অনুরোধ করবো উইলিয়াম ব্লেকের সেই অমর সৃষ্টিকে একবার চোখ বোলাতে— যেখানে কেন্দ্রে জীসাস। তলদেশে উলঙ্গ নারী গায়ে ঘুরছে বিষাক্ত সাপ। এ-ছবি হয়তো ৩য় লিঙ্গকে কল্পনা করে।

এবিষয়ে আগামীতে একটি বিশেষ লেখা লেখার ইচ্ছে আছে।


৬. কাব্যময়তা একটি না ছুতে পারা গোলাপ:

কাব্যময়তা— কথাটা আপেক্ষিক। অনেক কিছুর মতো।

চলুন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ একটু অন্যভাবে দেখা যাক। বিশ্লেষিত হোক।

যদি আইনস্টাইনের শক্তি রূপান্তরের ত্বত্তটিকে দেখা যায়— দেখবো শক্তির পরিমাপ (e) = বস্তুগত ভর (m) x সি-র বর্গ (cর স্কোয়ার)।

C = আলোর গতি যা ধরা হয় একটি ধ্রুবক।

এর সাথে কবিতা বা ভার্শন বলা ভাল দর্শনের রিলেশন কোথায়?

একটাই— ধ্রুবকের মান পরিবর্তিত হলে ইক্যুএশন পাল্টাবে।

ধ্রুবক কি— একটি নির্দিষ্ট মাত্রা যা যেকোনো অবস্থান ও রূপকে এক। তার মানে এই মাত্রারূপই হলো ১ ও ০ এর ডেফিনেশন।

একটু সহজতম উদাহরন নিই নিম্নলিখিতভাবে:
রাহুল খুব খারাপ ছেলে— কেন?
সে মদ খায়। সিগারেট খায়। নারীকে বিছানায় প্রত্যাশা করে।

কিন্তু রাম ভালো— সে অল্প মদ খায়। সে দিনে তিনটে সিগারেট খায়। সে কেবল প্রেমিকাকেই চুমু খেতে চায়।

এরপর— রতন মদ খায় না। সিগারেট খায় না।নারীকামনা করে না— ঈশ্বরকে উপাসনা করে।

কী দেখছি, রাহুল খারাপ— রাম রাহুলের থেকে ভালো— রতন রামের থেকে ভালো।

তাহলে এই ভালো-খারাপ একটি মাত্রার উপর নির্ভরশীল। যা কে বলা হয় ধ্রুবক।।


৭. ধ্রুবক ছাড়া কবিতায়:

এটা প্রসঙ্গের উপর নির্ভরশীল বা বলা যায় এটা একটা ভার্চুয়াল ভার্শন।।

সেখানেই কবিতা মাল্টিডাইমেনশনাল। আর এটাই হয়তো প্রতিবাদ— বকলমে দর্শন— বকলমে রোমান্টিসিজম।

এখন রোমান্টিসিজম থেকে অনেক কিছুই একে কনট্রাডিক্ট করে। পরীক্ষা কিন্তু থেমে থাকছে না। বরং আগামী দিনের কবিতায় কাল্ট কালচার বাড়বে।

যদি মানসিকতা পাল্টায়।

সঠিক কবিতা সেটাই— যা আগামী ১০০ বছর পর কোনো পাঠক কাল্টিভেট করবে কবর থেকে।

সভ্যতার আফসোস— এদের কেউ প্রত্নতাত্ত্বিক বলেন না।
                                    —•—



[ধারাবাহিক: আগামী শনিবার পাওয়া যাবে পর্ব: দুই]


রাহুল গাঙ্গুলী। কবি। জন্ম তারিখ: ১০ই আগস্ট ১৯৮১, দুর্গাপুর, পশ্চিম বঙ্গে।
পেশা: সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।
কিছু কথা : কোনো মহাপুরুষ হয়ে দেওয়ালে ঝুলবার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, নিজেকে আবিষ্কার তথা সময়কে আবিষ্কারের ভিতর দিয়েই যোগ ও যাপন। ভালোবাসা, প্রেম, ঘৃণা বা প্রতিবাদ ~ সময় তথা নিজের কাছে : যে কোনো সৎ সূক্ষ্ম অথবা স্থূল প্রশ্ন করার অধিকার এবং নিজের কাছেই সমাধান, সেই বিশ্বাস নিয়ে দীর্ঘ চিন্তনের প্রতিফলনে লিখে যাওয়া অনুরণিত কবিতা
প্রকাশিত গ্রন্থ:
নো ম্যানস্ ল্যান্ড’ (কবিতা পাক্ষিক) ২০১৭, ‘ব্যক্তিগত জরায়ু থেকে’ (ঐহিক) ২০১৮, ‘খাদ্য - খাদক - খাদ্য’ [অনলাইন বই] (ফেরারি) ২০১৮, ‘১ মুঠো জলীয় দূরত্ব ভেঙ্গে’ (টার্মিনার্স) ২০১৮,
কবিতাবিহীন মুহূর্তগুলো’ (তাবিক) ২০১৯,
পরিত্যক্ত ০|র খোঁজে’ (ঘোড়াউত্রা) ২০২০।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. Wow অন্যস্বাদের লেখা পড়লাম৷ কনসেপ্ট ক্লিয়ার৷ একট ছোট্ট ত্রুটি চোখে পড়ল৷ রহিম না হয়ে রতন হবে৷

    উত্তরমুছুন

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।