মালিকানা
তোমার কাছেই জমা রাষ্ট্রের চাবি, যুদ্ধ বাহিনী
ফসলের মালিকানা, ব্যবসা-কাজ-দোকানদারি
নগরের সামিয়ানা, বুদ্ধের শান্ত ললিত বাণী
কুকুরের বিষ্ঠা-বমি; প্রসবিনী-মধ্য কারবারী
কী নেই? সবই আছে; নেই শুধু হারাবার ভয়
আছে সাহিত্য পূজারী, আছে অনুসারী, পাকা লোক
আছে পারস্য বিড়াল, বাধা-বেদনাবিহীন জয়
ফুটো চৌবাচ্চার গল্প, নিয়ত জমে উঠছে শোক
শহরে জমছে খাদ, পাথরে পাথরে হয় বৃষ্টি
আইবুড়ো প্রেম জমে, চাকরির দরখাস্ত-খামে
মানুষ নিলাম হয়, আমাদের ছিপিখোলা দৃষ্টি
নগরের পশুগুলো চেয়ারে বসে বিভিন্ন নামে।
অর্থহীন
পাতা ঝরার মতন শব্দ শুনি, হাস্যরস, গ্লানি
যেন দূর থেকে ক্রমে কাছে আসছে ঢোলের শব্দ
তার পাশে পড়ে আছে অহংকার মিছে সম্মানী
ব্যথা-বেদনাবহুল চোখ, দূর থেকে দ্যাখে—স্তব্ধ
স্পষ্টত মনে পড়ছে গতরাত্রির ক্ষুধার্ত মুখ
সহিষ্ণু জীবনগুলি, গল্পগুলো থাকে অসমাপ্ত
রঙিন মলাটে আঁটা অর্থহীন দুর্বিষহ সুখ
আকাঙ্ক্ষায় পরিপূর্ণ বিদ্যা শেখায় সুবিধাপ্রাপ্ত
কুয়াশায়-সূর্যভারে জানে জল ডিঙানোর কলা
জানে বাতাস শাসন, মৃত সৎকারের কৌশল
শীৎকারমগ্ন শিস—জোড় বেঁধে থাকা আরশোলা
জানে উৎপীড়নের কালে জননের কোলাহল
ঝরে পড়া জীবনের স্বর, অজস্র ভিক্ষার থালা
চলে যায় উৎসবে আমাদের ভুলের শহরে
গ্রাহক জীবন এক—তবু যথেষ্ট হয়েছে বলা
ফুয়েল পেপার থেকে এসো মানুষের দরকারে।
ক্ষুধা ও মৃত্যুর চেয়ে বড় কোনো সাক্ষ্য নাই
সাক্ষ্য মানো, জনরোষ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে?
অথবা ভাবার ছলে পার করে দিতে পারো দিন
কিন্তু জেনো, সাহসের কাছে মৃত্যু এসে জড়ো হবে
আকাশে মেঘের ছাল—দ্যাখো ওই পতাকা উড্ডীন।
তুমি স্নান শেষ করে এসে, আলগোছে চুল ঝারো
ভাঙা কণ্ঠের স্লোগান কান পেতে শোনো দূর থেকে
ভাবো, মিছিমিছি এরা শহরে নেমে এলো আবারও
ওরা ক্ষুধার শরীরে মরে গিয়ে বাঁচতে চেয়েছে!
অথবা ফুরিয়ে গ্যাছে ফসলের আনকোড়া দিন
হাটে-হাটে, মাঠে-ঘাটে কৃষকের ফেটে যাওয়া পা
ধীরে ধীরে আরো ফাটে, তোমরা ক্ষমতায় আসীন
কখনো শোনোনি স্বর, ওরাই মহেঞ্জাদেরো-হরপ্পা।
ক্ষুধার্ত মানুষ রেখে তোমরা মাংসের বাজারে—
লকডাউন ছুটিতে নানারঙ খাদ্যের রেসিপি
ক্রমাগত নিষেধাজ্ঞা মৃতের সংখ্যা শুধু বাড়ে
সরকারি প্রেসনোট আর অসুখের দিনলিপি।
দিনগুলো চলে যায় তুমি খোঁজো সাক্ষ্য ও প্রমাণ
সেইসব সাক্ষ্যগুলি আমরা দ্যাখি প্রতি টিভিতে
ওদের দাঁতাল মুখ শিকারীর মতো কম্পমান
এই মুখ কতোদিন দ্যাখে না—সরল আয়নাতে।
লকডাউন পেরিয়ে এইসব সাক্ষ্য জমা দিও...
লিমেরিক ০১
সারাটা রাত জায়নামাজের পরে
পিতার সরল চোখের নিচে জল
মাতার হাতে তজবিমালা জপে
শোকের মতো তুমুল এক অঞ্চল
সেহেরি যায় ইফতারও যায় চলে
শহরজুড়ে মড়ক একাকার
ক্ষুধার্ত সব মানুষগুলোর হাতে
ভিক্ষাথালার শূন্য হাহাকার
ব্যক্তি এখন মানবতার ফেরি
রাষ্ট্র যখন অর্থনীতির চর
রাজনৈতিক বাস্তবতার দিনে
আমার করের টাকা হিসাব কর
আবার কেউ ঢেউ খেলানো চুলে
কত গাঢ় আঁধার জমে ওঠে
এই প্রেমেতে মত্ত থেকে থেকে
কাব্য করে খাবার টেবিলেতে
অথবা কেউ রঙ মাখানো ঠোঁটে
বৃত্তমতো ছবি তুলে রাখে
কেউ ছোঁয়নি, কিছুই ছোঁয়না তাকে
বিরল এই প্রবল দুর্বিপাকে
কী করে থাকে বেদনাহীন এতো?
কেউ জানে না, জানে যারা মরে
ফুল-পাখি আর লতাপাতায় কতো
মরছে মানুষ, বাঁচো—কোন অধিকারে?
বরং এবার লিভার টানো জোরে
ভাঙা বুকে আর কত পাও ভয়
তোমার লড়াই আমার লড়াই হবে
যদি দাঁড়াও ভুলে সংশয়
এই মুখবন্দি দিনে
স্মৃতির ঐশ্বর্য নিয়ে কতদূর চলে যেতে পারো?
হাড়ের গভীরে বাজে সেইসব শীতের কাঁপন
আমি মুখবন্দি রই, শীতল রক্তের মতো গাঢ়
কুয়াশায় ঢেকে যায়—প্রিয়মুখ, চির প্রিয়জন।
মৃতের শরীরে তুমি কতদূর চলে যেতে পারো?
নতুন ধানের বীজ রুয়ে অপেক্ষায় থাকে চোখ
কত সবুজের মুখ মাটি ফুঁড়ে কথা বলে আরো
বাজার-বিষাদ ঘ্রাণে—মাঠজুড়ে ফসলের শোক!
বিষাদ প্রপঞ্চ দিনে কতদূর চলে যেতে পারো?
আলপথে শুয়ে থাকে ঘাস, বাদামী রঙের গম
জলের সীমানা ভেঙে চোখ থেকে জল পড়ে কারো
পোকারাই বেঁচে থাকে, প্রতিপদে বাড়ায় সঙ্গম।
কতপথ চলে যায়, কতদূর চলে যেতে পারো
পথ কি চিনেছো আজো? কোনপথে হতে পারো জড়ো?
শর্ত অ-শর্ত
বরং গভীর আঁধারে ডুবে যাও
নির্বুদ্ধি হও,
হও প্রশ্নহীন পোষা প্রাণী
অথবা হারিয়ে যাও
যেভাবে হারিয়ে যায় শেষ বিকেলের আলো
যেভাবে প্রতিসরণের আলো চলে যায় ভিন্ন দিকে
বরং বিষণ্ণ থাকো, থাকো শব্দহীন
মৃত্যুর আগেই চির শান্তির ঘুমে থাকো বিকল
অথবা গৃহহীন হও
আগুনের মতো শতমুখী
পুড়িয়ে যতটুকু থাকে তাতে আবার জ্বালাও!
স্মৃতি-২০২০
নতুন ধানের বীজ তুমি জানো মাঠের গোপন
রঙিন পরাগ রেণু পরাগায়নের সরলতা
মানুষ জানে না কিছু, ভুলে গ্যাছে কে আপনজন
উদার আকাশ তবু—স্মরণে অবাক বধিরতা।
তুমি বুঁদ হয়ে আছো, জাগতিক ভুল, বহুস্তম্ভে
বিবিধ কপাটে , ধর্মে ও বাসনার বিপুল গানে
যুদ্ধ বিরতির মতো সাময়িক হিসেব-নিকেশে
ঘরের আজব স্বরে—খাদ্য ও পোশাকের আবেশে।
এসব প্রবল দিনে রাইফেলস্মৃতি মনে পড়ে…
পথে খাদ্য সংকট, নিরন্ন মানুষ কাঁদে, ক্ষুধা—
প্রবল রোদে-বৃষ্টিতে, মানুষের সারি দ্যাখি শুধু
বন্ধুদের মনে পড়ে, যারা দাঁড়িয়েছে, যারা যোদ্ধা
কেউবা তামাশা করে—সময়ের কাছে পোষা জন্তু।
তুমি খোলো মৃত্যুরূপ কারখানা, কফিনের দ্বার
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পাহাড়চূড়ার কল্পস্বপ্ন
কতদূর যেতে পারে? এইসব দৃষ্টির বাহার
শোকের কার্তুজ জানে—মৃতশরীরে লাগে না যত্ন!
একটা রেললাইন চলে যায় শরীরের দিকে…
সৈয়দ সাখাওয়াৎ। কবি। জন্ম ৮ আগস্ট ১৯৭৮। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ দুইটি: ‘খণ্ড খণ্ড রাত্রির আলাপ’ (কাঠপেন্সিল: ২০১৩), ‘পাতাচূর্ণ উড়ে যাবার সাথে সাথে’ (বাঙ্ময়:২০১৮)।
2 মন্তব্যসমূহ
দারুণ...
উত্তরমুছুনএক অনন্ত উচ্চারণের মত নিচের অংশগুলো মনে হল। অসাধারণ! সত্যি অসাধারণ! বারবার বোধির ভিতরে হারিয়ে যাওয়ার মতো কবিতাগুলো বারবার মর্মজালে জড়িয়ে ধরে
উত্তরমুছুনক) "কুয়াশায়-সূর্যভারে জানে জল ডিঙানোর কলা
জানে বাতাস শাসন, মৃত সৎকারের কৌশল
শীৎকারমগ্ন শিস—জোড় বেঁধে থাকা আরশোলা
জানে উৎপীড়নের কালে জননের কোলাহল
খ) কী করে থাকে বেদনাহীন এতো?
কেউ জানে না, জানে যারা মরে
ফুল-পাখি আর লতাপাতায় কতো
মরছে মানুষ, বাঁচো—কোন অধিকারে?
গ) বিষাদ প্রপঞ্চ দিনে কতদূর চলে যেতে পারো?
আলপথে শুয়ে থাকে ঘাস, বাদামী রঙের গম
জলের সীমানা ভেঙে চোখ থেকে জল পড়ে কারো
পোকারাই বেঁচে থাকে, প্রতিপদে বাড়ায় সঙ্গম।
ঘ) বরং বিষণ্ণ থাকো, থাকো শব্দহীন
মৃত্যুর আগেই চির শান্তির ঘুমে থাকো বিকল
অথবা গৃহহীন হও
আগুনের মতো শতমুখী
পুড়িয়ে যতটুকু থাকে তাতে আবার জ্বালাও!
ঙ) তুমি খোলো মৃত্যুরূপ কারখানা, কফিনের দ্বার
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পাহাড়চূড়ার কল্পস্বপ্ন
কতদূর যেতে পারে? এইসব দৃষ্টির বাহার
মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।