TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

টোটালিটির দায়ভার: ‘কবিতার জগৎ, আত্মার জগৎ’ | পর্ব: দুই | সাজ্জাদ সাঈফ

অলঙ্করণ: নাজমুল হোসাইন


স্বকীয় যাত্রায় আত্মজিজ্ঞাসার আরেক শিল্পী আহমেদ মওদুদ হাজির হন নিজ কাব্যভাষা নিয়ে উজ্জ্বল আদলেই, কবিতার জগৎ আত্মার জগৎ ভাবতে স্পৃহা জাগে বারবার—

পুরো একটা হৃদয়ের ভার একা বইতে পারবে না জন্যই কি হৃদয়টাকে টুকরো টুকরো করে রেখেছিলাম!

রাখালকে গরুর পাল নিয়ে যেতে দাও... 
রাখাল এবং গরু যে যার জায়গায় সন্তুষ্ট, একমাত্র অসন্তুষ্ট তোমরা, যারা উত্তরকে পেছনে রেখে প্রশ্নের পাহাড়ে লুকিয়ে রাখো নিজেদের

দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানে’ কাব্যগ্রন্থ এই কবির আত্মপর বোঝাপড়ার ভিতর দিয়ে অস্তিত্বের শৈল্পিক বিচরণ, মেদহীন ভাষার জাদুতে পরিপূর্ণ, এই সময়ের বিশ্বকবিতার অনন্যতা বহন করছে নিঃসন্দেহে। এখানে সংকেত, চিত্রময়তা, দৃষ্টান্তের অধ্যয়ন, নিগ্রহ, আত্মসমর্পণের নিজস্ব কৌশল অনবদ্য।

 ...ও স্মৃতি, আমাকে বেঁধে রাখো জলের পেরেক দিয়ে বাতাসের সাথে

চলমান বাংলা কবিতা সত্যিই আন্তর্জাতিক মর্মরে এভাবে নির্মিতির সুরম্য উদ্যান পেতে রেখেছে, এই সময়ের বেশ কিছু মুখ সে-ই উদ্যানের সৌরভ। আহমেদ মওদুদের কবিতা সময়ে আরো পাঠক অন্তরে ন্যস্ত করবে কাব্যতরু এতে সন্দেহ নেই।

বাংলা একটি ভাষা হিসেবে আন্তর্জাতিক দেশগুলির চেয়ে এখন একদম যে পিছিয়ে আছে সে আর বলার সুযোগ নেই হেতু চলিত ও প্রমিত ভাষার সংমিশ্রণ যা একটি বৃহৎ জাতিগোষ্ঠির প্রাত্যহিক কথাবার্তার চরিত্র ধারণ করে আছে তা ইতিমধ্যেই কবিতার কার্যপদ্ধতির অংশ। এতে মোটের ওপর এই ভাষার আগামী রচিত হচ্ছে দিনে দিনে বিভিন্ন বৈচিত্রের মধ্য দিয়েই, একই সময়ে ভাষাকে যে যার মতো করে মোলায়েম করে কবিতায় পুঁতে রাখছেন বিজয়ীর ভঙ্গীতে যে-রকম শিল্পে এন্টারটেইনমেন্ট বিরাজ করে আরকি। সে অনেক কথা আসলে। 

গদ্যের এই পর্যায়ে সাম্প্রতিককালের বাংলা কবিতায় নিরীক্ষার যক্ষ সাধনে অভিলিপ্সাময় কবি আরণ্যক টিটোকে পাঠ করা যাক—

সুন্দর মুহূর্ত্তটুকু ফুটিয়ে তোলার জন্য
অপরাধটুকুর প্রয়োজন ছিল...

মনস্তত্ত্বকে শুষে নেবার ক্ষমতা অর্পণ করে কবি এখানে কবিতাকে স্বাবলম্বী স্বরের যোজনা দিয়েছেন—

অপরাধ
বিপ্লবের ধাত্রী, ফুল ফোটার ব্যাকরণ!...

সাইকোলজিকাল থ্রিলারের টোনে দস্তয়ভস্কির নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড-এর কথা মনে আসাটাও স্বাভাবিক এই কাব্যে—

আহা...
সৌন্দর্য্যপিপাসা মনে খেলা করে
অপরূপ অপরাধ 
প্র-ব-ণ-তা!...

একেকটি স্লাইসের মতো পঙক্তি এসে অনির্ণেয় কিছু আতজিজ্ঞাসায় সুপ্ত আর প্রকাশ্যও বটে—
‘অনশ্বর কবিতা পাঠকের কাছে দাবি করে তীব্র অভিজ্ঞতা’
—জীবনানন্দ দাশ

এই কবিতাগুলিতে সেই হাইপোথিসিস প্রমাণিত বটে। ‘ফুলেরা পোষাক পরে না’ কাব্যে আরণ্যক টিটো সার্থকতার সাথে সেই প্রামাণ্যকে জোর আর উচ্চতা দিয়েছেন স্বকীয় সূর্যরথে।

সাম্য রাইয়ান এই সময়ের আন্তর্জাতিক বাংলা কবিতার তীব্র কিছু স্বাতন্ত্র্য ইনপুট জারি রাখার সাধক, শিল্পী, একপ্রকার শিল্পতাড়া স্বীকার করেই তাঁর এই যাত্রাপথ, ‘চোখের ভেতরে হামিং বার্ড’ কাব্যগ্রন্থে এই কবি সেই স্বীকারোক্তির আভাস বিস্তার করেছেন ক্রমশঃ—

উন্নত মন্দিরের কাছে প্রার্থনা করেছি— এ রাত
পূর্ণদৈর্ঘ্য হোক...।

এক প্রকার অভিলিপ্সার ধার বয়ে বেড়ায় সাম্য রাইয়ানের কবিতারা, শিল্পে একে কন্টেন্ট বলে, সেই অভিসিপ্সা অনন্তকে গ্রাহ্য করে কখনো-বা চলমান জীবনপ্রবাহকে ক্লিক করে এগিয়ে আসে নিজস্ব স্বর ও শৈলীর নদীপথে, পলিতে, উঁচানো মেঘে কিংবা 
পতিত মাঠে। 

নিদারুণ বায়ু জমে ভরে যায় খাবার বয়াম
...পাতার আড়ালে মূক ও বধির 
একটা চড়ুই, দু’ফোটা
লাফ দিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে জল

অথবা

চোখের ভেতরে 
একটা হামিং বার্ড
নিয়ে বসে আছি

চমকে দিও না তাথৈ
উড়ে যাবে...

এক ধরণের মহাভাবনার দৌরাত্ম্য টের পাওয়া যায় এই কবিতাগুলিতে, আর সেই পথে সাম্য রাইয়ানকে স্বাগত জানাতে অসুবিধাও হয় না পাঠকের, জনমানসে লিপ্ত থাকার এক মোহময় প্রবৃত্তি নিয়ে সাম্য রাইয়ানের কবিতা এমন করে এগিয়ে কোনো অদূর নন্দনলোকে প্রাণিত হবে সেই আশাবাদও জিইয়ে রাখার সুযোগ সেই হেতু থেকে যায়ই।

মাহফুজুর রহমান লিংকন এ সময়ে লিখছেন গীতল বোধের কবিতা, যেনো কোথাও একটা ভ্রমণের লিপি তৈরি হচ্ছে কোথাও একটা অবগাহনের ত্বরা। ‘অমমাংসিত ফুলের দেবতা’ গ্রন্থে আমরা কবির স্বপ্নের দেখা পাব, ভাবনার পাব গুঞ্জরন, সময় কবিতার অঘোষিত অভিভাবক হয়ে কালে কালে যে নন্দনের ধারা বজায় রাখে সেখানে আমরা এই কবির যাত্রাকে নির্বিচারে শুভেচ্ছা জানাতে পারি—

আমার প্রাণের শহরটা
মৃন্ময়ী, শাদা শাদা
বয়সের দাগ মাথায় করে 
বয়ে চলে...

অথবা

অজ্ঞাত কারণে বৃষ্টি এসেছিল
নিকটবর্তী নারীর চোখ দু’টো এতোদূরে ছিল
ভিজে গেছি কিনা দেখতে পাচ্ছি না...

কবিতায় একটা খোলামেলা আতিথেয়তার ভঙিমা এই কবির সহজাত, পাঠককে যেনো ডাকছেন, যেনো শোনাতে চাইছেন ভাবনা, কিছুটা মোলায়েম এই স্বর আমাদের চারপাশের যেনো খুব চেনা উচ্চারণ, কানেক্টেড। কাব্য প্রগতিকল্পের অনুমোদিত 
দৃষ্টিসততার যে দায় বহন করে এই কবি সেদিকেই নিয়ে যেতে চান পাঠককে, এতে নন্দনের আলেখ্য রূপে তাঁর কবিতারা প্রস্তুত সম্মিলনে, যদিও বিবরণধর্মে অভ্যস্ত কবিতার প্রতি তাঁর মনোযোগ স্থিত আমরা ভাবকৌশলের দীক্ষার দিকে বক্তব্য জারি রাখতে আশাবাদী হতে পারি এই কবির কলমে।

স্বৈরমতি পিরিতের শূল’ কাব্যগ্রন্থে সমকালীন আরেক কবি শামীম সাঈদ বেশ নিষ্ঠার সাথে চলৎপ্রতিভাময় পটভূমির বিস্তার ঘটিয়ে পাঠককে আশ্বাস দিতে পারছেন বহুভাবনাজারিত মৌলিকত্বের। এক ধরণের অন্তঃপ্রেরণার আভাস দিচ্ছে এই কবির কবিতারা, কালের সঙ্গতি নিয়ে এক নিজস্ব বয়ান জারী রাখতে তাঁকে ইতস্তত করতে হয় না যা চমকপ্রদ—

একটা দোলক যেন তোমার মুখের মতো...
দুলছে

প্রকৃতি ও সময়ের শোভাযাত্রায় অনাদিসত্যের মত রয়ে যাওয়া অস্তিত্বের কথাও বলে যায় শামীম সাঈদের কবিতা, ব্যঞ্জনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ, আর আঙ্গিকের দিক থেকেও তীব্রভাবে সমকালীন।

নিজের কাছে স্বকৃত চোরাবালি করেছি গোপন

পাঠকের প্রতীক্ষায় নয় যেন তার কবিতা মহাসময়ের সাক্ষাতে বেশি আগ্রহী সে-রকম আভাসের প্রেক্ষিত বিস্তার করে এগিয়ে যায় ক্রমে, সুন্দর, সরল আর সৌহার্দময়।

মানবজীবনকে চিনে নেবার ও চিনিয়ে দেবার আলেখ্যকে আন্তরিক করে লিখছেন কবি সুলতান স্যান্নাল। প্রকৃতি ও সময়ভাবনাকে নিরীক্ষ্য করে এক নিজস্ব স্বরের সন্ধানে প্রাণপণ এই কবির যাত্রা তা তাঁর কবিতাতে স্পষ্ট ও প্রোজ্জ্বল।

সবুজ ধানের ঝিরিঝিরি পাতা, মাঝে মাঝে তুমি মৃদুমন্দ হলুদ কেন; ঝড়ো কেন;...

মহাবিশ্বের ঈশারালোকের দিকে প্রায়শঃ দৃষ্টিপাত এই কবির অন্তরের ভাষাকে পাঠকের জন্য কোথাও কোনো আত্মীয়সম বক্তব্যের রূপ দেয় সাবলীলভাবে। এই সময়ের বাংলা কবিতার তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ চর্চাবাস্তবতায় কবি সুলতান স্যান্নালের ভাবনা ও অনুষঙ্গ আত্মতত্ত্বের কঠিন পথে ধাবিত, আমরা সময়কে ট্রিগার গছিয়ে দিয়ে আশাবাদী হতে পারি সম্ভাবনার শিল্পে।

হোসাইন মাইকেল এই সময়ের কবি, শিল্পী, চিত্রকর, স্বাপ্নিক। এই কবি আত্মবিবরণী চড়িয়ে দেন কবিতার চুলায় চমৎকার সব উপমার আয়োজন করে-

ক্লাসে শারীরিক ঢেউবিদ্যা পড়ানো হতো— ইশারায়
ওতে আমার মনোযোগ ছিল না,
তোমার মনের শরীর আঁকতাম কেবলই।
ঢেউবিদ্যা কিংবা তোমার মতো কেউ-বিদ্যা শেখা হয় নাই। আজকাল
পার্থক্যের প্রেম আর বিষকাঁটা বুকে নিয়ে ফিরে আসি;
বাড়ির দেয়ালে শ্যাওলায় আঁকা নরোম গ্রাফিতি–...’
কবিতা নিমেষমাত্র যে নয় তা এই কবি খুব স্পষ্ট করে বোঝেন এবং সেই স্বকীয়তা নিয়ে তাঁর কবিতা উজ্জ্বল। 

সবচেয়ে বিশ্বাসী ঈশ্বরের নাম ঈশ্বর’ কাব্যগ্রন্থে কবি অনির্বান সূর্যকান্ত তীক্ষ্ণভাবেই জানান দিয়েছেন বাংলা ভাষার সবুজে নিজের উপস্থিতির—

মেরুদন্ড বেয়ে আমাদের বাবারা বড় হয়ে যাচ্ছে

অথবা

দেশপ্রেম থাকলে যেকোন কেয়ামত স্থগিত করা যায়

অনির্বানের কবিতা মেলোডিকালি তীর্যক আর স্পর্ধাশোভিত। পাঠককে আঙুল উঁচিয়ে যেন দেখিয়ে দিচ্ছে জগতের কর্মপরিচয়। সময়ে এই কবির স্থিতি আরো সংহত হবে সেও জোর টোনে বলা যায়।

নাজমুল হোসাইন এই সময়ের প্রাণান্ত আন্তরিক একজন কবি, যাপন আর বাস্তবতার বিজ্ঞান লিখে যাচ্ছেন স্মার্টলি, বিশেষরকম আলাদা স্বর এই কবিকে আমাদের কাছে কবিতার সুরম্য আগামীর বার্তা পৌঁছে দেয়।

পথ জানে, মানুষ ৯০ ডিগ্রি এঙ্গেল ছাড়া দাঁড়াতে পারে না
সুতরাং সব মানুষই জ্যামিতিদাস

অথবা

সমানচিহ্নে শিল্প নেই
শিল্প অসমান শরীর

একান্তই নিজস্ব করে বলবার কায়দাটি এই কবিকে আলাদা করে নিমেষেই, এতে করে শিল্প তাঁর নিজের প্রয়োজনীয় খোরাক ঠিক ঠিক পেয়ে যায়, যার নাম নতুনত্ব তার দিকে এই কবির সতর্ক যাত্রা নিঃসন্দেহে এপ্রেসিয়েবল।

নৃত্যের কর্মশালা শেষে রাত্রি হয়ে ওঠে নূপুরঘুম

আমরা আজ যে-রকম রেষারেষির পৃথিবীতে বেঁচে আছি এর ভিতর দিয়ে অসংখ্য হিজিবিজি ভাবনার ভীড় ঠেলে নান্দনিক সত্য বা নিদেন কল্পনার জোর বজায় রাখার অনুশীলন হিসেবে কবিতা তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে আর সব বিনোদনমাধ্যমের সাথে স্পষ্টতই লড়ছে, এর পরেও কবিতা বহুবিতর্ক সামাল দিয়ে এই জগতের শুদ্ধতম ভ্রমণ হিসেবেই থাকবে ইতিহাসে, আশা করি বরং।


               [সমাপ্ত] 



 এই লেখকের অন্যান্য লেখা: 
• লকডাউন: সাওম শেষের কবিতা | সাজ্জাদ সাঈফ
• পাণ্ডুলিপির কবিতা: ‘করোনা সিরিজ’ শেষ (তিন) পর্ব | সাজ্জাদ সাঈফ
• সাজ্জাদ সাঈফের ‘ভাষার সি-বিচে’ হইতে দশটি কবিতা
• সাজ্জাদ সাঈফের কবিতাভাবনা, সাক্ষাৎকার ও ‘বহুদিন ব্যাকফুটে এসে’ বই থেকে কবিতা


সাজ্জাদ সাঈফ। কবি। জন্ম ১৯৮৪ সালে
যাত্রাবাড়ি, ঢাকা।
এসএসসি ও এইচএসসি ঢাকায় এবং শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়াতে। চিকিৎসা বিদ্যায় গ্রাজুয়েশন, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পাবলিক হেলথ বিভাগে পোস্ট গ্রাজুয়েশন (থিসিস পার্ট অন অ্যাডিকশন সাইকোসিস এন্ড ইটস ডিজিজ প্রোসেস ইভ্যালুয়েশন ইন এসপেক্ট অফ মেন্টাল হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার সেন্টারস ইন বগুড়া সদর এরিয়া)।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: ‘কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা’ (২০১৭), ‘মায়ার মলাট’ (২০১৯), ‘ভাষার সি-বিচে’ (২০১৯, ভারত), ‘বহুদিন ব্যাকফুটে এসে’ (২০২০)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ