TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

সাদাত হাসান মান্টোর গল্প ‘খুশিয়া’ | অনুবাদ: কাউসার মাহমুদ


খুশিয়া ভাবছে...

একটু আগে, দোকানীর কাছে থেকে কালো তামাকের পান নিয়ে, দোকানের পাশে এই সংকীর্ণ চাতালে এসে বসে সে। যেটি দিনে টায়ার ও গাড়ির বিভিন্ন পার্স-এ বোঝাই থাকে। এবং রাত প্রায় সাড়ে আটটার দিকে গাড়ির সাজ-সরঞ্জাম বিক্রয়কারী এই দোকান বন্ধ হয়ে গেলে— দোকান লাগোয়া সংকীর্ণ এ চাতাল খুশিয়ার জন্য খালি হয়ে যায়।

সে কুচকুচে কালো তামাক দেয়া পান ধীরেধীরে চাবাচ্ছে আর ভাবছে। মুখের ভেতর পান ও গাঢ় তামাকের সংমিশ্রণে তৈরি পিক; দাঁতের ফাঁক থেকে বেরিয়ে মুখের এদিকওদিক পিছলে যাচ্ছে— এতে তার এমন লাগছে যেন, তার সমস্ত ভাবনা দাঁতের নীচে পিষে তার পিকের মধ্যে মিশে যাচ্ছে। হয়তো এ কারণেই সে ওটাকে ফেলতে চাচ্ছে না।

খুশিয়া মুখের ভেতর পানের পিক মোলায়েমভাবে শোষণ করছে, আর মাত্রই তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি নিয়ে চিন্তা করছে। মাত্রই, অর্থাৎ- এই আধঘন্টা আগে। মূলত  এই সংকীর্ণ চাতালে নির্দিষ্ট সময় বসার পূর্বে খেটওয়ারির পাঁচ নম্বর গলিতে গিয়েছিল সে। মঙ্গুর থেকে কান্তা নামের যে নতুন ছুকড়ি এসেছে; ওই গলির মাথায়'ই থাকে। কে একজন খুশিয়াকে বলেছে কান্তা জায়গা পাল্টাচ্ছে; সে বিষয়েই খোঁজ নিতে খুশিয়া গিয়েছিল ওখানে।

ওখানে গিয়ে কান্তার খোলা দরোজায় সে খটখট কড়া নাড়ে। ভেতর থেকে আওয়াজ আসে— ‘কে?’

উত্তরে খুশিয়া জানায়— ‘আমি খুশিয়া।’

কান্তার আওয়াজে বোঝা যাচ্ছিল সে ভেতরের কামরায়। তাই একটুপর দরোজা খোলা হলে; খুশিয়া ভেতরে প্রবেশ করে। এবং কান্তা ভেতর থেকে দরোজা বন্ধ করে দেবার পর, খুশিয়া ওর দিকে ফিরে তাকাতেই হতভম্ব হয়ে যায়। এ কি আশ্চর্য কাণ্ড! কান্তাকে সে একেবারেই উলঙ্গ দেখে। বলতে গেলে একেবারে উলঙ্গ'ই। কেননা সে তার অঙ্গসমূহ শুধু কেবল একটি তোয়ালে দিয়ে ঢেকে রেখেছে। আসলে ‘ঢাকাও’ বলা যায় না। কারণ, সাধারণত যেসব অঙ্গ ঢাকা থাকে—সেসবগুলাই তো খুশিয়ার হতভম্ব চোখের সামনে উদাম ছিল।

‘হ্যাঁ। বলো খুশিয়া,  কি মনে করে এলে?...ওহ, আমি এখন স্নান করবো ভেবেছিলাম।... বসো...বসো...আচ্ছা এলে যখন, বাহির থেকে নিজের জন্য তো চায়ের কথা বলে আসবে... জানোই তো মুয়ারামা এখান থেকে চলে গেছে।’

খুশিয়ার এ চোখ— যা কখনোই নারীদের এভাবে হঠাৎ উলঙ্গ দেখিনি; ভীষণ ঘাবড়ে যায়। কি বলবে খুশীয়া ভেবেই পায় না! হঠাৎ এমন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা উলঙ্গ নারী দেহাবয়বের সামনে তার হতভম্ব অক্ষিযুগল নিজেকে কোথাও লুকোতে চাচ্ছিল মূলত।

তাই দ্রুত সে শুধু এটুকুই বলতে পারে— ‘যাও... যাও তুমি স্নান সেরে এসো।’ বলতেই যেন মুহুর্তে তার জবান খুলে যায়— ‘তা তুমি যেহেতু ন্যাংটাই ছিলে, দরোজা খোলার কি দরকার ছিল?' ভেতর থেকে বলতেই পারতে আমি ব্যস্ত। আমি পরে আসতাম৷... কিন্ত! আচ্ছা যাও, তুমি গোসল সেরে এসো।’

কান্তা মৃদু হেসে বলে— ‘আরে যখন বললে, তুমি খুশিয়া; তখন ভাবলাম অসুবিধে কী! খুশিয়া'ই তো।’

কান্তার সে মৃদুহাসি এখন অবধি খুশিয়ার মন-মগজে বিঁধে আছে। এখনও কান্তার বিবস্ত্র দেহ মিহি শীতল আবহাওয়ার মত তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর গলে গলে তার ভেতরে যাচ্ছে।

তার দেহাবয়ব সত্যিই খুব সুন্দর ছিল। এই প্রথমবার খুশিয়ার মনে হয়, শারীরবৃত্তীয় নারীরাও এমন সুষম শরীরের অধিকারীনী হয়। এ যেন তার কাছে ভারি আশ্চর্য লেগেছিল।  তবে সবচেয়ে বেশী হতভম্বের বিষয়টি হলো— কান্তা কেমন পুরো শরীর মেলে তার সামনে দাঁড়িয়েছিল; অথচ সামান্য লাজটুকু ছিলো না! কেন?

এই কেন-এর জবাব কান্তা এই দিয়েছিল— ‘যখন তুমি বললে খুশিয়া! তখন ভাবলাম, অসুবিধে কী! খুশীয়া'ই তো। আসতো দাও সমস্যা কী!’

কান্তা ও খুশীয়া উভয়ই একই পেশায় জড়িত ছিল। খুশিয়া  তার দালাল, তাই সে হিসেবে কান্তা তার ছিল। তবুও এটা কোন কারণ হতে পারে না যে, সে তার সামনে ন্যাংটা হয়ে যাবে।  হতে পারে কান্তার কথায় কোন বিশেষ কিছু ছিল। আর খুশিয়াও অন্য কোন উদ্দেশ্য ধরে নিয়েছে। কিন্ত এ নিহিতার্থ উদ্দেশ্য; একইসাথে এতো স্পষ্ট ও অস্পষ্ট ছিল যে, খুশিয়া কোন নির্দিষ্ট অর্থে পৌঁছতে পারে না।

তখনও সে যেন তার চোখের সামনে কান্তার উলঙ্গ শরীর দেখছিলো; যা ঢোলের উপর মুড়ে দেয়া চামড়ার মত স্ফীত ও বিস্তৃত ছিল। সেসময় তার কম্পিত দৃষ্টি থেকে যা একদমই বেপরোয়া। বার কয়েক বিস্মিত হয়েও সে কান্তার সোনালী দেহবল্লরীর উপর আড়চোখে দৃষ্টিপাত করেছে। অথচ অন্যদিকে কান্তার শরীরের সূক্ষ্ম, পাতলা একটি লোম পর্যন্ত কাঁপেনি। ব্যাস শুধু এক সোনালী পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিল সে; যা ইন্দ্রিয়ানুভূতি থেকে অক্ষম হয়।

হা, ভাই! একজন পুরুষ তার সামনে দাঁড়িয়েছিল। পুরুষের  দৃষ্টি যেখানে কাপড় ভেদ করে নারীর শরীরে ঢুকে যায়; সেখানে আপাদমস্তক নাঙ্গা হয়েও সে কেমন সামান্য ঘাবড়ায়নি। অন্তত সামান্য লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল তার? সামান্য লালিমাভাব তো তার চেহারায় ফুটে ওঠা উচিত ছিল! মানলাম সে বেশ্যা। কিন্ত বেশ্যারাও তো ন্যাংটা হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায় না।

দালালির করে তার প্রায়  দশ বছর হয়েছে; আর এ দীর্ঘ সময়ে পতিতাদের সকল গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে সে পুঙ্খানুুপুঙ্খ জেনে গেছে। যেমন, তার জানা ছিল; কলনীর শেষ প্রান্তে যে মহিলাটি একজন যুবককে তার ভাই বানিয়ে থাকে, এজন্য হরদম সে তার ভাঙ্গা রেডিওতে কুমারি মহিলার (মূর্খ কেন ভালোবাসার বুলি জপে) গানের রেকর্ড লাগিয়ে শুনতে থাকে। যেন সে বলতে চায়, অশোক কুমারের সঙ্গে তার গভীর ভালবাসার সম্পর্ক আছে। আর এ সু্যোগেই অনেক দুষ্ট ছেলেরা তাকে অশোক কুমারের সঙ্গে সাক্ষাত করানোর কথা বলে নিয়ে গিয়ে— নিজেদের কাজ সেরে নিয়েছে।

এছাড়া সে এও জানতো যে, দাওয়ারে যে মহিলাটি সর্বদা কোট ও চাপা প্যান্ট পরে থাকে; মূলত সে তার এক বন্ধুর কথায় প্রতারিত হয়েছে। তার বন্ধু তাকে বলেছে— ‘তোমার  পা গুলা একেবারে ইংলিশ ফিল্মের অভিনেত্রীর পায়ের মত। যে 'মেরা কো উরফে খুন তামান্না' মুভিতে অভিনয় করেছে আর এ মুভিটা  সে কয়েকবার দেখেছে। ফলে তার বন্ধু  যখন তাকে বলল— 'পা অনেক সুন্দর ছিল বলেই মার্লিন ডেটস কোট প্যান্ট পরতো। এবং এই দুই  পায়ের জন্য  সে দুই লাখ টাকার বিমাও করে রেখেছিল।’ — মূলত এ কথায় প্ররোচিত হয়েই দাওয়ারের সে মহিলা কোট প্যান্ট পরা শুরু করল। হায়! অথচ যেটা তার নিতম্ব পর্যন্ত আসতেও ভীষণ কষ্ট হতো।

এমনকি তার এও জানা ছিল, দক্ষিণ পাড়ার যে মহিলা কলেজের সুদর্শন যুবা ছেলেদের শুধুমাত্র এজন্যই তার ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে যে; তার ইচ্ছে একটি সুন্দর ছেলের মা হওয়া। অথচ সে জানে; তার এ ইচ্ছে কখনো পূর্ণ হবার নয়। কারণ সে হলো একজন বন্ধ্যা।

সর্বোপরি ওই কুচকুচে কালো মহিলার ব্যপারেও তার জানা ছিল; যে, সবসময় কানে হিরার দুল পরিধান করে থাকে। কিন্তু সে ভালো করেই জানে— তার রং কখনো ফর্সা হবার নয়। অথচ এর পেছনে সে অযথা টাকা ব্যয় করছে এবং সামনে আরো করবে।

মোদ্দাকথা তার গ্রুপের সব মেয়েদেরই ভেতর-বাহির পূর্ণ জানা ছিল তার। কিন্তু এটা জানা ছিল না যে একদিন কান্তা কুমারী তার সামনে ন্যাংটা হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। এবং জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্চর্যতায় হতভম্ব করে দেবে।

এসব ভাবতে ভাবতে খুশীয়ার পুরো মুখে পিক জমে গেছে। সংকীর্ণ মাথায় ঘামের ছোটছোট বুদবুদ প্রকাশ পেয়েছে; যেন তার পৌরুষের মর্যাদায় প্রবল এক ধাক্কা লেগেছে। এমনকি যখনই সে কান্তার উলঙ্গ শরীর কল্পনা করছে; তার ভীষণ অপমান মনে হচ্ছে।

‘হ্যাঁ, একদম’ —খুশীয়া আপন মনেই বলে। পরে আবার বিরবির করে বলে, তা ভাই এ অপমান নয় তো কী, হ্যাঁ। মানে, এক ছুকড়ি ন্যাংটা হয়ে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে যাবে আর বলবে— ‘এতে অসুবিধে কী? তুমি খুশিয়া'ই তো।’

শালা খুশীয়া বুঝি বিড়ালের মতো সর্বদা ওর বিছানা শুঁকেছে।... তা এ নয় তো কী?'

এখন তার দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গেছে যে, তখন সত্যি সত্যিই তার অসম্মান হয়েছে। সে মূলত একজন পুরুষ। আর সর্বদাই অবচেতনভাবে তার এ বিশ্বাস ছিল যে, নারী; হোক সে ভদ্র-অভদ্র, সম্ভ্রান্ত বা বাজারী-বেশ্যা; তাকে একজন পুরুষই ভাববে। এবং নিজের ও তার মাঝে একটি আবরণ রাখবে; যা দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। আর তাছাড়া, সে তো কান্তার ওখানে তার বাসা পাল্টানোর কথা জানতে গিয়েছে? কবে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে, এইতো! এর বেশী তো কিছু নয়। তদুপরিও কান্তার ওখানে তার যাওয়াটা একেবারে স্বাভাবিকই ছিল। খুশিয়া যদি কান্তার ব্যাপারে— দরোজায় আওয়াজ করার সময় ভাবতোই যে সে ভেতরে কি করছিল? তখন তার কল্পনায় বেশী থেকে বেশী এ কটি কথাই আসতো—

‘হয়তো, মাথায় পট্টি বেঁধে শুয়েছিল।’

‘বিড়ালের পশম থেকে পোকা বার করছিলো।’

‘অথবা পাউডার দিয়ে বগলের লোম তুলছিলো; যা থেকে এমন বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ বেরুয় যে, খুশিয়ার নাক সহ্য করতে পারে না। অন্যথা, খাটের উপর বসে একাকী তাশ বাটায় মশগুল হয়েছিল।’

ব্যাস, এ ক'টি বিষয়ই; যা তার মাথায় আসতে পারতো।  তাছাড়া ঘরে যেহেতু সে কাউকে রাখতো না, তাই ও ব্যাপারে কোনকিছু চিন্তাতেই আসার কথা না। তার উপর খুশিয়া তো অমন কিছু ভাবেইনি। সে তার কাজে ওখানে গিয়েছিল, আর তখনই কান্তা....অর্থাৎ কাপড় পরিধেয় কান্তা...অর্থাৎ সে কান্তা; যাকে সে সর্বদা কাপড় পরিহিত অবস্থায় দেখেছে, তার সামনে একেবারে ন্যাংটা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। একেবারেই ন্যাংটা ধরা যায়। কারণ একটা ছোট তোয়ালে তো আর সবকিছু ঢাকতে পারে না। এই দৃশ্য দেখে খুশিয়ার এমন মনে হয়েছে, যেন ছিলকা তার হাতে রয়ে গেছে আর কলার শাঁস পিছলে তার সামনে এসে পড়েছে।  শুধু পড়েইনি— বরং তার অন্য কিছুও অনুভূত হচ্ছিল। যেন সে নিজেই দূর্বল হয়ে গেছে।  যদি বিষয়টি এখানেই শেষ হতো; তাহলেও কিছু হতো না। খুশিয়া নিজের এ হতভম্বতা কোন না কোনভাবে দূর করে ফেলতো। কিন্তু মুসিবত হলো— ওই মাগী আবার মুচকি হেসে বলেছে ‘যখন তুমি বললে খুশিয়া। তখন ভাবলাম, খুশিয়া'ই তো। আসতে দাও।’ এ কথাটিই তাকে এতক্ষণ ধরে কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছে।

‘শালি হাসছিলো’ —খুশীয়া বিড়বিড় করে। যেভাবে কান্তা উলঙ্গ ছিল, ঠিক সেভাবেই তার হাসিটি খুশিয়ার চোখে উলঙ্গ হয়ে ভেসে উঠছিলো। যেন তা হাসি'ই নয়।

এসব ভাবতে ভাবতে বারবার তার শৈশবের সেসব দিনের কথা স্মরণে আসছিল, যখন প্রতিবেশী এক মহিলা তাকে বলতো— ‘খুশীয়া বেটা! যাও তো দৌঁড়ে, বালতিতে পানি ভরে নিয়ে এসো!’ যখন সে পানি ভরে আনতো; তখন সে মহিলা ধুতি দিয়ে আড়াল করা পর্দার পেছন থেকে বলতো— ‘ভেতরে এসে বালতিতা আমার পাশে, এখানে রাখো। আমি মুখে সাবান দিয়েছি, কিছুই দেখতে পারছি না।’ সে তখন ধূতির পর্দা সরিয়ে, তার পাশে বালতি রেখে দিত। তখনও সাবানের ফেনায় লেপ্টে থাকা একটি উলঙ্গ নারী শরীর তার চোখে আসতো; কিন্তু তার মনে কোন প্রকার উত্তেজনা সৃষ্টি হতো না।

ভাই, আমি সেসময় একটি শিশু বাচ্চা ছিলাম। একদম আলাভোলা বাচ্চা। তাছাড়া শিশু ও পুরুষের মাঝে পার্থক্য থাকে। বাচ্চা ছেলে থেকে কেউ পর্দা করে না কিন্তু এখন তো আমি পূর্ণ এক যুবক। আমার বয়স এখন প্রায় আঠাশের কাছাকাছি। আর আঠাশ বছরের যুবকের সামনে তো কোন বৃদ্ধা নারীও উলঙ্গ দাঁড়ায় না।

কান্তা তাকে কি ভেবেছে! একটা নওজোয়ান পুরুষের মধ্যে যা থাকে— সেসব কি তার মাঝে নেই? এতে কোন সন্দেহ নেই যে, সে-কান্তার সুডৌল উলঙ্গ দেহাবায়ব ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আঁড়চোখে কি সে কান্তার সেসব অঙ্গ দেখার সুযোগ নেয়নি, যা রোজ ব্যবহারের পরও স্বস্থানে বহাল ছিল! আর কি অদ্ভুত; পুরুষ হওয়া সত্বেও তার এ চিন্তা আসেনি যে দশ রুপিতে কান্তা একেবারেই দামী নয়। এক মুহুর্তের জন্যও কি তার সমস্ত পেশীতন্ত্রে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল না!  আর সেও কি এমন এক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেনি, যা দিয়ে সে তার হাড় অবধিও চেটেছিল।

তারপরও কী সেই কারণ! যাতে মঙ্গোরের ওই লাবন্যময়ী, কান্তিমান ছুকড়ি তাকে পুরুষ ভাবেনি। আর শুধু....শুধু কেবল খুশিয়া ভেবেই, তাকে তার সমস্ত দেখতে দিয়েছে।

রাগে, ক্ষোভে সে থুক করে, মুখভরা পানের গাঢ় পিক ফেলে। ফুটপাতে যা কাপড়ের উপর বুনট কয়েকটি ফুলপাতা মনে হয়। পিক ফেলে সে উঠে দাঁড়ায় এবং ট্রামে বসে সোজা নিজের ঘরে যায়।

ঘরে এসে সে ভালো করে গা ধোয়। ইস্ত্রি করা নতুন ধূতি পরে। যে বিল্ডিংয়ে থাকে; তার নীচে একটি সেলুন আছে— সেখানে গিয়ে আয়নার সামনে খানিকক্ষণ নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, চুলে চিরুনি মারে। যদিও সেদিন সকালে সে দাড়ি বানিয়ে গেছে, তবুও হঠাৎ কি ভেবে যেন সে আবার চেয়ারে বসে। এবং গম্ভীর স্বরে নাপিতকে শেভ করতে বলে। নাপিত বেচারা হতভম্ব হয়ে বলে— 'আরে ভাই খুশিয়া, ভুলে গেলে নাকি! আজ সকালেই তো তোমার দাড়ি বানালাম। এতে খুশিয়া আরো বেশী গম্ভীর হয় এবং ধীরে দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলে— ‘ক্ষুরটা ভালোভাবে যায়নি তখন।’ যাহোক পুনরায় খালি গালে ক্ষুর মেরে, চেহারায় পাউডার লাগিয়ে সে সেলুন থেকে বেরুয়।  সামনেই টেক্সীর ভিড়। বোম্বের নির্দিষ্ট স্টাইলে সে ‘চ্ছিছিহ, চ্ছিছিহ’ করে এক টেক্সী ড্রাইভারকে নিজের দিকে ফেরায় এবং আঙ্গুলের ইশারায় টেক্সী নিয়ে আসতে বলে।

টেক্সিতে বসলে, ড্রাইভার পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করে— ‘কোথায় যেতে হবে সাহেব!’

এ চারটি শব্দ; বিশেষ করে, 'সাহেব' শব্দটি খুশিয়াকে ভীষণ আনন্দিত করে। সেও মৃদু হেসে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ কায়দায় জবাব দেয়— ‘তুমিই বলো! আচ্ছা, লিমাংটান রোড হয়ে পাসিরা হাউসের দিকে চলো। বুঝলে!’

ড্রাইভার তার গন্তব্যের দিকে টেক্সী ঘোড়ায় এবং চলতে শুরু করে। রোডের শেষ মাথায় আসলে, খুশিয়া ড্রাইভারকে বা দিকে যেতে বলে। টেক্সি বায়ে মোড় নেয়। তখনও ড্রাইভার গিয়ার বদলায়নি; অমনি খুশিয়া বলে— ‘এই সামনের খুঁটিটির কাছে একটু থামাও তো।’ ড্রাইভার নির্দিষ্ট খুঁটি'র কাছে গাড়ি থামায়। খুশিয়া দরোজা খুলে বাহিরে বেরুয় এবং একটি পান দোকানের দিকে এগিয়ে যায়। পান নেয় এবং দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলে তাকে টেক্সিতে নিয়ে আসে। লোকটিকে পাশে বসিয়ে ড্রাইভারকে নির্দেশ করে— ‘সোজা যাও।’

দীর্ঘসময়ধরে টেক্সী চলতে থাকে। খুশিয়া যেদিক ইশারা করে, ড্রাইভার সেদিকেই টেক্সী ঘুরিয়ে নেয়। আলো ঝলমল বিভিন্ন শহর-বাজার ছাড়িয়ে অবশেষে টেক্সি এক আধোআলোমাখা গলির ভেতর প্রবেশ করে। গলিতে যানচলাচল কম। কিছু লোক পথের উপরই বিছানা পেতে শুয়ে পড়েছে। তাদের ভেতর কেউকেউ আবার বড়ো নিশ্চিন্ত মনে জেগে আছে।টেক্সি সেসব ছাড়িয়ে আগে চলে যায় এবং ভাঙা, কাঠের একটি ঘরের কাছে এসে পৌঁছলে খুশিয়া ড্রাইভারকে থামতে বলে— ‘ব্যাস! এখানেই থামো।’ টেক্সী থামে। খুশিয়া তার সঙ্গের; পান দোকান থেকে ধরে আনা লোকটিকে আস্তে বলে— ‘যাও আমি এখানেই অপেক্ষা করছি’

লোকটি নির্বোধের মত খুশিয়াকে দেখতে দেখতে টেক্সি থেকে নেমে আসে এবং সামনের তাঁবু মতো ঘরটিতে ঢুকে যায়।

খুশিয়া এবার জুত করে টেক্সির গদিতে বসে। পায়ের উপর পা রেখে সে পকেট থেকে সিগারেট বার করে জ্বালায়। এবং একটি দুটি টান দিয়ে, বাহিরে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়। সে ভীষণ অস্থিরতা বোধ করছিল। বুকের ভেতর ধড়ফড় হচ্ছিল। তাই বুঝি তার মনে হয়—গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়নি। সে ভাবে, ড্রাইভার বিল বাড়ানোর জন্যই হয়তো পেট্রোল ছেড়ে রেখেছে।' এমনকি ভাবনার ভেতরই ড্রাইভারকে সে ধমক দিয়ে বলে— ‘অনর্থক ইঞ্জিন চালু রেখে আর কত টাকা বাড়াবে!’

ড্রাইভার ঘুরে খুশিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে— ‘শেঠ! ইঞ্জিন তো বন্ধ।’

খুশিয়ার যখন নিজের এ ভুল অনুভূত হয়, তখন তার অস্থিরতা আরো বেড়ে যায়। এবং কোনকিছু বলার পরিবর্তে সে তার ঠোঁট চাবাতে শুরু করে। তারপর এতক্ষণ অবধি বগলে চেপে রাখা কিশতি টুপিখানা শুন্য মাথায় পরিধান করে, ড্রাইভারের কাঁধ চেপে বলে— ‘শোনো ভাই! এই এক্ষুণি এক ছুকড়ি আসবে। আসতেই তুমি চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে দেবে। ঘাবড়ানোর  কিছু নেই। কোন সমস্যা হবে না।’

ইতিমধ্যেই সামনের ওই তাঁবু মতো ঘর থেকে দু'জন লোক বেরিয়ে আসে। সামনে খুশিয়ার সে বন্ধু আর তার পেছনে শঙ্খ রঙের শাড়ি পরা কান্তা। ওরা আসতেই খুশিয়া এক ছুটে রাস্তার অন্ধকার পাশে চলে যায়। খুশিয়ার বন্ধু টেক্সির দরোজা খুলে কান্তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরোজা বন্ধ করে দেয়। ততক্ষণাত কান্তার বিস্মিত আর্তচিৎকারভরা নিনাদ শোনা যায়— ‘খুশিয়া তুৃমি?’

হ্যাঁ, আমি। কিন্তু তোমার তো টাকা মিলে গেছে না! বলেই খুশিয়ার ভারি স্বর আরো উচ্চকিত হয়— ‘ড্রাইভার জোহো নিয়ে যাও।’

ড্রাইভার সেলফ চাপে। ইঞ্জিনের ফটফট শব্দ শুরু হয়। এক ঝাঁকুনি দিয়ে টেক্সি সামনে বাড়ে। এবং খুশিয়ার বন্ধুকে সড়কের মাঝে হতভম্ব অবস্থায় ছেড়ে, নিম আলোর ওই  গলি থেকে গাড়ি অদৃশ্য হয়ে যায়। এই ঘটনার পর, কেউ কোনদিন খুশিয়াকে আর ওই সংকীর্ণ চাতালে দেখে নাই।



কাউসার মাহমুদ। কবি, গল্পকার ও অনুবাদক। জন্ম নরসিংদী জেলায়, ৭ জুলাই। থাকতেন ঢাকায়। বর্তমানে প্রবাসে আছেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ