TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

‘আগামীর কবিতা কিছু নন-প্যারালাল ইনডেক্স’ পর্ব: পাঁচ | রাহুল গাঙ্গুলী


পর্ব: পাঁচ


বিবর্তন ও ভাষা: সোঁদা মাটির আঁশটে গন্ধ:

ভাষা চিরকালীন একটি অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। এছাড়া তার কোনো অস্তিত্ব নেই। যেমন ধরা যাক আদিম মানুষের কথা। তারা এই ভাষাকে শুরু করেছিলো ইশারা, ইঙ্গিত ও কিছু অস্পষ্ট শব্দ উচ্চারণ দিয়ে। আবার প্রকৃতি এইসব শব্দের জন্মদাতা। কারণ, প্রকৃতির ভিতর উৎপন্ন শব্দ যখন মানুষ নিজস্বতার উদ্দেশ্যে প্রয়োগের চিন্তা শুরু করলো, সে তাকে বানালো তার মতো করে বা তার নিজস্ব সহজগম্য কম্পাংক ও মডিউলেশন করে। আর এখান থেকেই শব্দের বিবর্তন ও নতুন শব্দ এবং নতুন উচ্চারণ সৃষ্টি।
এখন পাঠকবর্গ বলতেই পারেন কবিতা নিয়ে আলোচনায় এসব পুরনো চর্বিতচর্বণ কেন।

আসলে মনে হয় এটার প্রয়োজন। আগে মাটি (প্রকৃতি), তারপর শব্দ, তারপর ভাষা, তারপর শিল্প। এই সিকুয়েন্স না বুঝলে শিল্প (বলা ভালো কবিতা) বা কোনো সৃষ্টি আত্মস্থ করা জটিল। যদি কেউ ভেবে থাকেন, এখানে প্রচুর তথ্য পাবেন বা গবেষণার খবর পাবেন, তাদের জন্য এই মুহূর্তেই বলে রাখি, সে ব্যক্তিগত যোগ্যতা এমন নেই যে নিজস্বতাকে প্রকাশ করতে গিয়ে অনেক সাপোর্টিভ কোটেশনের ভিত ধার করতে হবে।

কি প্রয়োজন প্রমাণের, তার জন্য বহু নলেজেবল মানুষ আছেন, বিদগ্ধ পণ্ডিতরা আছেন, বহু বই আছে, বহু গবেষণাপত্র ও গবেষক আছেন। তবুও এতো কিছুর পর যারা লেখাটি পড়তে চাইছেন, তাদের বলি পুঁথিগত সিলেবাস নয় বরং সেই বিশ্বাসে লেখা উচিত, যা মাথা থেকে বুক বা নাভি থেকে লিঙ্গ বা থাই থেকে পায়ের পাতা: এই সর্বত্রকে ছুঁতে পারে বাস্তবে। অর্থাৎ পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সাথে গড়া সম্পর্কের দ্বারা চালাতে পারে নিউরোটিক হ্যামারিং। আর সেখানেই চিন্তনের সার্থকতা। সময় এগিয়েছে তাই সেই সময়কে না বুঝলে পিছিয়ে থাকতে হবে বৈকি।

ভাষার উৎপত্তি কোথায়। কেন। একথা সকলের আজ ফিরে দেখা প্রয়োজন। প্রয়োজন বোঝা, যে ভাষা না থাকলে আমরা কি পিছোতাম, না কি বিবর্তন এমনভাবেই ঘটতো।

আগেই একথা বলা হয়েছে, আদিম মানুষের কাছে চিন্তনের বহিঃপ্রকাশ বলতে ছিলো অনুভূতি এবং কিছু প্রাকৃতিক শব্দের ভান্ডার। তখনো গোষ্ঠীবাদ আসেনি, মানুষ ছিলো স্বাধীন : তার চিন্তন ও যাপনে। কিন্তু যখন থেকে উঠে এলো গোষ্ঠীবাদ, এলো এলাকা দখল করার অহংকার, এলো ‘উইদিন স্ট্রাগল ফর এক্সিসটেন্স’, ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া শুরু হলো। আসলে, গোষ্ঠীপতির অবর্তমানে তার একনায়কতন্ত্রকে বিনা বাক্যব্যয়ে যাতে সকলে মেনে নেয়, সে জন্য প্রয়োজন ছিল বিভিন্ন প্রকারের উপকরণ : যেমন ভাষা। এলাকা দখলের পর হেরে যাওয়া বাসিন্দাদের বাধ্য করা হলো একছত্র অধিকার মেনে নিতে। আর তার সবচেয়ে বড়ো মাধ্যম হলো ভাষা এবং স্থানীয় শিল্পকে ধ্বংস করে বেনিয়াভিত্তিক নয়া শিল্পের স্থাপন, যাতে শাসন ও শোষণ সহজ হয়।

উদাহরণ স্বরূপ আমাদের ভারতবর্ষের রাষ্ট্রভাষা হিন্দীকে নেওয়া যেতে পারে। সেনসাসের গণনা অনুযায়ী মাত্র ২০% ভারতবাসীর মাতৃভাষা হলো হিন্দী। কিন্তু তা দিয়ে তো রাষ্ট্রভাষা হয় না। অতএব, তাকে ৫০% করা হয় আরো কিছু ভাষাকে হিন্দী তকমা লাগিয়ে। যেমন: ভোজপুরি, ব্রজ, মৈথেলী, অবোধি, বুন্দেলী ইত্যাদি আরো প্রায় ৫০টি ভাষা। অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে এটি একটি চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় খেলা এবং ক্রমবিবর্তনে অন্যভাষাগুলোকেও হিন্দীর উপযোগী করে এক ধরনের নিবর্তিত করা। তেমনি বাংলা ভাষাও নেওয়া যেতে পারে। বাংলায় কতো শব্দ মিশে আছে, যা সম্পূর্ণ বাংলা নয়। আবার দেখা গেলে, পশ্চিমবঙ্গের ভাষা বাংলা হলেও এই বাংলাই একেক ভৌগলিকপ্রান্তে একেকরকম।

একটা সময় ছিলো যখন বাংলায় কিছু শব্দ ছিলো, প্যাটার্ন ছিলো। আজও কি তা আছে? দেখা যাবে তা বিবর্তিত হয়ে এখন অন্য প্যাটার্ন হয়েছে বা অনেককিছুই উহ্য। যেমন: টেবিলের পায়াভূজের ভিতর কর্তন বল কাজ করছে। এখানে, প্রতিটা কথার মানেগুলো আলাদা করা যাক। টেবিল : জানা আছে, পায়া+ভূজ : পা একটা বাহু, ভিতর : ভেতরে, কর্তন বল : এখানেই হোঁচট খাবেন, কারণ আপনাকে সময় করে অভিধান দেখতে হবে। এর ইংরাজি বানানটি হলো shear force। দেখুন এটি কিন্তু সাধারন চলতি ইংরেজি না হলেও, আপনি নিমেষে ইন্টারনেট থেকে পেয়ে যাবেন। অতএব, ভৌগলিক অবস্থান, জলবায়ু ইত্যাদি ছাড়াও প্রযুক্তি কাজ করছে।

সুতরাং যারা প্রশ্ন করেন ভাষার বিশুদ্ধতা বা স্বচ্ছ ভাষার কাঠামো নিয়ে, তাদের যুক্তি কতোটা গ্রহণীয়? যদি 1 = I বা 2 = II হয় : এখানেই তো ভাষাচর্চার বিবর্তন ধরা পড়ে। অতএব যারা বলছেন অমুকভাবে লিখলে বাংলা ভাষা বাঁচবে না, তারা তো মায়ের এবং মাটির ভাষাটাকেই বুঝলেন না। তার বিবর্তনের ইতিহাসকে দেখলেন না, তা হলে বুঝতেন ২০৫০/৬০ সালে বাংলাভাষা কোন পথে যেতে পারে।
আরো আছে কিন্তু তা বিষয়ান্তরে চলে যাবে বলে আর লিখলাম না। তা হলো ভাষার সার্বভৌমত্ব। প্রসঙ্গে বলাই যায় : কোনো ইংরেজকে বা ফরাসী বা স্প্যানিশ বা জার্মান, কাউকে বলতে কি কখনো শুনেছেন যে আগামী ১০ বছর পরে ভাষাটিকে বাঁচানো যাবে না। নিদেনপক্ষে বাংলাদেশ থেকেও কোনো বন্ধু বলেন না। কেন এই উত্তরটা একটু ভাবুন, অনেক অনেক দিক উপলব্ধি হবে।

আমাদের উপমহাদেশীয় ঔপনিবেশিক কাঠামো আজও বেশ কিছুটা রয়ে গেছে। কারণ, স্কুল সিলেবাসের কবিতা, যার অধিকাংশই হলো রবীন্দ্র পূর্ববর্তী বা রবীন্দ্রযুগের সময়কালীন কবিতা। রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ে যে ভাষাকে নতুন করে ভেঙে ফেলে তার নতুন ডিসকোর্স বা নতুন উপাদান— উপকরণ বের করা শুরু হয়েছিল, তার ইতিহাস আজও সর্বজনগ্রাহ্য নয়। বরং একটা তকমাও লাগানো হয়েছে কবিগুরুর বিরোধীতা। অথচ, সাহিত্যের ইতিহাস বলছে লিপি, চর্যাপদ, পয়ার, মঙ্গলকাব্য, মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি অনেক পর্যায়।

যেখানে প্রতিক্ষেত্রে ভাষা ও শব্দ নতুন নতুন দিকনির্নয় করেছে। তাহলে পরবর্তী ডিসকোর্সগুলো মানতে দ্বিধা কিসের? উত্তরে কি ধরে নেবো : পূর্বপুরুষদের ফেলে যাওয়া সামন্ততান্ত্রিক অবশেষের দাসত্ব আমাদের মজ্জাগত। তাই যখন অবলিলাক্রমে সময়ের দাবি মেনে ঠোঁটস্থ অন্য কোনো ভাষা (বাংলা ছাড়া) বা সংকেতের মাত্রা বাড়ে, আমরা তৎক্ষনাত তার মেরুকরণ করে ফেলি।

একটু ভেঙে ফেলার উদাহরন দিই। কদিন আগের সুকুমার রায় নিয়ে ব্যক্তিগত মূল্যায়নটির কিছুটা অংশ এখানে রাখলাম:

নামটি ওতোপ্রতো ভাবে বাঙালি বা অন্য ভাষার মানুষের কাছে জড়িয়ে আছে শিশুসাহিত্য বিষয়ে। কিন্তু যে কথাটা বলা প্রয়োজনীয় তা হলো ভাষার বিনির্মাণ বা অক্ষর বা শব্দ নিহিত শক্তি। দেরিদা বা ফুকো বা পরবর্তী সময়ে বিনির্মাণ এসেছে, কিন্তু বাংলায় প্রথম সুকুমার রায় সম্ভবত কাজটি বহু আগে করেছেন। এছাড়া সেই ননসেন্স আর্টে আরো একটি বৈশিষ্ট্য দেখার মতোন তা হলো রাজনৈতিক সাম্যের কথা।

সমসাময়িক সাহিত্য চর্চার ভিতরে তিনি যে নতুন ভাষা তৈরি করতে পেরেছিলেন, তা চিরস্মরণীয়। বাংলা সাহিত্য একমাত্র লোকসাহিত্যের ফর্ম ছাড়া এই ফর্ম কেউ দেখিয়েছেন কিনা জানা নেই। জানা নেই প্রাক ডাডাবাদ বা আভাগার্দো মুভমেন্টের সাথে বাংলা সাহিত্যের কোনো সেতুবন্ধন ছিলো কি না। তা যাই থাকুক, দুঃখের কথা হলো এটাই বাঙালি চিরকাল এই লিখন ধারাকে শিশুসাহিত্য ও ননসেন্স পোয়েম বলে সীমাবদ্ধ করে রাখলো।

আসুন ১টা উদাহরণ নেওয়া যাক:

রোদে পোড়া ইঁটের পাঁজা
তার উপরে বসলো রাজা
ঠোঙা ভরা বাদাম ভাজা
খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না

এটি আবোলতাবোল থেকে নেওয়া। এখন আসুন ২০১৭তে পড়ি লাইনকটিকে সময়োচিতভাবে।

(রোদে + পোড়া) ?  ইঁটেরপাঁজা ? 
(তার উপরে) ? বসলো রাজা ? 
(ঠোঙা ভরা) ? বাদাম ভাজা ? 
খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না ?

এতোগুলো প্রশ্নচিহ্ন কেন? স্রেফ বিশ্লেষণের সুবিধার্থে বলা যেতেই পারে। তবে এই বিশ্লেষণ ভুল না ঠিক সে বিচারের দায়ভার সময়ের উপর।

রোদে পোড়া = একটি শক্তির ফলাফল
ইঁটেরপাঁজা (১টা নয়, অনেক) = একটি শক্তির বহুশক্তিতে রূপান্তর ও তার সম্মিলিত রূপ
তার উপরে (নীচে নয়) = একটি বস্তুর আভ্যন্তরিক শক্তি প্রদত্ত ভরবেগ, যা মুখোমুখি ২য় বস্তুর সরণ ঘটায় (একটি মুখ্য ডায়ালেকটিক্স)
বসলো রাজা = ডায়াকেকটিক্স ইন সোসাইটি। অর্থাৎ সাম্যবাদের কথা
ঠোঙা ভরা = মুঠো হাতের কাউন্টার ফোর্স (হ্যাভস নটসদের প্রতিআক্রমণ)
বাদামভাজা = চূড়ান্ত অসাম্যকে সাম্য প্রদান। শক্তির চূড়ান্ত ঘাতকে স্থিতিকরণ
খাচ্ছে, কিন্তু গিলছে না = স্থিতিকরণের ফসলে সমাজের এলিট উপাদানগুলির ভিতর বৈপরীত্য (ভয়)
এরকমই খুড়োরকল। কেরানী বাঙালীর ছুটে যাওয়ার ইঙ্গিত : এসময়ের রেসিজম।
আরো আরো আছে। শুধু ভাবতে হবে সবটুকুই ঘোর মেটাফর।

অতএব দেখাই যাচ্ছে ভাষা সময়ের সাথেসাথে নিজেকে বিনির্মাণ করতে চাইছে, অর্থ বদল করতে চাইছে এবং তা পরিকল্পিত ভাবে হচ্ছেও। রাষ্ট্রশক্তি স্বীকৃতিও দিচ্ছে কিন্তু সীমানাও টানছে। ঘটনাটি অনেকটা ইংরেজদের রেললাইন আর ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োগ। সেগুলো একটা পরিকল্পিত স্বার্থের উদ্দেশ্যে হলেও, সময় এগোনোর সাথেসাথে তার সুফলে কিন্তু জনজীবন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সময়ের দাবিকে দেখতে হবে আগে।

• পর্ব: এক পড়তে এই লেখাটির উপর স্পর্শ/ক্লিক করুন
• পর্ব: দুই পড়তে এই লেখাটির উপর স্পর্শ/ক্লিক করুন
• পর্ব: তিন পড়তে এই লেখাটির উপর স্পর্শ/ক্লিক করুন
• পর্ব: চার পড়তে এই লেখাটির উপর স্পর্শ/ক্লিক করুন


[ধারাবাহিক: আগামী শনিবার পাওয়া যাবে পর্ব: ছয়]



রাহুল গাঙ্গুলী। কবি। জন্ম তারিখ: ১০ই আগস্ট ১৯৮১, দুর্গাপুর, পশ্চিম বঙ্গে।
পেশা: সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।
কিছু কথা : কোনো মহাপুরুষ হয়ে দেওয়ালে ঝুলবার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, নিজেকে আবিষ্কার তথা সময়কে আবিষ্কারের ভিতর দিয়েই যোগ ও যাপন। ভালোবাসা, প্রেম, ঘৃণা বা প্রতিবাদ ~ সময় তথা নিজের কাছে : যে কোনো সৎ সূক্ষ্ম অথবা স্থূল প্রশ্ন করার অধিকার এবং নিজের কাছেই সমাধান, সেই বিশ্বাস নিয়ে দীর্ঘ চিন্তনের প্রতিফলনে লিখে যাওয়া অনুরণিত কবিতা
প্রকাশিত গ্রন্থ:
নো ম্যানস্ ল্যান্ড’ (কবিতা পাক্ষিক) ২০১৭, ‘ব্যক্তিগত জরায়ু থেকে’ (ঐহিক) ২০১৮, ‘খাদ্য - খাদক - খাদ্য’ [অনলাইন বই] (ফেরারি) ২০১৮, ‘১ মুঠো জলীয় দূরত্ব ভেঙ্গে’ (টার্মিনার্স) ২০১৮,
কবিতাবিহীন মুহূর্তগুলো’ (তাবিক) ২০১৯,
পরিত্যক্ত ০|র খোঁজে’ (ঘোড়াউত্রা) ২০২০।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।