TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

কবি প্রতিকৃতি | শিমুল মাহমুদ

প্রচ্ছদ: নাজমুল হোসাইন 

অগাস্টিন গোমেজের মনে হলো পাশের ভদ্রলোক তার দিকে বিরক্ত চোখে তাকালো। দ্বিতীয় বারের মতো বাসে উঠতে না পেরে পিছিয়ে এলো। লোকগুলো কি তাকে নিয়ে হাসছিল! মনটা দমে গেলো। সিগারেটের ধোঁয়ায় নিজেকে আড়ালে নিয়ে আস্তে আস্তে চায়ের দোকানের দিকে এগিয়ে গেলেন গোমেজ সাহেব। 
ভাই এক গ্লাস পানি দেয়া যাবে?
এটুকু বলতেই চোখে নিরীহ নিষ্প্রাণ বিষণ্ণতা পেয়ে বসলো তাকে। ইতিমধ্যে দু’জন ব্যস্ত ব্যস্ত ভাব নিয়ে দুগ্লাস পানি খেয়ে চলে গেলো। অথচ দোকানদারের ওর দিকে নজর নাই। একবার দোকানী ছোকড়ার দিকে অল্প করে তাকায়। ভীষণ ব্যস্ত। হয়তো শোনেনি। না আসলে শুনেছে। এবারে বললে হয়তো মুখের ওপর না করে দেবে। আস্তে ভিড়ের মধ্যে সরে এসে আত্মগোপন করলেন গোমেজ সাহেব। 
ঘুম থেকে জেগে প্রথম যে কথাটা মনে হলো, ক্লাশে ছেলেদের আজ ক্রোচের Intuition ব্যাখ্যা করবেন এবং সেটা আজ রাত্রির চমৎকার স্বপ্নটিকে কেন্দ্র করে। কেমন যেন একটু আরাম বোধ হচ্ছে। না স্বপ্নটা আসলে আজ দেখেনি। গতকাল। না তারও আগে। নাকি কোথাও পড়ে থাকবে। কেমন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। নিস্পৃহ চোখে গোমেজ স্যান্ডেলের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলো। আবার পা গুটিয়ে বিছানায় উঠে পড়ে। 
টেবিলের ওপর তিনটি কাগজ। গতরাতের লেখা কিনা সন্দেহ হলো। আসলে আজকে হয়তো ছুটির দিন। গ্লাসের অর্ধেক পানি মুখে দিতেই ঘামের মতো গরম বোধ হলো। সিগারেটের ধোঁয়ায় গোমেজ নিজেকে গোপন করে। আরও নিরিবিলি। হয়তো চোখ বন্ধ আছে। আরাম বোধ হচ্ছে মনের কোথায় কোথায় যেন। আসলে সেদিন ক্লাশের ভিতরটা হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেলো। কে কে যেন বারান্দায় মিছিলে চলে গেলো। মোসলেম সাহেব বলে উঠলো, আরে সাহেব আপনার ক্লাশ তো শেষ। 
গোটা ব্যাপারটা হয়তো মোসলেম সাহেবেরই কারসাজি। ছেলেদের সাথেও হয়তো আলোচনা করে থাকবে। ভার্সিটিতে ফয়সাল আসলে ঠিকই বলতো। কথা বলার আগে মানুষের পোঁদে একটা লাথি মারা দরকার। তা’হলেই চায়ের দোকানে চা আগে আসবে, পানির গ্লাস পরিষ্কার হয়ে আসবে। ভদ্রলোকের ভদ্রতা আগে আগেই চলে আসবে ঠিক দরকার মতো। 
আসলে সেদিন সত্যি সত্যি ফয়সাল তাকে মারতে চেয়েছিল কিনা বিষয়টা আজও পরিষ্কার নয় গোমেজের কাছে। গোমেজ চিকন করে ঘামতে থাকে। সাবা ভয়ানক না হলেও কোথায় যেন একটু ধারালো। বুক দুটো উঁচু। ছেলেদের মতো হাঁটে। গোমেজ তার কাছে ছিল বিষণ্ণ চরিত্র। একটু বেশি হাসতো তাকে দেখলে। উপহাস! তাচ্ছিল্য? কিন্তু লাইব্রেরিতে পাশের চেয়ারে বসতো কেন। মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। কী ভয়ানক কথা বলতে পারে মেয়েরা। বিষয়গুলি কি স্বাভাবিক? নাকি শুধু তার ক্ষেত্রেই ঘটে। 
তারামন বিবির নোংরা অভিনয় ভালো লাগেনি। অথচ শিমিকে সরাসরি বলা উচিত ছিল। তার সামনেই শফিক স্যার বেশ খানিকটা শুনিয়ে দিলো। সেদিন কী সুযোগটাই না গেলো। দু’কথা শুনানো হলো না। অথচ কতদিন মনে মনে প্রতিশোধের কথা ভেবেছে গোমেজ। ওর দিকে ট্যারা চোখে তাকিয়ে হেঁটে গেলো মেয়েটা। হয়তো ঠোঁটে নোংরা হাসি লেপটে ছিল গোমেজের জন্য। আসলেই শিমির হাসিটা ভয়ানক নোংরা অথচ ঐ নোংরা হাসি দিয়ে ক্যান্টিনে বিল না দিয়ে দিব্যি গোমেজকে দেখিয়ে দিয়ে চলে যায় শিমি। ওর স্বামীর টাকাগুলো সব কী করে। আমাকে একটা কলম উপহার দিলেওতো পারে। 
বুকের বাঁ পাশটা যেন-বা দু’তিনবার লাফালো। ঘাম চিকন থেকে মোটা হয়ে গড়িয়ে পড়লো। নেশার মাত্রাটা কি বেশি হচ্ছে। টানটান দাঁড়িয়ে যায় গোমেজ। হাত দুটো আছাড় মারে আকাশে। মাথাটা চক্কর দেয়। টানটান শুয়ে পড়ে মেঝেতে। চিল্লাতে ইচ্ছে করে। পরমুহূর্তেই বিড়বিড় করতে থাকে গোমেজ। কোথায় যেন পড়েছিল, একাকী একখানা নিঃসঙ্গ পাপ চুপচাপ শুয়ে আছে কবরখানায়। আত্মগত কণ্ঠে গোমেজ ভয় পেয়ে যায়। 
দিনটা ছিল রোববার; রাকীবকে ওর টেবিল হতে তুলে নিয়ে গেলো ওরা। তুহিন আর গালীবকে চিনতে পারলো গোমেজ। দুই রাত দুই দিন পর বস্তাবন্দী রাকীবের লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি রওয়ানা দিলো গোমেজ। কেমন একটু জড়সড় হয়ে আসে গোমেজ। সংকুচিত হয়। বুকটা ফাঁপতে থাকে। ভয় পাচ্ছে কেন?
স্কুলের হলঘরে একাকী দুপুরে আশ্চর্য রকম উঁচু ছাদের দিকে তাকিয়ে খুব জোরে চিৎকার করে নিজ-কণ্ঠের প্রতিধ্বনিতে গোমেজ কতো আশ্চর্য দুপুর পার করে এসেছে। আর এখন ভর দুপুর না ভরা রাত্রি বোঝা যায় না। ভরা সন্ধ্যায় বিশাল মাঠের ওপারে পানির ক্যানালের ধারে নির্জনে বসে সমস্ত শৈশব কী অদ্ভুত আদর আদর কল্পনা। লম্বা লাল রেলগাড়িতে করে গোমেজ যাচ্ছে। বাঁশঝাড়ে শীতের ধূসর ঘুঘু পাখি ঘুমাচ্ছে। সবুজ টিয়ে শীতের কুয়াশামাখা খাঁচায় ঘুম যায়। গোমেজের ঘুম আসে না। কাল ভোরে একা একা ঘুঘু শিকারে যাবে। চিকন চিকন মেয়েরা সবাই নৌকাতে হাসতে হাসতে হাত নাড়িয়ে চলে যাচ্ছে যমুনা পেরিয়ে। তীরে দাঁড়িয়ে লক্ষীদি গোমেজের হাত ধরে টানছে। লক্ষীদির নরম বুকে চোখ ঘঁষে ঘঁষে কাঁদতে থাকে গোমেজ। একটা সাপ গোমেজের গলাটা পেঁচিয়ে ধরে জোর করে চুমু খায়। লক্ষীদির বুক জোড়া কেমন গলে যেতে থাকে। তিনজন চিকন চিকন লম্বাটে কন্যা গোমেজকে লক্ষীদির কাছ থেকে নৌকার মাঝে নিয়ে গিয়ে ওর প্যান্ট খুলে ফেলে হাসতে থাকে। 
গোমেজের কেমন যেন ভালো লাগে উলঙ্গ অবস্থা। পরক্ষণেই চিৎকার করে উড়তে চেষ্টা করে কিন্তু পা দুটো কেমন ভারি হয়ে আসে। নৌকার পাটাতনে পায়ের পাতা লেপটে থাকে। দু’একবার পিছলে যায়। অদ্ভুত শিশু শিশু কণ্ঠে গোঙাতে গোঙাতে গোমেজের দেহটা নড়ে ওঠে। চোখ খুলতেই উঠে বসে। 
বেশ খানিকটা সময় ঝিম মেরে থাকবার পর বুঝতে পারে পিপাসায় গলাটা তেতো হয়ে গেছে। দ্বিতীবারের মতো চোখ খোলার পর মা কালির মূর্তিটা চোখে পড়ে। গোমেজ বুঝতে পারে ভাঙ্গা কালিবাড়ি মন্দিরে গতরাতে এসেছিল সে নেশা করতে। সিগারেট ধরাতেই নিস্পৃহ চোখে চারিদিকটা দেখে নেয়। বুঝতে পারে না রাত কতো হলো। হঠাৎ মনে পড়ে নৌকার ওপরে হাসতে থাকা চিকন চিকন সাদা মেয়েদের কথা। ওদের মধ্যে লক্ষীদিটাকে ঠিক চিনতে পারলো না গোমেজ। 
পুরনো ভাঙা পাথরের সিঁড়িগুলোর ওপর পা রাখে গোমেজ। মনে হতে থাকে মা কালির মূর্তিটা যেন-বা নড়তে শুরু করেছে। কালি মূর্তির হাত লম্বা হচ্ছে। চুলের পেছনে মনে হলো ছোঁয়া লাগলো। কানের পাশে কে যেন নিঃশ্বাস ফেলছে। দ্রুত সিঁড়ি থেকে নেমে আসে গোমেজ। 
ভাঙা গেটের পাশে বারান্দা। বারান্দায় কী যেন নড়ে উঠলো। মনে হচ্ছে মেয়েছেলে। গোমেজের মাথার ভিতর এলোমেলো সময়গুলো যেন জোড়া লেগে গেলো। চিনতে পারলো ওকে। পাগলী। প্রায়ই দেখা হয় এই মন্দিরে। সব ঠিকঠাক মতো পরিচিত হয়ে এলো। 
ফটকের মুখে কেশরভাঙা সিংহ মূর্তি। সিংহটার পাটাতনে প্রতিদিনের মতো আজকেও কুতকুতে কুত্তাটা ঘুমাচ্ছে। সিংহটা হঠাৎ যদি ওকে লাথি মেরে বসে। পাগলীটার বুকদুটো বুকের সাথে ঝুলছে। তলপেট থেকে যেন গন্ধ ভেসে আসছে। পাশ দিয়ে ইঁদুরের মতো কী যেন একটা হেঁটে গেলো। চোখের ওপর থকথকে মাছি। গোমেজের গলার নিচে দলা পাকিয়ে এলো। থুথু ফেলতেই মাথাটা ঘুরে গেলো। বমি বমি ভাব হচ্ছে গোমেজের। পাগলীটাকে একটা লাথি মারতে ইচ্ছে করলো। সিংহটা কুত্তাটাকে লাথি মারছে না কেন? 
ভীষণ লাথিতে কুত্তাটা গড়িয়ে পড়ে পাটাতন থেকে। পাগলীর তলপেটে গিয়ে ধাক্কা খায়। মা কালির সাদা দাঁত এগিয়ে আসতে থাকে গোমেজের দিকে। গোমেজের পায়ের পাতা ভারি হয়ে আসে। মদের মতো ভারি ভারি ব্যথা। মচ্কে গেছে লাথিতে। 
সরে যাচ্ছে গোমেজ। মাথাটা ফাঁকা হতে শুরু করেছে আবার। মাথার ভেতর অনেক গভীর থেকে চিকন একটা একটানা শব্দ হচ্ছে। পা উঠছে না কেন? স¦প্নের কথা মনে পড়ে গেলো। যেন-বা নৌকার পাটাতনে পা পিছলে যাচ্ছে। এটা কি স্বপ্ন! চিকন চিকন কোমর। উঁচু স্তন। গোমেজ ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করে। 
পাগলীটা ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে। দাঁত বের করে হাসছে। দুধ দুটো ধরে কাকে যেন ডাকছে। ওর কি বাচ্চা আছে। মায়ের দুধ এতো বিশ্রী! গোমেজ কি কোনদিন পান করেছে! ভাবতেই বমি উঠে এলো। 
চট করে সরে আসে গোমেজ। পাগলীটা কুকুরটার গলা জোর করে পেঁচিয়ে ধরে দুধের ওপর ঠেসে ধরে। খা দুধ খা। পেছনে মা কালির হাতটা দ্রুত লম্বা হচ্ছে আরও। 
গলির পথ ধরে দৌড়াচ্ছে গোমেজ। মোড় ঘুরতে গিয়ে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে  দাঁড়ায়। জানালার ফাঁক দিয়ে চিকন আলো ছিটকে আসছে। হাসছে গোমেজ। পরক্ষণেই বুঝতে পারলো না, হাসছে কেন সে। জানালায় কান পাততেই কেমন যেন ভালো লাগলো। শব্দ হচ্ছে মাথার গভীরে। নাকি শব্দটা জানালার ওপাশ থেকে ভেসে আসছে? ঘন ঘন নিঃশ্বাস। চিকন চিকন ফিসফিস আওয়াজ। গোমেজ ডুবে যাচ্ছে। কে যেন ককিয়ে উঠলো। নারী কণ্ঠ পুরুষ কণ্ঠের সাথে মিশে মিথুনদৃশ্য হয়ে উঠছে। 
দৃশ্যের ভেতর কারা যেন হাঁটছে। লক্ষীদি? কেমন মায়াতে জড়িয়ে যাচ্ছে চোখ। চিকন চিকন মেয়েগুলোকে মনে পড়লো। লক্ষীদির পেছন পেছন হেঁটে গেলো গোমেজ। লোহার গেটের ওপাশে চলে গেলো লক্ষীদি। গোমেজ গেট বেয়ে উঠে যায়। কেঁপে উঠলো গেটটা। 
উঠানে লাফ দিতেই গোমেজ চিনতে পারে বাড়িটার রঙ। একটু পিছিয়ে আসে। লক্ষীদিটা কে? পেন্টের চেনে হাত দেয় গোমেজ। বুকের হাড্ডিতে টুকরো টুকরো কাঁচা কলিজা লাফাতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে পিছাতে থাকে। পাশে দেয়াল ঘেঁষে পায়রার খোপ। খসমসে শব্দের ফাঁকে ফাঁকে পায়রার ঘুমঘুম চিকন আওয়াজ। 
এই বাড়িতেই তিন বোনের বাস। ওরা বেশ ভালো। বুকের খাঁচায় এমন হচ্ছে কেন? কবুতরের খাঁচাগুলো যেন ঘনঘন চেঁচাতে থাকে। তিনবোনের ছবিগুলো ভেঙে যাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে গোমেজ খোপের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দেয়। ঝটপট হাতের দু’তিনটা জায়গা ছিলে গেলো। আরও জোড়ে কবুতরটা চ্যাঁচাতে থাকে। জোড়ে চেপে ধরে গোমেজ। হাতের সাথে কিসের যেন চাপ লাগলো। গোমেজ বুঝতে পারলো পায়রার ডিমগুলো পিষে যাচ্ছে হাতের ঘঁষাতে। 
হঠাৎই বাড়িটার বাইরের দরজাটা খুলে গেলো। উপরের বাল্বটা জ্বলে উঠলো। গোমেজ দ্রæত সরে যাচ্ছে। পাকা রাস্তা বরাবর ছুটছে। মাথার ভেতর চো-র শব্দটা পেটাচ্ছে। থামছে না। গোমেজ অন্ধকার খুঁজছে। চারদিকে থই থই আলো। চাঁদের আলোয় গোমেজ কেমন যেন অসহায় হয়ে উঠলো। নদীর ধার বরাবর ছুটে গেলো। চাঁদটা আরও দ্রুত থই থই আলো হয়ে যমুনাতে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ছড়াতে ছড়াতে আরও দূরে, আরও দূরে।
আরও দূরে চিকন চিকন মেয়েগুলো সাদা সাদা নৌকায় করে ভেসে যেতে শুরু করলো। ওরা সরু সরু আঙুল তুলে গোমেজকে ডাকছে। গোমেজের আঙুলে কবুতর থরথর কাঁপতে থাকে। গোমেজের চোখের তারায় চাঁদের আলো থই থই কাঁপতে থাকে। লক্ষীদির হাতটা যেন গোমেজের কোমর জড়িয়ে নিচে নেমে গেলো। 
গোমেজের মনে হলো ওর হাতে ধরা পায়রাটা আস্তে করে এক জোড়া হয়ে গেলো। একজন আরেকজনকে আদর করছে। চিকন ঠোঁট দিয়ে কামড়াচ্ছে। রতি সুখে পাখা ঝাপটায় পায়রা দুটো। গোমেজের চোখে কপালে চাঁদের আলো তরল হতে শুরু করলো। বাল্মীকির চোখে পড়ে মিথুনরত পাখি। গাছের ডালে আনন্দ কেঁপে কেঁপে উঠছে। শিকারী বেদের তীর ছুটে গেলো। তীরে গেঁথে ওদের মিথুন-দৃশ্য কাঁপছে। 
চাঁদের আলো গাছের পাতায় পাতায় কাঁপতে থাকে। কাঁপতে কাঁপতে পাতা থেকে শিকারী বেদের কলিজাতে এসে কাঁদতে শুরু করে। মা সরস্বতী চক্ষু উন্মোচন করলেন। গোমেজ থরথর করে কেঁপে উঠলো। মাথার ভেতর দিয়ে দ্রুত ছবিগুলো চলে যাচ্ছে, ধরা যাচ্ছে না। 
গোমেজের মনে হলো পাঠশালার পণ্ডিতত মশাই সপাং সপাং চিকন বেত বসিয়ে দিলেন হাতের তালুতে। গোমেজ হাতের সাথে হাত ঘঁষে চিৎকার করে ওঠে। চিৎকারে চাঁদের আলোর সাথে বাতাসেরা ঘরঘর আওয়াজ তুলে কাঁপতে শুরু করে। দ্রুত দুহাত একটানে সরিয়ে ফেলে গোমেজ। করতলে সঙ্গমরত কবুতর ডানা ঝাপটাতে গিয়ে চাঁদের আলোর সাথে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত হয়ে গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। গোমেজ যেন-বা পণ্ডিত স্যারের কাছে ক্রৌঞ্চ ক্রৌঞ্চীর মিলনদৃশ্য মুখস্ত বলতে থাকে, মা নিষাদ! প্রতিষ্ঠাং স্তমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ। যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনা দেকমবধীঃ কামমোহিতম্।
হাতের মুঠোয় তখনও ধরা আছে তাজা কবুতরের টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলা দেহ। হাত দুটো চোখের কাছে তুলে গোমেজ হাঁটতে থাকে। বিড়বিড় করতে করতে নদীর নিকট এগিয়ে যায়। নিচে নামতে থাকে। পায়ের তলায় নদীর জল ক্রমাগত গভীর হয়। চোখ খোলার পর আশেপাশে তাকিয়ে দেখে বেশ কিছু মানুষ এই প্রভাতে নদীর জলে স্নান করছে। 
গোমজ অনেক লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বুক ভরে আরেকটা ডুব দেয়। দেহ প্রথমে গভীর ভারী হয়ে আসে তারপর হালকা হয়ে ভেসে উঠতে থাকে। 
মাথার ওপর যমুনার জলে সূর্যের চিকন চিকন আলো নড়ে নড়ে উঠছে।




শিমুল মাহমুদ। কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক। জন্ম ৩ মে ১৯৬৭, সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পাঠ গ্রহণ শেষে ইউজিসি-র স্কলার হিসেবে পৌরাণিক বিষয়াদির ওপর গবেষণা করে অর্জন করেছেন ডক্টরেট ডিগ্রি। বর্তমানে তিনি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। নেশা: অধ্যাপনা। পছন্দ: পাঠগ্রহণ, ভ্রমণ ও একাকিত্ব। অপছন্দ: মঞ্চলোলুপ আঁতলামো। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: ‘মস্তিষ্কে দিনরাত্রি’ (কারুজ, ঢাকা: ১৯৯০), ‘সাদাঘোড়ার স্রোত’ (নিত্যপ্রকাশ, ঢাকা: ১৯৯৮), ‘প্রাকৃত ঈশ্বর’ (শ্রাবণ প্রকাশন, ঢাকা: ২০০০), ‘জীবাতবে ন মৃত্যবে’ (শ্রাবণ প্রকাশন, ঢাকা: ২০০১), ‘কন্যাকমলসংহিতা’ (ইত্যাদি, ঢাকা: ২০০৭), ‘অধিবিদ্যাকে না বলুন’ (ইত্যাদি, ঢাকা: ২০০৯), ‘আবহাওয়াবিদগণ জানেন’ (চিহ্ন, রাজশাহী: ২০১২), ‘কবিতাসংগ্রহ : সপ্তহস্ত সমুদ্রসংলাপ’ (রোদেলা, ঢাকা: ২০১৪), ‘স্তন্যপায়ী ক্ষেত্রউত্তম’ (অচেনা যাত্রী, উত্তর ২৪ পরগণা: ২০১৫), ‘বস্তুজৈবনিক’ (নাগরী, সিলেট: ২০১৬), ‘সমূহ দৃশ্যের জাদু’ (চৈতন্য, সিলেট: ২০১৮),   ‘ভাষাদের শষ্যদানা’ (বেহুলা বাংলা, ২০১৯), ‘ব্যাকটেরিয়া চিহ্নিত কবিতা’ (ঘোড়াউত্রা, ২০২০), দীর্ঘকবিতা: ‘দেশভাগ হইলো একফালি নকশাদার লাল তরমুজ’ (বেহুলা বাংলা, ২০২০)। গল্পগ্রন্থ: ‘ইলিশখাড়ি ও অন্যান্য গল্প’ (নিত্যপ্রকাশ, ঢাকা: ১৯৯৯), ‘মিথ মমি অথবা অনিবার্য মানব’ (পুন্ড্র প্রকাশন, বগুড়া: ২০০৩), ‘হয়তো আমরা সকলেই অপরাধী’ (গতিধারা, ঢাকা: ২০০৮), ‘ইস্টেশনের গহনজনা’ (আশালয়, ঢাকা: ২০১৫), ‘নির্বাচিত গল্প’ (নাগরী, সিলেট: ২০১৬), ‘অগ্নিপুরাণ ও অন্যান্য গল্প’ (চৈতন্য, সিলেট: ২০১৬), ‘মনবিকলনগল্প’ (২০২১)। উপন্যাস: ‘শীলবাড়ির চিরায়ত কাহিনী’ (ইত্যাদি, ঢাকা: ২০০৭), ‘শীলবাড়ির চিরায়ত কাহিনী’ (ধানসিড়ি, কলকাতা: ২০১৪), ‘শীলবাড়ির চিরায়ত কাহিনি’ (চৈতন্য সংস্করণ, ২০১৬), ‘সুইসাইড নোট’ (নাগরী, ২০১৯)। প্রবন্ধ: ‘কবিতাশিল্পের জটিলতা’ (গতিধারা, ঢাকা: ২০০৭), ‘নজরুল সাহিত্যে পুরাণ প্রসঙ্গ’ (বাংলা একাডেমী, ঢাকা: ২০০৯), ‘জীবনানন্দ দাশ : মিথ ও সমকাল’ (গতিধারা, ঢাকা: ২০১০), ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ধারার কবিতা’ (গতিধারা, ঢাকা: ২০১২), ‘মিথ-পুরাণের পরিচয়’ (রোদেলা, ঢাকা: ২০১৬)। তিন দশক যাবৎ সম্পাদনা করছেন সাহিত্যের ছোট-কাগজ: ‘কারুজ’।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ