TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

পাণ্ডুলিপির কবিতা: ‘করোনা সিরিজ’ পর্ব: তিন | সাজ্জাদ সাঈফ


আত্মা 

এবারের শীতে হাতের তেলোয়, শিশির-কণা ওজন করে দেখি
আত্মা নামের পিং পং বলটাকে ধরা যায় কিনা!

তুমি আমি এক বিরল পিরান, ভাবি;
শীতের সড়কে গা’য় জড়াজড়ি নতুন কুয়াশা!

বলো তো এবার শীতে
পাতাদের সাথে ঝরে যাবে নাকি করোনা-ব্যারাম?
এইসব ভাবি আর মুখে, রাতের আকাশ কিনা ঘাম জমা টের পায়
বিদ্যুচ্চমকে!

এতো যায় নরকের হাতকড়া বেজে, মর্গের আন্ধারে, একা!
মৃতদের নাক শুঁকে নমুনা সংগ্রহে যায়, কাঠের চিমটা!
আমি এক মৃতের শরীর নাকি? গায়ে লাগে এসে মর্গ-বাতাস!

এবারের শীতে, বিল শুকালে রোদের ভারে
কতটা সহজ ধুলি, ক্যামনে-বা তাহা বলি!

শোক থেকে নেমে গিয়ে, নদীসজ্জা কি পাব
জলের সামনে গিয়ে?

স্বস্তি কুড়িয়ে নতজানু হও, এইবার; আর হও, উচ্চারিত;
হও দুর্দম ষাঁড়ের সিনা, সাফা-মারওয়া-বুকে উচ্চারিত হও, ক্রমে
গাছেদের গ্রহে, পৃথিবীর দহে, শ্রাবণের স্নেহে;

আনত স্মৃতির পায়ে পায়ে, সিজদা-কুসুমে আসো;
সারা মন-দেহে, ধীর হয়ে যাক জবার গোলক-
তুমি কিনা সারসের ঠোঁট, হৃদয়-ট্রমায় এক দম হাসি;
লোকে বলে আত্মা তোমাকে?


গোল
(কবি শামীম রেজা, প্রিয়ভাজনেষু)

তারপর মরে-ঝরে গেলে, আকাশ-টানানো ফুলে
পতঙ্গ-টাচ, বিনিয়ে এসে, বসবে কবর-ধারে?

সমরাস্ত্রের ওজন ঘাড়ে, বিভূতি পাঠাবে মেঘ?
নাকি পৃথিবীর ক্ষুধা, পৃথিবীর দ্বিধা হেসে, চুপচাপ রবে, শরণার্থীর জিঞ্জিরে?
অথবা শালুক জমে, নীল-নাগরিক মনে, হবে না গিমিক-ছড়া?

একটা জীবন বেয়ে
কতোভাবে গান গেয়ে, সময় সাঁতারে হেঁটে
কত শত ঘুণ কাটে, ঘুমের ঝিমুনি দাঁতে!

আর দ্যাখো রাষ্ট্রকে নির্জলা। কৃষকের ধান, কাঁচাসোনা ধান
ফটোসেশনের ফাঁদে, পান্ডব নদীও কাঁদে?

অথচ করোনা এলো, ভোরের পাখিরা এলো, মৃতেরা জানে না
তাহাদের নিয়ে, ইকোনমি হিমশিম!

এবার তাহলে বলো, তুমি কার কার
মনের মতন করে, এই ধারা জীবন-ব্যাধিকে একা, কাটিয়ে গিয়েছো বলো!

বলো তুমি, তার বা তাদের
ঠেলে দেয়া বলে, মিস করো নাই গোল?


সামাদ
(সতীর্থ কবি সালেহীন শিপ্রা সমীপে)

এই যে পাঁজরে থামছে একা, হাওয়াই দীর্ঘশ্বাস;
এই যে প্রহরী তারার চোখে, চেয়ে আছে নদী-ঘাট;
দ্বিধা ঝেরে ফেলে নামাজ-গ্ল্যামারে, মৌন সুরেলা ‘সামাদ’
পৃথিবীতে রুয়ে, থেকে যাই চলো, কিছু দিন, কিছু রাত!

এই যে মাশুল, তৌবা-স্বরে, পাতক কলবে ওড়ে-
মগজে বিলানো ছন্দ কেরাত, তাকোয়া হৃদয়ে চড়ে;
গ্রামদেশ হতে আজানের ডাক, নগর-মিনারে থামে;
তকদির চেয়ে তাকায় মানুষ, আকাশের নীল ধ্যানে!

এতো যে ব্যাধিরা ভাসে আর আসে মানুষের ফুসফুসে-
চিরল আলোয় রোদ ভরে গ্যাছে, রোদ ডুবে গ্যাছে ত্রাসে!

আর
কিছু কিছু দিন বিষণ্ণতা, কিছুদিন জারি নবীর দরুদ;
কলিজা রাঙায় বিষ-মাখা ছুরি, মোহ-লোভ, অদ্ভূত!
প্রকৃতিই নাকি ভালো; গেছে, উচাটন পাখি উড়ে
সেচ-মেশিনের ধ্বনি, গান হলো, পাখিদের সংসারে!

কারো বুকে-পিঠে গাছির কলস, স্মৃতির ধোঁয়াটে শীতে;
কারো স্মৃতি নিয়ে টানা টানা চোখ, ঘাসফুলে হলো নীল!
কাজল আঁকানো কারো দুই চোখে, দুপুরের দ্রাঘিমাতে
ইতিহাস ভেজে, সাথে ভেজে ব্যাধি, চমকে তাকায় বিল!

চারধারে পথঘাট সব আমাদের খোলা পথ;
আমাদের পথে ওড়ে, রোদ জাঁকানো পিরান!
করোনা এসেছে ভেসে? হবে নাকি জখম-সুরত?
তাঁহার বুকটি শেষে? যার বুক নিজে, দরুদ-মোকাম?


রোদের শলার নিচে
(কবি জুয়েল মোস্তাফিজ প্রিয়ভাজনেষু)

যেদিন উইকেন্ডে, শয়তান এসে মগজ চিবাবে মানুষের
দ্বিচারী প্রেমের দিকে হেলে যাবে, তুষার-ঝরা শহর;
ধীরে, অতি ধীরে যাবে নফস, পুরাণের অজাচারে ফিরে!

সেদিনও কিনা জ্বর-গায়ে, বৈশাখ ও বাতাসের, আলাপ সালাপ শুনে
উড়ে যাবে হাস্যোজ্জ্বল, স্বর্ণাভ ফড়িঙ, সিদরাতুল মুনতাহায়-
বিপুল ছায়ার নিচে উটের কাফেলা, খুঁজে পাবে হাওয়া, জাগ্রত-ধ্যানী;

রোদের শলার নিচে অতুল ফোরাতে
প্রবল বর্ষা পেয়ে ভেসে যাবে এজুজ-মাজুজ!
ভেঙে চূর্ণ হবে ব্যক্তির দৌলত, ক্রমে!

টীকা ও টিপ্পনীযোগে আরো সব পাজল স্নায়ুর সাথে
জেরুজালেম, নিজেই এক অভাগা জমিন ভবে
যার হাওয়া ধরে কাঁদতেছে ঋণ, ফিলিস্তিন!

আমি নিঃসঙ্গতা হয়ে খুঁজে ফিরবো তোমার স্মৃতি
যেনো কতোদিন ‘কথা নাই, ভাষা নাই’-মতো ফুল
ভিজবে উঠান ভরে; কিছুই বুঝবো না ভাষা, ঘাস আর
পাতাদের!

তবু ময়দান উড়ে বসবে ধুলায়, সালাত দাঁড়াবে উপত্যকায়;
অসুখ ভাসিয়ে নিলে ফাতেহা জিকির, ওহুদ জড়ায়ে তুমি
কাঁদবে সেদিন, নাকি?


বাংলাদেশ-২০২০
(কবি ও প্রিয় অনুজ উত্তম মন্ডল সমীপে)

দুই দিকে দাঁত নিয়ে যাপন-করাত আসে
দুই চোখে টানটান স্বপ্ন-প্রতিভা;
চোখ মেলে চাঁদ দ্যাখে, রক্ত গোলাপে-ঘাসে;
দুই সিকি নদী, নাম 'পান্ডব' অভিধা!

এই দেশে ঘুরে ফিরে, যতটা বাতাস মেলে
তার বেশি আগুনের, করোটি-পাঁজরা খেলে!
আমাদের গভীরতা, খনার বচনে ভারী
হাঁটা-চলা, কথা-বলা, রক্তও স্বেচ্ছাচারী?

লজ্জার দু'গালে দ্যাখো, রক্ত ছড়িয়ে গ্যাছে
রক্তেও সমান ক্ষুধা, স্বপ্নকে নিচ্ছে শুষে!


মে-ডে
(কবি সাম্য রাইয়ান প্রিয়ভাজনেষু)

আমাদের কথাগুলা, ক্ষুধার দু'ধারে কাটা-পড়া;
এমন ক্ষুধার ছুরি ‘বুকে গাঁথা’-নিয়া কাজ করে, আমাদের গার্মেন্টস!

ক্ষুধাই মূলত সব
দেশপ্রধানের বিরোধীশক্তি, আর দেশে দেশে
আজ নাকি শ্রমিক দিবস গ্যাছে!

অথচ করোনা একা, ক্ষুর টানে, মানচিত্র জখম করে!

আর, আমাদের ক্ষুধাগুলা পাল ছিঁড়া নৌকা নাকি?
ডোবে আর হাবুডুবু খায়!

ডোবে আর পতাকা ডোবায় রাগে!


একদা ঘুরঘুর করা পুরানা দু’তিন বন্ধু

এক একটা হাসির গাছে গিয়ে, ঢুকে যাচ্ছে করাত বন্ধুদের;
কবিতা লিখিয়ে, জনা-দুই-চার, বন্ধু তাহারা, অরূপ-রতন সাজ!

একবারে চূড়ায় তাকালে যে-রকম দমবন্ধ লাগে
আর, সেই ফুসফুসের চেইন খুলে দিচ্ছে এক একজন
পাহাড়-জাতক; হাত থেকে মুঠি খুলে যায় মেঘে, পিছনে বিদ্রূপ থরথর-

ডানাঅলা ঘুমের ভিতর নড়ে, আলজিভ দুঃস্বপ্নের!

টালিছাদ ঘেরা বুকে, একটা আয়না হাসে;
আত্মগোপনের চাবি নাকি সে?
হৃদয় অবধি ঘাসপথ, ভিজতেছে সেইখানে?

ঢেউ-ভাঁজ খুলে খুলে নৌকা আসে, আসে পালং শাকের জ্বাল দেয়া ঘ্রাণ;
ঘুরে ফিরে এক পুরান জলচৌকিতে বসে, পোষা বিড়ালের স্মৃতি;
এরই ভিতর কেউ হাসে, নিজের ভিতর হাঁটে;
পিছনে বিদ্রূপ থরথর!

ডাঙা নাই, দুপুরের ভাতঘুম নাই, এইসব অথই যুবক, ভারি করে
ফেলে গেছে স্মৃতি-

বাবার ডাকের মত সরু, আমি এক বোকাটে পেন্সিল নাকি?
অসুখ-বিসুখে সাদা খাতা পেলে, তাতে, সরলরেখাই দাগাই!



[বিঃদ্রঃ করোনা সিরিজ-এ অন্তর্ভুক্ত লেখাগুলা দিনলিপি জাতীয় কিছু নয় চলমান বৈশ্বিক করোনা-মারীতে, নিছক লেখা-খেলা'ই আর সব লেখাগুলার মতো। এখানে মালার্মে কথিত ‘ভাব নয়, কবিতার নির্মাণ হয় শব্দ দিয়েই’ এবং তার ঠিক বিপরীতে জার্মান কবি বার্নার্ড হেইনরিচ উইলহেম ভন ক্লাইস্ট কথিত ‘যেমন ক্ষিদের ভাবনা আমাদের খাবার প্রক্রিয়ার দিকে ঠেলে দেয়, ঠিক তেমনই কাব্যচিন্তা কবিতার সৃষ্টি করে। আর সেই কাব্যচিন্তার ভিত্তি পরিপার্শ্বিক ঘটনার বিষয়।’ —বক্তব্যদ্বয়ের মাঝখানে হেঁটে, ঘুরে ফিরে আমার কথাগুলা ভাষার স্নেহ আরজ করে যা পেলো সেইসবই তুলে আনা আরকি।

এই সমস্ত লেখায় ব্যবহৃত নতুন কিছু শব্দবন্ধ ও সিনট্যাক্স এর স্বত্ব সংরক্ষিত। কাজবাজে ব্যস্ত দিনকালে রাত জাগরণ ছাড়া আসলে লেখা বা শিল্প নিয়া কাজকামের(পাঠ/পরাপাঠ/পর্যবেক্ষণ/চিত্র-বিচিত্র অনুধাবনের নিমিত্তে আবশ্যক চিত্রনাট্য দেখাদেখি) সময় মেলে না বিধায় এদের(লেখাগুলার) নৈপথ্য সত্যিই বিধুর তবে ক্লিষ্ট নয়। করোনা সিরিজ বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতায় কি রকম কাজ তার হিসাব আমার কাছে নাই, এ আমার কর্তব্যও নয়। আমি প্রথম পাঠক এদের, যেভাবে আর সব লেখক। সময়কাল তীব্র যন্ত্রণায় গোঙরাচ্ছে, এর বেশি আর কিছু বলা গেলো না এই দফা। প্রার্থনা ও শুভ কামনা বাংলা ভাষাভাষী আত্মগত সকলের জন্য।]


এই লেখকের অন্যান্য লেখা:
• পাণ্ডুলিপির কবিতা: ‘করোনা সিরিজ’ পর্ব এক | সাজ্জাদ সাঈফ
• পাণ্ডুলিপির কবিতা: ‘করোনা সিরিজ’ পর্ব দুই | সাজ্জাদ সাঈফ
• সাজ্জাদ সাঈফের ‘ভাষার সি-বিচে’ হইতে দশটি কবিতা
• সাজ্জাদ সাঈফের কবিতাভাবনা, সাক্ষাৎকার ও ‘বহুদিন ব্যাকফুটে এসে’ বই থেকে কবিতা



সাজ্জাদ সাঈফ। কবি। জন্ম ১৯৮৪ সালে
যাত্রাবাড়ি, ঢাকা।
এসএসসি ও এইচএসসি ঢাকায় এবং শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়াতে। চিকিৎসা বিদ্যায় গ্রাজুয়েশন, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পাবলিক হেলথ বিভাগে পোস্ট গ্রাজুয়েশন (থিসিস পার্ট অন অ্যাডিকশন সাইকোসিস এন্ড ইটস ডিজিজ প্রোসেস ইভ্যালুয়েশন ইন এসপেক্ট অফ মেন্টাল হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার সেন্টারস ইন বগুড়া সদর এরিয়া)।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: ‘কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা’ (২০১৭), ‘মায়ার মলাট’ (২০১৯), ‘ভাষার সি-বিচে’ (২০১৯, ভারত), ‘বহুদিন ব্যাকফুটে এসে’ (২০২০)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ