TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

পুরুষপাঠ | নাহিদা নাহিদ

প্রচ্ছদ: নাজমুল হোসাইন

ইস্কাপনের টেক্কায় তোয়াক্কা না করেই গার্গী হরতনের রাজাকে ছেড়ে দেয়। রাজার মুখ গম্ভীর! বিশাখা সেদিকে তাকায় না, টপ টপ করে তুলে নেয় সকলের হরতন, রইতন আর চিড়িতনের দান। পরপর কয়েকটা গোলাম পেয়ে বিব্রত কঙ্কা। শবনমের হাতেও নেই তেমন কিছু। মোটে একটা পাদ্রীর রাজা! হরতনের রানীতে ভরসা নেই, হেলায় ছুটে গেল চিড়িতনের দান। ঘড়িতে সমান সমান বারোটা। কঙ্কা, শবনম, বিশাখা ও গার্গী সরঞ্জাম গুটিয়ে নেয়। খেলা শেষ। দেবদূতের আসার সময় হলো। বিশাখা এগিয়ে ছিল গতকাল, আজও তাই। প্রার্থনাগৃহ প্রস্তুত, এটাকে ল্যাবও বলা যায় অথবা স্টাডিরুম! শ’য়ে শ’য়ে পাতা ভরা কেইসহিস্ট্রি। বাইরে কোথাও একটানা ঢং ঢং করে বাজছে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ। মুহূর্তেই নিভে গেল ঘরের আলো। শবনম মোম জ্বালায়। ঠোঁটের নির্মম হাসিতে ধীরে  ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে সম্ভাব্য বীভৎসতা দেখার পুলক!

বিশাখা তাদের সামনে আজকের আলোচ্যপাঠের খাতা ওল্টায়। প্রথম পাতায় কঙ্কার প্রাসঙ্গিক পুরুষের বায়োগ্রাফি। সাদাকালো ও রঙিন থ্রিআর দু’টো ছবি পাশাপাশি। লোকটার মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, পাশেই নানাবিধ শিশিতে কঙ্কার পুরুষের জমিয়ে রাখা স্পার্ম, রক্তের নমুনা, এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক পদার্থের রিপোর্ট।

: কঙ্কা, আপনার বিয়াল্লিশ বছর বয়সি সুপুরুষ সহকর্মী অতিসম্প্রতি চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন কি?

: জি, যৌন হয়রানির দায়ে অভিযুক্ত।

: খুব সম্ভবত তিনি খুন হয়েছিলেন।

: আপনি কিন্তু নিশ্চিত নন তিনি আত্মহত্যা করেছেন কিনা।

: বোকার মতো কথা বলবেন না। এভাবে কেউ আত্মহত্যা করে না। তাছাড়া তার অগ্রমস্তিষ্কে হাইপোথ্যালামাসের সক্রিয়তায় ভালবাসার অনুভূতি তীব্র। এটাকে কামতৃষ্ণাও বলা যায়। কোনো মাত্রাতিরিক্ত কামুক পুরুষ সহজে আত্মহত্যা করে না। আমরা আমাদের পোস্ট-ডক্টোরাল কোর্সের তৃতীয় চ্যাপ্টারে এ সম্পর্কে বিশদ পড়েছিলাম। মনে করে দেখুন।

: মনে আছে, এমনকি আমার নিয়োগপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যও।

: আপনিই বলুন, আপনি কি সফল?

: আমিতো চেষ্টা করেছিলাম। আমার গণ্ডির আওতাভূক্ত সকল পুরুষকে আমি কুৎসিত পতনে সাধ্যমতো উৎসাহী করেছি।

: ‘আন-নিসা হিবালাতুশ শাইতান—নারী শয়তানের জাল’, জেনে রাখুন আপনিই সেই। তো এক পুরুষের নরকতুল্য পৃথিবী তৈরিতেই যেখানে আপনি ব্যর্থ সেখানে গণ্ডিবদ্ধ সকল পুরুষের প্রসঙ্গ অবান্তর।

: এ অভিযোগ মিথ্যে। মৃত্যুর আগের কয়েকটা দিন হিসেবে আনুন। আর তাছাড়া ওর শরীরের ইনার পার্টসে কিছু সমস্যা ছিল। মধ্যমস্তিষ্কের কর্পোরা কোয়াড্রিজেমিনা সকল সময়ে সকল নারীর প্রতি সমান কৌতূহলী। অথচ সকল নারীতো একা আমি নই। কেউ প্রেয়সী, কেউ জননী, কেউ ঈশ্বরী। সকল দায় আমার একার?

: জি, আপনার। তাকে খুন করে দায় সেরেছেন। অথচ আমরা দেখতে চেয়েছি পুরুষের করুণ আত্মহত্যা।

: প্রতিশোধ! বিশাখা, আমি ভুলে যাইনি আমাদের পূর্বনারীদের করুণ মৃত্যু, পুরুষ কর্তৃক পীড়ন! ধর্ষণ ও লাঞ্ছিত হবার ইতিহাস।

: তবে?

: আমি আমার নারীশরীর পুরোটা ব্যবহার করেছি কিন্তু ওর লিঙ্গপ্রধান চিন্তার ক্রিয়াশীল মনোভাবে আমার কর্তৃত্ব ওই শরীর পর্যন্তই।

: তো তার ফায়দা তুলতে পারেননি?

: নিয়েছি, যথার্থই। কিছু পুরুষ ঈর্ষাকাতর হলেন। দোষটা আমার ঘাড়েই এল।

: তারপর?

: তার চাকরিটা চলে গেলো। ও হয়ে উঠল উগ্র। আমায় হত্যা করতে চাইল।

: করত হত্যা! তাকে নিষ্ঠুর লম্পট প্রমাণের আরো একটা সুযোগ পাওয়া যেত।

: হলো কই! তার চারিত্রিক পতনের প্ররোচক হিসেবে উলটো আমিই আরো বিপন্ন হয়ে উঠলাম।

: আবার সে পুরুষের কাছেই পরাজয়!

: আমায় ক্ষমা করুন, আমি পারিনি।

বিশাখার হাই ওঠে। কঙ্কার হিস্ট্রি খুব কমন! নতুন কিছুই নেই, একটা আত্মহত্যা বা একটা সাদামাটা খুন, সে একই সোশ্যাল পিউরিটান সিনড্রোম। বিশাখা আড়মোড়া ভেঙে হাই তোলে। ঘটনা যাই হোক, মৌলিক কিছু না। সব কেমন পানসে লাগে। এখানে কঙ্কার কত কী করার ছিল। পুুরুষের লিঙ্গকে দায়ী করে বড় বড় মিছিল, মিটিং, পোস্টার আরও কত কী! প্রমাণসহ মিডিয়া কনফারেন্স, এক অভিযোগে হাজার পুরুষকে ঘায়েল করার মোক্ষম সুযোগ এভাবে কেউ হেলায় ছাড়ে? শাস্তি হওয়া দরকার এ মেয়ের, কঠিন শাস্তি! নিজে বাঁচতে কেমন হুট করে লোকটাকে মেরে ফেলল। জীবনের এত দাম। এত সহজ খুনে প্রতিহিংসা মেটে!

বিশাখা এবার গার্গীর দিকে মনোযোগ দেয়।

: আচ্ছা গার্গী, গতকাল আপনার পুরুষটির ফলাফল কি আমরা দিয়েছিলাম?

: নাহ, তখনো আমাদের পাঠ শেষ হয়নি, এমনকি নথিভুক্ত করার অংশটাও বাকি ছিল।

: যাক আপনার পুরুষের ঘটনাটা ইন্টারেস্টিং। তাকে তো নিতান্ত শিশুই বলতে হয়।

: জি, তবে নারীশরীর অভিজ্ঞতায় তিনি পরিপক্ক। পার্লারে তিন রমণী কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছেন আমার পুুরুষ!

: ওমা তাই নাকি! এ তো খুশির খবর। তা সে পুরুষ হলো কবে?

: এইতো দুই বছর সতের দিন, যদিও সকলে তাকে কিশোর বলেই জানে।

: আচ্ছা, আপনি তাকে কতদিন ধরে চিনতেন?

: বেশিদিন না, ওর নিউরোলজিক্যাল কাউন্সিলর ছিলাম।

: যেমন?

: এই যেমন ছেলেটার ফ্যান্টাসিগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতাম, আবেগ বুঝতাম, তার অনুভূতির সমমানের আচরণ করতাম, এইসব।

: কী চাইতো সে?

: তার একজন প্রেমিকা থাকুক, যার জন্য সে হৃদয় উজাড় করে ভালবাসা জমা রাখবে।

: এর জন্য কী করতো?

: বিচিত্রসব কর্মকাণ্ড।

: তারপর?

: মনোযোগ আকর্ষণ করতে না পারলে হাত কাটতো, পা কাটতো। কখনো পায়ের রগ। আমার বেশ লাগত।

: গার্গী, আমরা কি আপনাকে নিষ্ঠুর, আনন্দলোভী আর প্ররোচক বলতে পারি?

: তা পারেন, আত্মপীড়ন না থাকলে সকল নারীই তাই। হয়তো আমার চেষ্টাটা একটু বেশিই ছিল।

: সাদাকালো আর রঙিন দু’টো ছবিতেই ছেলেটার মুখ মায়াবী।

: হু, চমৎকার কবিতা লিখত!

: শবনম, আপনি বায়োলজিক্যাল রিপোর্টে ওর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাগুলো ব্যাখ্যা করুন।

: মাননীয়া, ছেলেটার সেরেব্রাম টেম্পোরাল লোবের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এটা নষ্ট হলে মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

: ডিটেইলস প্লিজ।

: ট্রম্যাটিক ব্রেইন ইনজুরি। ছেলেটা তার তিনগুণ বয়সি গার্গী ম্যাডামকে শারীরিকভাবে কামনা করতে গিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের ভারসাম্য হারিয়েছে।

: এইতো, আমাদের টিনএজ মেয়েগুলো যেমন কিছু না বুঝেই চল্লিশোর্ধ্ব-পঞ্চাশোর্ধ্ব বুড়ো হাবড়াগুলোকে জামার চেইন খুলে দেয় অথবা ফাঁদে পড়ে মলেস্টেড হয়ে চুপসে থাকে তার বিপরীতে গার্গীর প্রচেষ্টা সফল!

: আপসোস, প্রথম প্রথম ছেলেটা ভেবেছিল সে সৌভাগ্যবান, স্বল্পসময়ে বহুনারী আগমনকে সে আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতাই ভেবেছিল!

: যা বলেছেন! একেবারেই পুরুষতান্ত্রিক ভোগবাদী চিন্তা!

: আমি সফল ছিলাম তার এনাটমিক্যাল টারমিনলজি বুঝতে। হাজার কিশোরীর বিপরীতে এক কিশোরের পতন!

: এরপর?

: জোরপূর্বক শুক্রানু নির্গমনে তার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

: দারুণ!

প্রতিহিংসায় বিশাখার চোখ চকচক করে।

: শবনম, ছেলেটার গলার কাটা দাগটা কতটা আকর্ষিক, দেখেছেন?

: জি, গতরাতে ছেলেটা রেললাইনে মাথা দিয়েছে! এজ অ্যা ইফেক্ট অফ আলট্রা সেক্সুয়াল এক্টিভিটিজ হি হ্যাজ ফলেন ইন ডিপ্রেশন।

গার্গীর সাফল্যে বিশাখা উশখুশ করে। তাসের দানে সে এগিয়ে থাকলেই কি সব হয় ! গার্গী স্মার্ট। 

বিশাখা আনমনা হয়। তার কোনো পুুরুষের ছবি নেই কোথাও। থ্রিআর  ফোরআর, ফাইভআর, রঙিন বা সাদাকালো কিছুই নেই।

আমার পুুরুষ! বিশাখা হাসে, তার আর তার পুরুষদের গৃহাবাসের চুক্তিতে স্বামী বা স্ত্রী শব্দটি প্রযোজ্য নয়। নারী আর পুরুষমাত্র!

চাইলেই তাকে ক্লাসলেস বলা যায়, শ্রেণি নিয়ে তার ভাবনাটাও এমনই। আইডিয়ার উপর ভর করে আইডল হওয়ার সুখে কাতর হতে চায়নি বলেই সে ব্রাত্য। শাহবাগ হেঁটে দু’কলম পিষে শিল্পের ষোলকলা দেখে শিল্প করার শখ তার নেই, যা করেছে জীবন থেকেই। প্যাস্টেল আঁকা ছবিতে বিশাখা বার বার এঁকেছে তার চেনা পুুরুষ। আদিম পুরুষ। লালপুুরুষ, নীলপুরুষ, সবুজপুরুষ। নতুন নতুন পুরুষকে চেনার আকাঙ্ক্ষা তাকে পেয়ে বসেছিল। প্রথম যেবার গ্যালারির প্রদর্শনীর কক্ষে উন্মুক্ত করলো সেসব পুরুষের বক্ষ, জঙ্ঘা, হাঁটু তখনই পেটোয়া সমাজের বাঘা কবি-সাহিত্যিক-আমলা আর রাজনীতিবিদ জেগে উঠলো প্রতিবাদে। এক উঠতি পাতি কবি নাকি গলায় দড়ি দিয়েছিলেন তার শিল্পের ধাক্কায়। এ নাকি কোনো ভদ্রোচিত আচরণ নয়। আরেক বুড়ো প্রফেসরের তো জীবন যায় যায় দশা। ওই বুড়োটা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের কারণে পিএমই এন্ড ইরেকটাইল ডিসফাংশনে ভুগেছেন দীর্ঘদিন। শেষকালে তার অল্প বয়সে ঘটে যাওয়া এন্ড্রোপোজে ইফেক্টেড অক্ষম পুরুষাঙ্গের দায় কিনা পড়লো বিশাখার পেইন্টেড ছবির উপর। রাতের অন্ধকারের   সঙ্গমদৃশ্য, সফলতা-ব্যর্থতার মধুরক্রীড়া দিনের আলোয় কেমন করে নৃশংস হয়ে যায় বিশাখার বুঝে আসেনি। তবে আশ্চর্য হয়ে বিশাখা দেখেছে এ ঘটনায় তাকে বেশ্যাকেন্দ্রিক অতলান্তিক ঘৃণার অন্ধকারে ছুঁড়ে দিয়ে সবচেয়ে বেশি মানসিক তৃপ্তিতে ভূগেছে নারীরা; পুরুষ নয়, মিডিকিউর ফাকিং মোরাল আইডলজিক্যাল সোশ্যাল  ইফেক্ট! অদৃশ্য কোনো ঘৃণায় বিশাখা এক দলা থুতু ছুঁড়ে মারে কোথাও। ফাকিং সোসাইটি ফাক। বিশাখা আবারও হাই তোলে।

: শবনম, সুইট গার্ল কাম অন। এবার আপনার গল্পটা শুনতে চাই। রাত ভোর হয়ে এলো। আমরা আশা করতেই পারি আপনার পুুরুষপাঠের অভিজ্ঞতা নিশ্চই চমকপ্রদ।

: আপনি ভুল করছেন বিশাখা, আমার গল্পটা একদম সাদামাটা। পাতলা সুখ অসুখের গল্প। আপনি ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বা নিদেনপক্ষে কোন মফস্বল শহরের যে কোন দু’কামরার ঘরে উঁকি দিলেই এরকম দুয়েকটা গল্প পেয়ে যাবেন নিশ্চিত।

: তবু আপনিই ইম্পর্ট্যান্ট। কেননা এ ল্যাবঘরে শুধু আপনাকেই আনা হয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বা মফস্বলের অন্যকোন নারীকে নয়। সময় শেষ হয়ে আসছে, আপনি শুরু করুন।

: বিশাখা, আপনি যদি আমার শুরুর জীবনটা খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন পুুরুষ সংশ্লিষ্ট জীবনে খুব একটা অসুখী ছিলাম না আমি। চিকিৎসাবিদ্যা পড়া শেষ করার আগেই সংসারি হই। আমার গর্ভে পরপর তিনটে বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পর টের পাই আমার জরায়ু ঠিক শক্ত বাচ্চা উৎপাদনের উপযোগী নয়, অথবা আমার পুরুষের বীর্য আমার জরায়ুর অনুপুযুক্ত। আমার অধিক উর্বরশীল কিন্তু কমজোরি শরীর নিয়ে আমি বিব্রত থাকতাম , কিন্তু অসুখী ছিলাম বলা যায় না। নিজের ভ্রুণহীন রক্ত-মাংস-পুঁজ সমেত মেদবহুল থলথলে স্থুল পেট নিয়ে  আমি আশাবাদীই ছিলাম যথেষ্ট। মাতৃত্বের জমিতে চাষ দিতে চাইতাম রোজ। মোসাদ্দেক রাত হলে ঘরে ফিরতো না প্রায়ই। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম তার ফিরে আসার। ফিরতো প্রতিরাতে তবে সেটা মোসাদ্দেক নয় অন্যকেউ। ঘরের সিঁড়ির গোড়ায় ধুপধাপ শব্দ হলে দৌড়ে যেতাম। উস্কোখুসকো একটা মাথা আমায় পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেত চিলেকোঠার ঘরে, আমি চেয়ে দেখতাম। দেখতে দেখতে এই দেখাটা আমার অপেক্ষা হয়ে যায়। আমার অভ্যস্ততা হয়ে যায়।

 "ভাবি দেয়াশলাই হবে?"—এ প্রশ্নে একদিন সে দেখতে থাকা লোকটা ভুল করে আমার ঘরের দরজায় থেমেই পড়ে। সেই ছিল শুরু।

 জ্বলন্ত আগুন নিয়েও আমি কিন্তু জ্বলিনি শুরুতে, এরপর কত রাত এসেছে সেও এক বিস্ময়! লোকটার বয়স একান্ন বা বায়ান্ন! আমার ছিল সাতাশ।

: এরপর?

: চতুর্থ বাচ্চাটা টিকে যায় গর্ভে। জানতাম টিকবে, আমিতো প্রস্তুতই ছিলাম।

: আবার

: হু, এবার পুত্র সন্তান ছিল।গর্ভে তার বয়স যখন সাত মাস তখন সে ভূমিষ্ঠ হয়। তার মৃত শরীর আমার রাত্রিকালীন মশারীর জালে আটকে থাকে পূর্বের অপর তিনটে মৃত সন্তানের মতই।

: এতদিন পর?

: হু, এবার যে মোসাদ্দেক পেটে লাথি দিয়েছিল বেশ অনেকমাস পর! লাথিগুলো আমার সয়ে ছিল, ভ্রুণগুলোর সয়নি।

: পার্ভার্ট!

: হু, আগে সন্দেহ করতো, এবার সত্যিই ছিল।

: বিশাখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মোসাদ্দেকের শরীরটা দেখে, খুবলে উঠে আছে মাংস, কী ব্যবহার করেছে মেয়েটা? ছুড়ি, না কুড়োল? চোখের কোটরের গর্তগুলো হা-করা। মনি নেই একটাতেও। নিশ্চই কাটাচামচের নৈপূণ্য। এঘরে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর লাশ এখন এটাই, অথচ শবনমকে দেখলে মনে হয় নিরীহ,বাচ্চা।  সরল, সাদা মুখ! 

: শবনম, আপনি এই লোকটার সাথে এত দীর্ঘদিন কেন ছিলেন?

: পরিবারতন্ত্রের মরাল শিক্ষায় আমি শিক্ষিত ছিলাম, স্বামী পরম পুরুষ, দেবতা।

: এই লোক দেবতা? ভ্রুণ হত্যাকারী!

: তা বলছি না, তিনি মানুষ এবং পুুরুষ তাই বলছি! 

:এবং তিনি এই সমাজের। রাত শেষ হয়ে এলো। শবনম, আপনি অবলায় জয়ী ছিলেন এখন হিংস্রতায়ও। আপনাকে অভিনন্দন!

: আপনি কেন? দেবদূতকে ডাকুন? তিনিই ঘোষণা করুক ফলাফল। ওনারতো আসার কথা!

: হা হা হা! এখানেও আপনি পুরুষ খুঁজছেন। তার উপর দেবদূত। হা হা হ!

: কেন তিনি কি আসবেন না?

: আপনি ভুল শুনেছেন। আমরা সব ভুলই শুনি, অথবা যা শুনি সবটা ভুলে যাই। আমাদের রাত পাল্টায়, পুরুষ পাল্টায়, হিস্ট্রি পাল্টায়! হয়তো তারাও পাল্টায় কিন্তু আমাদের সেসব মনে পড়ে না, ল্যাবঘরে রোজ জমে থাকে কয়েকপুরুষ! এ রাতে প্রথম পুরুষ সম্ভবত কঙ্কার ছিল। স্টাডির দায়িত্বে ছিলেন গার্গী। যুক্তি-পাল্টা যুক্তিতো দিয়েছিলেন আপনি শবনম।

: শুরুটা আমাদের ভালই থাকে কিন্তু কিছুদূর গেলেই সব কেমন গোলমেলে হয়ে যায় কেন? কে, কাকে, কি নিয়ে প্রশ্ন করছি মনে পড়ে না কেন আমাদের?

:বিশাখা দেখুন পাতায় পাতায় জমে আছে কত কথা, বাতাসে উড়ছে ইস্কাপন, রইতন, হরতন, চিড়িতন ।

: আপনি প্রলাপ বকছেন । এখানে আমি আর আপনি ছাড়া কেউ নেই। আপনি কঙ্কা বা গার্গীর নাম অযথা টানছেন।

: ওহ তাই!

: হু এটা প্রার্থনাগৃহ, ভুলভাল বকলে হবে না। আমি যিশুমাতা মেরি অথবা পবিত্র শিশু।

: ভুল ভুল ভুল! এখানে হিংস্রসব দানবদের আসার কথা, আমাদের লালন করা ক্রোধ, কামনা, আর হিংস্র  প্রতিশোধদের আসার কথা। আমরা চাই পৃথিবী নরক হোক। আমরা পতন উন্মুখ ইভ।

: এটা কি লাশকাটা ঘর নয়?

: আবার ভুলে গেলেন মাদাম মেরি! নাহ এটা ল্যাবঘর, এখানে পাঠ হয় রোজ, পুরুষপাঠ।

: তাহলে আমাদের হাতে তাস কেন?

: খেলছি।

: কেন?

: আমরা নারী, খেলা আমাদের ধর্ম।

: এ জন্য এতো পুরুষপাঠ লাগে?

: হুম,লাগে, নারীপাঠ এখন প্রাগৈতিহাসিক। পুরনো ফর্ম।

: পাঠ আয়োজনে ক্রীড়া, কী চমৎকার অভিযাত্রা ব্রাভো!

: হু মহাকালের কৃষ্ণগহ্বর আমাদের গন্তব্য! চলুন যাই।

: গতকাল কি শুক্ল অভিমুখে ছিলাম?

: হয়তো ছিলাম, হয়তো  না। হাতের কার্ডগুলো দেখুন, সব মনে পড়বে। এখানে আমাদের পুরুষেরা আছে, আমরা আছি, আর আছে হাজার বছর ধরে জমে থাকা অন্ধ আইডলজির বোধ ও শোধ !

হাতে সময় আছে। এখন আমরা অধিক পাঠে মনোযোগী হবো। যত্নকরে খুলে খুলে দেখবো পুরুষের শরীর-মন-মগজ। হাতের দিকে তাকান, রানীকে দেখুন, রাজাকে দেখুন। হয়তো আপনি হার্টস নেননি, পাদ্রী আপনার পছন্দ নয়। জুলিয়াস সিজার আপনার মোসাদ্দেক। না না না! আপনিতো রইতনের রেচেল নন, নিশ্চয়ই ওটা কঙ্কা। ঐ দেখেন গার্গী। রানী এলিজাবেথ। সেই কিশোর ছেলেটা ক্লাবসের রাজা আলেকজান্ডার! দেখুন দেখুন সব মনে পড়বে।   আমি ইস্কাপুনের বিবি, আমাদের খেলার অবসরে আমাদের পুরুষগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে দেখেছেন। অথবা আমরা ধরে নিতে পারি তারা মরে গেছে, ধরে নিই তাদের আমরা মেরে ফেলেছি। অথবা দেখবেন একজোট হয়ে এই পুরুষগুলোই আবার জেগে উঠছে।

: হু হু পুরুষ মৃত, পুরুষ জীবন্ত, পুরুষ ঘুমন্ত। 

: এই ল্যাবঘরে আমাদের হাতে তাস, মৃতদের জন্য কষ্ট, মৃতদের জন্য করুণা, মৃতদের জন্য ক্রোধ। আসুন কঙ্কা, আসুন বিশাখা, এগিয়ে আসুন, সকাল হওয়ার আগেই হয়ে যাক আরেকদান। কেইসহিস্ট্রির পৃষ্ঠা খুলুন। চলুন নাচের তালে পড়তে থাকি নতুন পুরুষ। হাতের তালুর তাস উড়িয়ে দিই আসুন। Let us play at Triumph!




নাহিদা নাহিদ। গল্পকার। জন্ম: ০৫ জানুয়ারী ১৯৮৩, চাঁদপুর। শিক্ষা: জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালায় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষ করে ‘কথাসাহিত্যে’ পিএইচডি কোর্সে অধ্যয়নরত। পেশা: সহকারী অধ্যাপক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। সাহিত্যকর্ম: গল্পগ্রন্থ তিনটি: ‘অলকার ফুল’ (২০১৭), ‘যূথচারী আঁধারের গল্প’ ( ২০১৮), ‘পুরুষপাঠ’ (২০১৯)। পুরস্কার: ১.‘যূথচারী আঁধারের গল্প’ গ্রন্থের জন্য কথাসাহিত্য বিভাগে ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’ — ২০১৮। ২.‘পুরুষপাঠ’ গ্রন্থের জন্য নবীন সাহিত্যশ্রেণি ক্যাটাগরিতে ‘এক্সিম ব্যাংক অন্যদিন হুমায়ূন আমাহমেদ সাহিত্য পুরুস্কার’ — ২০২০।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।