TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

সাজ্জাদ সাঈফের ‘ভাষার সি-বিচে’ হইতে দশটি কবিতা


ভাষার সি-বিচে



আমার হাসিতে মরমিয়া নাই, মুখে নাই সবুজ চিহ্ন, আমার কাজকাম দশাসই নক্ষত্রের নিচে কেমন চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে আছে, আমি শুধু হাওয়ার ভিতর হাওয়ার অভিকর্ষ টের পাই আর সেই হাওয়ার গিট্টুগুলার ওপর কথা বসায়া দুটা লাইন লিখি; এইভাবে জন্মাবধি, উবুত হয়ে, সরীসৃপের বুকের দাগ দেখতে দেখতে সমাজের কপালে ভাঁজ ফেলে আসছি আমি, এখানে, বিষে পুড়ছে লখিন্দরের রগ, মেঘে নিখিল নিনাদ, দ্বিবীজপত্রী গাছে হেলান দিয়ে এতসব তুমি দেখতেছো; আমাকে প্রার্থনার মতো একা আর রক্তের মতো টগবগ করে গেছে এজিবি কলোনীর হাঁস- তার সাঁতার, তার অবিশ্রান্ত ডাক আমার মগজে মাহফিল করে;
বিষণ্ণ শালদুধ পেয়ে আমার কন্যার ঠোঁট দুইটা হইছে দেখার মতো, এইভাবে একটা তামাটে মুখমণ্ডল নিয়া তারে চুমু খাই। আমি জানতাম না ইথারে সব কিছু থাকে, তুমি আমারে নিয়া কিসব বলে বেড়াচ্ছো আজকাল! পাতাকে ঝরে যেতে দিয়ে হাওয়া খায় আনারের কোয়া, হাই তোলে, গ্যাস ফুরায় যাওয়া সিএনজি; আমার হাঁটা চলা তোমার অসমান পৃথিবীরে কটুক্তি করে না কখনো, আর আমি তো নিজেকে সাজাতে না শেখা একটা মানুষ, আমি দর্শনীয় নই, সুখপাঠ্য নই; অতো হাইট আমার নাই! একটা খুলিহীন পাগল এসে দরজা ধাক্কায়, এরকম করে শহরটারে ডেকে ডেকে কবিতা শোনাতে গিয়ে অর্থাভাবকে ঘরে তুলে আনি, জনশ্রুতিকে পেছনে ফেলে শুকায়া যাচ্ছে করতোয়া, পাখার নিচে একটা বুলেটক্ষত নিয়ে পঞ্চায়েতের সামনে দাঁড়ায় আছে পিঞ্জিরা- আমি জানতাম না ইথার শক্তিমান, মায়ের বলা সিনডারেলার জুতার গল্পটা এখানে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে!

তোমার আত্মার সমস্ত ঘাস, ভাঙন কবলিত মানুষের মুখটা সবুজ করবে, এই ভরসায় খালি পায়ে এদিকে চলে এসেছি- কোনো আমন্ত্রণ ছাড়াই বাংলা ভাষায় ভজঘট করছি, মাস্তানী করছি স্বরবর্ণের! এইদিকে আলোরে টাইনা নামাচ্ছে রোদ; আর নিউজরুমে তোমরা সেসব এডিট করতেছো, করো!




এখানে ফুলের আছে পরিচিত নদীর হাওয়া-
ছায়ারা এমন যেনো, মেঘ পেয়ে থেঁতলে-যাওয়া
হলুদ পাপড়িগুলো, ধার নেয়া ব‌ইয়ে জমানো
বাবার চোখের নীচে, নাও এসে থাকুক সাজানো!

রেণুকে উড়িয়ে দিয়ে জাড় ডাকে নিওরপ্রতিভা
জিয়ানো মাছের মতো, চোখ খোলে দূরের শহরে
ডেকে আনে রেলগাড়ি, সাইরেন ও অনেক ধাঁধা
এখানে শূন্যতা যায়, ঢেকে যায় শ্যামল চাদরে!

রক্তে লুকানো আছে শোকাহত রঙের আগুন
বাসনাকে চাষ করে পাঠকের বিরল করোটি
কার্নিশে উঠেছে নাকি জোড় বেঁধে মোরগমিথুন?
হাড়ের ভিতর ড্রামা, মালা গাঁথে শীতের ভ্রুকুটি!

হাড়ের ভিতর হাড়, একনায়কের হাসি
পোশাকে ধানের চিটা, ভাষার সি-বিচে আছি-
এসব‌ এমন যেনো উদাস কবিতা এসে
এগিয়ে দিতেছে পাতা, রাষ্ট্রকে বধির দেখে;
রাষ্ট্র কি ছাগল নাকি? বাগানে ঢুকেছে কারো?
মগজে আগুন জ্বলে, দৃশ্যটা বদল করো!




সিঁথিতে গোধূলি নামে, তাতে এক জামবন আঁকো
সিঁথি বুঝি মাইগ্রেন পোষে? মাথা খোঁড়ে ব্যাথার শাবল?
তুমি আছো তমসাপ্রবণ, মেঘ পেয়ে ভেসে যায় সাঁকো
দূরে চর, উষরতা জানে? প্রেম নাকি দূরত্বে উজ্জ্বল?

প্রেম এক সুফলা প্রার্থনা, ঝাঁক বেঁধে পরিযায়ী পাখি আসে
শরীরে অপেরা কারো, কারো থাকে চিরকুট দুই চোখে;
অসুখের সঙ্গে কথা হয় সারাদিন, কতো কথা থাকে প্রতিবেশিনীর সাথে;
চাক বেঁধে হাসপাতালের গাছে, ভ্রমর কোথাও রৌদ্র ভ্রমণে গেছে!




হরিণ ডোবানো ছায়া, কুয়াশা এবারে নাই; নাই কারো ভীরু চোখ চেয়ে
আলের ওপর ধান খেতে আসা ঘুঘু, খাল পারি দিলে বকুল ফুলের ঘ্রাণ
ছোট হয়ে আসে মাছরাঙাটির চোখ, অতল গড়িয়ে পোনামাছ পানি বেয়ে
রপ্ত করছে মেঘে তাকানোর স্বভাব, রপ্ত করে ফুলকা রচিত গান-

কলমি ডাঁটায় চুপ করে আছে ঝিঁঝিঁ, কোথাও তাহার তাড়া নাই উড়বার
পৃথিবীকে এক ট্রাভেলার মনে হয়, এসে এখানে থমকে গিয়েছে এবার
যেনো পারাপার তিতিক্ষাকে ডাকে, মূর্ত সবুজ প্রতিশ্রুতির ধারায়
এসে এখানে চাতালগামী হাওয়ায়, মন্থরতা, হিংসা ও মশকরায়-

তোমার কাছে বৃত্ত মানে গোলক
আমি ভাবছি তালপাখাটির কথা
ঘুরে ঘুরে হাওয়া, ঘুরে ঘুরে নিঃশ্বাস
জন্মদাগের ওপর ঝরছে পাতা!




আমি সাগরপাড়ে গিয়ে একলা দাঁড়ালে পানিছোঁয়া লিরিকাল লাগে, পাথরে নীল নকশা কাটে শ্যাওলা- রোদ খাঁড়া এসে যেটুকু নেমেছে, ততো নীচে ডুবে ভাব করে দুটি মাছ, ঘাড় সোজা করে তাকায় ওপরে, তাদের আছে ইকোবন্ধন-
চোখে পড়ে কৃর্তীতে সাজানো সমাজ, কতো কথা ছিলো আমাদের;
তুমি গেছো উষরতা নিয়ে, মৃত্তিকা সবুজ এখানে;
তোমাকে ধরতে গেলে স্মৃতিকে বেঁকে যাওয়া সাঁকো মনে হয়, প্রচন্ড কুয়াশা;
যেনো হাত বাড়ালেই টিলা, স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে আমাদের চোখ;
এতো ভোরে, জানালায় উজানী বাতাস!




একদিন দুঃস্বপ্নের সাপের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে তোমারও, পৃথিবীর সমস্ত বাগান শীতে জীর্ণ, তুমি জানো কাতরতা কাকে বলে, তুমি জানো হুমড়ি খাওয়া ঘুড়িরা এসে আটকায় তোমাদের ছাদে-
এই যে সংসার ও সংস্কৃতি একে অন্যের; ডালে রোদের মতো ঝলসে যাচ্ছে, প্যাচ খাচ্ছে সমানে, আর, আকাশে নীল নীল মেঘ থুতনি উঁচানো ড্রাগনের মতো বেঁকে দেখছে জগত-
এখানে, শিশুদের বুকে নিউমোনিয়া, গাঢ় হয়; তুমি এও জানো এ চিত্র সদ্য আঁকানো কারও, যে থাকে অতল অঙ্গারে, বহুদিন তারে নাম ধরে ডাকছি না আমি-
দাঁড়ের নিকট এসে, থমকে আছে ঢেউ; নদীবুক তবু কি ভরাট, শীতপাখিময়!




দ্বিধা, পরমার্থের কাছে হেলে আছে, দ্বিধা নৈমিত্তিক, যেমন শ্যাওলার ওপর একটি ব্যাং ভাবছে সাঁতার; কুয়াশার ভিতর একটা সার্কাসের ঘর দেখা যায়, এখানে বিশাল ময়ূরী সারাদিন ব্যাঙ্গ করে হাঁটে, ঘাড় ডুবিয়ে তাকায় সাপেরা!
দ্বিধার মধ্যে অর্ধ গোলাপ ফোঁটে, জরার মধ্যে স্মৃতি; সুর কেটে কেটে ছোট হয়ে আসে গান, তোমাকে চর্চা করি আমি- যেভাবে অর্ধেক কবিতা পড়ে চাপা দিয়ে রাখছি বইয়ে, খাঁচার ভিতর চাঁদের আলো আসে!




ফিরে যাওয়া
এই অবিশ্রান্ত বর্ষণ ফেলে;
পড়ার ঘরে শান্ত বিড়াল প্রবেশের মত ক্যামন ইল্যুশনময় লাগে!
ফিরে যাওয়ার জন্য এট লিস্ট একটা ছাতা দরকারে লাগে, কদম ফুলেরও লাগে খোঁপার স্নেহ কারোর!
বৃষ্টি, প্রবাসী ক্লাসমেট নাকি তুমি?
এতটা আপন কেন লাগে?





কোথায় গ্রীষ্মের গোলপাতা? কোথায় গিয়ে হাঁটছে শামুক? সমস্ত প্রশ্নকে গলায় আটকে যেতে দেখে একগ্লাস পানি নিই! হরীণি থেমেছে একা, তার খুরে ধাক্কা খায় বিপুল আঁধার, মনে হয় আয়না ধরে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ, তোমাকে দেখা যায়, স্পর্শ করা যায় ।



দোচালার ঢেউটিনে আছর গড়িয়ে নামে, মেঘে পিছল খায় সূর্যস্নেহ
এসব‌ই গণিত, গান বাঁধা, পাতা ওড়ে, তোমার কি এই দিকে ঘর?


১০

তারপর একদিন
উইপোকা হেঁটে যাবে, আমার কবরের ওপর;
সরু তৃণ ঘাসেরা একে অপরের গায়ে হেলে পড়বে, তুমুল বাতাসে;
তোমাকে যে কথা বলা হলো না, হবেও না হয়তো কখনো,
সে কথা তুমি টের পেয়ে যাবে সেদিন!
আমাকে আরেকবার ছোঁবে নাকি তখন, বন্ধু, ছুঁতে পাবে তো?


সাজ্জাদ সাঈফ। কবি। জন্ম ১৯৮৪ সালে
যাত্রাবাড়ি, ঢাকা।
এসএসসি ও এইচএসসি ঢাকায় এবং শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়াতে। চিকিৎসা বিদ্যায় গ্রাজুয়েশন, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পাবলিক হেলথ বিভাগে পোস্ট গ্রাজুয়েশন (থিসিস পার্ট অন অ্যাডিকশন সাইকোসিস এন্ড ইটস ডিজিজ প্রোসেস ইভ্যালুয়েশন ইন এসপেক্ট অফ মেন্টাল হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার সেন্টারস ইন বগুড়া সদর এরিয়া)।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: ‘কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা’ (২০১৭), ‘মায়ার মলাট’ (২০১৯), ‘ভাষার সি-বিচে’ (২০১৯, ভারত)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ