TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

স্বাদ বিষয়ক অভিজ্ঞতা | সঞ্জীব নিয়োগী

প্রচ্ছদ: নাজমুল হোসাইন

কুণ্ঠে যেছিস বে লাউড়ার বাল?
যেছি বে, হাসিমুদ্দিন জবাব দেবে না দেবে না করেও বলে, যেছি রেশন ডিলারের হুনে ফিরির গোহুম আর চানা লিতে।
বুরমারানি! করুনা না ফরুনা শালা মেলাই ফিরির মাল দিল বে! ঘরগুষ্টি খা শালা বসে বসে!
ন্যাংটা বয়সের দোস্ত সুফিয়ান তখনও খ্যা খ্যা করে হাসছে। শালা বুরবক চোদা! মনে মনে গাল দেয় হাসিমুদ্দিন। হারামি শালা!
...এইসব গালিগালাজের মতো শুনতে হার্দিক সংলাপ অনেকক্ষণ ভালোবাসার রেশ বয়ে বেড়ায় বাতাসে।
পটলডাঙার হাট বসেছে জুম্মাবারের বিকেলে। হাসিমুদ্দিন এক পাল্লা বেগুন কিনে বস্তায় ভরতে ভরতে ভাবে, ভোট তো ঘাড়ের উপর এসে পড়ল, কিন্তু বোতাম টিপবে কোন ছবিতে? মসজিদের মোলবির ফরমান মানবে, নাকি মাইকে যে বেশি গলা ফাটাবে তাকে দিবে, না আম বাগানে বসে শান্তি মনে বেশ খানিক চিন্তা ভাবনা করে দেখবে।
বেগুন পটল আলু কিনে সাইকেলে বস্তা চাপাতে চাপাতে হাসিমুদ্দিন ভাবে, সুফিয়ান তো আজকাল কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। হঠাৎ এভাবে হাসি-মজাক করল কেন। হয়তো পুরোনো ইয়ার কে দেখে মনটা খুশি হয়ে থাকবে। কোনও নেশা ভাঙ নাই, কোনওদিন আঠা শুঁকেনি, সিগ্রেট খায়নি তাও মাথাটা একটু কেমন যেন হয়ে গেছে আজকাল সুফিয়ানের, বুঝতে পারে হাসিমুদ্দিন। আর বুঝতে পারে বলেই মনের মধ্যে কেমন যেন একরকম তিক্ততা জমে। আল্লার দরবারে কী যে খ্যালা চলে কে জানে। কার যে কী মতি হয়, কী গতি হয়, আল্লাপাক ছাড়া কে আছে সেসবের মালিক।

*********

জিভ বের করুন
ল্যান, দ্যাখেন!
হুঁ। গন্ধ পাচ্ছেন?
না...। হুঁ, পেছি...। খানিক পেছি সার!
বেশ, স্বাদ?
মুখে কিছু রুচে না সার, বেটা কে কহিনু, হাঁ রে বেটা, মাংস লিয়ে আয়, তো কহিল আব্বা আজ টাকা নাইখো!
তার মানে স্বাদ পান ?
কিচ্ছুতে সুয়াদ নাই জি ডাক্তার! করোনা হলছে নাকি জি ডাক্তার?
শুনুন, এখন আর রিপোর্ট আসার অপেক্ষা করছি না আমরা। এই ওষুধগুলো লিখে দিচ্ছি, আজ থেকে শুরু করে দিন।
করোনা হলছে তবে হামার, নাকি জি?
ওষুধ খান, ঘরে থাকুন, আবার পনের দিন পরে আসবেন...
ফের আসতে হবে?
হবে!
কেনে?
ঠিক আছে, দরকার না হলে আসবেন না...
দরকার ফের থাকবে না? মালদা টাউনে তো রোজই দরকার জি ডাক্তার, আসতেই হয় মাসে দুচার বার, আসলেই!
আমার কাছে দরকার হলেই আসবেন। কেমন? আসুন এখন।
আচ্ছা তবে টাউন যদি আসিই তবে ফের আপনার কাছেও একবার দেখা করে লিব জি, ওষুধ লিখে দিয়েন ফের। বড্ডা দাম হে দাওয়াই এর!

*********

সুফিয়ানের একটাই বিবি ছিল, ছেড়ে চলে গেছে মাস তিনেক আগে। সুফিয়ান আজকাল আর অন্য কোনও কাজ করে না। শুধু সারাদিন বকরি আর খাসি মিলিয়ে আঠারো খানা ছাগল আর সাতটা গোরুর বাগালি করে কবরখানার পাশের মাঠে। লোকে বলে, হাঁ বে বোকাচোদা, যুয়ান মরদ হয়ে কামকাজ নাই যে, বকরি বাগালি করছিস বে! রাঁঢ় মাগী আর ছেলা পিলার কাম হছে বাগালি বে, তুই বুরমারানি কেনে গোরু-বকরির পোনে পোনে ঘুরবি বে সারাদিন!
সুফিয়ান সুফি সাধকের মতো উদাসীন চোখে চেয়ে থাকে। উত্তর দেয় না।
তার আব্বাকে আজ টাউনে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিল। করোনা না মরোনা বালের কী শালা বেরাম এলো দেশে। তিন শো টাকা ভিজিট লিয়ে হাজার টাকার দাওয়াই লিখে দিল ডাক্তার। ফের কোহিছে পন্দ্র দিন বাদে যেইতে হবে। লাউড়ার ডাক্তার! ফিরে ফিরে টাকা হুঁকাবার ফেরা।
সুফিয়ান শুক্কুর বারে গোরুর মাংস আনতে চেয়েছিল, বড় ভাবী খুব ভালো রাঁধে গোরুর মাংস। কিন্তু বাপ বলে খাসির মাংস খাবে, তাহলে মুখে রুচি হবে, গন্ধ পাবে রান্নার। কী বদ মতলবের মানুষ রে বাবা! সাড়ে ছয় শো টাকা কিলো খাসির মাংস আনতে পারেনি সুফিয়ান। বড় ভাই জালালুদ্দিন তিন মাস হলো টাকা পাঠায় না বম্বে থেকে। ফোনও করে না খুব একটা আজকাল। ভাবী টিভিতে সিনেমা দেখে আর ভাবে সুফিয়ানের বড়ভাই জালালুদ্দিনকে বোম্বের কোনও হিরোইন বশ করে রেখেছে। সেই কারণেই আর তাদের খবর নেয় না লোকটা।

*********

রেশনের ফ্রি গম, আর ছোলা আনতে অনেকবার সুফিয়ানকে বলেছে তার বাপ নিজামুদ্দিন। সুফিয়ান শুনতে চায় না। শেষে আজ বেজায় রেগে নিজেই বস্তা হাতে বেরোতে যায়। সামনে সুফিয়ান কে দেখে খিঁচিয়ে ওঠে, শালার ব্যাটা শালা! ঢেমনা চোদা! কত টাকা কামাছিস বে লাট সাহেবের বেটা? হামি শালা করোনার গায়ে গোহুম আনতে কন্ট্রোলে যাব বে?
সুফিয়ান গোরু ছাগলের বাগালি ছাড়া আজকাল আর কোনও কাজে স্বাদ পায় না। শুনেছে করোনা হলে স্বাদ চলে যায়। কিন্তু সে তো মুখের স্বাদ। মনের স্বাদ তাহলে কখন চলে যায়? আল্লা মালিক জানে। আর জানে সে, যার মনের স্বাদ মরে গেছে।
খুব লজ্জা লাগে ফ্রি মাল নিতে রেশনের দোকানে লাইন দিতে। এ যেন হারামের জিনিস ভোগ করা। কিন্তু গোরু ছাগল পুষে কত টাকা আর আসবে। কুরবানির আগে কিছু চড়া দামে বেচবে বটে, তাতে সারা বছর ছয় খান পেট চলে না। বড় ভাই আর টাকা পাঠাবে বলে মনে হয় না। ভাবী তিনটা বাচ্চা নিয়ে ভাতারের আশায় বসে আছে। বুড়া বাপ পোস্ট অফিসের সামান্য চাকরির পেনশন পায়, তাতে এতগুলো পেটের কিছুই হয় না। জালালুদ্দিন আর টাকা না পাঠালে সংসারটা ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাবে।
সুফিয়ান লাজ-সরম ভুলে ফ্রির মাল নিতে রেশন দোকানের লম্বা লাইনে গিয়ে দাঁড়ায়। পরের বাঁড়া দিয়ে কদিন মুতব? নিজেকেই গাল দেয়। গাল দিলেও স্বাদ ফিরে আসে না জীবনের। এসব করতে ভালোই লাগে না। তার স্বাদ-বদল হয়ে গেছে। এসবে স্বাদ নাই আর। তবু ভাত না খেলে মাথা গরম হয়ে যায়। ভাত খেতেই হয়। ছাগল গোরু পুষে ভাতের জোগাড় হয় না।

*********

বিড়ি বাঁধার কাজ হানিফা বিবি জানে। হানিফ বিবি বিড়ি বাঁধার কাজ আবার শুরু করে। হানিফার মরদ জালালুদ্দিন তাকে বিড়ি বাঁধার কাজ করতে দিত না। বিড়ি জমা দিতে মহাজনের কাছে যেতে হয়। পরপুরুষ বিড়ি গুনে গুনে হিসেব করে জমা নেয়। পরপুরুষ হাতে হাতে টাকা দেয়। জালালুদ্দিন সেটা পছন্দ করতে পারেনি।
জালালুদ্দিন হানিফাকে মানা করেছিল। হানিফা একটু আধটু মৃদু প্রতিবাদ করায় জালালুদ্দিন তার গালে পিঠে চড় মেরেছিল। হানিফা তখনও বলেছিল, দেশ-গাঁয়ের হাজার হাজার মেয়ে মানুষ বিড়ি বাঁধে ও মহাজনের কাছে জমা দেয় আর হাতে হাতে টাকা নেয়, তারা কি সবাই মহাজনের সাথে শোয়? বিড়ি বেঁধে টাকা কমায়, মহাজনকে চুদিয়ে কমায় না, রেগে গিয়ে বলেছিল হানিফা। তখন জালালুদ্দিন তাকে যথোচিত মর্যাদা সহকারে আরও শারীরিক নির্যাতন করে ও তালাকের ভয় দেখায়।
আজ আবার বিড়ি বাঁধা শুরু করে হানিফা। যদি ভাতার টাকা পাঠায় বা নিজে ফিরে আসে তাহলে বিড়ি বাঁধা ছেড়ে দিবে। মাইকে প্রচার করছে, বড় বড় কাগজে ছেপে রাস্তার ধারে ব্যানার টাঙিয়েছে, বাংলা নিজের মেয়েকে চায়। হানিফার মনে গর্ব হয়, সেও তো বাংলার মেয়ে, তাকেও তবে সবাই চায়। তার কথা সবাই ভাবে, বাংলা তার উন্নতি চায়। নিশ্চয় চায়, এটাই তবে কথাটার সারাংশ। হক কথা। হিন্দুদের পার্টি যেন না জিততে পারে। আল্লা, হিন্দুর দলকে জিতাস না আল্লা।
...রাঁধে ও সেই রান্না করা খাবার বাড়ির সবার মুখে বেড়ে দেয় হানিফা; নিজেও অভ্যাসবশে ভাত বেড়ে খেতে বসে। খুচরো মাছের ঝাল বা মাংস খেতে ভালো বসে। কিন্তু সেই খাবারেও স্বাদ পায় না আজকাল। নাড়াচাড়া করে আর মুখে নিয়ে চিবায়। গিলতে খুব কষ্ট হয়। স্বাদ নাই, ভিতরে ঢুকতে চায় না। ভাতারের কথা ভাবে। টাকা পাঠায় না আজ কমাস হলো। ভিন্ন মাগীতে ঢুবেছে হে আল্লা। সব পয়সা খিঁচে লিছে ওই মাগী। বিড়ি বাঁধে আর উকুন খোঁজে মাঝে মাঝে মাথার চুলে আঙ্গুল চালিয়ে।
দেওর সুফিয়ান যুয়ান মরদ, তাকে তার মাগী ছেড়ে যায়। সুফিয়ানের চোখে আকাশের মতো রং লেগে থাকে। সেই রং এর ভাষা বোঝা যায় না। গোরু ছাগলের বাগালি করে। ফ্যান ভাত বেড়ে দিলে বিনা প্রশ্নে খায়। খেতে খেতে উদাস চোখে হানিফার দিকে চেয়ে থাকে।
কী হলো জি, সুফি, কিছু দিব?
তার তাকানো দেখে মাঝে মাঝে জানতে চায় হানিফা। সুফিয়ান তখন আরও মগ্ন হয়ে ভাত খেতে থাকে।
তোমার দাদা ফোন করেছিল কি ?
সুফিয়ান উদাস হয়ে থাকে। মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
হানিফা বলে, তোমার বিবি জিন্দা আছে, তাও তোমার কাছে মরে গেছে...
তখন সুফিয়ান খাদ্য থেকে মুখ তোলে ও বলে, হামার দাদা জিন্দা আছে, তোমার কাছে কি জিন্দা আছে?
সতেরো মাস হয়ে গেল সুফি ভাই! দেশে গাঁয়ে আসার ইচ্ছা হয়নি তোমার বড় ভাইয়ের!
করোনার লেগে ইনকাম বন্ধ হয়ে গেছে জি ভাবী হামার বড় ভাইয়ের। তোমার তো স্বামী। মনে দুখ হয় না তোমার?
কিসের দুখ সুফি ভাই?
তোমার মরদ মুম্বাইয়ের কোন গলিতে কী করছে, খেতে পেছে কি না, দিল কান্দে না তোমার জি?
তোমার ভাই কি খবর লিছে জি হামদের? কহ, লিছে?
ইনকাম বন্ধ হয়ে গেছে ভাবী, করোনা বুরমারানি সভার কাম খতম করে দিলছে জি। হাথে টাকা নাই, সেই গুণে ফোন করে না বড় ভাই, বুঝলা? টাকাই সব। টাকা পিরিত, টাকা মাগী, টাকা ভাতার, টাকাই আল্লা!
তুমি কী হুনে জানলা জি সুফি ভাই, তোমার বড় ভাই টাকার লেগে খেতে পেছে না, ইনকাম নাই সেই লেগে হামদের ফোন করে না। তুমি জানলা কেমন করে?
সুফিয়ান একমনে খায় ও চুপ করে থাকে। সে ওকালতি তর্ক করবে না, সম্ভবনার কথা বলেছে। যেমন অনন্ত সম্ভাবনা লেগে থাকে গোরু ছাগলের বাগালির কাজে। একটা বড় গোটারি খুলতে চায় না, তবু কোনও অজানা সম্ভাবনার সম্বল ধরে থাকে।

**********

পাখি ঠোকর দেওয়া ফল যেমন স্বাদহীন, কুলসুম চলে যাবার পর সেরকম এক অনুভূতি হয়। জীবনটাকে ঠোকর দিয়ে চলে গেছে, স্বাদ পায় না। ...আগে কোনও কোনও নারীর দিকে তাকালে কুল কুল করে নদী বয়ে যেত শরীরে। এখন আর সেসব হয় না। 
দূরে পশুগুলো মাঠে চরছে, ঘাস খাচ্ছে, মুখ তুলে আকাশের দিকে চাইছে, সঙ্গম করছে, ঘাসের উপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছে, একে-অপরকে তেড়ে যাচ্ছে, আহ্লাদ করছে। সেখানে সুফিয়ানের মন থাকে না।
সে তখন একটা ‘জাগ’ গান ধরে...
“একেতো মুসুরি কলাইয়ের ডগা ডলমল করে রে/
হায় রে মজার ডলন কে ডলিতে পারে রে/
কইনার মাক্ বন্ধিয়া থুনু আড়িয়া গোরুর মাঝে রে/
চপুরাইতে আড়িয়া শালা হিকরিশ মারিয়া থাকে রে /
কইনার বইনোক বন্ধিয়া থুইচং ঘোড়া শালের মাঝে রে/
চপুরাইতে ঘোড়া শালা চ্যেহে চ্যেহে করে রে/
কইনার মাসিক বন্ধিয়া থুইচং পাঁঠা ঘরের মাঝে রে/
চপুরাইতে পাঁঠা শালা ম্যাল ম্যালায়া থাকে রে...”

তা, এই গান সুফিয়ান শেখে কোথা? এই কথা তো আরও উত্তরের দিক থেকে আসে। তখন আবার কুলসুমের কথা মনে পড়ে যায়। বেলাকোপায় বাপের বাড়ি কুলসুমের। সেখানেই এখন চলে গেছে সে। বিড়ি ধরিয়ে নিজের মনে হাসে সুফিয়ান। সেইখানে গেছে না লাউড়ার বাল! কোন জাহান্নামে গেছে কে খবর রাখে। এক বছরও থাকেনি কুলসুম সুফিয়ানের ঘরে। কিন্তু সেই কদিনেই কিছু গান শিখিয়ে গেছে। ...কার জন্য আকুল হয়ে গাইতো কুলসুম এখন বুঝতে পারে, তার জন্য নয়। মনের মধ্যে অন্য কেউ ছিল।

**********

ভ্যানে করে মাইকে প্রচার করে ফেরিবালা যায়। হানিফা বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে সেই প্রচার শোনে। ...“ভাঙা সাইকেল, ভাঙা ব্যাটারি, লোহা-টিনের যে কোনও সামান লিয়ে আসুন হামাদের পরচার গাড়ির কাছে... ‘বইরের’ আচার আর এক নম্বর কাপড় কাচার সার্ফ, নুন বা নগদ টাকা দিয়ে কিনে লিব... জলদি করে লিয়ে আসুন পরচার গাড়ির কাছে...”।
হানিফা একবার ভাবে বাড়ির ভাঙাচোরা সাইকেলটা বেচে দেবে। ভাতার চালাতো। বহু বছর পড়ে আছে। মাঝে বড় ব্যাটাটা মেরামত করে কিছুদিন স্কুল নিয়ে যেত। এখন আর চালানোর মতো অবস্থায় নেই। অচল জিনিস বেচে দুটো টাকা হয়। কিন্তু কোনও এক মায়ায় একমনে বিড়ি বাঁধতে থাকে। ভাঙা বেচার প্রচারে সায় দিতে মন ওঠে না।
বসে বসে ঘোরের নেশা, বিড়ি বাঁধে, নেশার ঘোর...। নানা কথা বুকে ঘুরপাক খায়। সুফিয়ান কি তার মাগীর উপর চাপতো না? শুতো না মাগীর সাথে? কেনে ফের ভেগে গেল বহুটি! পেট ভরে ভাত, শরিল ভরে কাপড় আর ভাতারের পিরিত, এই তিন জিনিস থাকলে বেটিছেলা আর কিসের খবর লিতে বাহিরে যাবে জি!
একটু ঢুলুনি আসে হানিফার। একটি সমর্থ পুরুষ দেহ, সুফিয়ানের, সংসারে উদাস হয়ে ঘোরাফেরা করে। থেকেও যেন নেই। হানিফা আকাশের দিকে একবার তাকায়, কল পাড়ে দেওয়ালে ঠেস দেওয়া সাইকেলটা দেখে, হায় তোলে। ...ঘুড়িটা উড়তে উড়তে কখন ভোকাট্টা হয়ে গেছে...তবু লাটাই হাতে কেউ অভ্যাস বশে সুতো গুটিয়ে যায়। তন্দ্রাঘোরে মাথা ঠুকে যায় বাঁশের খুঁটিতে, আল্লা!

**********

নিজামুদ্দিন মনে করতে পারে, তখন মালদার হেড পোস্ট অফিসের সামনে এসব ফোয়ারা মোড় ইত্যাদির বাহার ছিল না। ওই চত্তর জুড়ে টাঙা ওয়ালাদের টাঙা স্ট্যান্ড ছিল। ...লহসুন আর গোলকি বাঁটা দিয়ে ডুমো ডুমো করে কাটা আলুর ভাজি, তার সাথে কলাইয়ের দাল আর মোটা চালের ভাত। ...নিজামুদ্দিনের বাপ কালিয়াচক-সুজাপুর-মোথাবাড়ি এলাকায় টাঙা চালাতো। ভাড়া ছিল দুই টাকা, তিন টাকা, পাঁচ টাকা।
দিনকাল কতো বদলে গেল দেখতে দেখতে। জাতীয় সড়ক, ট্রেকার-বাস-অটো-ট্যাক্সি। এখন তো আরেক হয়েছে, টোটো।
ডাক্তারকে ফিরে দেখানোর টাইম হয়ে গেলছে, চিন্তিত হয় নিজামুদ্দিন। শহর শালা বড্ডা হাবিজাবিতে ভরে গেলছে। ...ধুকিয়ে ধুকিয়ে শহরে ঘুরতে ভালো লাগে না। ছিল একসময় যুয়ান বয়স, শরীরে স্বাদের খবর, মনে রহস্যের ডাকাডাকি। এখন টাউনের নাম শুনলে গায়ে জ্বর আসে নিজামুদ্দিনের।
দিনগুলো কেমন হাহাকার ভরা আর বিবর্ণ আজকাল। নামাজ পড়তে আর গাঁয়ের শেষ মাথায় মসজিদে যেতে পারে না। মাথার উপর রোদ থাকলে আরও বুক ধড়ফড় করে।
রেশনের ফ্রি’র গম ছোলা গ্রামের অনেকেই বিক্রি করে দেয়। কিনবার লোক ভ্যান নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘোরে রেশন বিলির পরদিন থেকে। সুফিয়ান ছোঁড়াটা রেশন তুলতে চায় না। কী ভাবে, কে জানে! দিন দিন কেমন পাগলাটে ধরণের হয়ে যাচ্ছে ছোঁড়া, নিজামুদ্দিন ভেবে কুলকিনারা পায় না। আল্লা এখন উপরে তুলে নিলেই শান্তি পায়। এক বেটা মুম্বাই গিয়ে খবর নাই, আরেক বেটা পাগলামারানি ছাগল গোরু লিয়ে বালের বাগালি করছে। মরদ মানুষের ইনকাম না হলে কোমরে তাকত আসে না। গাঁড়ে গু নাই আর বদনা লিয়ে বাগানে বসলে ঝাড়া পাইখানা হবে জি? কোনও মাগি কি ভাত খাবে এমন কুঁকরা মরদের!
...ইয়ার দোস্ত সব একে একে ইন্তেকাল করে আর দুনিয়াটা বেজান হয়ে যায়। এই তো কাল খবর পেলো মোথাবাড়ির সুজন বসাক মারা গেল। যে দু চার জন হিন্দু বন্ধুর সাথে খুব মাখামাখি ছিল, সুজন তাদের একজন। স্কুলের বন্ধু। নিজামুদ্দিন সুজনকে ভালোবেসে ডাকতো, কী বে হারামখোর! আর সুজন বলতো, কী বে শালা আগাল কাট্টা! 
দিনগুলো সব ফুরিয়ে গেছে, টের পাওয়া যায়...আল্লা...

**********

এরই মধ্যে গতকাল দুপুরে যোহরের নামাজের আগে হঠাৎ নিজামুদ্দিন এর বড় বেটা, সুফিয়ানের দাদা, জালালুদ্দিন এসে হাজির। ফ্যালফ্যাল করে ভূত দেখার মতো চেয়ে থাকে হানিফা। বাচ্চারা ভয়ে ভয়ে উঁকি দিয়ে বাপকে দেখে। সুফিয়ান ঘরে ছিল না। নিজামুদ্দিন বেটার সাথে সালাম বিনিময়ের পরে কেমন শান্ত হয়ে যান আরও। কিন্তু জালালুদ্দিন বেশ চনমনে ও উৎসাহী ভাবে নিজেকে জাহির করতে থাকে। হা হা হা করে হাসে ও বাচ্চাদের জন্য ব্যাগ থেকে বিস্কুট, ফল, ট্রেনে কেনা চানাচুর-এর মিনি প্যাক ইত্যাদি একে একে বের করে।
বিকেলে সুফিয়ান ঘরে ফেরে গোরু ছাগল নিয়ে। তখন জালালুদ্দিন বাজার ঘুরতে মোড়ের দিকে গেছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলে যখন বড় ভাই ঘুরে ফিরে ঘরে আসে, সুফিয়ান ততক্ষণে রোজকার অভ্যাসে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। জালালুদ্দিন অবশ্য তার খোঁজও করে না।

রাতে বিবির কাছে শুয়ে জালালুদ্দিন সকালে বারান্দায় বসে  চা খেতে খেতে সুফিয়ান কে গোয়াল ঘরের দিকে যেতে দেখে। ছোট ভাইকে হাঁক মেরে ডেকে জিজ্ঞাসা করে, হাঁ বে বুরমারানি! তোর ভাবীর স্বাদ পেছিনা কেনে বে লাউড়া!




সঞ্জীব নিয়োগী। জন্ম: ১৯৬৬ (ঝাড়খণ্ড, ভারত)। স্থায়ী ঠিকানা: লালবাগ, মুর্শিদাবাদ। বর্তমান ঠিকানা: মোথাবাড়ি, কালিয়াচক-২, মালদা। রোজগার: কেন্দ্রীয় সরকারের রেশম পর্ষদে চাকরি। প্রকাশিত গ্রন্থ: ৮টি: ‘একটি সুইসাইড নোট বা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট’ (নভেলা, ১৯৯৩), ‘মোষ একটি বর্ণান্ধ চতুষ্পদ প্রাণী’ (গল্প, ১৯৯৭), ‘সুদূরপ্রসারী লিপস্টিক’ (কবিতা, ২০১১), ‘গড়দূরত্বের স্বরলিপি, (কবিতা, ২০১২), ‘অগল্পনীয়’ (গল্প, ২০১৪), ‘মউলডাঙা’ (উপন্যাস, ২০১৯), ‘প্রেসক্রিপশনের বাইরে ও অন্যান্য গল্প’ (গল্প, ২০২০), ‘খাঁচা বিষয়ক অন্যান্য গল্প’ (গল্প, ২০২০)। সম্মাননা: কবিতা পাক্ষিক ৫০০ সম্মাননা ২০১২।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ