TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

‘কয়েকজন গদ্যশিল্পী নিয়া কবীর রানার লগে আত্মজৈবনিক’ বয়ান: ০৪ | শিমুল মাহমুদ


বয়ান: ০৩ -এর পর:

কবীর বলছিল সে কোথাও তার লেখা ছাপতে দিতে চায় না, কারো পেছনে ঘুরতে চায় না, সরাসরি বই; পৃথিবীর অজস্র ভালো বই সরাসরি প্রকাশ পাচ্ছে। আমি বলছিলাম, ঠিক আছে সেক্ষেত্রে বাইরের দেশের প্রকাশনাগুলো প্রচার অর্থাৎ পাঠকের কাছে উপযুক্ত তথ্য পৌঁছে দেবার দায়িত্ব পালন করে থাকে। আমাদের দেশে পাঠক কীভাবে জানবেন যে তোমাকে পাঠ করতে হবে, কীভাবে বুঝবেন কোনগুলো পাঠ করলে তিনি ঠকে যাবেন, ভুলভাল পাঠের ভিতর নিজেকে অপচয় করবেন। তা হলে তোমাকে জানার জন্য তো উপযুক্ত প্লাটফর্মে তোমার লেখা উপস্থাপন করতে হবে, জানার সুযোগ দিতে হবে; অন্তত কবীর রানা যে পাঠযোগ্য এইটুকু জানানোর দায়িত্ব কে নেবে? লেখক আর পাঠকের মধ্যে দূতিগিরির দায়িত্বটা আসলে কার?
এই যে তোমার বইয়ের ফ্লপিতে লেখা আছে, ‘কবীর রানা [জ.১৯৬৮] শূন্যদশকের গল্পকার। সিরিয়াসধর্মী লেখার প্রতি আগ্রহী। তাঁর গল্পের স্বর নিজস্ব। গল্পকথনের ধরন এবং বুননরীতিতে তিনি খন্ড খন্ড অসংখ্য ঘটনার সমাবেশ ঘটিয়ে আখ্যানের প্রেক্ষাপট বিস্তৃত করে দেন; যেখান থেকে পাঠক প্রয়োজনানুসারে ঘটনাগুলোকে নিজের মতো করে সন্নিবদ্ধ করে নিতে পারেন। তিনি সাধারণত ঘটনার ধারাবাহিক বিবরণ বা বিবৃতি দেন না; আপাত বিচ্ছিন্ন ঘটনা অথবা চিন্তারাজির অভ্যন্তরীণ ঐক্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে কবীর রানার গল্পদেহ। তাঁর গল্পের ভাষা-রীতি সংহত এবং প্রয়োজনমাফিক পরিমিত। ছোট ছোট বাক্যে কখনো-বা দীর্ঘ বাক্যবন্ধে তিনি ঘটনার এতোটাই ঘনপিনদ্ধ বর্ণনা করেন, যা প্রায়শই কাব্যময় হয়ে ওঠে। কবীর রানার গল্পে বিষয়-বৈচিত্র্য যেমন আছে তেমনি গল্পের কলেবরে উঠে আসা চরিত্রগুলোর আছে বাস্তবতা। তবে তাঁর গল্পের পাত্রপাত্রীরা প্রায়শই পরাবস্তবতা এবং জাদুবাস্তবতার জগতে পরিভ্রমণ করে। আনবিক পৃথিবীতে মানবসভ্যতায় যন্ত্রনির্ভর অমানবিকতায় আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ব্যক্তির যাপিত জীবনের পরিবৃত্তে রানা গল্পের বিষয়-উপাদান আবিষ্কার করেন এবং সচেতন দক্ষতায় তা শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় মূর্ত করে তোলেন।’
প্রশ্ন হল, এই কথাগুলোর ওপর আমরা ভরসা রাখবো কীভাবে? আমাদের তো তোমাকে পাঠের সুযোগ দিতে হবে; পাঠের পর যদি দেখি এইগুলো তোমাকে নিয়ে অতিকথন তাহলে তোমার ওপর আমাদের ভরসা থাকবে না। সবার মতো তুমিও হয়ে উঠবে বাকোয়াজিদের একজন। এহেন পরিস্থিতিতে একজন লেখকের পক্ষে স্পর্ধা নিয়ে নিজের চরিত্র স্টাবলিশ করা টাফ। সেই লড়াইটা আসলে চলতে থাকে তার লেখায় এবং সেই লেখা নিয়ে সমকালে যথার্থ জায়গাগুলোতে যথার্থ আওয়াজ থাকা উচিত।

মামুন হোসাইনের প্রসঙ্গ উঠে এলে, আমি তো মামুন ভাইকে নিয়ে লিখেছি, হুমায়ূন মালিককে নিয়ে লিখেছি; বাংলাদেশের সিরিয়াস ধারার গল্পকারদের নিয়ে আমার একটা আলোচনা ছিল, সেখানে অনেকের পাশাপাশি জাকির তালুকদারকে নিয়েও কথা বলেছিলাম। মামুন ভাই সিরিয়াস ধারার রাইটার। আমার বন্ধু জাকির তালুকদারও বিস্তর লিখেছে, তবে গতকাল ফেসবুকে জাকির ‘একটি রাবীন্দ্রিক ভ্রমণকাহিনী’ শিরোনামে গল্প পোস্ট দিয়েছে। এইটা নিয়া তার নিজেরও সংশয় ছিল, যার জন্য পোস্টের উপরে থার্ড ব্র্যাকেটে লিখে দিয়েছে, ‘গল্পটা পড়তে রুচিতে বাধলে সেখানেই পড়া বন্ধ করে দেবেন প্লিজ!’ এত নিম্নমানের লেখা জাকির কেন পোস্ট দিয়েছে বুঝতে পারলাম না। কেননা ও কিন্তু প্রথম দিকে বেশ কিছু সিরিয়াস ধারার গল্প লিখেছে। ওকে আমরা যারা পাঠে রেখেছি তাদের কাছে ওর লেখালেখির ক্যারেকটারটা সে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি; অনেকের মতো বাজারের দিকেই তাকে হাঁটতে হয়েছে।

যাই হোক জাকির তালুকদারের লেখার ভাষা আমার কাছে মনে হয়েছে গত শতকের আর মামুন ভাইয়ের ক্ষেত্রে মনে হয়েছে এগিয়ে থাকা শতকের। তারপরেও ভাষাসৃজনের ক্ষেত্রে মামুন হোসাইন সারাজীবনে একটি মাত্র গল্পই লিখে চলেছেন। তার লেখার ফর্ম, চিন্তা ও ভাষার গণ্ডী থেকে কিন্তু তিনি বের হতে পারেননি। কবীর রানা, তোমার লেখাও এগিয়ে থাকা শতকের কিন্তু মামুন ভাইয়ের মতো তুমিও আটকে আছো নিজের তৈরি একটি নির্দিষ্ট ভাষার জালে। তুমি কি মনে করো তোমার প্রতিটি বইয়ের মধ্য দিয়ে প্রতিটিকে তুমি অতিক্রম করে গিয়েছো?

কবীর রানা এর উত্তরে বলেছিল, লেখকরা তো এইভাবে নিজের ভাষাটাই সারাজীবন ধরে খুঁজতে থাকে, সেটাই তো তার মোক্ষ। ওর অভিমত শুনে স্পষ্ট করেই আমি বলে উঠেছিলাম, না আমি তা মনে করি না, আমি মনে করি প্রতিটি গ্রন্থের মধ্য দিয়ে একবার করে একজন লেখক নিজেকে অতিক্রম করে, সেখানেই তার মোক্ষ। তুমি কি বলতে চাও কমলকুমার মজুমদার ‘অন্তর্জলী যাত্রা’য় আটকে গিয়েছিলেন? না তার ‘সুহাসিনীর পমেটম’কিন্তু ‘অন্তর্জলী যাত্রা’কে অতিক্রম করেছে; তার ছোটগল্পের প্রত্যেকটির মধ্য দিয়েই তিনি নিজেকে অতিক্রম করেছেন।

যাই হোক, হাসান আজিজুল হক নিরীক্ষায় নন বরং প্রচলের ভিতর দিয়েই ভাষার সম্ভাবনাকে বাজিয়ে দেখে সফল হয়েছেন; প্রচলিত ধারার পাশাপাশি সিরিয়াস ধারার গল্পেও তিনি আমলযোগ্য। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস গল্পে তেমনভাবে সিরিয়াস না হলেও গল্পের মধ্য দিয়েই কিন্তু তার উপন্যাসের ক্ষেত্র, ছক, ভাষা-পরিকল্পনা তিনি নির্মাণ করে নিয়েছিলেন। আখতারুজ্জামানের চেয়ে কায়েস আহমেদ শক্তিশালী গল্পকার। যাই হোক ইনারা সবাই কিন্তু ভালো লিখেছেন, কিন্তু মনে রাখতে হবে ওইগুলো সবই গত শতকের গল্প; আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে এই শতকের কথাসাহিত্য, আগামী শতকের ভাষা।

আবার একথাও ঠিক ইনতেজার হুসাইন বা ওরহান পামুকের মতো রাইটাররা গত শতকের ভাষায় আখ্যান বয়ান করলেও তাদের কনটেন্টে রয়েছে চিরায়ত মশলা; যার ফলে তাঁদেরকে ভাষার জন্য হাপিত্যেশ করতে হয়নি বরং বিষয়ানুসারি ভাষার হাত ধরে, কিংবদন্তি মিথ আর ফোক বিলিভের হাত ধরে তারা মোক্ষে পৌঁছে গিয়েছেন। আবার পাওলো কোয়েলহো থ্রিল লিখেও কীভাবে উপযুক্ত চিন্তাকে আখ্যানের ভিতর চালান করে দিয়েছে সেই টেকনিকটাও কিন্তু আমলযোগ্য। আর বর্তমান বিশ্ববাজারে এই ধরনের চিন্তানির্ভর থ্রিলের বেশ কাটতি। বাংলা ভাষায় চিন্তানির্ভর থ্রিলের কাজ তেমন চোখে পড়ে না। অবশ্য মাসরুর আরেফিন চেষ্টা করেছে।

যাই হোক গত শতকের ভাষার ওপর ভর করে আখ্যানবয়ান, ওইসব কাজ তো হরহামেশা হচ্ছে, এইগুলা থেকে তোমাকে আমি পৃথক করবো কীভাবে? এইটা তো বুঝতে হবে। তোমাকে পৃথক করতে হলে, তোমার এগিয়ে থাকা ভাষার সঙ্গে চিরায়ত চিন্তার মিলমিশে তোমার বয়ান আমাকে যেইখানে নিয়া আছড়ে ফেলবে, সেই জায়গা থেকে আমি তাকায় দেখবো আসলে তুমি কী বলতে চাও; তোমার বয়ানকৌশল তোমার চিন্তার জগতটা খুঁজতে বাধ্য করাবে আমাকে। এইখানে তোমার ক্ষমতা। এই খানেই লেখকের ক্ষমতা। না হলে বহুত তৃতীয় চতুর্থ পঞ্চম শ্রেণির স্টরি-রাইটার, ফিকশন রাইটার, থ্রিল রাইটার আছে তারা অনেক শক্তিশালী, তারা পাঠকদের কিনে নিয়ে বেকুব বানিয়ে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবার ক্ষমতা রাখে, এইগুলা তাদের মজ্জাগত। এক্ষেত্রে বলবো মাসরুর আরেফিনকে কিন্তু পৃথক ভাবেই চেনা যাচ্ছে; তিনি তার জায়গায় বাংলাভাষার ফিকশনে কিছুটা বলবো না বরং অনেকটাই পৃথক।

মাসরুর আরেফিনের ‘আগস্ট আবছায়া’পড়তে গিয়ে আমার সমকালিন ডাচ লেখক মার্সেল মোরিঙের কথা মনে এসেছে। দর্শন আর থ্রিলের সমন্বয়, সেইসাথে পাঠককে আটকে রাখার এক ধরনের উপরচালাকি। সিরিয়াস পাঠক যখন এই চালাকিটা বুঝতে পারে তখন আগ্রহ থিতু হয়ে আসে। যেভাবে ‘আগস্ট আবছায়া’র শেষাংশটুকু গোটা উপন্যাসটিকে ক্রমশ সিরিয়াস চিন্তনের জগৎ থেকে টেনে নামিয়ে আনে সাইন্স ফিকশনের জগতে। অথচ আমরা কিন্তু সাইন্স ফিকশন বা স্পাই-থ্রিলার পাঠ করছি না; পাঠ করছি পূর্বঘোষিত অবশ্য পাঠ্য সিরিয়াস উপন্যাস। যা লিখে নাকি মাসরুর আরেফিন বাংলা সাহিত্যের পাপমোচন ঘটিয়েছেন। বিজ্ঞাপনে এরকম অনেক কিছুই বলা হয়েছিল।
ইয়েস্তেন গার্ডার দর্শনকে আখ্যানে রূপ দিতে গিয়ে সোফিস ভার্ডেনের শেষে এসে অবশ্য এমনটি করেছিলেন। সমকালিন বিজ্ঞাননির্ভর দর্শনাশ্রিত থটকে সিম্বল হিসেবে বিষয়যৌক্তিকতার আশ্রয়ে শতভাগ বৃদ্ধি করে পাঠককে ভাবাতে বাধ্য করানোর স্বার্থে লেখক এমনটি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ ধরনের কৃৎকৌশলের সাথে বাংলা ভাষার পাঠক-লেখক অনেক ক্ষেত্রেই অভ্যস্ত নন। এখন প্রশ্ন হল, মাসরুর যেভাবে প্রস্ত থেকে শুরু করে কাফকা পর্যন্ত চেতনার জগতে খাবি খেয়েছেন সে অর্থে ‘আগস্ট আবছায়া’কতটুকু মর্যাদায় পৌঁছিতে পেরেছে? এটা নিয়ে যে মাসরুর ভাবেননি এমনটি নয়, কেননা তিনি জেনে বুঝে প্রিপারেশন নিয়েই লিখতে এসেছেন।

বাংলা ভাষার লেখকদের ভিতর সচরাচর দেখা যায় এমন এক অহঙ্কার যাকে ছাপিয়ে প্রকাশ পায় এক ধরনের কাঙালেপনা। অবশ্য যে কাঙালেপনা লেখকদের কুটকৌশলনির্ভর রাজনীতির আড়ালে লুকিয়ে থাকে। হাসান আজিজুল হকের সাথে মাসরুরের পার্থক্য হল, হাসান আজিজুল হকের লেখায় ওই রাজনীতিনির্ভর কাঙালেপনার ছাপ অপ্রকাশিত থাকে, আর মাসরুরের লেখায় তা অনেকটাই প্রত্নপ্রতীমাতুল্য প্রকাশিত। এটা কি আর্কিটাইপকৃত জটিলতা?

থাকতেই পারে কিন্তু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হল এই ছাপ কতটা নান্দনিক? প্রশ্নটা কৃৎকৌশলের ক্ষেত্রে আমলযোগ্য। যার জন্য লেখককে দর্শননির্ভর সিরিয়াসনেসের পাশাপাশি পাঠক-আটকাবার নাটকীয় লিবিডোর দিকেও সমান নজর রাখতে দেখা যায়; দেখা যায় থ্রিলারঘেঁষা ইমেজের প্রতি পক্ষপাত। এইগুলান ভয়ানক রকম রিক্সি। মাসরুর রিক্স নিয়েছেন। তবে সব ক্ষেত্রেই কি উৎরাতে পেরেছেন? আমাদের এ প্রসঙ্গে অবশ্যই বিনয়ের সঙ্গে, বিবেচনার সঙ্গে মনে রাখতে হবে হাসান আজিজুল হক আর এ সময়ের মাসরুর আরেফিন একেবারেই ভিন্ন মেরুর লেখক। অন্তত আঙ্গিকে তো বটেই এমনকি সমকালনিয়ন্ত্রিত সংটাশ্রিত দর্শনপ্রকাশের ক্ষেত্রেও। এবং সেক্ষেত্রে ভাষাশাসনের প্রশ্নেও তারা পৃথক হতে বাধ্য। এটা সম্ভব হয়েছে ক্রমপ্রসারিত কর্পোরেট সোসাইটির কারণে। যে সোসাইটিকে হাসান আজিজুল হকের পক্ষে জেনারেশন গ্যাপ তথা বয়সজনীত কারণেই রিড করা সম্ভব নয়। এ অর্থে মাসরুরদের জন্য এখন লেখার যে জগত তা হাসান আজিজুল হকদের জন্য নয়। হাসান আজিজুল হকদের ঘরানায় তিনি হিম্মৎওয়ালা স্পার্কিং রাইটার হিসেবে নানাবিধ কারণে বিবেচিত হয়েছেন; তাঁদের সীমানায় তাঁরা নমস্য। কিন্তু বাংলা ভাষার সম্ভাবনা তো আর এক জায়গায় আটকে থাকবে না। তো তারপরও আমাদের এ অবস্থায় ভাবতে হচ্ছে আচেবে, মার্কেস, পামুক, বোর্হেজ, য়োসা, হারুকি এ রকম অনেক অনেক বিগ-বসদের নিয়ে। সে যাই হোক ভিন্ন ভাষায় এমন অনেকেই আছেন যারা সিরিয়াস রাইটার হয়েও নিজ দেশে এবং ভিন্ন ভাষায় বহুল পঠিত। অথচ বাংলা ভাষায় সিরিয়াস রাইটাররা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনেকটাই অপঠিত। এর একটা কারণ হতে পারে, প্রথাগত প্রত্নঅভিজ্ঞতার প্রতি আমাদের দীর্ঘমেয়াদি দাসত্ব। আরেকটা বাস্তবতা হল আনুপাতিক হারে আমাদের পাঠকদের পাঠযোগ্যতার, পাঠশিক্ষার, দর্শনচেতনার সীমাবদ্ধতা।

তো অধিকাংশ পাঠক যদি তরল বিনোদনাশ্রিত লেখা পছন্দ করেন, সেই লেখাগুলো জনপ্রিয় হবে এটা রিয়েলিটি। তারা সুবিমলমিশ্র, শহীদুল জহির, কমলকুমার, সতীনাথ, অমিয়ভূষণ, দেবেশ রায় বাংলা ভাষায় এরকম কয়েক ডজন লেখকের নাম বলা সম্ভব তাদের লেখা পাঠ করে বিরক্তবোধ করেন; এমনকি যারা লেখক হবার মোহে পাঠযোগ্যতার প্রয়োজনবোধ করেন তারাও অনেক ক্ষেত্রেই ওই পর্যায়ে গিয়ে বিমর্ষবোধ করেন। এইটা পাঠকের দোষ না। তাদের চিন্তার জগৎ যদি সহজ, তরল ও বিনোদননির্ভর হয় তাইলে এমনটাই বাস্তবতা।

সমস্যা হল আমি বিনোদননির্ভর জনপ্রিয় ধারার বিখ্যাত লেখা পইড়া বিরক্তবোধ করি। তাই বইলা কি এইগুলাকে বাতিল মাল বলবো? আমার জবাব, না তা বলবো না। এইগুলার বাজারদর বেশি। এইগুলাকে আমি আপনে আটকাইবার পারবো না; বা আটকাইবার কে? যার যার লেবেলে সে সে লিখবেন আর যার যার লেবেলে তিনি তিনি পড়বেন। কিন্তু প্রশ্ন হইল আমি টাফ এবং ডিফিকাল্ট পাঠক। সমাজ যেইগুলারে চায় আপনেরা সেইগুলারে প্রমোট করবার চান; বাট আমার পঠনপ্রক্রিয়ার লগে মিশ না খাইলে ওইগুলা নিয়া বাকোয়াজিতে আমি বিরক্তবোধ করি।

আইডিয়া আর আখ্যান যদি ভাষায় মিলমিশ খায় তাইলে ওইটা এক ধরনের আর্টিফিসিয়াল অ্যারেন্জম্যান্ট হইতে পারে, তারপরও তা হইতে পারে ক্লাসিক। ত্রয়োদশ শতকের অ্যালিঘরি দান্তেও তার ‘লা ডিভাইনা কমেডি’  আরটিফিসিয়াল অ্যারেঞ্জ থেকেই ক্লাসিকে উন্নীত করেছিলেন। মাসরুর অবশ্য এইখান থাইকাও টেকনিক শিখেছেন, কৃৎকৌশল কম্পোজিশনের মেধা তার আছে; কিন্তু ওইটা আমার বিবেচনায় ঠিক মতো পালিশ হইবার পারে নাই। প্রশ্ন হইল, কোন জায়গাগুলা পালিশড স্পার্কিং হইতে পারে নাই? যেই জায়গাগুলোতে লেখকের প্রধান চরিত্রের প্রতি এক ধরনের দায়বদ্ধতা থেকে তিনি এক ধরনের জেটলগে আক্রান্ত হয়েছেন, সেই জায়গাগুলো। লেখকদের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় সিরিয়াসনেসের কারণে এমনটি হয়ে থাকে। এইগুলান চিহ্নিত কইরা রিপেয়ার করার চোখ স্পার্ক করার অবকাশ লেখকের থাকন জরুরি। লেখকের ভিতর যদি নিজে চরিত্র হিসাবে অর্থাৎ আত্মরতি হিসেবে ম্যাডনেস চাইপা ধরে, তাইলে এইগুলা থাইকা রেহাই পাওয়া মুশকিল। এই লেকিংগুলা তখন ঠিক মাথায় ক্লিক করবার চায় না। তখন এই রকম লেকিং থাইকা রেহাই পাওয়া মুশকিল। এ কারণেই মাসরুরের ‘আগস্ট আবছায়া’মূলত ‘আবছায়া’নয় বরং উহা হয় ‘আগস্টবিভ্রম’। ওইখানে স্বপ্নপ্রতীক আছে, ইলিউশন এবং রিয়ালিটি আছে; যেইগুলা পয়দা করতে গিয়া লেখক সিজোফ্রেনিয়া-আক্রান্ত ‘সাচ আ লং জার্নি’তৈয়ার করেছেন। অবশ্যই এইটা কিন্তু রোহিন্তন মিস্ত্রির ‘সাচ আ লং জার্নি’না।
এই রকম কৃৎকৌশল বাংলা উপন্যাসে দেখি না। তবে ভিন্ন ভাষায় কমবেশি আছে। থ্রিলার রাইটার পাওলো কোয়েলহো তার থ্রিলারকে ক্রমশ ফিকশনে উন্নীত কইরা ক্রমশ দর্শননির্ভর করতে ওস্তাদ। এইগুলা জনপ্রিয় ধারার চিন্তানির্ভর কাজ। মাসরুর সেই জায়গাটাতে কাজ করার চেষ্টা করেছেন। থ্রিলারের সীমাবদ্ধতা ডিঙ্গাইবার কসরত করেছেন। এমনকি এইটারে ক্লাসিক করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন। ওয়েলকাম। সে ক্ষমতা তার যে নেই তা সুলুক করে বলা যাবে না। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে চিন্তনযোগ্যতা এবং দর্শনযোগ্যতা তার আছে। তয় সিকোয়েন্স বয়ানে তিনি বেশ কিছু ক্ষেত্রে চর্বি-আক্রান্ত হয়েছেন। অথচ ওই জায়গাগুলান হইতে পারতো জাস্ট আ আনফিনিসড রাফ ইমপ্রেশন। ক্লদ মানের ‘সানরাইজ’।

স্যরি জ্ঞান দেবার ইচ্ছায় বলছি না, জাস্ট তুলনামাত্র। যেমন ‘আ লাস্ট সাপার’। অথবা প্রধান চরিত্রের ডিপ্রেশনের সমান্তরালে প্রয়োজন হতে পারে ক্লদ মানের ওয়াটার লিলি সিরিজের রিল্যাক্স ইমপ্রেশন যা পাঠকের ভেতর চিন্তার সাজুয্য নির্মাণে সহায়ক। এ সুযোগটুকু পাঠককে না দিলে পাঠকের ভিতর প্রধান চরিত্রের সাথে সাথে যে জেটলগ তৈরি হয় তাতে লেখক তার পাঠককে যা ভাবাতে চাচ্ছেন সেটা না হয়ে বরং পাঠক নিজেও প্রধান চরিত্রের মতো ডিপ্রেশনের প্যাশেন্ট হয়ে ওঠেন।

আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার লেখায় আখ্যান নির্মাণের চেষ্টা করি না; নির্মাণ করার চেষ্টা করি ‘চিন্তা’। অপরপক্ষে মাসরুর আখ্যানাশ্রিত চিন্তার ওপর আস্থা রাখতে চান। সেই আখ্যানের ভিত্রে ম্যাজিক পয়দা করতে গিয়া তিনি পাঠকদেরও সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত করার চেষ্টায় লিপ্ত হন। কিন্তু আমার মনে লয় সিরিয়াস পাঠক কনশাস। আর এইটা মাসরুর আরেফিন বুঝবার ক্ষমতা রাখেন, বিধায় তিনি আগামী সময়ে মেদহীন চিন্তননির্ভর আখ্যান উপহার দিবেন বইলা আস্থা প্রকাশ করা সম্ভব। সম্ভব এই কারণে যে, তিনি নিছক গল্পের বয়ানকর্তা নন, বরং দর্শনের অধ্যাপকের মতো তার চিন্তার পেছনে রয়েছে বিস্তর কার্যকরণ; সেইসাথে রয়েছে সমকালকে নিরিখ করার যৌক্তিক পরম্পরা।

না মাসরুর আরেফিনের ‘আগস্ট আবছায়া’কে গদবাঁধা ঢালাওভাবে স্ট্রিম অব কনশাসনেস দিয়া ধরতে গেলে সবটা পাওয়া সম্ভব না। বিষয়টা এক ধরনের সাইকো-ট্রিটমেন্ট; যেইটা ভাষার ভিত্রে লুকাইয়া থাকা দৃশ্যকল্পসমূহকে প্রতিরূপ দিবার তাড়নায় লেখক নিজে বাস্তব-অতিরিক্ত এক ধরনের ফ্যান্টাসির জগত নির্মাণ কইরা পাঠককে সম্মোহিত কইরা পাঠকের যুক্তিশীল চিন্তনকে ব্ল্যাকমেইল কইরা লেখক কী বলতে চান সেইটারে প্রায়োরিটি দিতে পাঠকদের বাধ্য করান। এইটা লেখকের ক্ষমতা। এইটা একটা আঙ্গিককৌশল। এহেন কৃৎকৌশল ভাষিক সক্ষমতার সমূহ দিগন্ত উন্মোচনের সুযোগ তৈয়ার করার স্পর্ধা রাখে। এইগুলান নিয়া ভাবতে গিয়া আমি আমার ‘শীলবাড়ীর চিরায়ত কাহিনি’তে বাখতিন কথিত পলিফনিক টেকনিকের আশ্রয় নিয়েছিলাম।
কাউকে না পড়ে মন্তব্য করা পক্ষান্তরে একচক্ষুহরিণতুল্য হীনমন্যতার প্রকাশ। মাসরুর আরেফিনের মতো আমিও দেখতে পাচ্ছি বাংলা ভাষার প্যারাডোক্সিক্যাল ম্যাজিকসমূহ এখনো পয়দা হয় নাই। তবে দ্রুতই বাংলা ভাষার ফিকশন গোত্রের সৃজনশীলতা তার সনাতন খোল বাকলকে বহুমাত্রিক সম্ভাবনায় পৌঁছে দেবার স্পর্ধা রাখে। সে চর্চা তো শুরু হয়ে গেছে। বাকোয়াজিতে বিভ্রান্ত না হয়ে খুঁজে খুঁজে পাঠ করতে থাকুন। আপনিও অনাবিষ্কৃত পথ পেয়ে যেতে পারেন।

মাসরুর আরেফিনের প্রচারকৌশলের সাতসতেরো যা পক্ষান্তরে তাকে প্রশ্নবিদ্ধই করেছে। এইটুকু বাদ দিলে মাসরুর আরেফিনের প্রতি আস্থা এই কারণে যে, কোনো কিছু না পড়ে তিনি মন্তব্য করেন না। যদিও আমি নিজে পাঠগ্রহণের বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক। কেননা এক জীবনে পৃথিবীতে পাঠের এতো বেশি গুরুত্ববহ বিচিত্র বিষয়াদি রয়েছে যে আন্দাজি জিনিসপত্র পইড়া ছোট্ট জীবনটা যাতে অপচয়ের মূর্খতায় না হারাইয়া যায় সেইটা সামলাইবার দায়িত্বখানাও তো আমার নিজেরই। আপনি কী বলেন?

হ্যাঁ মাসরুর আরেফিন লিখেছেন ‘আগস্ট আবছায়া’। এইখানে পাঠককে একটা ধাক্কা দেবার চেষ্টা তার আছে, বলা চলে সচেতন চেষ্টা। দর্শন থট রাজনীতি সবকিছু ঢুকায় দিছে ওইটাতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হইছে ওইটা? আমি এই বইটা নিয়া ফেসবুকে মতামত দিছিলাম। কিন্তু আমার মনে হইছে লেখক আমার আলোচনাকে ঠিক নিবার পারেন নাই। সবাই তো চায় নিজের গুণগান। কেউ ভাষ্যকার অথবা ক্রিটিক চায় না। চায় শুধু চাটুকার। অদিতি ফাল্গুনীকে পইড়া দেখেন, জনপ্রিয় ধারার গল্পকার না। এই রকম অনেকেই আছেন। স্বভাবজাত কারণে তারা পিছিয়ে থাকেন অথবা যারা তাদের লেখা বোঝেন তারা তাদের মতো লেখকদের নিয়া কথা বলার যোগ্যতা রাখেন না, বা কথা বলতে ঈর্ষা বোধ করেন। রুমা মোদক তো গড়পড়তা লেখেন না, সিরিয়াস কাজ করার প্রচেষ্টা আছে। উপযুক্ত মানের পাঠকও বটে, কিন্তু কই উপযুক্ত লেখাগুলো নিয়া তো সচরাচর কথা বলেন না। না শুধু তাকেই নির্দিষ্ট করে বলছি না বরং বলছি এমন অনেকেই আছেন ভালো লেখেন ভালো বোঝেন কিন্তু মার্কেটের হাওয়ার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পছন্দ করেন; মিডিয়ার নেক নজরে থাকতে পছন্দ করেন। তো এইগুলান দোষের কিছু না, তবে ভালো লেখাকে সামনে নিয়া আননের দায়িত্বটাও বিবেচনায় রাখনের দরকার। কিন্তু গ্রহণযোগ্য প্লাটফর্মগুলো যখন গড়পড়তা লেখাগুলারে আগাইয়া রাখতে নানান তালবাহানা করে তখন আমি বিমর্ষ বোধ করি বৈকি।

[সমাপ্ত]

বয়ান: ০১ পড়তে এই লেখাটিকে স্পর্শ করুন

বয়ান: ০২ পড়তে এই লেখাটিকে স্পর্শ করুন

শিমুল মাহমুদ। কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক। 
জন্ম ৩ মে ১৯৬৭, সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পাঠ গ্রহণ শেষে ইউজিসি-র স্কলার হিসেবে পৌরাণিক বিষয়াদির ওপর গবেষণা করে অর্জন করেছেন ডক্টরেট ডিগ্রি। বর্তমানে তিনি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
নেশা: অধ্যাপনা। পছন্দ: পাঠগ্রহণ, ভ্রমণ ও একাকিত্ব। অপছন্দ: মঞ্চলোলুপ আঁতলামো।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: ‘মস্তিষ্কে দিনরাত্রি’ (কারুজ, ঢাকা: ১৯৯০), ‘সাদাঘোড়ার স্রোত’ (নিত্যপ্রকাশ, ঢাকা: ১৯৯৮), ‘প্রাকৃত ঈশ্বর’ (শ্রাবণ প্রকাশন, ঢাকা: ২০০০), ‘জীবাতবে ন মৃত্যবে’ (শ্রাবণ প্রকাশন, ঢাকা: ২০০১), ‘কন্যাকমলসংহিতা’ (ইত্যাদি, ঢাকা: ২০০৭), ‘অধিবিদ্যাকে না বলুন’ (ইত্যাদি, ঢাকা: ২০০৯), ‘আবহাওয়াবিদগণ জানেন’ (চিহ্ন, রাজশাহী: ২০১২), ‘কবিতাসংগ্রহ : সপ্তহস্ত সমুদ্রসংলাপ’ (রোদেলা, ঢাকা: ২০১৪), ‘স্তন্যপায়ী ক্ষেত্রউত্তম’ (অচেনা যাত্রী, উত্তর ২৪ পরগণা: ২০১৫), ‘বস্তুজৈবনিক’ (নাগরী, সিলেট: ২০১৬), ‘সমূহ দৃশ্যের জাদু’ (চৈতন্য, সিলেট: ২০১৮),   ‘ভাষাদের শষ্যদানা’ (বেহুলা বাংলা, ২০১৯)। 
গল্পগ্রন্থ: ‘ইলিশখাড়ি ও অন্যান্য গল্প’ (নিত্যপ্রকাশ, ঢাকা: ১৯৯৯), ‘মিথ মমি অথবা অনিবার্য মানব’ (পুন্ড্র প্রকাশন, বগুড়া: ২০০৩), ‘হয়তো আমরা সকলেই অপরাধী’ (গতিধারা, ঢাকা: ২০০৮), ‘ইস্টেশনের গহনজনা’ (আশালয়, ঢাকা: ২০১৫), ‘নির্বাচিত গল্প’ (নাগরী, সিলেট: ২০১৬), ‘অগ্নিপুরাণ ও অন্যান্য গল্প’ (চৈতন্য, সিলেট: ২০১৬)।
উপন্যাস: ‘শীলবাড়ির চিরায়ত কাহিনী’ (ইত্যাদি, ঢাকা: ২০০৭), ‘শীলবাড়ির চিরায়ত কাহিনী’ (ধানসিড়ি, কলকাতা: ২০১৪), ‘শীলবাড়ির চিরায়ত কাহিনি’ (চৈতন্য সংস্করণ, ২০১৬), ‘সুইসাইড নোট’ (নাগরী, ২০১৯)।
প্রবন্ধ: ‘কবিতাশিল্পের জটিলতা’ (গতিধারা, ঢাকা: ২০০৭), ‘নজরুল সাহিত্যে পুরাণ প্রসঙ্গ’ (বাংলা একাডেমী, ঢাকা: ২০০৯), ‘জীবনানন্দ দাশ : মিথ ও সমকাল’ (গতিধারা, ঢাকা: ২০১০), ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ধারার কবিতা’ (গতিধারা, ঢাকা: ২০১২), ‘মিথ-পুরাণের পরিচয়’ (রোদেলা, ঢাকা: ২০১৬)। তিন দশক যাবৎ সম্পাদনা করছেন সাহিত্যের ছোট-কাগজ: ‘কারুজ’। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. এরকম সমৃদ্ধ লেখা জলনুপুরে বারবার পড়তে চাই। লেখক ও সম্পাদক দুজনকেই আমার এই সকালটি ভালো লাগায় ভরিয়ে দেবার জন্য অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।