বাবা ও দৃষ্টিঘোড়া
##
বাবা বসে আছেন—
এক হাত রাখা আছে
অন্য হাতের উপর
অপেক্ষা গুনছে তার চোখ
সামনে তুলসির গাছ
আঙুলের ডগায় তিলকের ফোঁটা
নাক থেকে কপাল বরাবর
সে এক মায়াগান
তখন প্রেম ও মন্ত্র প্রার্থনার
এমন দৃশ্যে— ঝুমকো জবায় জাগছে
সুন্দর আনন্দ অপার
আমাদের বাড়িতে—
ভরে উঠছে আলোর যে স্তুপ
স্বেচ্ছায় তা বারান্দায় দোরগোড়ায়
এখন দুপুর সুবিশাল—
তাকানোর পথ ধরে গাছেরাও
পেয়ে যাচ্ছে আদর বাবার
##
সকল ফুল শুনতে পায়
বাতাসের সুরসন্ধি
কিংবা আলো স্পর্শে খুঁজে পায়
রঙের গরিমা—
যেখানে নীলচে পৃথিবীর কোথাও হয়তো
আমাদের বাড়ি—
এলোমেলো দাঁড়ানো সমস্ত ফুলের গাছ
ঝুঁকে বেঁকে ওঠা পাতারা নির্জন
রোল কল ডেকে ডেকে
পাখিরা এক গাছ থেকে অন্য গাছে চলে যায়
ধরো এমন রাতের পরে
গোপন পরীরা ফুটিয়ে গেছে যত ফুল
খুউব ভোর তাতে অদ্ভুত হয় জেনো
তবে রঙ্গনের ঠোঁট ভরা
অনেকটা দিন ধরে রাখা থাকে
লাল লাল ফুটকি
মা অসুস্থ বলে—
বাবা আজ পূজার জন্য ফুল তুলছেন
সাথে ভাসিয়ে দিচ্ছেন
পুকুরের জলে
ঠাকুরের আসনে গত হওয়া ফুলগুলো
##
ভোরের ভেতর এতো এতো অবিকল ভোর
যেন প্রতিদিন একই রকম লাগে
আর বাড়ি খুলে দিলেই ছড়িয়ে পড়ছে
এঁটো যতো থালা বাসন
একটু সকাল পাখিরা এসেছে
আদর জড়ানো রোদরঙিন আনন্দ নিয়ে
বাবা বসে আছেন মৌন হয়ে
তার পায়ের কাছেই পোষা কুকুর
যেন প্রহরার প্রাচুর্য উঁকি দিচ্ছে তীর্যক
পরিবার মানেই দেবালয়
আলোতে, জমানো প্রচ্ছদে
আমাদের টিনের চাল হতে কতটুকু শূন্যে
কবুতরগুলোর পথের পরিধি থাকে
সেখানে হাওয়া ছুঁয়ে দেয় চঞ্চল
নারিকেল পাতারা দৌড়ায়
তখন কালক্রমে কবুতরগুলোর ওড়ার মাঝে
উপেক্ষা করে প্রত্যয়—
##
নিরিবিলি নেমে গেছে পথ
ঝোপ ছেড়ে সাবলীল আঁকাবাঁকায়
ছায়ায় ঝুলে আছে শ্রান্তি, স্বাভাবিক
রোদের দুপুরে তাকিয়ে দেখছি
রঙের বিবিধ উৎসবে—
আরো স্ফীত হচ্ছে গাছেদের গভীর দাগ
বাবা, বাড়ি ফিরে এলো
হাতে বাজারের ব্যাগ চটের
তার চোখ হতাশা মেলে ধরা
এ কেমনতর অসহায়!
তারপর বাবা যেনবা কৃষক
ললিত শিম গাছের দলাগুলো ভেঙে দিচ্ছে
ধীরে ধীরে স্পর্শের ভেতর
যেভাবে নিয়ম করে বেড়ে ওঠে
জাংলায় পাতারা পরস্পর
অদূরে ওই যে শব্দসচল পথ
আর বাহির বাড়ির বাঁশের আড়ে বসে থাকে
দম ধরা পাখি এক
এইসবকেই সারানিকটে মনে হয়
যেন আমাদের—
##
বাবা সংসার মাপতেছেন দূর দীর্ঘশ্বাসে
পুকুরে জলের মুখে নিজের মুখ নিয়ে
নিচ্ছেন প্রশান্তি
তখনো শীত গোবরের ঘষির মতন
লেগে আছে শীতপোশাকে
কেবল নিকটে চলে আসা পাখিগুলো
সূর্য উদয়ের দিকে চলে গেছে
আর এইসকল বিভ্রান্তির মাঝেই
ফড়িং ইতিউতি আনাগোনায় প্রজাপতি
খোঁপায় বসে থাকে গাঁদা ফুলের
শুনেছি, মানুষের মনমরা থাকলে
জীবন হতে অনেকটা অপচয় ঝরে যায়
বাবার হয়তো তাই—
অথচ আমাদের ঘরের ভেতর অভাবের এমন
আড়ষ্টতা দ্যাখে
বাবা কিছুটা ভাবলেশহীন চুপচাপ থাকছেন
##
কোন কোন রাতে বাবার সাথে মায়ের
ঝগড়া হলে—
বাবা, অনেক দূরেই বয়ে যাওয়া
পুরনো স্মৃতির হাত ধরে বসে থাকতেন
আমরা দ্বিধাগ্রস্থ চোখের কোচকানিতে
অপেক্ষা করতাম— সহজ বিরাগে
মা এসে কখন বাবাকে খেতে ডাকবেন
আমাদের ঘরগুলো চুপচাপ জোড়াচ্ছন্নের মাঝে
নিশুতি ধরে এলে
আমাদের চোখ যেন ঝাপসা হয়ে আসতো
তখন অন্ধকারে কেমন জানি উলুঝুলু
সন্ত্রস্ত ঘনশ্বাসে—
বিছানার প্রপেলারে মিলিয়ে যেতাম
অজানার পিঠে চড়া আমরা তেমনই
একজোট ঘুমের সেপাই
কোথাও গিয়ে আবার ফিরে আসতাম
কেবল ঘুমের যৌথতায় এইসব ভাবতাম—
##
আজ উরাধুরা বাতাসে পাতাসমেত পথ
যেন মাছের ফুলকার মতন
অল্প অল্প নড়ে ধান শুকানোর দিন!
এসব হেমন্তের কথা, শীতের প্রযত্নে
উড়ে উড়ে যায় পাখিদের এমন
মাধূর্য বিকেল আর পালক ঝরার গান
বাবা, ক্ষেত কাটানোর প্রস্তুতি নিয়ে
সাজানো ফসলের কাছাকাছি হাঁটছেন
তখন ছায়াদীঘল তার পা
পশ্চিমের রোদ লেগে ছোট হয়ে যাচ্ছে
দূরে ছুটে আসা শিশুরা খেলার ছলে
হচ্ছে আরও আপন পারিবারিক—
##
দুপুর এইক্ষণে—
বাবা, স্নান সেরে এসে আহ্নিক করছেন
ধূতির খয়েরি বসনে তার হৃদয়
যেন আরও আরও নির্জন
ঘর বারান্দার এক কোণে—
একটা বিড়াল রোজ শাসন মেনে
পেয়ে যায় সংসার আদর
তখনও রোদ মোড়া দুপুর উঠোনজুড়ে
হলুদ খেলে খুুউব—
এইরকম উজ্জ্বল প্রহরে
মা আমার চুলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে
ভাজছেন বিলাতি ফুলের বড়া
আর ওইদিকটায় শুকনো পুকুর
মাটি গেঁথে জমে আছে ঝিনুক
এমনতর—
সূর্যের কিরণে ছলকে উঠছে
ঘাটলার পাথরফাঁড়ি—
শুভ্র সরকার। কবি। জন্ম ০৯ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৯ মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: ‘বিষণ্ণ স্নায়ুবন’। সম্পাদিত ছোট কাগজ: ‘মেরুদণ্ড’।
0 মন্তব্যসমূহ
মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।