TopTime

আজ ২২ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হীরার কাউন্টার অ্যাটাক ও অন্যান্য বোধ | দুর্জয় খান



কবিতার গ্র্যান্ড স্টাইলের কথা যদি বলা হয় কিংবা প্রশ্ন তোলা হয়, সেক্ষেত্রে অন্তত আমি চুপ থাকবো। কারণ পূর্বেই বলেছি কবিতার কোনো নির্দিষ্ট রূপ নেই। ম্যাথু আর্নল্ড মনে করতেন, কাব্যগুণ সংবলিত কোনো মহৎপ্রাণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সরলতা কিংবা কঠোরতার সঙ্গে তুলে ধরে তখন সেখানে কিছু বলার থাকে না বরং এতে একটা উপকার হয় যে, সেখানে শৈলির জন্ম হয়। হেলেনিজম-এর সারসত্তা দুই ভাবে উপলব্ধি করা যায়:
(১) বিবেকের কঠোরতা এবং
(২) চেতনার সাবলীলতা।

অতএব বুঝতেই পারছেন কবিতার ভেতর গথিক স্থাপত্যকে। “বাঁক বাচনের বৈঠা” কাব্যগ্রন্থে কবিতার নতুন প্রস্তাবনা অনুযায়ী কবিতাগুলোতে শব্দের একটা ধাড়-তকমা লক্ষ্য করতে পারবেন। শব্দকে কবি হাসনাইন হীরা ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। শব্দকে কবিতার আত্মা মনে করেছেন। বুদ্ধি, বাস্তব, পরাবাস্তব, আবেগের মিশেলে শব্দ দিয়ে তৈরি করেছেন হিরোটিক মিশাইল। মূলত কবিতা সৃষ্টির পেছনে শব্দই এক ও অখণ্ড। বাস্তব ও আধ্যাত্মের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। যেমনটি এস টি কোলরিজ বলেছেন, কবিতার শব্দকে হতে হয় স্বতঃস্ফূর্ত। আসলে কবিতায় শব্দ কী? অ্যাবস্ট্রাক্ট ইমেজিনারি হিসেবে বলা যায়, একশ’ ফিট উঁচুতে শূন্যে একটা আপেল ঝুলছে। সুন্দর ও হৃদশীল নয় বরং সুঁই ও সুতো, যা মগজের ভেতর সেলাই করে চলছে বিচিত্রগামী রঙ। পঞ্চভূতের শরীরে সে রঙ অলৌকিক ঘনত্ব সৃষ্টি করে দশদিগন্তের মার্গে নতুন নতুন অভিষেক ঘটিয়ে বন্ধ করে দিচ্ছে ফিরে আসার পথ। কবিতায় যা কিছু বিবর্তন তা বোধের নয় বরং শৈলির দ্যোতনাহীন লাল লাল ফুল। স্বয়ংক্রিয়। এমন এক যোজনা যা অঘোরীর মতো শরীরকে ধ্যানে বসিয়ে অবস করে দিচ্ছে অনুভূতির ঐকতান। শব্দবিন্দু দিয়েই স্বয়ং সাগরকে আহবান করছে লীলাসঙ্গমের। কবি হাসনাইন হীরা সেই অর্থে শব্দেরও শাব্দিক ঈশ্বর। ব্রহ্ম। দৃশ্য, গন্ধ ও স্পর্শকে পুঁজি করে উপলব্ধির প্রতীকে সম্পন্ন ও সম্পূর্ণ ঐকতান কারিগর। জীবনের সম্ভোগ, আকাঙ্খা ও তৃষ্ণাকে ব্ল্যাক ঠোঁটের আদলে জীবনচেতনার অনুষঙ্গী করে তুলছেন। গতিশীল ও সংবেদনশীল চিন্তার থ্রো-কে নন্দনবোধের অভিজ্ঞান দ্বারা করে তুলছেন বিচিত্রগামী। আর এখানেই যেনো “দশঘরার বিনুনিবিতান” মিথের কাঠামোয় বুনিয়াদ গড়ে তুলছে এক অভিনব বোধ ও সিরিয়াল কিলার সংগীত। মানুষের বিশৃঙ্খল অভিজ্ঞতাকে ধীরপায়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সমতল ভূমির দিকে। পথিমধ্যে যাবতীয় অ্যাটাক ও বোধ নৈর্ব্যক্তিকতায় মিলিয়ে দিচ্ছে ক্ষত-অক্ষতের দাগ। “বাঁক বাচনের বৈঠা”য় এখানেই সৃষ্টিশীলতার বোধ আরো স্পষ্ট ও স্বতন্ত্র।

‘দশঘরার বিনুনিবিতান’ অংশের ‘চক্রবূহ্যলোক’ কবিতাটি পাঠ করা যাক—

চয়নে আমি স্নানযোগ্য পুরুষ 
বীর্য ঢেলে আত্মজীবনী লিখি
যেখানে আমার নিরঙ্কুশ কোনো 
জন্ম থাকে না, মৃত্যু থাকে না
ঢুকে পড়ি তাই অনন্তের গুহায়।

লাগামহীন নির্বিকার ভাবনায় 
সাতরঙা ভোরের ফুল ফোটে
লাল হয়ে ওঠে বিজনের মুখ, 
দ্রষ্টব্য দেওয়ার মতো ব্যাকফুটে
আলো কিংবা অন্ধকার নেই।

মোম ও সমুদ্রের মতো তাই দুরারোগে ভুগি। সোমত্ত ঢেউ ভাঙে পুরোনো প্রাচীর। বিষণ্ন রোদ্দুরে খুঁজি ফ্রয়েডের টগবগে দ্যুতি। কেউ বলে ভণ্ড, অণ্ডকোষের জোরে ভুঁই ফাঁড়ি আর পাড়ি দেই ব্রহ্মদেয়াল। কেউ বলে— আমি উদগ্রীব, আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মাছ ও মাছির মতো সাংঘর্ষিক। অথচ আমি গহিনের গোপন চোখ, আমার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। আমি আর আসব না, যাবও না কোনোদিন।

এই কবিতায় কবি হাসনাইন হীরা যে দর্শন ও ম্যাসেজ পাঠকের কাছে প্রদান করেছেন তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক। পরাজিত মানসিকতা, নৈরাশ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও নেতিবাদী সিদ্ধান্ত ছাড়াও কবি তাদের সৃষ্টিতে জীবনের স্বাভাবিক দুঃখ বেদনা, উদ্বেগ উৎকন্ঠা, বিকার বিকৃতি ও হতাশার চিত্র পরিবেশন করে থাকেন। মানুষের দুঃখের কারণ একই সঙ্গে তার স্বভাবের মধ্যে এবং পরিস্থিতি ও পরিবেশের মধ্যে নিহিত থাকে। সাংখ্যদর্শন ও বৌদ্ধধর্ম দুঃখের কারণ ও দুঃখনিবৃত্তির উপায় সন্ধান করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত জীবনের সম্পূর্ণ বিলুপ্তিই তো কামনা করেছেন। জীবন থাকলে দুঃখও থাকে। দুঃখ দূর হতে পারে জীবন বিলুপ্ত হলেই। কামনা-বাসনার বিলুপ্তি তো জীবনের বিলুপ্তি। যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক, নির্বাণ জীবনের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি (complete annihilation of life)। জীবনের অস্তিত্ব বজায় রেখে নির্বাণ লাভ কি আসলেই সম্ভব? কিংবা নির্বাণ লাভের পরে জীবনের কিছু কি অবশিষ্ট থাকতে পারে? বৌদ্ধ ধর্মে অবশ্য বলা হয়েছে যে, নির্বাণ লাভ করলে জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে চিরমুক্তি লাভ করা যায়।

‘চক্রবূহ্যলোক’ কবিতায় লক্ষ্য করুন কবি কী বলছেন? “আমার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। আমি আর আসবো না, যাবও না কোনোদিন”। অর্থাৎ কবি এখানে পরিপূর্ণভাবে নিজেকে মুক্ত করেছেন সংসারের যাবতীয় আহ্লাদ, সুখ, দুঃখ, আশা প্রত্যাশা থেকে। বিজনের মুখ নিয়ে বিষণ্ন রোদ্দুরে নির্মোহভাবে হেঁটে গেছেন জীবনের স্ফূর্তির মূলমন্ত্র পাঠ করতে করতে। “চয়নে আমি স্নানযোগ্য পুরুষ / বীর্য ঢেলে আত্মজীবনী লিখি” আত্মমুক্তি নয় বরং বোধিসত্ত্বক হিসেবে নিজেকে কল্পনা করেছেন। উপলব্ধি করেছেন। আত্মমুক্তির আদর্শকে কবি মনে করেন স্বার্থপরের আদর্শ, যেমনটি বলছেন বীর্য ঢেলে আত্মজীবনী লিখি পক্ষান্তরে জাজ্ করছেন বোধিসত্তার আদর্শরূপে। এই বোধিসত্তা কী? এর আদর্শ কী? বোধিসত্ত্বের আদর্শ হলো পরম জ্ঞান লাভ করা এবং এই পরম জ্ঞান বা প্রজ্ঞা ও ভালোবাসার সাহায্যে বিশ্বের অগণিত দুঃখ পীড়িত মানুষের দুঃখ দুর করে তাদের মোক্ষলাভ তথা নির্বাণ লাভ করে। অর্থাৎ কবি এখানে সত্যোপলব্ধি ঘটিয়ে প্রজ্ঞার অধিকারী হয়ে অপরের মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করছেন। যার কারণে কবি এখানে স্পষ্টই হয়ে উঠেছেন বোধিসত্ত্ব। কবির এই পরম সত্তা বেদান্তের নির্গুণ ব্রহ্মের মতই অবাঙমানসগোচর। স্বয়ং ঈশ্বর রূপে অবতরণ করে নিজেই ঘোষণা দিচ্ছেন “আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মাছ ও মাছির মতো সাংঘর্ষিক”। তবুও প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে যে, জাগতিক বস্তু শূন্য কারণ এর নিঃস্বভাব। কিন্তু পারমার্থিক সত্তার শূন্যতা হলো জাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর অবর্ণনীয়তা। পারমার্থিক সত্তা আমাদের বুদ্ধির অতীত। এজন্যই আমি বেদান্তের ভাষায় বলেছি ‘অবাঙমানসগোচর’ অর্থাৎ পরম স্বজ্ঞার মাধ্যমে পরমতত্ত্বকে অনুভব করা।




হাসনাইন হীরা
জন্ম: ১৮ নভেম্বর, সিরাজগঞ্জ
প্রথম কাব্যগ্রন্থ: ‘বাঁক বাচনের বৈঠা’
অর্জন: “জেমকন তরুণ কবিতা
পুরস্কার-২০২০”


“ফাস্টফুড ইন্দ্রিয়দশা” কবিতায় ‘মায়া’ শব্দটির প্রয়োগ করা হয়েছে। সেখানে কবি এমনভাবে চিন্তার সংযোজন করেছেন যা পৃথিবী ব্যতীত অন্যকোনো সংযোগ নেই বলে স্বীকার করেছেন। কিন্তু এর বাইরে বিশদভাবে চিন্তা করলে এর দ্যোতনা কিংবা উলম্বতা ভিন্ন মতামত আনয়ন করে। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে আমাদের আরো পেছনে যাওয়া উচিত বলে মনে করি। কেননা কবি হাসনাইন হীরা এখানে নিজেই একটি চিন্তাকে সুসংহত করেছেন। শংকরাচার্য একজন ভারতীয় দার্শনিক। ভারতীয় দর্শনের অদ্বৈত বেদান্ত নামের শাখাটিকে তিনি সুসংহত রূপ দেন। তাঁর মতে ‘মায়াবাদ’ অদ্বৈতবাদেরই নামান্তর। মায়াবাদ ও অদ্বৈতবাদ একই সিদ্ধান্তের নাম। এই শংকরাচার্যই সর্বপ্রথম সর্বসত্তাময় আত্মার জ্ঞানকে মায়াবাদে দৃঢ় ভিত্তিরূপ প্রদান করেন। ‘ফাস্টফুড ইন্দ্রিয়দশা’ কবিতার শেষ চরণগুলো পাঠ করলে স্পষ্ট বোঝা যাবে কবি হাসনাইন হীরা উক্ত চিন্তার বিষয়ে যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত তা গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি। কবির এন্টিথিসিস যেন এ্যাফরিজমে সহসাই মোড় ঘুরিয়ে নিয়েছে। এক ইন্দ্রিয় দ্বারা বহুরূপে নিজের চিন্তার শৈলিকে প্রকাশ করেছেন। শব্দ ব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপোদ্যাতক ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গিকে জগৎ-বৈচিত্র্য সমকোণ সূচিত করে ‘মেঘফল’ ‘ওফল’-কে একমেবাদ্বিতীয়মে পরিণত করেছেন। এই কবিতার প্রাণ হচ্ছে বক্রোক্তি। সেটাকে কবি অতি চতুরতার সাথে প্রয়োগ করেছেন। বৈদগ্ধ্যপূর্ণ ভঙ্গির সাথে কবির চিন্তাশীল, মননশীল ও প্রায়োগিক কৌশল, বৈচিত্র্য চারুত্ব, হৃদ্যত্ব, সৌন্দর্য্য এমনকি সুন্দরের ধ্বনিসৌন্দর্য্য। যেখানে কবির বুদ্ধিবৃত্তির প্রাবল্যে দীপ্তিশক্তির স্ফুরণে সামগ্রিক ধারণা ধারণ করার ক্ষমতা রাখে। অতএব স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে, কবির কবিতা সৃষ্টির মূলে সেটাই হলো অদ্বৈত বহুর মধ্যে যা ব্যাপ্ত। যদি ক্ষুরধার তর্কপদ্ধতির খাতিরে এগিয়ে যাওয়া যায় “ফাস্টফুড ইন্দ্রিয়দশা” কবিতাটি নিয়ে তবে সৌন্দর্য্যের বিদ্যমান লক্ষণীয়। সৌন্দর্য্য কখনো একটি ধারণামাত্র নয়। যেকোনো বস্তু সুন্দর বলে বিবেচিত হতে পারে তখনই যখন সঠিক পারস্পর্য, সামঞ্জস্য এবং স্পষ্টতা বিদ্যমান থাকে। যেমন প্লেটোর মতে, “The chief forms of beauty are order and symmetry and difiniteness,which the mathematical science demonstrate in a special degree.”

প্লেটো এখানেই তিনি সম্পূর্ণ পৃথক এই জন্য যে সৌন্দর্যকে তিনি ব্যয়বয়ি ও অস্পষ্ট অনুভূতির জগৎ থেকে সরিয়ে জ্ঞানের সীমার মধ্যে নিয়ে এসেছেন। অর্থ্যাৎ কবি হাসনাইন হীরার সুনিয়ন্ত্রিত বক্রোক্তি ভাবনার সরাসরি প্রকাশের সঙ্গে সুরসংগীত বজায় রাখে এবং সহজ সুরপ্রবাহকে আরো তরঙ্গায়িত করে। “মায়া-ভোজবিদ্যার দীর্ঘতম কবিতা সিরিজ / মনে হয় মেঠোপথ, মূলত অন্তবীজ” এমন বাক্য গঠনের পর সহসাই টের পাওয়া যাচ্ছে যে,  বিষয়বিন্যাস ও শব্দ ব্যবহারে কবিকে অতিশয়োক্তির আশ্রয় নিতে হয়েছে ঠিকই কিন্তু পরিমিতবোধকে তিনি ছেড়ে দেননি। কবিতায় দুঃসহ বিস্তার যেমন নিষ্প্রাণ তেমনি অতিরিক্ত হ্রস্বতা sublimity নষ্ট করে। বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ‘মায়া’ কে ‘অন্তবীজ’ রূপে আখ্যায়িত করেছেন। স্বতন্ত্র উচ্চতা দেবার চেষ্টাকে কৃত্রিম ও বিরক্তিকর থেকে সহসাই শেষ পর্যন্ত কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে। এখানে “ফাস্টফুড ইন্দ্রিয়দশা” কবিতাটি ঘটনা-প্রসঙ্গ-প্রবাহের মতোই ভাষা ও প্রকরণে ইন্দ্রিয়কে স্বাভাবিক এবং বাস্তব রূপ প্রদান করেছে।



দুর্জয় খান। কবি ও সমালোচক। জন্ম: ১২ ই অক্টোবর ১৯৯৬, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: ‘মানসিক অতৃপ্তির আখ্যান’ (২০২০) ও ‘ছায়াক্রান্তের শব্দানুষঙ্গ’ (২০২১)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ