TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

পোয়েট্রি অফ রিলেটিভিটি | খান আলাউদ্দিন


হৃদয়ের তাপীয় মৃত্যু

বিচ্ছেদ, যুগল তারকার মহাকর্ষ বল ছিন্ন করা যেন!
কিন্তু তুমি যেদিকেই চাও মহাশূন্য থেকে মহাশূন্যে
কিছু স্মৃতির প্লাজমা ধুলো রয়ে যাবে টেলিস্কোপে!
পুরান ঢাকার দু’টি চিল বাইনারি স্টারের মতো ঊর্দ্ধাকাশে উড়ে
প্রেমে ও ভালোবাসায়
তাতে বজ্রপাতসহ ভয়দ সাইক্লোন  সৃষ্টি হয়।
শীতলায়ন এ জীবন থেকে সব ঘূর্ণি উড়ে যাওয়া গ্যাসীয় পদার্থ।
এখন হৃদয়
পরম শূন্য তাপমাত্রায় জমে হিম
মৃত!


আইসোলেশন  

ধূলিকণা, জলীয় বাষ্প ও মেঘে মেঘে বিচ্ছুরিত রোদ, নম্র আলোক ভরহীন। ফলে আকাশভরা নীল। নীলে চক্রাকারে উড়ে কিছু অ্যারোপ্লেন ঘুড়ি চিল। উড়ে আর একচক্কর দুচক্কর দিয়ে ফিরে যায় শূন্যে যেন কোনো আততায়ী প্লেনের ভেতরে ওত পেতে ছিলো, যেন কোনো প্রাণী তিন জোড়া ক্রোমোজোমবিশিষ্ট এসপার-ওসপার ঘটাতে পারে প্লেন থেকে নেমে আসতে পারলে এই বাঘ অধ্যুষিত দেশে।

পাহাড় পর্বত পার হয়ে আসা পরিযায়ী পাখি তাকে দেখি আর ভাবি, আমিওতো এমন একজন পরিযায়ী, আর আমার রক্তের মধ্যে রক্তকণিকার মতো ছোট ছোট জীবাণুরা এদেরও আছে আদিবাসস্থান কোনো এক বনের গভীরে অন্ধকারে। স্বচ্ছজলে। যে প্লেন ধরায় ল্যান্ড না করে আকাশে উড়ে যায়, যে জাহাজ বহিসমুদ্রে নোঙর ফেলে বসে থাকে পোর্ট থেকে দূরে আর জাহাজের ডেক, কেবিন, ইঞ্জিনরুম তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয় প্লেগবাহী ইঁদুর, সেই জাহাজের মতো আমি  আজ ঈদের ছুটিতে বাড়ি থেকে বহু দূরে বসে আছি। না জানি এবার বাড়ি গেলে মাইগ্রেশন প্রত্যাশী জীবাণুও আমার সাথে চলে যায়।


সাপের চোখে দেখা

ফুলের  ভেতর রেণু, হাঁচিউদ্রেক, অ্যালার্জিউদ্রেক স্ত্রীকেশর, বৃতি জুম করে দেখি, জুম করতে করতে একসময় ক্লোরোপ্লাস্ট চোখে পড়ে। আমার এমনই চোখ মাইক্রোস্কোপিক, রড ও কোণ কোষ চোখে সংযুক্ত করায় দিন-রাত সব সমান সমান দেখি। পাখি উড়ে গেছে গান জানা সেই পাখি, তড়িৎবেগে দীর্ঘ ডানা ঝাপটে। পাখি উড়ে গেলে তার মোহময় ডানা, দীর্ঘ লেজ, স্মৃতি, বাঁকা চঞ্চু টেনে টেনে দেখি। সময়টা যেন ভিডিও প্লেয়ারে চলতে থাকা চলচ্চিত্রের মতো। পাখি সে আমার চিরস্থায়ী স্মৃতির ভেতর বন্দি হয়ে আছে আর স্মৃতি একটা রেডিও অ্যাকটিভ চিপের ভেতর। পিঠের স্টেমসেল স্মৃতি সেলে পাল্টে দিয়ে সেখানেও রেখেছি সযত্নে তাকে। রিভিউ চলেছে। রিভিউকালীন অনেক কিছু চোখে পড়ে ধূলি ধূসরিত নিউরন মেমোরিসেলে— সাঁজের আঁধার, মাথা উঁচু সুপারির বাগান এবং সবশেষে স্ট্রিং। একসময় আর কিছু চোখে পড়ে না স্মৃতিহীনতা, শূন্যতা ব্যতীত।


পরিণত ফল

দইবান্ধব ব্যাকটেরিয়া দুধ ও দইয়ের জন্য দইদায়ী বটে–এই জেনে যা প্রচুর অনারোগ্য জার্ম মনবান্ধব, শরীরবান্ধব রূপ দিয়ে নিই।
জীবাণুকে স্বাস্থ্যকর বৈশিষ্ট্যের মিউটেশন করি। 
কামারের দোকানঘরে প্রজ্বলিত লাল লোহা প্রসারণমান ঘাতে আঘাতে,
সে যে একখানা শাণিত অস্ত্র হয়ে উঠছে নিঃসন্দেহে।
কেননা, অপরিপক্ক ফল ঘণ্টায় ঘণ্টায় গা দিয়ে প্রতিপদার্থ ছাড়ে ঘামের বদলে, ব্যাকটেরিয়া কবলিত হয়ে পঁচে যায়। তাদের নরম ত্বকে
গোলাপি, সিঁদুর রঙ ও রুপ আসে না আর
ফল পরিপক্ক হলে তবে অল্প আঘাতেই পেকে উঠে।


অন্ধের যষ্ঠি

অন্ধ লোকের মতন আঁকড়ে আছি পুষ্পকর; ছেড়ে দিলে    আমি বিপথগামী, কি করে পেরুব সর্পপথ, সারিসারি ফণিমনসার বাগ?
গভীরে পৌঁছুতে চাই, যেথায় জলতলে বন, আশ্চর্য রঙিন মাছ ঘুরে ফিরে,
রাতে তারাদের স্নিগ্ধ প্রতিবিম্ব ধরে ফেলা যায়।
চোখ বুঁজে শুধু স্পর্শমাত্র বুঝে নিবো আমি কোথায় রেখেছি হাত,
কার হাতে, কার ত্বকে? ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিবো কুন্তলগুচ্ছ।
পায়ের আওয়াজ পেলে বুঝবো যে সে আসছে,
জন্মান্ধ লোকের মত তাকে ভালবেসে যাবো মনেপ্রাণে, নিঃশ্বাসে,
আমার অন্ধের যষ্ঠি।


ইনসেপশন

স্বপ্নে দৌড়ুলেও ঘুমন্ত শরীর চুঁয়ে সোডিয়াম-ঘাম ঝরে, হৃৎপিন্ড ক্রমশ দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে যায়। তখন নিজেই আমি সন্দিহান হয়ে পড়ি– জেগে আছি নাকি ঘুমিয়ে পড়েছি? ঘুমিয়ে যাবার  পর মানুষেরা কখন তৃষ্ণার্ত হয় তা তাদের মুখের লালা পরীক্ষা করে বলে দেয়া যায়, মানুষেরা কখন ঘুমিয়ে স্বপ্নে খাবার দাবার দেখে, স্বপ্নে খায়, সে কথা তাদের পাচক রসের নিঃসরণ মেপে বলে দেয়া যায়। আবার যখন মানুষের তীব্র হ্যালুসিনেশন হয়, কাল্পনিক স্মৃতিতর্পন করে তখনো তাদের নিউরনে নিউরনে বৈদ্যুতিক ক্রিয়া জারি থাকে। ফলে এ কথা নিশ্চিত করে বলতে পারবো না যে আমি ঘুমিয়ে গিয়েছি নাকি জেগে আছি, জীবনভর আমি হ্যালুসিনেশন দেখছি নাকি দু’চোখের সামনে ইল্যুশন হচ্ছে।


আফিম

যদি কিছু পাতা পোড়া বাষ্প টেনে নিই তাতে কি আর এমন ক্ষতি হয়? দুর্বোধ্য শরীর স্ক্যান করেও তো সিংহভাগ প্লাস্টিকের কণা শরীরের চোরা কুঠুরীতে ও নিউরনে থেকে যায়। প্লাস্টিকের চেয়ে আরো ক্ষতিকর ফরমালিন , ইউরিয়া ও নিকোটিন আমরা ধারণ করি। কিছু পাতা পোড়া ধুম্র নিউরোট্রান্সমিটারে অভাবনীয় অনুরণণ তোলে, সেই ধোঁয়া জমে জমে প্রসারণমান চেতনায় নতুন তারার জন্ম দিয়ে থাকে। এমনকি নিউরন থেকে এন্টিজেনগুলোকে খুঁজে খুঁজে মেরে ফেলে। তখন চোখের রড ও কোণকোষগুলো অতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। কৃষ্ণপক্ষের আঁধার কেটে যায় অবলোহিত আলোকরশ্মিতে। হা হা অশেষ হাসির বার্তা বয়ে আসে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে।



আত্মবিস্মৃত হও। বিষয়ের কেন্দ্রে নিউট্রালাইজড হও। ঘন হও। সময় উড়াও। তল্পিতল্পা গুছিয়ে একদিন কোথাও চলে যাও নিজের অস্তিত্ব ভ—লে। নিজের ভেতর। সমুদ্র নাবিক যেন। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে দ্বীপ থেকে দ্বীপে, ভাসমান নগর বন্দরে চলে যাচ্ছো ভাবো। ভাবতে ভাবতে চলে যেতে পারো আলফা স্টেটে। যেখানে পৌঁছুলে যে কেউ ঝড়ের সংকেত শুনেও গভীর সমুদ্রে চলে যায় ঝু্ঁকি নিয়ে মাতাল প্রাণের। এই ধরো তোমাকে দিলাম অপিয়াম, ক্যানাবিস, স্কাইরকেট। ফিরে এসো সুখী মানুষের জামা গায়ে। আহরিত বাকফসল নিয়ে।


পোয়েট্রি অফ রিলেটিভিটি

স্টেশনে দাঁড়িয়ে দূরগামী ট্রেনের শব্দ শুনি— ইঞ্জিনের গড়-গড় ও আকাশবিদীর্ণ ভেঁপু। আমার কানের চোখ খুলে যায়, দেখি  কতদূর চলে গেছো ট্রেনে ,অন্ধকারে। কার্তিক মাসের নিদ্রাহরণকারী মুনিয়াপাখি। পাতায় পাতায় ঝরছে শিশির, পথে বংশীঝিঁঝিঁ, আমি কান দিয়ে দেখছি তোমার একাকী ঘরে ফেরা। কান দিয়েই দেখছি যেহেতু জলচর মাছ কোনোদিন পাখির চোখে দেখতে পায় না, পাখির চোখও প্রাপ্ত হয় না  মৎসচোখ তবু সব চোখই স্বপ্ন প্রাপ্ত হয় প্রেমে। স্বপ্নে বালি ও কাঁচের অস্বচ্ছতা কমে আসে, ওদিকটা দেখা যায় মঞ্চের কালো পর্দা ভেদ করে।

এবং ট্রেনের চোখ থাকে দূরে ... বাষ্পভেজা। লোক গিজগিজ স্টেশনে একটুখন থেমেই বেরিয়ে যায়। বাঁশি ভেজে ওঠে। ইত্যবসরে ট্রেনের জানালায় দেখে ফেলি, বিষণ্ন চিবুক, হেলেন অব ট্রয় বা মিসরের রাণী ক্লিওপেট্রা। পর পর বাসে আর লঞ্চেও একই ঘটনা ঘটে চলেছে। যেন সব সুন্দরী মেয়েরাই কোনো না কোনোভাবে অদিনের যাত্রী। মেঠোপথ , বনবনানীর ভেতর দিয়ে অজানা গন্তব্যে চলে যাচ্ছে।

অপুর চোখে বিস্ময়। গরুর গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, ভাবি, ট্রেন থেকে থেকে নেমে গরুর গাড়িতে এসে উঠবে। অথচ তোমার নামা হয় না। পরের স্টশনে নামো কিনা তা-ও জানি না।

সেই থেকে স্টেশন আমার কাছে জড় প্রসঙ্গ কাঠামো ছাড়া আর কিছু নয়। আমিতো পর্যবেক্ষক, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি তোমার চলে যাওয়া। দেখেছি ট্রেন কি করে u বেগ থেকে v বেগ প্রাপ্ত হয় আর তোমাকে নিয়ে যায় দৃষ্টির আড়ালে। প্রিয়, একটা গতিময় ট্রেনের সাপেক্ষে আমি কত নিশ্চল। তুমি চলে যাবার পর আরো বেশি নিশ্চল হয়েছি! গাছের সাপেক্ষে নড়নে সক্ষম।


ক্লোনিং

এমন একদিন আসবে হুবহু তোমারই সাথে দেখা হবে। রাস্তায়, বাজারে, বাসে দেখা পাবো অসংখ্য তুমির জেনেটিক প্রতিলিপি। তুমি চলে যাবার পর সেই অন্য তুমি, যার ক্রোমোজোম তোমার সদৃশ, তাকে সাথে নিয়ে ঘুরতে যাবো, সারারাত গহীন শালবনে রুপার থালার মতো গোল চাঁদ দেখবো। হাতে থাকবে হাত, দু’জনে নির্জন রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটবো - হাঁটবো - হাঁটবো। তারপর কখন হ্রস্ববেলা পড়ে আসবে। তোমাকে না পাওয়ার গভীর বেদনা থাকবে না। তুমি চলে গেলে অন্য যমজ তুমির মাঝে তোমাকে প্রতিষ্ঠা করবো। এমন একদিন আসবে শুধু আমার সাথেই দেখা হবে। রাস্তায়, বাজারে, বাসে দেখা পাবো অসংখ্য আমির। যাদের মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোম নিখুঁত আমার।সেইসব আমির নিজের উপর কোনো ঘৃণা, বিদ্বেষ থাকবে না দ্বেষ।


ট্রমা

কালবৈশাখির হাওয়া লাগছে মর্মমূলপর্যন্ত এবং মেঘে মেঘে। উলটপালট হচ্ছে নিউরন স্টেমসেল। সমুদ্রতর গভীর মস্তিষ্ক। বালুর অতলে লুকায়িত জাহাজের স্কাল, পুরোনো শহর নিমিষেই উন্মোচিত করে ফেলে ভয়দ সাইক্লোন। আবার কি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ট্রমাটিক ঝড়? পাগলা বাতাসে মেন্দি পাতা চুঁয়ে নামছে ফোঁটা ফোঁটা ধাতু, জিঙ্ক কিংবা দস্তা। সর্বগ্রাসী ডিপ্রেশন, ধ্বংসাত্মক স্মৃতি সবকিছুতে অস্থির মাতম। প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল, জীবাশ্মের মতো উত্তোলিত হচ্ছে স্তরে স্তরে খনিজ স্মৃতিও। গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট থেকে বেঁচে যাওয়া সর্বশেষ অতীতটুকু নিউরোলিঙ্কের ভেতর দিয়ে চুরি করে নিয়ে যেতে চাচ্ছে মনের ডাক্তার।


খান আলাউদ্দিন। জন্ম: ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭, কাপাসিয়া, গাজীপুর। পড়াশোনা: ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে। প্রকাশিত কবিতার বই: ‘ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ডিসঅর্ডার’ (চৈতন্য, বইমেলা ২০২১)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ