TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

পাণ্ডুলিপির কবিতা: ‘করোনা সিরিজ’ পর্ব: এক | সাজ্জাদ সাঈফ


আমাদের সকল দরোজা

আমার বেঘোর অনিদ্রাকে প্রশ্ন করেছো তুমি
যেনো তার হয়ে খোলা চোখ জানে, চৈত্রের ইরি-ধান;
যেনো, শহরের দিকে এতোসব হর্ন, মিথ হবে একদিন!

আজ কিছু অদেখা জীবাণু এসে
আমাদের চারধারে ওড়ে, পৃথিবীকে নিরন্ন সাজিয়ে
সে’ও কিনা করতালি নেয়! আমাদের সকল দরোজা
লক করা অজানা আতংকে, চারদিকে সাইরেন-ডাক!

আজ তুমি প্রশ্ন করেছো
অনিদ্রা বিষয়ে, আর দেখো পতঙ্গ-স্বরূপে
করোনার নিকষ থাবায় কাঁপে, ফসলি-জমিন; এইসবে মনোযোগ দেই!

এর ধারে চতুর-মুখর যারা, আমি চাই থেমে যাক তারা;
থেমে থেমে দ্বিধার দেয়াল, আমাদের পৃথক করেছে মনে!

পৃথিবীতে দু’ভাগে মানুষ ভাগ হয়ে, ছড়িয়ে পড়েছে দেখো, একদিকে বহুবিধ ভোগ;
আর কিছু ভাবছে ত্রিকাল, এই জরা প্রাণাধিক যদি
তুমি কারে অনিদ্রা কও?


অসুখ দেখেছো পাখি?

অসুখ ধরেছে মানচিত্রে
আর শকুনের ডানা, উড়ালভঙিমা নিয়ে
পৃথিবীরে তাওয়াফ করে, দিনরাত

মুভির ভূতের মত আওয়াজ করে
চলে গেল অনতিদূর ট্রেনের বগি;


আমাদের কতো শত কথা
হাতে হাতে পরে আছে গ্লোভস, সংগত মনে, মুখে-মুখে মাস্ক


মনে হয় দুয়ার দুলিয়ে, ঘরে যেতে দেই চৈতালি রইদ
মনে হয় মানব-সভ্যতা, ভুল করে ফেলে গেছে মুখ
মুখর-মুখোশ পথে; আর, যেখানে মানচিত্রের কাটা ঘায়ে
কাটাতার পেয়ে এক কোকিল বসেছে উড়ে
মনে হয় জিগাই তাহারে ডেকে, অসুখ দেখেছো পাখি?

বলিকাঠে ঘাড় রেখে লিখতেছে সুর, কবিতা যাহারা
তাঁদের দু’পায়ে বেড়ী, এই বাসা-বাড়ি, সমাজ-পাহারা!


অসুখ দেখেছো পাখি? দেখেছো অসুখ নাকি?


যে কয়টা দিন বাঁচি

পাঁজর ঠুকরে মন শুধু বিস্ময়ের কলকাঠি নাড়ে
এদিকে সাগর, বুকে হার্টবিট, যেনো পুরা ভোর হতে না হতে
হৃদয়ে হেঁচকি তোলে প্রাচীন পাথর!

আর তুমি কাগজের নৌকা, এত জল কোথায় পেয়েছো!
এতটা হাওয়ামেলা পাল, কোথায় পেয়েছো তুমি?

এদিকে এসেছে ব্যাধি, করোনা বাহিত ধুলি
এদিকে পড়ন্ত রোদ, মেঘবর্তুল-

স্বপ্নকে আহত লাগে, মার্চ মাস এলে, কেউ বুকে ড্রয়ার হাতায়;
কেউ খুব চুপ, পায়ে পায়ে শূন্য বেড়ী, বাজারে বেড়েছে ভীড়!

এদিকে প্রস্তুত ব্যাধী, তার আছে গণ-দূর্ভোগ, ঈশারা অর্ধসত্যমুখী;
যে কয়টা দিন বাঁচি, এই নিরাশায়, ঘাম মুছে, শুকনো-সুবোধ বাঁচি!


ফ্যান্টাসি

আসেন ডুবতে ডুবতে ভাসি আমরা
এমন মানব জন্মের কৃপা
কয়জনে মনে রাখি বা রাখতেছি কন?
তারচেয়ে একটা সাতচারা খেলাখেলি বিকালরে ডাকি
মনে জায়গা আছে, অঢেল, যেমন জন্ম-বর্ষানুষ্ঠান
যেমন ইতালির ম্যাসাকার, আমরা অঢেল
আমরা উদ্বেল জাত!
আমাদের ফ্যান্টাসি নিয়া
চাল দেয় মাউন্টব্যাটেন
হাত নাড়ে, মাছিরে তাড়ায়, টাটা-বিরলা
ফলতঃ বাংলা-রায়ট, আমরা রায়টফেরত জাত
আমাদের করোনারি পালস নিয়া
করোনার প্লান নাই কোনো?
ডিয়ার বিকাল,
সন্ধ্যা হবার আগেই তুমি
নীল দ্রাঘিমায় জায়গা করে দিও আমারে

সেখানে অফুরন্ত নিঃশ্বাস আমি নিতে চাই হেসে
চারপাশে কেউ নেই ধরো, আমি এক বরফবিক্রেতার সাথে
একা একা হেঁটে যেতে পারি বরফ-বন্দী পাহাড়ের দিকে
ডিয়ার বিকাল, কুইক;
হাইরাইজ নগর ও নৈরাজ্যে পোড়া ঘাসে বসে, সন্ধ্যা হবার আগে আগে
চলে যেতে চাই, দ্রাঘিমা-দিগন্তে, এ'ই আমার ফ্যান্টাসি!


সকলই যে আন্ধার লাগে
(ডাঃ শরীফ আহমেদ, আলো-আঁধারের শিক্ষানবিশ স্মৃতি)

এই যে অন্যত্র, অন্য কোনো ঘরে
তোমারে খুবই ব্যস্ত দেখি আজকাল
হয়তো দেখি না অথচ ভাণ করে পড়ে থাকি রাস্তায়
সাত প্যাচ খাওয়া রইদের মত, যেনো দেখতেছি আমি
আজকেও তোমারেই, গায়ে ভায়োলেট নয় পিঙ্ক!
এই যে একটা বড়সড় আকাশ বুকে
গ্লোবটাও চুপ, হতচকিত; ঘাড়ের দিকে, করোনার নিঃশ্বাস টের পায়?
তুমি অতো সুখি নাকি 'রো'?
শ্রীকান্তের গান নাকি তুমি আজকাল?
অথচ শ্যাওলা দেখো সবুজাভ কালো রঙ
বুকের কুয়ায় মাইখা রাখে প্রত্যেকদিন
আমি ক্ষুধা-নাই মতো একটানা সাতদিন
কিছুই রাখি না বুকে, না-অনুভূতি, না-বিকলাঙ্গতা!
এই যে সাতটা দিন কাটে অমাবস্যায়
বাঁকি থাকে পাড়ার কলহ ভোরে, তুমি আজ
নামাজ পড়ছো, ফজরে?
আমি নাকি কর্কট-জাত, নিজেই অসুখ, তুমি কও 'রো'
এই খেলাখেলি কোনো অসুখ মানে? বজ্রপাতের নাকি ইতিহাস থাকে;
ভূমিধ্বস, তারও; আজকে করোনা, নিজে থেমে শোনে
কার মুখে তেলাওয়াত কার? সকলই যে আন্ধার লাগে, অতি লিপ্সার!


অমিতচয়নে মা

একদিন কলকাকলির দিকে
আমাদের কান পাতা ছিলো;
ভোর ছিলো চুলার কিনারে শতরঞ্জি, ঝাপসা দেয়াল;
বিশ্বাস করো মা
সমস্ত রাত্রির শেষে, সমস্ত অধ্যায় শেষ করে দেখি
জীবনের সাথে দেখা হওয়া-টওয়া, সকলই ভ্রান্তি আমার-
মিছরির দানাগুলা দেখো, পানির ভিতর হতে
ফুটফুটে ছেড়ে দেয়, বুদবুদ নিজে!
ও মা
আমারও তেমনই জীবন-
তেমনই পানি থেকে, আলাদা হতেছে যেনো অদৃশ্যের বুদবুদ!
মিথ্যার গরীমা থাকে
চরাচরে, কড়ি ও কর্মের ভিড়ে, নিজেকে ঘিরে, নিজেরই ভিতর!
আর থাকে লক ডাউন
দুয়ারে নিমের পাতা, ক‌ও না মা
অসুখের স্মৃতিরা আসে, তুমি যেনো স্বপ্নে ডাকো;

নিকটে করোনা এলো, আলোহীন-ভালোবাসাহীন
কোন সেই প্রান্তর হতে, স্লিপ খায় এসে, আমাদের গায়?


লাল-নীল মাস্ক

পাহাড়টি ঢালু হোক এইদিকে, আমাদের এতোসব গান
এইদিকে জুড়ে যাক গড়িয়ে-ছড়িয়ে, দূরে, দিনমজুরে!


অমাবস্যাও গাছের চূড়ায় বসে, তুলে নিক হাতে মেঘের গেলাস;
তোমাদের প্রস্থান খুব মনে মনে থাকে, খুলে দিই সমতল;
তোমাদের ফেলে যাওয়া সুরে, গুনগুন করে রেসকোর্স ময়দান-


ইতিহাস বোকা মেয়ে, ছেড়ে যায় তাঁকে একা সন্তের উদ্যান-
একদিন সেও যাবে মাটি ও মন্থরে মিশে, আমাদের মুখ থেকে
মুখোশেরা সরে গিয়ে লাল-নীল মাস্ক-


কাছাকাছি ছায়ার মানুষ
ততোধিক সরু হতে হতে
চোখের আড়াল হয়ে, ইশারা ও গ্লানির আকার
দীর্ঘ করে, ততোক্ষণে, বুকের ভেতর হতে
থানকুনিপাতা ছিঁড়ে নিচ্ছে কেউ!


করোনা-ত্রিশূলে বাঁধা

যখন পৃথিবীর বিকালটা স্বর্গ থেকে আসে আর দূরত্ব
পৃথক হতে পৃথকতর হয়, পাখি-ঠোঁটে শিস তুলে দেয়
ভুট্টা ও বিবিধ জোয়ার

তোমার ভিতর যদি ঝড় থাকে
আমাকে ছিটকে ফেলো, সেই তুফানি বাতাসে;
কেননা যখন অন্দর গলিয়ে ঘরে আসে প্রেম
তখনি হাওড়-পাড়ে ধবধবে কাশফুল, একলা পলাশ
জড়ো করে লালচে আকাশ বুকে, তখনি শরত ডাকে!

তারপর তুলে রাখি সেই গুঞ্জন, সেতারে
এসবে বিজয় নাই, নাই কোনও নাট-মন্দির খোলা
আমি শুধু পরাজিত হতে চাই, তোমার পলকে ধুলি

আমি শুধু করোনা-ত্রিশূলে বাঁধা
দিগন্ত সারাতে চাই, প্রেমে-পদ্যে
এর বেশি জানা নাই ওষুধ-বটিকা কারো!



তাৎক্ষণিক ভূমিকা:
করোনা সিরিজটি ব্যক্তিজীবনের আলাপমাত্র যেন না হয়ে থাকে সেই চেষ্টা চলমান, এইখানে নির্মিতি নিয়ে সূক্ষ্ম কিছু নতুন কাজ ধরে রাখতে চেয়েছি আসলে, কাজটি ক্রমশঃ, এইখানে যে কবিতাগুলি থাকলো সেগুলি বিশেষ কোনো ফরমাশ মেনে আগায়নি। তাৎক্ষণিক কিছুও নয়, নির্মাণ এইখানে সময় আদায় করেছে আমার মস্তিষ্কের সঞ্চালন হইতে হৃদয় অব্দি হেসে গেয়ে আতংক পুষে ও স্মৃতিদৃশ্য সহযোগে...



এই লেখকের অন্যান্য লেখা:
• সাজ্জাদ সাঈফের ‘ভাষার সি-বিচে’ হইতে দশটি কবিতা
• সাজ্জাদ সাঈফের কবিতাভাবনা, সাক্ষাৎকার ও ‘বহুদিন ব্যাকফুটে এসে’ বই থেকে কবিতা



সাজ্জাদ সাঈফ। কবি। জন্ম ১৯৮৪ সালে
যাত্রাবাড়ি, ঢাকা।
এসএসসি ও এইচএসসি ঢাকায় এবং শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়াতে। চিকিৎসা বিদ্যায় গ্রাজুয়েশন, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পাবলিক হেলথ বিভাগে পোস্ট গ্রাজুয়েশন (থিসিস পার্ট অন অ্যাডিকশন সাইকোসিস এন্ড ইটস ডিজিজ প্রোসেস ইভ্যালুয়েশন ইন এসপেক্ট অফ মেন্টাল হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার সেন্টারস ইন বগুড়া সদর এরিয়া)।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: ‘কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা’ (২০১৭), ‘মায়ার মলাট’ (২০১৯), ‘ভাষার সি-বিচে’ (২০১৯, ভারত), ‘বহুদিন ব্যাকফুটে এসে’ (২০২০)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ