TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

ছোটগল্প: ‘লোকটা মানুষ পড়তে জানত’ | মাসুম বিল্লাহ


মেঘ সরে গেল। জোছনা নামল। নির্জন সড়কের পাশে ছোট্ট চায়ের দোকান। বেঞ্চিতে জন তিনেক মানুষ, হাতে চায়ের কাপ, এদের দুজনের হাতে সিগারেট—বাতাসে ধোঁয়া কুন্ডুলি পাকিয়ে জোছনায় মিশে যাচ্ছে। একটু দূরে বয়স্ক মেহগনি গাছের গোড়ায় দুটি পা মেলে সেই বিকেল থেকে লোকটি বসে আছে। সমস্ত শরীর ধুলো-বালিতে মাখামাখি। মাথাভর্তি ঘন কালো দীর্ঘ চুল, দাড়ি-গোঁফে মুখটা ভালো চেনার উপায় নেই। চোখের দৃষ্টি ধারালো এবং জ্বলজ্বলে। পরনে একটি পুরনো লুঙ্গির টুকরো জড়ানো, গায়ে চটের লম্বা একটা অংশ বুক-পিঠ মাত্র ঢাকা। চা-অলা ছেলেটি এক কাপ চা আর এক একটি টোস্ট নিয়ে এল—‘লন, চা খান—টোস্ট দিয়া ভিজাইয়া ভিজাইয়া খান—ভালো লাগবো’।
সাগ্রহে চা খেতে লাগল লোকটি। যেন এই প্রথম তিনি চা খাচ্ছেন। কাপের তলানিটুকু জিহ্বার উপর অশ্রুর মতো পড়ল। 

চাঅলা ভাবে—মোর চায়ের দোকানে ভাত-তরকারির ব্যবস্থা থাকলে খাইতে দিতে পারতাম! 

লোকটি হাসে। চাঅলা সে হাসি দেখতে পেল না। সে দেখল—একটি সবুজ পাতার ওপর টোস্টটি রাখা এবং অসংখ্য লাল পিঁপড়ে, কালো পিঁপড়ে টোস্টটি ঘিরে রেখেছে। 

হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। বৃষ্টি আসছে! তিনি বৃষ্টি পছন্দ করেন—বৃষ্টিতে চোখের জল ধরা পড়ে না! 

২.
তিনি আবার হাঁটেন। গভীর বন। মেহগনি আর তমালের সারি। ঘুমন্ত পাখিরা ডেকে উঠল। পাখিরা তাকে দেখল। একটা হলদে পাখির বাচ্চা বাসা ছেড়ে নেমে এল। লোকটির মাথার উপর উড়ে চলল। তিনি হাত নাড়লেন। ফিরে গেল হলদে পাখি। মথিত লেবুপাতার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। আবার জোছনা ফুটল। হাঁটতে গিয়ে দেখলেন, পা দুটো ভীষণ আড়ষ্ট হয়ে আসছে। থামলেন। একটি কাঠবাদামের গাছের নিচে শুয়ে পড়েন। হাত-পা ছড়িয়ে দিলেন চার দিকে। হিম হিম চারপাশে। আবহাওয়া পাল্টে নিতে পারতেন। নিলেন না। ঘুমিয়ে গেলেন। স্বপ্ন দেখলেন—চাঅলার একটা ভাতের হোটেল হয়েছে, যাদের পকেটে পয়সা নেই তাদের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে—সকালে গরম ভাত, আলুভর্তা, মরিচভর্তা আর পানিডাল। দুপুরে মাছ আর শাক। রাতে আধা প্লেট ভাত আর সবজিমিক্সড। 

৩.
আলো ফুটল। ফুল হাসল। পাখি ডাকল, উড়ল। তিনি দেখলেন—কাঠবাদামের সবুজ পাতার চাদরে তিনি ঢেকে আছেন! তিনি হাসেন। সবুজ পাতারাও হাসে। কী সুন্দর সবুজ পাতা! সকালের আলো চিকচিক করে। সবুজ পাতার উপর গড়াগড়ি খায়। তিনি নরম রোদ করতলে নেন—একটা প্রজাপতি উড়ে এসে বসে, তিনি বলেন, তুমি কত সুন্দর! 
প্রজাপতি বলে, তুমিও! সবার চেয়ে সুন্দর তুমি। 
প্রজাপতি রোদের দিকে উড়ে চলে যায়। একটা ভাতশালিক এসে মাথার উপর বসল। তার কান খুঁটে দিল, দু গালে ঠোঁট বুলিয়ে তারপর চলে গেল। কচু পাতার ফাঁকগলে একটা সবুজ সাপ মাথা উঁচু করে আবার লুকিয়ে পড়ে। তিনি দেখলেন। হাসলেন। 

৪.
গভীর বন পেরিয়ে এলেন তিনি। বড় রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেন। এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা। ছোট-বড় গর্ত, জলকাদায় ভর্তি। বাসভর্তি গাদা গাদা মানুষ—বাস গর্তে পড়ে কাত হচ্ছে, আবার সোজা হচ্ছে; তিনি ভয় পান, অথচ তার ভয় পাওয়ার কথা নয়! 
তিনি ধীর পায়ে হাঁটেন। পিচগলা ক্ষত-বিক্ষত রাস্তার পাথরের টুকরো তার মলিন পায়ের তলায় পড়তে উহ্ করে ওঠেন। অথচ তার উহ্ করেও ওঠার কথা নয়। তিনি আনমনা হন। চমকে ওঠেন—দু’হাতে কান চেপে ধরেন, পাশ থেকে একটা মালবাহী ট্রাক বিকট হর্ণ চেপে সাই করে ছুটে গেল। তার বুকের ধকধকানি বেড়ে যায়। মনে হয় মাথার ভেতর শর্ট সার্কিট হচ্ছে। উড়ে এল একটা কাক, কা-কা করে বার দুয়েক চক্কর মেরে ঘাড়ের ওপর এসে বসল। তিনি স্নেহভরা হাতে আদর করলেন। কাকটি বলল, আমি কালো কেন? 
তিনি স্ফীত হাসলেন—কালোই আলো।...কাক হলো কালো তবু কাক ভালো। 
কাকটি খুশিমনে উড়ে গেল। 
তার মনের ভেতর একটা সুর গুনগুন করে ওঠে, তিনি সুরটা তোলার চেষ্টা করেন। পুরোটা আসছে না...

সামনে বিপদ। তার বুকের ভেতর আবার মোঁচড় দিয়ে উঠল। তিনি চোখ বন্ধ করে ফেলেন। চারপাশে চিৎকার, চেঁচামেচি, কান্না—বাঁচাও, বাঁচাও! 
বাস ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ। এটাকে বলা হয়—সড়ক দুর্ঘটনা! 
তার চোখ ছলছল করছে । রক্ত দেখলে পুরো শরীর জমে পানি থেকে বরফ হয়ে যায়। তিনি আবার চোখ বন্ধ করলেন—দেখলেন, একটা লোক সড়ক দুর্ঘটনার কথা শুনে দাঁত বের করে হাসছে! 

৫.
রোদ উঠেছে। চাইলে মাথার উপর ছায়া দিতে পারতেন তিনি, কিন্তু তা করলেন না। হেঁটে চললেন। রাস্তার দুই পাশে ময়লাটে পরিবেশ, পঁচা-নোংরার স্তুপ, ছোট ছোট বাচ্চার চিৎকার-কান্না-হাসি; তুমুল ঝগড়ারত মহিলাদের জটলা—সব নিশ্চুপ হয়ে গেল তাকে দেখে, সবাই বিস্ময়ভরা চোখে তাকে দেখছে, কেউ খোঁচাতে এল না, বরং সবাই তাকে পথ করে দিল। তার ইচ্ছে এখানে একটু থামে, একটু জিরোয়। ঘুপচি ঘরে গিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে—ঘরের আসবাবপত্র, বিছানা-বালিশ আর তাদের লুকিয়ে রাখা সুখ! 
দুপুরের মেহমান হতে ইচ্ছে করছে তার। 
স্ত্রী লোকটি মাটির চুলায় কালো মতোন একটা ছোট্ট হাড়িতে ভাত বসিয়েছে, ধোঁয়ায় স্ত্রী লোকটা চোখ জ্বালা করে, জল বেয়ে নামে... ছোট ছোট কয়েকটি টেংরা মাছ আর ফালি ফালি করে কাটা দুটি আলুর টুকরো যেন তার দিকে চেয়ে আছে, বলছে —এবেলা দুটো ভাত খেয়ে যাও, অতিথি তো সবার ঘরে আসে না; অতিথি সবার ভাগ্যেও নেই। 

তিনি মাটিতে চোখ রেখে হাসেন। তারপর লম্বা পা ফেলে বস্তিটা পেরিয়ে যান। আরেকটু এগিয়ে যেতে তার চোখ অবাক হয়। পরিপাটি পরিবেশ। ধবধবে সাদা সাদা উঁচু উঁচু ঘর-বাড়ি, প্রবেশ পথ একটাই, লোহার উঁচু গেট, দারোয়ান... সব সিস্টেম মতো। তিনি গেটের মুখে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে পড়েন। লাঠি নিয়ে তেড়ে এল দারোয়ান, পশ্চাৎদেশে দু’ঘা বসিয়ে দিতে গিয়ে থেমে গেল, তারপর সটান স্যালুট ঠুকে দিল। বলল, স্যার, যান, আপনি ভিতরে যান—'আপনে যাইবেন না আর কেডায় যাইবো'! 
তিনি মাথা নাড়লেন। সামান্য হাসলেন। ঘুরে উল্টো পথ ধরলেন। রোদের তেজ ধরে এল। হেঁটে রেল স্টেশনে এলেন। ভিড় পাতলা। স্বস্তির গাঢ়শ্বাস নেন। ফাঁকা বেঞ্চিতে গা এগিয়ে দেন। তারপর তলিয়ে গেলেন গভীর ঘুমে।

৬.
সন্ধ্যা হয়ে এল। বৃষ্টি আসছে। ঘুম ভাঙল তার। মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টি দেখছেন। হেঁটে গেলেন বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। বৃষ্টির ফোটায় শুষ্ক গলা ভিজল, পিপাসাও দূর হলো; শরীর ভিজে জবুথবু। গায়ের ধুলো-বালি সাফ হলো। তিনি খুশি হলেন না—‘ধুলো-মাটি ছেড়ে মানুষ কোথায় যাবে’! শহর তাকে আর টানল না। ফিরে চলেছেন গহীন বনের পথে। 

লম্বা পথ হেঁটে ফিরলেন। রাতের নির্জনতা ভাঙল। পাখিরা ডেকে উঠল। হিজল গাছের নিচে ঠেস দিয়ে তিনি বসলেন। এসময় নারীর চিৎকার ভেসে এল... তিনি উঠে এগিয়ে গেলেন...

চারজন লোক একটি মেয়ে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে বিকৃত হাসি হেসে চলেছে... মেয়েটি ওদের হাতের স্পর্শ থেকে নিজের শরীর বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে...
মেয়েটি কাতরকণ্ঠে বলে, আমাকে ছেড়ে দাও, তোমাদের পায়ে পড়ি...
চারকণ্ঠ একসঙ্গে বলল—আগে আমাদের কাজ শেষ হোক তারপর তোমার দু চোখ যেদিকে খুশি সেদিকে চলে যেও... হো হো হা হা...

শেষতক তিনজন মেয়েটিকে মাটিতে ফেলে দিয়ে চেপে ধরতেই বাকি একজন মেয়েটির শরীরের ওপর চেপে বসল। মেয়েটি হাত-পা ছুঁড়ল কিন্তু পেরে উঠল না...

তিনি গিয়ে দাঁড়ালেন ওদের সামনে দাঁড়ালে—‘মেয়েটিকে ছেড়ে দাও’! 

অন্ধকার ভেদ করে তার কথাটি প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার ফিরে এল। ওরা ভড়কে গেল এবং সামলেও নিল—দুইজন মেয়েটিকে ছেড়ে তাকে ঝাঁপটে ধরে পেটে-মুখে লাথি-ঘুষি বসিয়ে কাবু করতে চাইল। তিনি বললেন—‘কাপুরুষের দল, মেয়েটিকে ছেড়ে দাও...আমি এই পৃথিবীর অধিপতি— জানিস, তোদের আমি কঠিন শাস্তি দিতে পারি...’

এ কথায় ওরা হো হো করে হাসতে লাগল—‘ছাগলে কি না খায় আর পাগলে কী না বলে’!

আরেকজন পেছন থেকে ফোঁড়ন কাটে—‘পাগলের সুখ মনে মনে...হা হা...পাগল রাজা...হা হা...’

দ্বিতীয়জন বিরক্তিপ্রকাশ করে—‘শালারা পাগলের পেছনে সময় নষ্ট করছিস কেন? পাগলটাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখ...তাড়াতাড়ি এসে মাইয়াডারে ধর—শেষে আমার সুযোগটা আবার মিস হয়ে যায়...’

তাকে বেঁধে রেখে চারজন মেয়েটি নিয়ে মেতে উঠলো।

তিনি চোখ বন্ধ করে ফেলেন।

কিছুক্ষণ পর ওরা উদ্দেশ্য হাসিল করে উঠে দাঁড়াল।
একজন বলল—‘মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখা ঠিক হবে না’! 

তিনি চিৎকার করে উঠলেন—‘মেয়েটাকে তোমরা মেরো না, ওর প্রাণটা ভিক্ষে দাও’!

তার কথা শুনল না ওরা। 

কাজ শেষ করে ওরা ফিরে চলল। কয়েক মুহূর্ত পর আবার ফিরেও এল। দলনেতা বলল—‘এই পাগলটাকেও বাঁচিয়ে রাখা আমাদের জন্য নিরাপদ নয়’! 

তিনি এবার বিপন্ন বোধ করছেন। তার চাঅলা ছেলেটির কথা মনে এল—‘শহরে ছেলেটির ভাতের হোটেলে প্রতিদিন উপচে ভিড়, ছেলেটি প্রতিদিন একজনের অপেক্ষায় থাকে—তাকে পেটপুরে ভাত খাওয়াবে বলে... আহারে ছেলেটির সে অপেক্ষা কোনোদিন আর শেষ হবে না’!

তিনি চোখ বন্ধ করলেন। মনেমনে বললেন—‘আমি মানুষকে পড়তে পারি, কিন্তু অমানুষকে পড়তে পারি না’! 

পূর্ণিমার আলোয় ভেসে যাচ্ছে বন । তিনি দেখলেন দলনেতার হাতে একটি ছুরি চকচক করে উঠল!



মাসুম বিল্লাহকথাশিল্পী। জন্মস্থান: খুলনা। প্রকাশিত গ্রন্থ: ৬টি: ‘মেঘের শাড়ি পরা মেয়ে’ (ফিচারধর্মী,  ২০১৩), ‘ভূতু’ (কিশোর উপন্যাস, ২০১৫), ‘অবুঝ সেফটিপিন’ (উপন্যাস, ২০১৬), ‘প্রেম অথবা ঘুমের গল্প’ (গল্পগ্রন্থ, ২০১৭), ‘পিঙ্গল প্রেম’ (গল্পগ্রন্থ, ২০২০) ‘ডানা ভাঙা সাইকেল’ (গল্পগ্রন্থ, ২০২০)। প্রকাশিতব্য গল্পগ্রন্থ: ‘একটা দুপুর মরে গেল’। সম্পাদিত লিটলম্যাগ: ‘’।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।