TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

লকডাউন: সাওম শেষের কবিতা | সাজ্জাদ সাঈফ


অনিদ্রা

আসে নিদ-জাগা রাত যার
দুই চোখে ওহুদের ওম;
নৈঋতে কুসুম আসে, গল্পে
বানর নিয়ে, দাউদ-কওম!

ফুল হতে একদিন চেয়েছো তুমিও মনে
এই ত্বরা মানবিক-বোধ-সিন;
অথচ কলব ডাকে, ভিতর-বাহির-বাঁকে
তুমি তার শোনো নাই কোনো ঋণ?

এই কথা সেই কথা নিয়ে, বুক ভরা অতল বিনয়ে
রাত ডাকে নিটোল পলক;
তারে তুমি পাগল কইবা যার, ক্ষত সারে সুরেলা প্রণয়ে?
মন সহে আগুন-বলক?

মেঘ তুমি আনন্দ-বিস্মৃতি কি?
তুমি সেই মুগ্ধ বাথান নাকি?

করতলে, কাটাকুটি গেলে থেমে
এই ত্বরা, বাঙালি নদীতে নামে!

জন্মকে ভ্রমণ লাগে যদি, মৃত্যুও ঢোলকলমি;
অনড় তারারা মাঝরাতে দেখে, আকাশ বোষ্টুমী!


হাতে অগ্নি
(কবি জুয়েল মাজহার ভাই-কে)

হাসে নিরোধ, হাতে অগ্নি
ভাসে করোনা, প্রাণ লগ্নি!
ঝরে বাকল, গাছে রাত্রি, নিশ্চিন্তি-
শাখা-মৃগয়া, শাখা-তৈজস, গানে বন্দী!

হাতে অগ্নি মুখে প্রান্ত, খোলে গ্রন্থি
উড়ু মন্দির, মনে কৈলাস, বাজে ঘন্টি!
বোন অগ্নি, পিতা চণ্ডী, গলে সূর্য।
ডালে মূর্ছা, ধীরে পাঁজরা, পাখি ভর্তি।

নাই মন্ডপ, নাই মিম্বর
হাতে কঙ্কর, বুকে পিঞ্জর-
সব হা-ভাতে, দুই শাখাতে
ভরা মজমা; ঘোট পাকাতে
পথে আর্মি, ঘাটে ঘূর্ণি
সব ভোক্তা, পাপে পূণ্যি!


অসুখ হতচ্ছাড়ায়

ধীরে এসে ধীর, সাদা, স্নিগ্ধ বাতাস
হাত উঁচিয়ে ডাকছে কাছে, কেনো?
এই ভূগোলে একলা আমার তরী;
ভাসছে হাওয়া, ভাসে ফুল-উদ্যান‌ও!

একার হাসি একার যত্নবিহীন;
ভাবনা গলিয়ে উড়ে আসছে ফড়িং!
এই নিলীমা আস্তে করে ধরে
লিখবো কবিতা, স্মরণযোগ্য স্বরে!

আমি ছিলাম, আমার ভাষা, হাসি-
রক্তরথে, ভাসিয়েছি, গান-বাঁশি।
তোমরা আমার উচ্চারিত স্বজন-
হাসির ভিতর মাটিস্পর্শ বপন
করবে হেসে, ভাটিয়ালি স্রোতধারায়;
দেখবে উধাও, অসুখ হতচ্ছাড়ায়!


লকডাউনঃ সাওম শেষের কবিতা

আপনারে স্বপ্ন থেকে এক নাগারে ডাকছি
আজও শুনতে পান নাই, বাম দিকে কাত হলো কার
কবর, বৃষ্টিতে?

আপনারে মনে করাতে চাইছি দিক
স্মরণ করাতে ধানে, শিল পড়ছে কতোটা, তাও!

এই যে মাহুত চেয়ে দেখতেছে চারদিক আর তার হাতীও ক্ষুধিত খুব
অথচ প্রণামী নাই, মানুষজন কেউই নাই যে বা যাহারা শুঁড়ের দিকে
মমতা এগিয়ে দেবে!

আপনারে ডাকতেছি, দেয়ালে বাঁধানো ছবি
এই নগরে নামবে খরা, আর দরজায় রক্তশুন্যতাও!

অথচ আপনি লিখে যে আঁকেন, স্বপ্নের সবুজ শাখা;
আর, হল্লায় শিশুরা লাফ দেয়, বালুঢিবি হতে নাগর নদীতে;
বাম দিকে কাত হলো ব্যাধীর ধমক, কবি শুনছেন?
এরই ভিতর জ্বলে, সাওম শেষের চাঁদ, কবি শুনছেন?


লকডাউনঃ মৌসুমী জ্বর

রাত জাগা বৃষ্টি হঠাৎ আজ
ভালো লাগে, মৌসুমী জ্বরটা!

যেনো এক বরফবিক্রেতার দুয়ারে
জল্পনা সে আঁকে, রাত জেগে আঁকে
টব-ছাওয়া, গাছের বুকে ফুল!

এইভাবে বাঁচি
যার দিকে যমুনার তীর
ছুঁড়ে দেয় নৌকাডুবি, এইভাবে থাকি জড়সড়;
একে অন্যের হুবহু ছবি, দুইজনে!

রাত শেষে রাস্তা দু'ভাগ করে, নক্ষত্রের ওম, ভেঙেচুরে
দ্রুতগামী, ছুটছে অ্যাম্বুলেন্স;

পাখি ডাকে, পাখিরা বাসায় ডাকে!


মন খারাপ ধ্বনি

প্রশ্নের দিকে ফিরে, জানালাটি খোলা পেয়ে
ঢুকেছিলো চাঁদনী-পসর ঘরে!

প্রশ্নচিহ্নের ডট থেকে
উঁকি দিচ্ছে তোমার 'মন খারাপ'-ধ্বনি!

এরকম বাঁচা, সমীচিন নাকি বলো?
এতোসব প্রশ্নে দীর্ণ কূটনীতি-রূপ, যাবজ্জীবন সাধনার ভার;
এরকম জড়সড় মুখ, মানায় তোমাকে?

স্বপ্ন আমার এক বন্ধুর নাম
যে  দূরের গ্রাম থেকে, রোজ রোজ আসে আর হাসে
সবুজ-সরল হাসি!

স্বপ্ন আমার এক পুত্রের নাম, যে আমাকে বাঁচতে বলে
ঈশারায়!

ঘোরানো সিঁড়িতে ওঠে গানের গুঞ্জন, শুনে
দ্বিধা ও প্রতিজ্ঞার মতো, আমাদের সকল বাক্য
শুধুমাত্র স্বপ্নকে আশা করে;

বৃষ্টি নামবে নাকি, ঝড় হবে এইদিকে?

জ্যৈষ্ঠ ছড়ালো হেসে, চোখের চারপাশে;
অড়হর ক্ষেত ফুঁড়ে মেঘ-লাগা ধুলি আসে।
চৌচির সব ক'টা জানালা, সজোরে
সব ক'টা ঝাপটাকে, সয়ে নেয় বাতাসের, বিস্মৃতির!


এইভাবে যাব না আমি

নিজের ভিতরে নিজে প্যাঁচ লেগে চুপ হয়ে আছি;
এভাবে চাই না আমি , প্রস্থান বা চলে যাওয়াটিকে!

এভাবে মায়ের দিকে, একবার চেয়ে শিশুর মতন
একবার চেয়ে নিঃসঙ্গ, একবার শুধু হেসে না ফেলে
যেতে চাই না, কোত্থাও তো নয়, তার চেয়ে তুমি
লাল ফিতা নাও, খোঁপা বেধে নাও, ফুলপ্রস্থে;

কেউ কেউ বলে অপাঙক্তেয়
আমার জীবনে তুমি, আমি তা বলিনি মেঘা
তোমাকে!

বাঁধের কিনার ঘেঁষে ঢেউ আছড়ায়, এই দৃশ্যে
কর্কশ বাজ পড়ে কিছু, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর দেশে
বন্যাও এক ভয়াল শ্বাপদ;

আর, ঝড় যেভাবে নামায়, আকাশ টেনে; মহামারী এসে
বিভ্রান্ত, খুব; বিশ্বাস এখানে ধুলি, কি রকম চতুরতা নিয়ে উধাও!

এই ভাসমান গ্রহে ক্ষুধা ও ক্রন্দনরত নিচুমানুষের ছায়াকে
অসুখ-অতলে ফেলে, আমি তো যাবো না চলে
কোথাও, এভাবে নয়, এ’ইভাবে নয়!


ফিলিস্তিন
(সাম্প্রতিক ভয়াবহ ঝড় আম্ফানে মৃত দুই বাংলার সকলকে, প্রার্থনাসহ)

আমাদের কাঁধের ওপর দ্যাখো, আজ কোনো দায় নাই
যেনো সবকিছু মিলিয়ে গিয়েছে হাওয়ায়!

খোলাচুল রমণীর কাছে, প্রজাপতি বসে থাকে এসে
চিরল দুপুরে, ঘাটে;

আমি সেই নির্জনতা-নীল, সেই থই-থই, পানা পুকুরের পানি;
তরঙ্গবেগের মতো, দেখে-দেখে যাই দোলায়িত, অববাহিকার মেঘ;
ক্ষিপ্র ঈগল ওড়া, আমাদের মাথার ওপর যত, ভারহীন কাঁধের ওপর যত!

মাথার ভিতর ঢুকে, কতকিছু ঘটে গেলো ঝড়ে, কতো খুলি শূন্য খাঁচার ঝুল;
করতালি ফেলে গেছে,  কতো শত হাত; আমাদের চামড়ায় জমে
পুরু হয়ে গেছে, অহম-পাথর-গিরি!

কাঁধে ভার নাই যেনো দুঃসময়ের!
নাকি চোখে চোখে, পর্দা-ত্রিপল টানা, আমরা দেখি না শাম;
ধুলি জমে গেছে, হৃদয়ে হৃদয় ভেসে, আগুন কিরাত পড়ে
ফিলিস্তিনে!


পিতা জানতেন গৃহ

পিতার আছিলো কোনো মোক্ষ বিজয় তাড়া, বুকের দেয়ালে, মায়া-পলেস্তারা;
বন্য ফুলেরা সব অদ্ভুত কলিতে লাল, ছড়ানো ছিটানো গমক্ষেত, রোদসহ
ফসল নিড়ানি, মাথালছাওয়া চাষি, হাসিখুশিমাখা নাকি?

পিতা জানতেন
শাশ্বত গীতিকা, মানুষের, চেতন ঘাসের, উপেনের জমি;
পিতা জানতেন গৃহ, ঘিরে যাবে দরদালানের ভিড়ে।

পৃথিবীতে ক্ষুধাই মূলত গান, একক মৌলিক স্বর!
আর বৃষ্টিপাত, সব থেকে বেশি হয় মানুষেরই হৃদয়ে।


যেমন খুঁড়েছো দমে
(কবি ত্রিশাখ জলদাস, প্রিয়ভাজনেষু)

ডাকিনি বিকার তবু নিজেই এসেছে তার, মনের নিয়মে;
ভিতরে বাহির গিয়ে খুঁজছে মানুষ, যেমন খুঁড়েছো দমে
কলিজা আমার তুমি; যেমন জীবন একা, ডুবছে পাথারে;
যে মনে কুমারখালি, তাবিজের মতো চাঁদ, ভাসে রাত্রে!

যেভাবে এলাম হেঁটে, মোরগের উঁচা ডাক, বাজছে মগজে;
সত্যি কি এসেছি চলে? খোলা উঠানের গাঁয়ে? বিরাগ দরাজে?
রক্তে গণিত খুলে, দুনিয়া ছড়ায় ধোঁয়া, আমি বেমানান;
সব জেনে-বুঝে-শুনে, শতরঞ্জিও কি, গাইছে রবীন্দ্রগান?


সোনালি ফোরাত নদী

বহুদূরে চারুকলা ফেলে এসে
আমাদের দেখা হবে আগুন-পাহাড়ে
এর ধারে সোনালি ফোরাত নদী, এর ধারে  ঘাস থরথর!

কে পারে বলো তো, সম্রাটও কি পেরেছে তাহার
মৃত্যু-তারিখ পেছাতে?

বহুদূর গোধূলির গা’য় লাগে, ঘৃতকুমারির টোকা;
গান গায় বনস্পতি, দুপুরের শিলা বৃষ্টি, বিস্মৃত মাঠ;
যেনো সব ভাসমান! খড়ের কুটিরে ভাসে, মেঘ-ঝিরি;
উঠে গেছে ছায়ার ধনুক মেঘে, মনে মনে হাতছানি দেয়;
পলকে পলক ঢাকে!

শুনে তুমি আশ্চর্য?

মিথের নদীতে নেমে, মেঘের ধারালো ঘাই
অবিহিত ছিঁপে, বধ করে, পাহাড়ে চড়াই
লিখে রাখি চরাচর, গ্রহের করাল রাত;
দিগন্তে জাগে ভোর, অচেনা আয়াত!



[নোট: আসন্ন ‘সুরের দ্বিতল কবিতাবইয়ের কিছু কবিতা রইলো কাব্যরসিক প্রিয়ভাজন/শ্রদ্ধাভাজনদের জন্য আর সৌজন্যহীন অপ্রিয়দের জ্ঞাতার্থে জানানো গেলো যে বিরূপ অতীত অভিজ্ঞতাহেতু এখানে প্রকাশিত লেখাগুলিতে ব্যবহৃত সকল নতুন শব্দবন্ধ/বাক্যপ্রক্রিয়া/উপমার স্বত্ব সংরক্ষিত এবং অতীতমতো এদের কোনোপ্রকার অনুমতিহীন ব্যবহারকে চৌর্যবৃত্তি হিসেবে গণ্য করা হবে আরকি। এই পান্ডুলিপিটি চলমান আকারে আছে, এর আগামী পরিমার্জন/সংযোজন/বিয়োজন বিষয়ে নিশ্চিত করে এখনই বলা যাচ্ছে না আসলে।  
সুরের দ্বিতল’-এ জাতীয়তাবাদ-অস্তিত্ববাদ-মানবিকতা-ধর্ম-অধর্ম-রাজনীতি নির্বিশেষে আবহমান ইতিহাসের টর্চ তাক করে কবিতায় আনন্দ-বিষাদ-জ্ঞান-অজ্ঞানতা-মৃত্যু-জন্ম-কৃষ্টির সূক্ষ্মতম অনুভবের মৌলিক মশলা(কন্টেন্ট)গুলিকে ব্লেন্ড করার চেষ্টা চলমান, এদের পক্ষে এর বেশি কিছু আর বলার উপায়ান্তর এই অধমের সামান্য মস্তিষ্ক-গুণের যোগ্যতায় নেই, বিপক্ষে বলার অনেক কিছুই আছে যেমন শেলী বা শেকসপিয়ারের পরের প্রতীকিবাদ হতে এরা পূর্ণাঙ্গ সরে আসে নাই, শৈলীতে নতুনত্ব বলতে পূর্বের বইগুলির টোন হতেও খুব বেশি ভিন্ন যে হতে পারছে তাও নয়। বাকিটা আপনার পাঠের পরই না হয় আলোচ্য হবার অপেক্ষায় থাকলো। ভালোবাসা ও করোনামারীর দিনে সুস্থতার প্রার্থনা জানবেন। জয়তু বাংলা কবিতা।]



এই লেখকের অন্যান্য লেখা:
• পাণ্ডুলিপির কবিতা: ‘করোনা সিরিজ’ পর্ব এক | সাজ্জাদ সাঈফ
• পাণ্ডুলিপির কবিতা: ‘করোনা সিরিজ’ পর্ব দুই | সাজ্জাদ সাঈফ
• পাণ্ডুলিপির কবিতা: ‘করোনা সিরিজ’ শেষ পর্ব | সাজ্জাদ সাঈফ
• সাজ্জাদ সাঈফের ‘ভাষার সি-বিচে’ হইতে দশটি কবিতা
• সাজ্জাদ সাঈফের কবিতাভাবনা, সাক্ষাৎকার ও ‘বহুদিন ব্যাকফুটে এসে’ বই থেকে কবিতা



সাজ্জাদ সাঈফ। কবি। জন্ম ১৯৮৪ সালে
যাত্রাবাড়ি, ঢাকা।
এসএসসি ও এইচএসসি ঢাকায় এবং শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়াতে। চিকিৎসা বিদ্যায় গ্রাজুয়েশন, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পাবলিক হেলথ বিভাগে পোস্ট গ্রাজুয়েশন (থিসিস পার্ট অন অ্যাডিকশন সাইকোসিস এন্ড ইটস ডিজিজ প্রোসেস ইভ্যালুয়েশন ইন এসপেক্ট অফ মেন্টাল হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার সেন্টারস ইন বগুড়া সদর এরিয়া)।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: ‘কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা’ (২০১৭), ‘মায়ার মলাট’ (২০১৯), ‘ভাষার সি-বিচে’ (২০১৯, ভারত), ‘বহুদিন ব্যাকফুটে এসে’ (২০২০)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. ব্রাত্য একজন২৮ মে, ২০২০ এ ৮:৫৫ AM

    বরাবরের মতো আকর্ষণীয়, উপভোগ্য৷ সুস্বাদু কয়েকটি লাইন
    "নাই মন্ডপ, নাই মিম্বর
    হাতে কঙ্কর, বুকে পিঞ্জর-
    সব হা-ভাতে, দুই শাখাতে
    ভরা মজমা; ঘোট পাকাতে
    পথে আর্মি, ঘাটে ঘূর্ণি
    সব ভোক্তা, পাপে পূণ্যি!"

    উত্তরমুছুন

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।