TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

‘ভেতরিন লুকিয়ে হলে সঙ্গে’র পাঠ-আলোচনা: লুকানো পরিব্রাজকের খোঁজে | পর্ব: ০৩ (শেষ পর্ব) | দুর্জয় খান


ইতিপূর্বে তিনটি চিন্তাসূত্র ধরে ‘ধারয়িষ্ণু’ কবিতাটির আলোচনা করেছি। এ-প্রসঙ্গে অরবিন্দের কবিতায় দ্বান্দ্বিকতার তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। কবিতার ভেতর দ্বান্দ্বিক চিন্তা! আচ্ছা এটা এতো কঠিন কেনো? প্রশ্নটা স্বাভাবিক। যদি এখন প্রশ্ন করা হয়,  নিত্য-অনিত্যতা নিয়ে এতো কথা বলা কেনো? কি উত্তর থাকবে অন্তত কবিতার ব্যাপারে? তার কারণ এই; শুধু প্রচারের প্রভাবে নয়, বাস্তব কারণেও নিত্যতার জন্য একটা ক্ষীণ অভিলাষ মনে জাগেই। যা আছে সে তো আছেই। তার বিকল্প যদি হতো তা কি মন্দ হতো! এমন ইচ্ছার জন্ম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। একদিকে এমন অভিলাষ যেমন সহজে পূরণ হবার নয় আবার অন্যদিকে এমন চিন্তা সকলের জন্যও নয়। আর এই সারসত্যটুকু উপলব্ধি না-হলে ‘ভেতরিন লুকিয়ে হলে সঙ্গে’-এর কবিতার দ্বান্দ্বিক চিন্তা পদ্ধতির সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায় না। আর একটি দিক মাথায় রাখতে হবে, প্রায় দেখা যায়, এখনকার তরুণ কবিদের হালচালে বিরক্ত হয়ে কোনো কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক কবি বলে ওঠেন, “আমাদের সময়টা এতো কঠিন চিন্তার ভেতর দিয়ে যায়নি।” শুধু তা-ই-বা কেনো, এখনকার লেখাপড়া, খেলাধুলা, ছবি, গান, কবিতা ইত্যাদি সবকিছু নিয়ে একই মন্তব্য শুনতে পাওয়া যায়। যাঁরা বলছেন, তাঁরা যে সজ্ঞানে নিত্যতায় বিশ্বাসী-এমন নয়। কিন্তু কয়েকটি ব্যাপারে তাঁদের মনে একটা ধারণা বদ্ধমূল রয়েছে: তাঁদের সময়ে যা ছিলো সেটিই একমাত্র ভালো; তার এতোটুকুও অদলবদল হলে তা আর ভালো হতে পারে না। তবে আমি মনে করি,কবিতায় দ্বান্দ্বিক চিন্তা আত্মস্থ করতে পারলে কেউ আর অমন কথা বলতে পারবেন না। ‘আমাদের সময়ে’ যা ছিলো তা অন্যদের সময়ে যে থাকবে না, এটা মানতে না-পারার মানসিকতা জড়তার লক্ষণ। ‘আমাদের সময়ে’ যা ছিলো, তা ভালোই হোক আর মন্দই হোক, অন্যদের সময়ে তা বদলাবেই। সে-বদল আরো ভালো দিক হতে পারে, খারাপের দিকও হতে পারে। যা-ই ঘটুক, অন্তত কবিতার ব্যাপারে ‘আমাদের সময়ে’ যা ঘটতো, তাকে চিরকালীন মাপকাঠি বলে ধরাটা অ-দ্বান্দ্বিক। 

ভেতরিন লুকিয়ে হলে সঙ্গে’ কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে আকর্ষণীয় কবিতাগুলো হলো ‘অন্তিম পটল’ পর্বের কবিতাগুলো। এই কবিতাগুলো নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক।

এই পর্বের প্রথম কবিতাটি হলো ‘অবরোধ অবরোধ ম্যাচ’। এটার প্রসঙ্গে একটু পিছনে ফিরে যাই, কবিতার যে তিনটি চিন্তাসূত্রের কথা বলা হয়েছে এখানে এসে তৃতীয় চিন্তাটি বিতর্কে চলে আসে। কীভাবে? শুধু বিশ আর একুশ শতকে বিস্তর কবি, তাঁদের সবাই মার্কসবাদ বিরোধী নন। এখানেই রয়েছে নিত্যতা ও অনিত্যতার লঘু দর্পণ। আধুনিকোত্তর ভাবুকদের মধ্যে আন্দ্রেঁ লাঁক ও হেগেল-এর তাত্ত্বিক তত্ত্ব হাজির হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার যদি কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের দিকে তাকানো যায় তবে দেখেশুনে মনে হবে তিনিও লাঁক’র-ই পক্ষপাতী ছিলেন। স্লোভেনীয় ভাবুক জিজেকের যদি তাকানো যায় তবে স্পষ্ট বোঝা যাবে তিনি আরেক টাটকা নতুন আজব কিসিমের লোক। শুধু এই ভাবুকদের রচনাতেই নয়, ১৯৬০ এর দশকে খোদ মাও-জে দং তিনটি চিন্তাসূত্রকে বাতিল করে দিয়েছেন। সবমিলিয়ে  ‘বিরোধ, অভেদ ও বর্জিত মধ্যম’-এর চিন্তাসূত্রগুলো লেগেঘেঁটে ছিড়িকছাড়াক হয়ে গেছে। এইজন্য ‘অবরোধ অবরোধ ম্যাচ’ কবিতাটি স্থিতিশীল বিষয় ছেড়ে গতিশীল (পরিবর্তনশীল) বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হয়, তাহলে আগে পরিবর্তনের স্ব-স্বভাবকে আগে বুঝতে হবে। আর সেই স্ব-স্বভাবকে যাঁরা বুঝতে চাননা, তাঁদের কাছে নিত্যতা, অনিত্যতা, নিরোধ, বিরোধ, অভেদ, বর্জিত মধ্যম-এর সকল চিন্তা ব্যর্থ।

যাচ্ছি///লাম’ কবিতাটি ‘অন্তিম পটল’-এর আপামর কবিতার মূলাধার বলে আমি ধরে নিয়েছি। কবিতাটি কবি অরবিন্দ শেষ পর্ব তথা ‘অন্তিম পটল’-এর দ্বিতীয় অংশে কেনো রেখেছেন তা আমার বোধগম্য হলো না। মূল ম্যাসেজকে হয়তো লুকিয়ে রাখার প্রবণতা থাকতে পারে। তবে এখানে আমি আমার ভাবনা শেয়ার করতে পারি, কেনো উক্ত কবিতাটি ‘ভেতরিন লুকিয়ে হলে সঙ্গে’-এর ঢাল হিসেবে ব্যবহার হলো না! একটা বিষয় খেয়াল করলে দেখবেন, ‘পোয়েটিকস’-প্রণেতা অ্যারিস্টটল-এর সঙ্গে ওয়ার্ডসওয়ার্থ সহমত ছিলেন যে, কবিতা সকল প্রকার রচনার মধ্যে সর্বাধিক দর্শনভাবনাঋদ্ধ। কবিতার লক্ষ্য সত্য; কিন্তু সে সত্য স্বতঃসিদ্ধ, কবির আবেগের আন্তরিক দৃপ্ততায় বাহিত, সজীব ও সক্রিয়। এই সত্য আনন্দের বার্তাবহ; আর কবিতার মূল্য এই আনন্দ বিধানে। ইতিহাসের সত্যকে এ্যারিস্টটল বলেছেন ‘নির্দিষ্ট’ (particular); অন্যদিকে কাব্যসত্য ‘বিশ্বজনীন’ (Universal) অথচ এই ‘নির্দিষ্ট ও বিশ্বজনীন’ ভাবনাকে আমরা কখনো পৃথক করতে পারি না। এর তারতম্যকেও অস্বীকার করতে পারি না। অষ্টাদশ শতকে মানবমনকে দেখা হয়েছিলো ইন্দ্রিয়-সংবেদনসমূহের এক ‘নিষ্ক্রিয় সংগ্রাহক’ (passive recorder) হিসেবে। জন লক মনকে বলেছিলেন a tabula rasa অর্থাৎ এক টুকরো সাদা কাগজ। যদি অরবিন্দ চক্রবর্তী এমন দৃষ্টিকোণ থেকে ইন্দ্রিয়সমূহকে কবিতায় ও ভাবনায় প্রয়োগ করে থাকেন তবে কেনই বা ‘যাচ্ছি///লাম’ কবিতার মতো কবিতাটিকে নীল দরিয়ার তৃতীয় অংশে রাখলেন! ‘ভেতরিন, ইতুর ডিম, ভায়োলেন্স, ছমছম, ফুটেজ, ক্যামেরা, আগুনের গুণ’ এই শব্দগুলো কি ভাবনার সঞ্জীবনী শক্তি বা নিছক ইন্দ্রিয়-সংবেদনগুলোকে একত্রিত করে না? dissolves, diffuses, dissipates, in order to re-create-এর মতো Imagination প্রতিস্পর্ধার উপাদানসমূহের ভারসাম্য বা সমন্বয় সাধন করে না? অথচ ‘জনখেলা’ কবিতায় তিনি যেভাবে এ্যালিগরির ব্যাপারটি ফুটিয়ে তুলেছেন তার পরের  প্রসবকৃত বাচ্চা বলা যায় ‘যাচ্ছি///লাম’ কবিতাটি।

অন্তিম পটল’ পর্বটি আরো আলোচনা করলে দেখা যাবে, ‘আর্কিটাইপ’-এর ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। আর্কিটাইপের সাহিত্যিক তত্ত্বের উৎস হচ্ছে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক নৃবিজ্ঞানের পঠনপাঠন ও গবেষণা, যে সম্পর্কে অন্যতম মৌলিক গ্রন্থ হচ্ছে জে.জি ফ্রেজারের আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘দি গোল্ডেন বাউ’ ( ১৮৯০)। বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতিতে সূদুর অতীত থেকে আজ পর্যন্ত মিথ এবং রিচুয়ালের যে মৌলিক প্যাটার্ন বারবার ঘুরেফিরে আসে, উপকথা তা বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে শনাক্ত করে ধারবাহিকভাবে ইতিহাসের মাধ্যমে লেখক ওই গ্রন্থে ফুটিয়ে তুলেছেন। অন্যদিকে আর্কিটাইপ তত্ত্বের আরেক উৎস হচ্ছে কার্ল ইয়্যু-এর গভীর ও সূদুরসন্ধানী মনোবিজ্ঞান। ‘মন্দ→মন্দা←সুর’ কবিতায় কতকগুলি মৌলিক শব্দের পৌনঃপুনিক অভিজ্ঞতার ফসল হিসেবে পাই। সেসব অভিজ্ঞতা যেনো অতীন্দ্রিয় অনুভূতির তলানি এবং আদি চিত্রকল্পের রূপ নিয়ে মানবজাতির যৌথ অবচেতনাকে উত্তরাধিকারসূত্রে সঞ্চারিত করছে, প্রভাবিত করছে। মড বোডকিনের ‘আর্কিটাইপাল প্যাটার্নস ইন পোয়েট্রি’ (১৯৩৪) প্রকাশ হবার পর থেকে আর্কিটাইপ ব্যাপারটি ব্যাপক সমালোচনায় এসেছে। অরবিন্দের কবিতায় যৌথ অবচেতন তত্ত্বটি একেবারেই ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে। গঠন-কাঠামো, টাইপ এবং চিত্রকল্প অতীন্দ্রিয় অনুভূতির তলানি থেকে উঠে এসেছে। ব্যাপারটি আরো পরিস্কার হতে, ফ্রেজার ও বোডকিন এবং নর্থরপ ফ্রাই’র ‘দি এ্যাটানমি অব ক্রিটিসিজিম’ ( ১৯৫৭) এবং জি. উইলসন নাইটের ‘দি স্টারলিট ডোম’ (১৯৪১), রবার্ট গ্রেভসের ‘দি হোয়াইট গডেস’( ১৯৪৮), রিচার্ড চেইসের ‘কোয়েস্ট ফর মিথ’ ( ১৯৪৯) গ্রন্থগুলো পাঠ করতে পারেন।

সবচেয়ে লক্ষনীয় ব্যাপার হলো ‘অন্তিম পটল’-এর কবিতায় এ্যান্টিথেসিস বহুলভাবে বিদ্যমান। তার প্রয়োগ কতখানি গভীর তা কবিতার সন্নিবেশিত শব্দগুচ্ছগুলো অবলোকন করলে বোঝা যায়। আর্কেইজমকে পুনর্গঠন করে একেকটি বাক্যে এমনভাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে যে, ফিগারেটিভ ভাষার একটি কৌশল। ঠিক মেটাফর, সিমিলি, পার্সনিফিকেশন, সিম্বল, এ্যালিগরির মতোই। তবে কবিতাগুলোতে এ্যাপসট্রপিকে কতটা উহ্য রাখা হয়েছে বর্ণনাক্রমের প্রায়োগিক রূপ বোঝা মুশকিল। এ্যাসোন্যান্স হোক অথবা এ্যাটমোসফিয়ার ক্রিয়ার প্রতি আকৃষ্টের পরিবর্তে এ্যাসাইড বা জনান্তিক ব্যাপারটি পাঠককে তীব্রভাবে আক্রান্ত করবে। আমি ক্যাকোফনির ঘোর বিরোধী, তাই আলোচনা ও সমালোচনার ক্ষেত্রে বাক্যের এমন জায়গায় এ্যাফেকটিভ ফ্যালাসি ও এইজ অব রিসন’কে ঢুকিয়ে দেবো যা স্বয়ং কবিতা হয়ে উঠবে কবিতার বিরোধী। যার কারণে নিজের ভেতর দিয়ে ভ্রমণকালে ‘ভেতরিন লুকিয়ে হলে সঙ্গে’র কবি অরবিন্দ চক্রবর্তীকে পরিব্রাজক হিসেবে আবিষ্কার করি। এ-পরিব্রাজক মূলত ‘লুকিয়ে হলে সঙ্গে’।


                           [সমাপ্ত]




 লেখকের অন্যান্য লেখা: 


দুর্জয় খান। কবি ও সমালোচক। জন্ম: ১২ ই অক্টোবর ১৯৯৬, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: ‘মানসিক অতৃপ্তির আখ্যান’ (২০২০) ও ‘ছায়াক্রান্তের শব্দানুষঙ্গ’ (২০২১)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. প্রায় দেখা যায়, এখনকার তরুণ কবিদের হালচালে বিরক্ত হয়ে কোনো কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক কবি বলে ওঠেন, “আমাদের সময়টা এতো কঠিন চিন্তার ভেতর দিয়ে যায়নি।” শুধু তা-ই-বা কেনো, এখনকার লেখাপড়া, খেলাধুলা, ছবি, গান, কবিতা ইত্যাদি সবকিছু নিয়ে একই মন্তব্য শুনতে পাওয়া যায়। --- এই অংশ নিয়ে চিন্তার কিছুই নেই। প্রবীণরা যুগে যুগে তরুণদের সম্পর্কে সবসময় একই মন্তব্য করেছে। সব দেশে সব কালে। যা হোক লেখাটি ভাল লেগেছে। চিন্তা উদ্বায়ী এরকম লেখা আরও চাই।

    উত্তরমুছুন

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।