TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

দেয়াল | কবীর রানা

প্রচ্ছদ: নাজমুল হোসাইন


গৌরবের কথা বলি আগে, গৌরবের কথা শুনি। দেয়ালের কথা বলি আগে, দেয়ালের কথা শুনি। গৌরব যদি দেয়াল, বলি দেয়ালের কথা, শুনি দেয়ালের কথা। দেয়ালে দেয়ালে লিখিত আছে, লিখিত হচ্ছে, লিখিত হবে এ সকল গৌরব— কীভাবে নর্দমা নদী হয়েছে, কীভাবে সে নদীতে চাঁদ ডুবতে না পেরে কবিতা হয়েছে, চিত্রকর্ম হয়েছে, রাজনীতি হয়েছে, অর্থনীতি হয়েছে, ধর্ম-কর্ম হয়েছে। সে নদীতে চাঁদ ডুবতে না পেরে রাস্তায় রাস্তায় গান হয়ে ভিক্ষা করেছে। সে নদীতে চাঁদ ডুবতে না পেরে কাক হয়ে, কুকুর হয়ে এ মহল্লার সকল ময়লার নির্জন ক্রন্দন জেনেছে। সে ময়লা বের হয়ে আসে এ মহল্লার সব কালের সকল গোলাপ থেকে। এ মহল্লার একটা বাড়ি, যে নিজেকে গোলাপ বলে; একজন পুরুষ, যে নিজেকে গোলাপ বলে; একজন নারী, যে নিজেকে গোলাপ বলে; একজন শিশু, যে নিজেকে গোলাপ বলে; আর এ মহল্লার কবিতা, গল্প, চিত্রকর্ম, সংগীত দাবী করে তারাও গোলাপগৃহ— যদিও তাদের ময়লা জানে চারজন কিশোর, চারটা কুকুর।

(২)
সেউজগাড়ী মহল্লার যেকোনো বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয় প্রশ্নের উত্তর দিয়ে। কী জন্য বিখ্যাত সেউজগাড়ী? এর উত্তর সাধারণ জ্ঞানের সকল পারিবারিক বইয়ে লিপিবদ্ধ থাকলে সকল শিশু ভর্তি হয় সেউজগাড়ির সকল বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের বাইরের কেউ থাকে না সেউজগাড়ি মহল্লায়। এ মহল্লার সবাই কোনো না কোনো বিদ্যালয়ে ছিলো, আছে এবং থাকবে। বিদ্যালয়ের, বিদ্যার শর্ত কিংবা উদ্দেশ্য নিজেকে জানা ও নিজের মহল্লাকে জানা হলে সবাই এখানকার নানা বিদ্যালয় থেকে নিজেকে জানে, নিজের মহল্লাকে জানে। নিজেদেরকে জানার পর, নিজেদের মহল্লাকে জানার পর তারা জানে এবং মানে সেউজগাড়ি বিখ্যাত তার দেয়ালের জন্য।
          সেউজগাড়ি দেয়ালের জন্য বিখ্যাত হলে কারো কারো মনে পড়ে গ্রেট ওয়াল অব চায়নার কথা। কারো কারো মনে পড়ে গ্রেট ওয়াল অফ ফেসবুকের কথা, কারো কারো মনে পড়ে নিজেদের বাড়ির দেয়ালের কথা, নিজেদের বিছানার দেয়ালের কথা, নিজেদের দাম্পত্যের দেয়ালের কথা, নিজেদের নদীর বাঁধের কথা। নদীর বাঁধও যদি দেয়াল । আর যারা ধার করা জ্ঞান চর্চা করে তাদের মনে পড়ে গ্রেট ওয়াল অফ অর্থনীতি, গ্রেট ওয়াল অফ রাজনীতি, গ্রেট ওয়াল অফ ধর্মনীতির কথা। আরো নানা রকম বিষয় মনে করে তারা ভাবে সত্যি সেউজগাড়ির গৌরব দেয়াল। বিদ্যালয়ের বিদ্যায় সংরক্ষিত থাকে এ সকল গৌরব। এ সকল গৌরবে অংশগ্রহণ আছে সবার। এ সকল গৌরবের পতাকা আছে, যে পতাকা তারা ওড়াতে চায় তাদের সকল আলাপে, সকল অবসরে।

তবে সেউজগাড়ির চারপাশের প্রধান চারটা আকাশছোঁয়া দেয়াল সব সময় আহ্বান করে নিজেকে জানো, সেউজগাড়িকে জানো। মাঝে মাঝে এ দেয়ালগুলো চাঁদ কিংবা সূর্যকেও আহ্বান করে সেউজগাড়িকে জানার জন্য। আর চাঁদ-সূর্য নিয়মিত আলো পাঠালে ধরে নিতে হয় তারাও জানতে চায় সেউজগাড়ি ও তার দেয়ালসমূহকে।

সূর্য আলো পাঠালে সেউজগাড়ির চার দেয়ালে দেখি লিখিত আছে কবিতা। সেউজগাড়ির চার দেয়ালে লিখিত হয়েছে, লিখিত হচ্ছে, লিখিত হবে কবিতা। এ নিয়ম সেউজগাড়িতে চালু আছে সপ্তাহে একদিন এ মহল্লার দেয়ালে লিখিত হবে কবিতা। সেউজগাড়ির কবিরা সেদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কবিতা লেখে দেয়ালে। দেয়াল কবিতা। সপ্তাহে একদিন গল্প-উপন্যাস লেখার নিয়ম চালু থাকলে সেদিন সারাদিন সেউজগাড়ির গল্পকার ঔপন্যাসিকেরা গল্প উপন্যাস লেখে দেয়ালে। সপ্তাহে একদিন ছবি আাঁকার নিয়ম থাকলে সেদিন সারাদিন সেউজগাড়ির চিত্রকরেরা ছবি আঁকে দেয়ালে। সপ্তাহে একদিন ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি, প্রত্ননীতি লেখার নিয়ম থাকলে একদিন একদিন সারাদিন তা লেখে তারা দেয়ালে। সেউজগাড়ির চার দেয়ালে বিকশিত হতে থাকে প্রকাশিত হতে থাকে সেউজগাড়ির গৌরব। দেয়াল গৌরব।
           চার দেয়াল ও তাতে লিখিত সকল কিছুকে সেউজগাড়ির সবাই নিজেদের ঐতিহ্য ও সভ্যতা জ্ঞান করলে, মান্য করলে তা রক্ষার জন্য তারা যুদ্ধ গ্রহণ করতেও রাজি থাকে। যুদ্ধ গ্রহণে যদি অস্ত্র সংগ্রহের বিষয় থাকে, তবে তারা অস্ত্র সংগ্রহে যায় নানাভাবে। কবিতার, গল্পের, উপন্যাসের, ইতিহাসের, অর্থনীতির, রাজনীতির, ধর্মনীতির, প্রত্ননীতির অন্তরে তারা যুদ্ধের অস্ত্র বিষ জমা রাখে একটা চড়ুই হত্যা করে, অসংখ্য চড়ুই হত্যা করে। যে চড়ুই, যে চড়ুইগুলো তাদের গৃহে থাকতে চেয়েছিলো, বাসা বাঁধতে চেয়েছিলো নিজেদের ঝোপসমূহকে ভুলে গিয়ে। এই কথা বলেছিলো কেউ ধার করা বিদ্যা দিয়ে নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে, আত্মহত্যা করতে করতে, এবং সে জেনেছিল যুদ্ধের আদিম ও শেষ অস্ত্র বিষ। 

(৩)
রাত ডুবে গেলে ভোর। ভোর হেঁটে আসে সেউজগাড়িতে। চারজন কিশোর, চারটা কুকুর— তারা সেউজগাড়ির রাস্তায় রাস্তায় দেয়াল খুঁজছে। তাদের দেয়াল নাই। কিশোর চারজনের শরীরের নিম্নাংশে ছিন্ন কাপড়ের দেয়াল থাকলেও কুকুর চারটার শরীর দেয়ালহীন। চারজন কিশোর চারটা বস্তা নিয়ে সেউজগাড়ির নর্দমায় বিক্রিযোগ্য আবর্জনা সংগ্রহ করছে। তাদের বিক্রিযোগ্য কিছু না থাকলে আহার কীভাবে পাবে। মাঝে মাঝে সেউজগাড়ির দেয়ালের বাইরে যারা বাস করে তারা নিজেদের আবিষ্কৃত পথে ঢুকে পড়ে সেউজগাড়ির দেয়াল এলাকায়। সেউজগাড়ির নাগরিকরা ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই তারা সেউজগাড়ির নর্দমাসমূহ থেকে বিক্রিযোগ্য আবর্জনা সংগ্রহ করে। তাদের সঙ্গে চারটা কুকুর। কুকুরগুলো তাদের খেলার সঙ্গী। তারা আটজন সেউজগাড়ির সকল নর্দমা চেনে। সেউজগাড়ির নাগরিকদের শরীর, মনে, গৃহে এতো ময়লা জমে যে যদি সেগুলো তারা নর্দমায় না ফেলে তবে তাদের শরীরগুলো, মনগুলো, গৃহগুলো বাসযোগ্যতা হারায়।
             নর্দমায় একটা কুকুর একটা পরিত্যক্ত ফুটবল কুড়িয়ে পায়। তারা আটজন ফুটবলটা নেড়েচেড়ে মনে করে এখনো কিছু খেলা অবশিষ্ট আছে সে ফুটবলটায়। তারা অবশিষ্ট খেলাটুকু খেলতে চায়। তবে তারা এটুকু জানে কোনো খেলাই খেলে পুরোপুরি শেষ করা যায় না। সকল খেলায় অবশিষ্ট থাকে আরেকটু খেলা।
          চারটা কুকুর আর চারজন কিশোর মিলে যে খেলা হয় সে খেলাকে তারা নাম দেয় দেয়াল দেয়াল খেলা। চারজন দেয়াল হয় আর বাকি চারজন দেয়াল ভাঙতে চায়। এই খেলা তাদের খুব মধুর লাগে। তারা দেয়াল তৈরি করার সময় গান তৈরি করে গান গায়, দেয়াল ভাঙার সময়ও গান তৈরি করে গান গায়। ফুটবলটার অবশিষ্ট কিংবা উচ্ছিষ্ট খেলাটুকু ফুরাতে না পারলেও তারা খেলা থামায়। দেয়াল হারিয়ে যায়, গান হারিয়ে যায়। তারা চলে যায় সেউজগাড়ির দেয়ালের বাইরে।
          
(৪)
রাত ডুবে গেলে ভোর। ভোরের অনেক পরে সেউজগাড়ির নাগরিকরা বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখে তাদের মহল্লার দেয়ালে নর্দমার ময়লা লেগে আছে। তারা এ দৃশ্যে ভীষণ কুপিত হয়। সেউজগাড়ির চার দেয়াল তাদের ঐতিহ্য। যেখানে লিপিবদ্ধ আছে তাদের চিরকালের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, চিত্রকলা, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি, প্রত্ননীতি, ইতিহাসনীতি। তারা দ্রুত চার দেয়ালের নর্দমার ময়লা ঢেকে ফেলার জন্য রং করায় রং মিস্ত্রি জামালকে দিয়ে। তারা বুঝতে পারে না কে বা কারা তাদের দেয়ালে নর্দমার ময়লা মাখিয়েছে। দেয়াল রং করার পর তারা স্বস্তি পায়, শান্তি পায়। দেয়াল রক্ষার জন্য তারা যে কোনো কিছু করতে প্রস্তত। দেয়াল রক্ষার জন্য তারা একটা কমিটি করে। যারা দেয়াল রক্ষার জন্য পথ ও পদ্ধতি বের করবে। আর তাদের কেউ কেউ তো দেয়াল রক্ষার জন্য গবেষণা করেছে দীর্ঘদিন।
 
(৫)
রাত ডুবে গেলে ভোর। ভোর ভয়ে ভয়ে আসে সেউজগাড়িতে। চারজন কিশোর, চারটা কুকুর সেউজগাড়ির পথে পথে নর্দমায় নর্দমায় বিক্রিযোগ্য ময়লা খোঁজে। সেউজগাড়ির পথে পথে, নর্দমায় নর্দমায় মাঝে মাঝে বিক্রিযোগ্য ময়লা পাওয়া যায়, জানে তারা। তারা মাঝে মাঝে সেউজগাড়ির পথগুলোকে নর্দমা ভাবে। তখন তো তারা বলে নর্দমাপথ। তারা একটা টায়ার খুঁজে পায়। তারা টায়ারটাকে নেড়েচেড়ে দেখে তার কাছে এখনো কিছু দৌড় অবশিষ্ট আছে। উচ্ছিষ্ট, উদ্বৃত্ত দৌড়। তারা সবাই মিলে টায়ারটার উচ্ছিষ্ট, উদ্বৃত্ত দৌড়টুকু পেতে চায়। এই উচ্ছিষ্ট, উদ্বৃত্ত দৌড়টুকু দিয়ে সেউজগাড়ির দেয়ালগুলোর দিকে  যেতে চায়। তাদের শরীরে তো এতো খাদ্য নাই যা দিয়ে ছোঁয়া যায় সেউজগাড়ির গৌরব। তারা একটু পরে বুঝে ফেলে উদ্বৃত্ত বা উচ্ছিষ্ট দৌড় দিয়ে সেউজগাড়ির দেয়ালের কাছে পৌঁছানো যায় না।
           তাদের আরেকটু সময় সেউজগাড়ির রাস্তায় থাকতে ইচ্ছে হয়। তারা একটা অগভীর জলাধার দেখতে পায়। সেখানে কয়েকটা কাক একবার তাদের শরীরের ময়লা পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে আরেকবার দেয়ালে গিয়ে বসছে। কাকেদের এ দৃশ্য কিশোরগুলোর ও কুকুরগুলোর ভীষণ ভালো লাগে। তাদের এ সময় মনে হয় সকল জলে মানুষের স্বপ্ন শুয়ে থাকে।  স্বপ্নগুলো ঢেউ হয়ে দূরে যায়। স্নান হয়ে নিকটে আসে। তবে তারা বুঝতে পারে না এই এতো অগভীর জলাধারে কীভাবে স্নান করবে। তারা সে অগভীর জলাধারে স্নান করতে না পারলে ফিরতে থাকে সেউজগাড়ির দেয়ালের বাইরে। ফিরতে ফিরতে তাদের এই কথা ভাবতে খুব ভালো লাগে যে তাদের শরীর সেউজগাড়ির জলাধারের চাইতে বড়, স্নানের চাইতে বড়। তারা এই চিন্তা রোপন করতে করতে একটা আনন্দ নাচ তৈরি করে।
 
(৬)
সেউজগাড়ির নাগরিকরা বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখে তাদের দেয়ালগুলোতে আবারো নর্দমার ময়লা। দেয়াল রক্ষা কমিটি আসে। তারা বুঝে উঠতে পারে না কীভাবে ময়লা আসে দেয়ালে। তারা এ সময় সবাইকে বলে সবাই যেনো নিজেদের ময়লার সংগে দেয়ালের ময়লা মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করে। কার কার বাড়ির ময়লা দেয়ালের ময়লার মতো। তারা পুনরায় বলে সেউজগাড়ির সকল নাগরিকের শরীর, মন ও গৃহ প্রতিনিয়ত নানা রকম ময়লা সৃষ্টি করে। নিজেদের শরীরের, মনের, গৃহের ময়লা চিনতে পারলে দেয়ালের ময়লা চেনা সহজ হয়ে যাবে। 
          আকাশে মেঘ। মেঘের ছায়া সেউজগাড়ির নাগরিকদের চিন্তার উপর। সবাই এ সময় চলে যায় নিজ নিজ চিন্তার গুহায়। সেউজগাড়ির কবিরা চেনার চেষ্টা করে তাদের ময়লা। তারা দেখে তারা তাদের শরীরের, মনের, গৃহের অনেক ময়লা কবিতায় প্রকাশ করেছে। আর যে কবিতাগুলো জমা আছে সেউজগাড়ির চার দেয়ালের ভেতর। সে সকল ময়লা কি বেরিয়ে আসছে দেয়াল ভেদ করে। সেউজগাড়ির গল্পকারেরা, ঔপন্যাসিকেরাও চেনার চেষ্টা করে তাদের শরীরের, মনের, গৃহের ময়লাগুলো। তারা স্মরণ করে নিজের শরীরের, মনের, গৃহের কতো সব ময়লা তারা ঢুকিয়ে দিয়েছে তাদের গল্পে, উপন্যাসে। আর সে সকল ময়লা জমা রয়েছে সেউজগাড়ির চার দেয়ালে। তাদের মতো অর্থনীতিবিদরা, ধর্মনীতিবিদরা, প্রত্নতত্ত্ববিদরা, রাজনীতিবিদরাও ভাবে শরীরের, মনের, গৃহের কতো রকম ময়লা তারা প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে তাদের লেখায়, তাদের বক্তৃতায়। যে সকল লেখা জমা রয়েছে সেউজগাড়ির চার দেয়ালের ভেতর। কারণ এ চার দেয়াল তো তাদের শিল্প, ঐতিহ্য, ইতিহাস ধারণ করে আসছে অনাদিকাল ধরে। তারা ঠিক বুঝতে পারে না সে সকল ময়লা প্রতিদিন রাতে দেয়ালের ভেতর থেকে দেয়ালের বাইরে বেরিয়ে আসছে কি-না। 
            আকাশের মেঘ সরে যায়। ছায়া সরে যায়। তাদের চিন্তা সরে যায়। চিন্তা সরে গেলে তারা কেউ কিছু বলে না। ময়লা কীভাবে সেউজগাড়ির দেয়ালে এলো সে বিষয়টা থেকে যায় অমীমাংসিত। চিন্তার মেঘ থেকে বৃষ্টি নামে না। 
           রং মিস্ত্রি জামাল আসে। সে তার লোকজন নিয়ে খুব দ্রুত দেয়ালগুলো রং করে ময়লা ঢেকে দেয়। তবে নাগরিক সিদ্ধান্ত এরকম হয়, এখন থেকে রং মিস্ত্রি জামালকে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়া হলো চার দেয়াল রং করার জন্য। আর রং পছন্দ করার জন্য সাহায্য করবে একজন চিত্রকর, একজন কবি, একজন গল্পকার, একজন ধর্মতত্ত্ববিদ, একজন রাজনীতিবিদ।
 
(৭)
জন্ম থামে না। পৃথিবীর তিনভাগ জন্ম, একভাগ মৃত্যু। পৃথিবীর তিনভাগ রাত্রি, একভাগ দিন। পৃথিবীর তিনভাগ গোপন একভাগ প্রকাশ। এই প্রকাশটুকু বলি। এই প্রকাশটুকু নিয়ে চলি। যে প্রকাশটুকু একটা পিঁপড়া বহন করে নিয়ে যাচ্ছে অপ্রকাশের দিকে, গোপনীয়তার দিকে। এই শ্রমিক পিঁপড়াকে থামাবে কে। যে ডিম পাড়ে তার জন্য খাবার বহন করে নিয়ে যাচ্ছে সে। 
           আর এ সময় আরেকটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে সেউজগাড়িতে। দেয়ালের ময়লা কার শরীরের, কার মনের, কার বাড়ির ময়লার মতো তা যেনো কেউ টের না পায় তাই তারা সবকিছু নতুনভাবে করা শুরু করে। সেউজগাড়ির সকল কবি একই রকম কবিতা লেখা শুরু করে। একই রকম ময়লা তারা কবিতায় ব্যবহার করা শুরু করে। আর এ সময় সব কবিতাকে এক কবিতা মনে হয়, সব কবিকে এক কবি মনে হয়। সকল গল্পকার ও ঔপন্যাসিক একই রকম গল্প ও উপন্যাস লেখা শুরু করে। সবার ভাষা এক, স্বর এক, ময়লা এক। সব রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ধর্মতত্ত্ববিদ, ইতিহাসতত্ত্ববিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ একই রকম লেখা লিখতে শুরু করে। আর দেখি এ সময় সবার শরীরের, মনের, গৃহের ময়লাকে একই রকম ময়লা মনে হয়।
           রং মিস্ত্রি জামাল এখন প্রতিদিন সেউজগাড়ির দেয়াল রং করতে থাকে। সে কখনো জানেনি দেয়ালের সম্মান ও সৌন্দর্য রক্ষার জন্য এত রং লাগে।
 
(৮)
চারজন কিশোর, চারটা কুকুর সেউজগাড়িতে আজ সকালে আসে ময়লার বস্তা না নিয়ে। তাদের কিছুই কুড়াতে ইচ্ছে হয় না আজ। তাদের ইচ্ছে হয়েছে নিজেদের মুখ দেখবে সেউজগাড়ির অগভীর জলাধারে। তারা খুব বিভ্রান্ত হয় যখন সেউজগাড়ির অগভীর জলাধার তারা খুঁজে পায় না। কিন্তুু তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তাদের রাতের স্বপ্নের কাছে যে, রাতে তারা আয়না স্বপ্ন দেখেছে। যদি আয়না স্বপ্ন, তবে তা দাবী করে মুখ দেখা। তাদের কোনো আয়না না থাকলে তারা এসেছে সেউজগাড়িতে। তাদের নিকটে আজ কোনো ময়লার বস্তা না থাকলে, তারা আজ চেষ্টা করে সেউজগাড়ির দেয়ালের নিকটবর্তী হবার। আগেরবারের চেয়ে তারা আরেকটু নিকটবর্তী হতে পারে দেয়ালের। তাদের এ সময় সেউজগাড়ির দেয়াল চারটাকে আয়না মনে হয়। যে আয়নার ভেতর জমা আছে ময়লা। অপরিমেয় ময়লা। তারা বিস্মিত হয়। তারা জানে না আয়না আসলে কী প্রতিফলিত করে কিংবা কী জমা রাখে। তারা এ চারটি আয়নায় তাদের শরীর ও চেহারার প্রতিফলন দেখতে পায় না। তারা চার দেয়ালের ভেতর চারটা ময়লার পাহাড় দেখতে পায়। তারা ভয় পায়। তারা এ দেয়ালগুলো থেকে পালাতে থাকে। তাদেরকে যেনো তাড়া করেছে সেউজগাড়ির কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, রাজনীতিবিদ, ধর্মতত্ত্ববিদ, অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসতত্ত্ববিদদের সৃষ্ট ময়লার পাহাড়ের বাঘ।

(৯)
এ সময় নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়। সেউজগাড়ির জন্য যাদের ভালোবাসা উদ্বৃত্ত আছে তারা নির্বাচনে প্রার্থী হয়। শুরু হয় নির্বাচনী প্রচারণা। সেউজগাড়ির প্রশাসক হবার জন্য চারজন প্রার্থী হয়। তাদের নির্বাচনী প্রতীক হয় চার রকম রং। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ। শুরু হয় নির্বাচনী প্রচারণা। সারাদিন চলে প্রচারণা। তারা সেউজগাড়ির চার দেয়ালের মর্যাদা রক্ষার কথা বলে। প্রতিশ্রুতি দেয় দেয়ালে সংরক্ষিত সেউজগাড়ির ঐতিহ্য তারা রক্ষা করবে।
           ভোটের প্রচারণায় তারা কবিতা, গান ব্যবহার করে। ব্যবহার করে অতীত ইতিহাস, অতীত শায়েস্তা খাঁ। কেউ ব্যবহার করে ভবিষ্যতের ভাষা। জীবিত কবি আর গীতিকাররা চারজন প্রার্থীর জন্য কবিতা লেখে, গান লেখে। সুর দেয় সুরকারেরা। তারা বলে মাটির সুর— যে মাটি পিচ রাস্তার নিচে; তারা বলে বনের সুর— যে বন ছিলো এককালে। আর যারা গল্পকার, ঔপন্যাসিক, ধর্মতত্ত্ববিদ, অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসতত্ত্ববিদ— তারাও এই চারজনের হয়ে লিখে দেয় ক্ল্যাসিক বক্তৃতা। যে সব বক্তৃতা পরবর্তীকালে বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হবে। মাইক দিয়ে সম্প্রচারিত এসব গানে, কবিতায়, বক্তৃতায় সেউজগাড়ির কোথাও নির্জনতা, নীরবতা অবশিষ্ট থাকে না। শিক্ষার্থীদের বইয়ের পাতায় প্রবেশ করে এসব প্রচারণা। রুগীদের শরীরে প্রবেশ করে এ সব প্রচারণা। মাইকে সম্প্রচারিত এ সব প্রচারণা শিশুদের মুখস্থ শক্তিতে প্রবেশ করে। আর বৃদ্ধেরা বলে এ সকল প্রচারণা তাদের আয়ু বৃদ্ধি করছে। 
           নির্বাচনের সাতদিন আগে এই চারজন প্রার্থী একমত হয় যে তারা সেউজগাড়ির চার দেয়াল চারজন নিজেদের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করবে। সে সময় তাদের এ চিন্তাকে, এ কাজকে না করবে কে। কারণ নির্বাচনের চাইতে, নির্বাচিত হওয়ার চাইতে শক্তিশালী আর কিছুই নাই সেউজগাড়িতে। আর সেউজগাড়ির প্রশাসক নির্বাচিত হবার পর তার ক্ষমতা থাকে সবকিছু জীবিত করার, সবকিছু মৃত করার। 
           চারজন প্রার্থী তাহলে প্রতিজন একটা করে চারটা দেয়াল নিয়ে নেয় নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহারের জন্য। রং মিস্ত্রি জামাল তার লোকজন দিয়ে চারটি দেয়াল চারজন প্রার্থীর প্রতীক লাল, নীল, হলুদ, সবুজ রং দিয়ে রাঙিয়ে দেয়। রঙের মাঝে তাদের নাম ও ছবি থাকে।
 
(১০)
সূর্য উঠে ডুবে যায়, না, সূর্য ডোবে না। চাঁদ উঠে ডুবে যায়, না, চাঁদ ডোবে না। নির্বাচন উঠে ডুবে যায়, না, নির্বাচন ডোবে না। সেউজগাড়ির প্রশাসক নির্বাচিত হয় জুলফিকার। নির্বাচনে বিজয়ী হবার পর ফুলের মালা গলায় নিয়ে সে তার অনুসারীদের নিয়ে যায় চার দেয়ালের কাছে। সেখানে সে তার গলার ফুলের মালাটি খুলে দেয়ালের কাছে রেখে সম্মান জানায় চার দেয়ালকে। যে চার দেয়াল জমা রেখেছে সেউজগাড়ির ঐতিহ্য। 
             জুলফিকারের প্রিয় রং লাল হলে, এবং তার নির্বাচনী প্রতীক লাল রং হলে এখন চার দেয়ালের রং লাল। নির্বাচিত প্রশাসক একটা বক্তৃতা দেয়। বক্তৃতার কথাগুলো লাল। সে সময় তার সঙ্গে থাকা একজন তরুণ কবি একটা লাল কবিতা পড়ে। সে কবিতায় সে তরুণ কবি জানায়, তাদের ঐতিহ্য লাল, তাদের রক্ত লাল, তাদের গোলাপ লাল, তাদের চিন্তা লাল, তাদের গল্প লাল, শিক্ষা লাল। তারপর কবিতা শেষ হলে তুমুল লাল কোলাহল। জুলফিকার বলে বাস্তবায়ন করবে সে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। শেষ করে দিবে দেয়াল যারা ময়লা করে তাদেরকে। আর সবাই তো এটা জানে পৃথিবীর শেষ রং লাল।

(১১)
রাত কতো যে পরিশ্রম করে। তার শরীর বেয়ে বেয়ে শিশির ঝরে। শিশির বিন্দু ঘাম বিন্দুর মতো। ঘামের চেহারা বদলে গেলে তা ঘুম বিন্দু। এই শিশিরসিক্ত, ঘামসিক্ত, ঘুমসিক্ত সকালে, সেউজগাড়ির রাস্তায় যেখানে এখনো ঘাস জন্মায়, সেখানে শিশির হয়ে, ঘাম হয়ে, ঘুম হয়ে শুয়ে আছে ছিন্ন শরীরের চারজন কিশোর, চারজন কুকুর। তাদের শরীরে পৃথিবীর শেষ রং লাল।




কবীর রানা। গল্পকার। জন্ম ১৯৬৮, কুষ্টিয়ায়। ইংরেজি বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। পেশায় সরকারি কলেজের অধ্যাপক। লেখালেখি করেন লিটলম্যাগে। সম্পাদিত লিটলম্যাগ ‘নিজকল্পা’। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: ‘জল আসে মানুষের দীঘিতে’, ‘মানচিত্রকর’, ‘আমাদের গ্রামে একটা পাখিচোর আছে’, ‘বিড়াল পোষা প্রতিবেশিনীরা’, ‘কোথায় কোথায় ঘুমিয়েছিলাম’।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. ভাল লাগল। এই জন্যে সাহিত্যিকদের জীবনের আয়না বলে। আপনাকে অভিবাদন হে শক্তিমত্ত লেখক। আপনার কলম অমর হোক।

    উত্তরমুছুন

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।