TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

পরীক্ষামূলক কবিতা: দু’চারটে ব্যক্তিগত নোটস | রাহুল গাঙ্গুলী


শিল্প নিয়ে কূপমন্ডুকতা বরাবরই ছিল এবং সর্বত্রই ছিল। আর তা ভবিষ্যতেও থাকবে। কারণ ছিল বলেই বিপরীত বা সমান্তরাল শিল্পের অনুসন্ধান মানুষ করে গেছে চিরকাল, সেই গুহাসময় থেকে। আর থাকবে, এই কারণেই যে ~ নিয়ন্ত্রিত বদ্ধজলার প্রভাব কাটিয়ে মুক্তির আনন্দ খোঁজা, মানুষের চিরাচরিত নেচার। আর একথা সর্বৈব সত্য “কবিতা শিল্পজাত মাধ্যমগুলোর সবচেয়ে জটিলতম চূড়ান্ত ফর্ম”। কারণ, এখানে প্রকাশের প্রত্যক্ষ উপাদানগুলো সীমিত। সুতরাং এখানেই ব্যক্তিগত নোটস ~ কিছু পর্যবেক্ষণ পরবর্তী উপলব্ধির শেয়ার “উইদাউট এনি বিশ্ববিখ্যাত মানুষের কোটেশন”। সাধারণত, পরীক্ষামূলক কবিতা নিয়ে বলবার আগে, একটু পরীক্ষা সম্বন্ধিত ধারণাটিকে আরো একবার দেখে নেওয়া যাক পর্যায়ক্রমিকভাবে।

১) পর্যবেক্ষণ: যেকোনো থিওরির প্রাথমিক বেস হলো পর্যবেক্ষণ। দৃশ্যগত অবস্থান থেকে বলা যেতেই পারে [পর্যবেক্ষণ = পর্যায়ক্রমে বীক্ষণ], যেখানে ‘বীক্ষণ’ শব্দটির অর্থ হলো নিরীক্ষণ (যদিও, অভিধানে শব্দটির আরেকটি অর্থ হলো বিশেষ দর্শন)। অতএব, পর্যায়ক্রমিকভাবে বারংবার কোনো ঘটনাকে বিশ্লেষণ করা, এটাই প্রাথমিক দশা বা stage বা পর্যায়।

২) প্রাক-অনুমান প্রকল্পনা বা pre-hypothesis: প্রাথমিক বিশ্লেষণের পর ঘটনা বিষয়ক সমস্ত তথ্য, উপাদান, অনুভূতিগুলোকে একেএকে সাজিয়ে রাখা এবং এই বিষয়ক যাবতীয় প্রশ্নোত্তর থেকে একটা সম্ভাব্য সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা।

৩) অনুমান প্রকল্পনা বা hypothesis: ঘটনাটি বারবার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, তার যাবতীয় গতিসমূহকে বিশ্লেষণ এবং error analysis করে প্রি-থিওরিকে আপডেট রাখা।

৪) পরীক্ষা (experiment): থিওরিকে উপলব্ধ বাস্তবোচিত মাধ্যমে রেখে এমন এক প্রয়োগ (application) পরবর্তী সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ~ যা স্বতঃসিদ্ধ।

৫) থিওরি (theory): স্বতঃসিদ্ধ হওয়ার বাস্তবসম্মত রূপ, যার ব্যাখ্যা সম্ভব, যা নিশ্চিতভাবে দৃশ্যমান বা বলা ভালো ব্যাখ্যাসমূহ নিশ্চিতভাবে রেকর্ড করা যেতে পারে (can be recorded)। যা থেকে নিশ্চিতভাবে পঞ্চইন্দ্রিয়ের কোনো একটির স্পন্দন অনুভূতি সৃষ্টিযোগ্য। অতএব, দৃশ্যমান কথাটিতে অদৃশ্য অনেক কিছুই থাকতে পারে।

৬) সিদ্ধান্ত (Decision): থিওরি উপলব্ধ এমনই এক নিশ্চিত প্রকল্পনা, যা সর্বজনবিদিত ও সর্বজনগৃহীত বাস্তবসম্মতভাবে সত্যি ( true)।

যদিও অল্প কথায় এভাবে প্রকাশ করা হয়তো ঠিক নয়, তবুও কেবলমাত্র সারটুকুই বলছি, যাতে ধারণাগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে আরেকটু স্পষ্ট হয়। হয়তো বিতর্ক থাকবে স্বভাবতই। কিন্তু যা বলতে চলেছি, তার জন্য এই ধারণাগুলোর স্বচ্ছতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ, প্রয়োজনীয়তা না থাকলে পথের খোঁজ সম্ভব নয়। তা সে উদ্দেশ্যমূলক বা উদ্দেশ্যহীন, যাই ফ্যাক্টর থাকুক না। সুতরাং তর্কবিতর্ক যাই থাকুক না কেনো, এপর্যন্ত বলা ও শোনার পর সরাসরি মূলপর্বে ঢোকা যেতেই পারে।

সাধারণত, কবিতার যা প্রচলিত ধারা আমরা ইতিহাসে পাই, মোদ্দাভাগে ভাগ করলে দুরকম: (১) প্রচলিত ধারার কবিতা, (২) অপ্রচলিত ধারার কবিতা। এদের এভাবেও বলা যায়: (১) সিলেবাসের কবিতা, (২) সিলেবাস বহির্ভূত কবিতা। একথা অতীতে বারবার বলেছি।

সিলেবাসের কবিতা: যা প্রচলিত, সমকালীন, গড়পড়তা সর্বজন-পাঠক-বিদিত ইত্যাদি নানাবিধ ভূষণ সম্বলিত। আর, সিলেবাস বহির্ভূত কবিতা হলো এসবের বিপরীত, অর্থাৎ ~ সমকালীন নয়, যেখানে ভবিষ্যৎ খোঁজের নানাবিধ উপাদান সেই মুহূর্তে বর্তমান ইত্যাদি।

সাধারণত, সিলেবাসের কবিতা সেইসব কবিতাকেই অন্তর্ভুক্ত করে, যা হয় এন্টারটেইনমেন্ট বা বিনোদন দিয়ে থাকে অথবা যে-কবিতা আরেকটি পূর্ববর্তী কবিতার সিদ্ধান্ত থেকে গৃহীত, বর্ণিত, লালিত-পালিত। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, বেশিরভাগই কবিতায় একমাত্র উপকরণ হলো শব্দ। কেউকেউ আবার শুধু শব্দ নয়, বলেন অর্থপূর্ণ শব্দ বা শব্দার্থ ছাড়া কবিতার কোনো উপকরণ থাকতে পারে না। এই কথাটার বিরোধিতা একারণেই করা যায় যে, ইতিহাস অনুযায়ী সর্বপ্রথম কবিতা কবে, কোথায় লেখা হয়েছিল এবং কে লিখেছিলেন, সে সম্বন্ধিত কোনো সঠিক নির্ভরযোগ্য তথ্য কোথাও নেই।

কিন্তু কবিতা যদি চেতনার বহিঃপ্রকাশ হয়, বা বলা ভালো, চেতনার সেই বহিঃপ্রকাশ যার অনুরণন দীর্ঘচিন্তা সৃষ্টকারী প্রক্রিয়ায় সামিল ~ এটাই যদি কবিতা হয়, তাহলে মানতেই হবে গুহাচিত্র ছিলো প্রথম কবিতা লেখার সার্থক প্রয়াস। কারণ, দৃশ্য → ধ্বনি → ছবি → চিহ্ন → বর্ণ → অক্ষর → শব্দ → অর্থ → বাক্য → প্রকাশ → যোগাযোগ; মোটামুটি এই পর্যায়ক্রমটি আমরা ইতিহাস ঘেঁটে পেয়ে থাকি। সুতরাং, এটা আমরা বলতেই পারি ~ কেবলমাত্র অর্থপূর্ণ শব্দ নয়, বরং যাবতীয় যা কিছু (অক্ষর, সংখ্যা, চিহ্ন, ছবি ইত্যাদি) আমাদের ভাব প্রকাশের সাংকেতিক উপকরণ, এগুলো প্রত্যেকটিই কবিতার স্বতন্ত্র উপাদান।

এখন, কবিতায় experiment বা পরীক্ষা সম্বন্ধীয় বিষয়টা আনার আগে, আমরা দেখে নিই ~ কবির চরিত্রগত প্রচলিত বৈশিষ্ট্যগুলো মোটামুটি এই সময়ে দাঁড়িয়ে ঠিক কীরকম?

১) কবি লিখছেন স্রোতের মতামত অনুযায়ী, যা তাঁকে দিচ্ছে খ্যাতি। বিনোদনই কবিতার উদ্দেশ্য।

২) কবি না-পাওয়ার প্রতিবাদ করছেন। তাঁর রাজনৈতিক চেতনাকে বহিঃপ্রকাশ করার মাধ্যম হচ্ছে কবিতা।

৩) কবি লিখছেন শুধুই তাঁর নিজস্ব খেয়ালে। কবিতা শুধুমাত্র একান্তভাবে তাঁরই, তাঁরই আত্মমগ্ন ধ্যানের চিন্তন। যা কবিতার প্রতি কবির প্রকৃত দায়বদ্ধতার অভাব বলেই মনে হয়।

৪) কবি লিখছেন তাঁর আত্মমগ্নতা পাঠের নেশায়। সৃষ্টি করছেন কবিতার ব্রহ্মাণ্ড এবং বিকশিত করছেন নিজের স্বতন্ত্রতা। এখানে কিন্তু কবিতার কাছে এবং সমসাময়িক সময়-ফ্রেমটির কাছে কবি দায়বদ্ধ। কবি দায়বদ্ধ তার সময়-ফ্রেমকে স্পর্শ করে চলে যাওয়া প্রতিনিয়ত ঘটে চলা ক্রিয়াবিক্রিয়ার কাছে।

যেহেতু প্রকৃত কবি দূরদর্শী বা বলা ভালো ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, সেহেতু উপরে লিখিত শেষ দুই সাধনার স্তরে যেতে গেলে, কবির প্রয়োজন পর্যবেক্ষণ, প্রাক-অনুমান, অনুমান প্রকল্পনা এবং এক্সপেরিমেন্ট। এখানেই, কবির দূরত্ব কমিয়ে দূরকে অনুভবের চোখ। যা তার সমসাময়িক টাইম-ফ্রেমকে তার সমান্তরাল মূর্ত ও বিমূর্ততার সাপেক্ষে অসীমতার অনুসন্ধানী করে তোলে। সহজ ভাষায়, পাঠকের সময়ের চেয়ে কবি এগিয়ে যান কয়েক শত যোজন। আসলে, অজানার অনুসন্ধান প্রকৃত সৃষ্টিশীলতার আত্মগত প্রবণতা।

আসলে, কবিতায় উদ্বুদ্ধ পাঠক যখন কবিতা লেখেন তখন তিনি প্রথমোক্ত দুটি স্তরেই বিচরণ করেন। আর তা এই কারণেই যে, সেখানে পাঠকের চেতনাকে সাময়িকী সম্মোহন করার কৌশল অনেক সহজ। কিন্তু ক্রমশ উপলব্ধিকৃত অনুভূতি কবিকে যখন সাধনার স্তরে নিয়ে যায়, কবি নিজেই তার কবিতার অন্তর্লীনতার ঝোঁকে ছুটে যান, তিনি নিজেকে নিজেই করে তোলেন সমাধিস্থ। একেকটি স্তরের বলয় পেরিয়ে, তিনি অপর-একটি বলয়ের ভেতর দিয়ে যাত্রা শুরু করেন। তাঁর স্নায়ুবিক ক্রিয়াসমূহ তাঁকে সচেতন থেকে অচেতন, এবং ক্রমেক্রমেই অচেতন থেকে অবচেতনমুখি করে তোলে।

যদিও, একথাও প্রমাণ করা যায় ~ কবিতা না পড়া পাঠকও কবিতাদীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে সৃজনশীল হতে পারেন, সহজ ভাষায় কবিতা সৃষ্টি করতে পারেন বা এটাও প্রমাণ করা যায় তথাকথিত শব্দবিহীন হয়েও সংকেত প্রকাশ করা যায়, তবে সে আলোচনা এই লেখাটির গতিপথ অন্যখাতে বাহিত করবে তাই এগুলো থাকলো পরবর্তীকালের জন্য।

এক্সপেরিমেন্ট শুধু যে আত্মমগ্ন দশাটির প্রতিফলিত বিশ্লেষণ তাই নয়, বরং সেই প্রগতিশীল অস্থিরতা যখন স্থিতিশীলতার দিকে যায়, কবিরও নিজস্ব বিকাশ ঘটে। তিনি উপলব্ধি করতে পারেন নিজেকে। তাঁর আত্মদীক্ষা, তাঁকে শুধু সময়-স্বনির্ভর করে তোলে না, তিনি হয়ে ওঠেন আত্মদর্শনকামী অসীমতার খোঁজে ব্রতী এক সাধক।

কিন্তু এই “এক্সপেরিমেন্ট” এমনই এক পর্যায়, যা অনুভূতি ও উপলব্ধিগতভাবে সঠিক না হলে, কবি নির্বাসিত হতে পারেন নিজেই নিজের কাছে। যদিও, এসবই তাঁকে শিখতে হবে তাঁর সময়ের কাছে। এবিষয় শেখানোর মতো কোনো গাইডবুক এ-ব্রহ্মাণ্ডে আপাতত নেই। সুতরাং, তিনি নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় ঈশ্বর এবং বিপরীতটুকুও। কিছু পন্থা (method) হয়তো তিনি জানতে পারেন, কিন্তু সেগুলোর যতক্ষণ না আত্মীকরণ হচ্ছে, অপেক্ষা ছাড়া কবির কাছে কিছু নেই। অতএব, সঠিক উপলব্ধিই হলো সঠিকতর পথ, সেকথা মেনেই কবির চেতনার শেষোক্ত দুটি স্তরের বিরোধ।

কবি যদি দায়বদ্ধ হন কবিতার কাছে ~ কবিতাসংশ্লেষের প্রকৃত স্ববিশ্লেষণ, কবিকে প্রভাবিত করবে সামনে আলো দেখতে। আর, দায়বদ্ধহীন কবির সাধনা ~ অন্তরীক্ষে কোনো বস্তুর হঠাৎই টুকরোটুকরো হয়ে যাওয়ার নির্বাসন। অতএব, চিন্তার সাধনা সালোকসংশ্লেষ ঘটাক কবির অন্তর্মননে, কবি হয়ে উঠুক প্রকৃত অসীমতাকামী মুক্তির প্রতীক। কবি হয়ে উঠুন স্বতন্ত্র, স্বনির্ভর, স্ববিকাশের সার্থকতম প্রতিবিম্ব। 


রাহুল গাঙ্গুলী। কবি ও প্রাবন্ধিক। জন্ম: ১০ই আগস্ট ১৯৮১, দুর্গাপুর, পশ্চিমবঙ্গে। পেশা: সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। কিছু কথা: কোনো মহাপুরুষ হয়ে দেওয়ালে ঝুলবার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, নিজেকে আবিষ্কার তথা সময়কে আবিষ্কারের ভিতর দিয়েই যোগ ও যাপন। ভালোবাসা, প্রেম, ঘৃণা বা প্রতিবাদ ~ সময় তথা নিজের কাছে : যে কোনো সৎ সূক্ষ্ম অথবা স্থূল প্রশ্ন করার অধিকার এবং নিজের কাছেই সমাধান, সেই বিশ্বাস নিয়ে দীর্ঘ চিন্তনের প্রতিফলনে লিখে যাওয়া অনুরণিত কবিতা। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘নো ম্যানস্ ল্যান্ড’ (কবিতা পাক্ষিক) ২০১৭, ‘ব্যক্তিগত জরায়ু থেকে’ (ঐহিক) ২০১৮, ‘খাদ্য-খাদক-খাদ্য’ [অনলাইন বই] (ফেরারি) ২০১৮, ‘১ মুঠো জলীয় দূরত্ব ভেঙে’ (টার্মিনার্স) ২০১৮, কবিতাবিহীন মুহূর্তগুলো’ (তাবিক) ২০১৯, পরিত্যক্ত ০|র খোঁজে’ (ঘোড়াউত্রা) ২০২০।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. ঠিক বলেছেন "কিন্তু কবিতা যদি চেতনার বহিঃপ্রকাশ হয়, বা বলা ভালো, চেতনার সেই বহিঃপ্রকাশ যার অনুরণন দীর্ঘচিন্তা সৃষ্টকারী প্রক্রিয়ায় সামিল ~ এটাই যদি কবিতা হয়, তাহলে মানতেই হবে গুহাচিত্র ছিলো প্রথম কবিতা লেখার সার্থক প্রয়াস।"
    সহমত ঘোষণা করছি

    উত্তরমুছুন

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।