TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

মোহাম্মদ জসিমের ‘তামাশামণ্ডপ’ থেকে অণুগল্প


অপুষ্পক

"অবশেষে, নিষ্ফলা বৃক্ষটিকে কেটে ফেলা হল"—একটি গল্প পড়তে পড়তে লাইনটি মাথায় গেঁথে গেল সামিরার। মনটি হু হু করে উঠলো তার। নিষ্ফলা, অকেজো গাছটি অন্তত জ্বালানি কাঠের যোগান দেবে; কিন্তু—সামিরা নিজে শেষপর্যন্ত জগতসংসারে কোন কাজে লাগবে ভেবে পায় না।

বিয়ে হয়েছে বছর তিনেক। শুরুটা দারুণ ছিলো। স্বামীর ভালবাসা আর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের স্নেহ-মমতায় এক টুকরো স্বর্গ পেয়েছিলো হাতে। এমনই কপাল, স্বর্গসুখ উবে যেতে সময় লাগলো না যখন জানাজানি হলো সামিরা আসলে বন্ধ্যা—তার সন্তানাদি হবার সম্ভাবনা শূন্য।

শূন্য আদতে ভারহীন হলেও চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়িয়ে তোলে শূন্যতা। শ্বশুর শাশুরী আকারে ইঙ্গিতে জানিয়ে দেয় তারা নাতি-নাতনীর মুখ দেখতে উদগ্রীব। স্বামী চান সন্তান—ডাক্তার বদ্যি কবিরাজের কাছে দৌড়ান সামিরাকে নিয়ে। হতাশ হন একসময়, ভাঁটা পড়ে উদ্যমে।

সামিরার জগতটি ধিরে ধিরে ফিকে হয়ে আসে, সংকুচিত হয়ে আসে। একা হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। স্বামিটিও বদলে যেতে থাকে। পাতলা হতে থাকে ভালবাসার মায়াময় বাতাবরনটি। এমনকি, আজকাল যেন সঙ্গমেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে ভালবাসার মানুষটি। ছল-চাতুরির ফাঁদ পেতে কিছুদিন কাছে টানা গেলেও এখন আর কাজে আসছে না কোন কৌশলই।
সামিরার জগতটি এখন এতটাই ছোট হয়ে এসেছে যে, নিজের বন্ধ্যাত্বই যেন তার একমাত্র ভাবনার বিষয়বস্তু। একা, একদম একা হয়ে শুধু নিজের ভূত ও ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে থাকে সে। উন্মাদের মতো অভিশাপ দিতে থাকে নিজেকে।

প্রতিটি বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের সঙ্গে কথা বলে সে। কাঁদে। সামনের রাস্তায় স্রোতের মতো মানুষ বয়ে যায়, ভেসে যায় যানবাহন। তাদের কথাবার্তা, চিৎকার-চেঁচামেচিতে পৃথিবী বিদীর্ণ হলেও সামিরার তাতে মনযোগ নেই। তবু মাঝে মাঝে এমনও হয়, টুকরো টুকরো ঘটনা বা দৃশ্য তাকে নিজের দিকে টেনে নেয় চুম্বকের মতো, আমোদে ভাসিয়ে নেয়।

সেই বিকেলটিতে বৃষ্টি ছিলো তুমুল। কতগুলো কাক ভিজে ভিজে তারস্বরে কোরাস গাইছিলো। আর সেই কাকপক্ষীর ভীড়ের পাশেই ফুটে ছিলো সংখ্যাতীত বকুল। তার বারান্দার এত কাছে যে বকুলগাছ ছিলো, যেন জানতোই না এমন বিস্ময় আর মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে ছিলো সামিরা। চোখের পলক পড়ে না, প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয় সে। যদি পারতো সমস্ত ঘ্রাণ শুষে নিয়ে পৃথিবীকে নিঃস্ব করে দিতো সে।

সামিরা ভাবে, সে যদি ফুল হয়ে জন্মাতো কতই না ভাল হতো! প্রজাপতি আর মৌমাছির দল বিনে দাওয়াতেই  হাজির হতো এসে। তার স্বামিটি—হৃদয়ের একান্ত কাছের মানুষটি যদি মৌমাছির মতো উড়ে আসতো আজ! ভাবতে ভাবতে কিছুটা মিঁইয়ে আসে আনন্দের রেশ। সামিরা বারান্দা থেকে শোবার ঘরে চলে যায়। অমনযোগ নিয়ে হাত লাগায় ঘরের কাজে, তার ভাবনা জুড়ে ফুল হয়ে জন্মানোর গল্পগাছা।

তার পর থেকে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে থাকে। দীর্ঘদিন বাদে সামিরার স্বামী জামালউদ্দিন উন্মাদের মতো বিছানায় ছুটে আসে। তাকে ছুঁয়ে দেয়, খোলে। খুলতেই তার যোনি থেকে একদল প্রজাপতি উড়ে যায় যেন, বকুলের ঘ্রাণে ভরে যায় সমস্ত বিছানা। আহ্লাদিত স্বামিটি ঘ্রাণ নেয় বকুলের।

সেই রাতে সামিরার কাছের মানুষটি উপুড় হয় তার ওপর, উপহার দেয় বীর্যবৃষ্টি। তুমুল ভালবাসায় সিক্ত করে তাকে।

মধ্যরাত পার করে ঘুমুতে যায় তারা। শেষরাতে আধো ঘুমের মধ্যে সামিরার দ্বিধান্বিত মন আবারও বিষন্ন হয়ে পড়ে। ভাবে, এসব কি শুধু শারিরিক প্রবৃত্তির টানে ঘটেছে নাকি সত্যি সত্যিই মুকুলিত হবার সময় এসেছে তার!



যেমন খুশি তেমন সাজো

ছেলেটি মঞ্চে এসে দাঁড়ালো। তার বুকে সাদা কাগজে লেখা—মানুষ। ছেলেটি মানুষ সেজেছে।
তার কথায় চমকিত হবার মতো কিছু ছিলো না। তার সাজপোশাকেও কোন বিশেষত্ব নেই। সাদামাটা স্কুলড্রেস পরনে। তবু কেন যেন বিচারকরা হতচকিত হলেন, নড়েচড়ে বসলেন।

দ্বিতীয় প্রতিযোগীটি যখন মঞ্চে এলো বিচারকরা আবারও নড়ে বসতে বাধ্য হলেন। তার বুকে লেখা—ধর্ষক। তার পোশাকও অবিকল প্রথম ছেলেটির মতো।
তৃতীয়জন মঞ্চে এলো, তার বুকে লেখা—খুনি।
চতুর্থজনের বুকে লেখা—দূর্নিতীগ্রস্থ রাজনীতিবিদ।
পঞ্চমজনের বুকে লেখা, দিনমজুর এবং ভোটার।
বিচারকগন একটু অবাক, তারা দেখছেন তাদের সামনে একইরকম হাত পা চোখওয়ালা মানুষ—যেমন মানুষ দেখে তারা অভ্যস্ত, এবং তাদের সাজপোষাকও অবিকল একরকম। অথচ তারা এসেছেন যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতায়,  যে সবচেয়ে ভাল ব্যতিক্রম এবং কৌতুহলউদ্দীপক ঢঙে সাজবে তাকেই প্রথম ঘোষনা করবেন।

বিচারকদের একজন বললেন, এ কেমন সাজ! সবাই তো অবিকল এক।
আরেকজন মন্তব্য করলেন, মানুষটিকে প্রথম করা হোক।

অন্যরা প্রতিবাদ করলেন, কেননা নিয়মানুযায়ী যে ভাল সাজবে সে প্রথম হবে, আর, এখানে সবার সাজই একরকম। অতএব সবাই বিজয়ী।
বিচারকদের বিতর্ক থামে না। প্রতিযোগিরাও অপেক্ষা করছেন।

বিভ্রান্ত বিচারকমন্ডলী শেষপর্যন্ত কাউকেই বিজয়ী করতে পারলেন না। তারা ফিরে গেলেন যার যার বাড়িতে, যে যার নিজস্ব মুখোশ ও সাজপোষাকের ভেতরে।

সে রাতে কারোরই ভাল ঘুম হলো না। ভাবছিলেন শুধু, মানুষ দেখতে অপরাধীর মতো, অপরাধীও অবিকল মানুষের মতো।



শোক ও একটি আপেলের জীবনকাল

পৃথিবী থেকে পালানোর ঠিক পাঁচ মিনিট আগে তিনি টের পেলেন তার বুকপকেটে একটিমাত্র চকচকে দশ টাকার নোট। ঘরবাড়ি কিংবা নিজস্ব মাটি তার কোনকালেই ছিলো না। যৎসামান্য যা কিছু উপার্জন সবই তিনি খরচ করে ফেলেছেন। তিনি পৃথিবী ছাড়ছেন একরকম পিছুটান ছাড়াই। অবশ্য স্বজন বন্ধু্দের সাথে তার যাবতীয় সম্পর্কের কথা যদি বাদ দেই তবেই।

দশ টাকা-তলানী হিসেবে টিকে থাকা চকচকে দশ টাকা এই মুহুর্তে তার সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু এবং মাথাব্যথার কারন। যৌক্তিক এবং যথার্থ উপায়ে তিনি এটিকে খরচ করে যেতে চাইছেন। ভিক্ষুককে দিতে পারেন-কিন্তু দিলেন না। অথবা খরচ না করলেও তো সেই অর্থে তেমন কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল। খরচ করেই যাবেন।

অবশেষে তিনি একটি আপেল কিনলেন। পৃথিবীতে এখনও দশ টাকায় একটি স্বাস্থ্যবান আপেল পাওয়া যায় ভেবে মনে মনে বেশ আনন্দ পেলেন ভদ্রলোক। মৃত্যুর কয়েক সেকেন্ড আগে তিনি সদ্য কেনা আপেলটিকে রাস্তায় ছুড়ে দিলেন-এবং আপেলটিকে ঘিরে মানুষের কাড়াকাড়ি ও কোলাহল দেখতে দেখতে চোখ বন্ধ করলেন।

পৃথিবী ত্যাগ করার কতক্ষন পরে তিনি পূনঃরায় চোখ খুলেছিলেন মনে করতে পারলেন না। ঘড়ি ব্যাবহার করে না এখানে কেউ। ইশ্বরের মুখোমুখি হলেন অল্প সময়ের মধ্যেই। ইশ্বর জানতে চাইলেন-মৃত্যুকালে আপেল কেনার রহস্য কি! লোকটি সহাস্যে জবাব দিলো-আমি আসলে জানতে চেয়েছিলাম একটি আপেলের আয়ুর তুলনায় মৃত মানুষের জন্য মানুষের শোক কতটা দীর্ঘস্থায়ী...



[‘তামাশামণ্ডপ’ অণুগল্পের বই
প্রকাশনী: পরিবার পাবলিকেশন্স
স্টল নং: ২৭০
প্রকাশকাল: একুশে বইমেলা ২০২০
প্রচ্ছদ: আইয়ূব আল আমিন]



মোহাম্মদ জসিম। কবি।
জন্ম ৩ এপ্রিল ১৯৮৭, বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার কাঠিপাড়া গ্রামে। ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: ‘ত্রয়োদশ দুঃস্বপ্ন’ (২০১২), ‘অসম্পাদিত মানুষের মিথ’ (২০১৮), ‘মিথ্যেরা সাত বোন’ (২০১৯)।
অণুগল্প: ‘তামাশামণ্ডপ’ (২০২০)।
সম্পাদিত ছোটকাগজ: ‘পৃষ্ঠা’।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।