TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

রূপা | মাহবুবুল ইসলামের গল্প


এই নিয়ে ছয়জনকে রিজেক্ট করেছে রূপা। রিজেক্ট করার কারণ এই নয় যে, সবার মাঝে ত্রুটি পেয়েছে। বরং কোন ত্রুটি না পাওয়াটাই রূপাকে প্রশ্নবিদ্ধ  করেছে। কারণ, রূপা মনে করে ত্রুটিহীন মানুষ হয় ফেরেশতা কিংবা শয়তান। আর রূপা এমন একজন মানুষকে বিয়ে করবে যার দোষ গুণ দুটোই থাকবে। তার দোষ ত্রুটির জন্য ছোট ছোট মান, অভিমান হবে, তার পুরুষ চেষ্টা করে যাবে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হতে। তাছাড়া নিখাদ কোন স্বর্ণও হয় না। এমনিতেই রূপা বড্ড ডানপিটে, আউটস্পোকেন এবং আনকম্প্রমাইজিং, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক সুন্দরী মেয়ে। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েরা যখন passive সে একজন active voice.

এবার সাতনম্বর পাত্রের সাথে সাক্ষাৎ। রঞ্জুর কথায়, তারই এক ব্যাংকার ছাত্রের সাথে রূপা দেখা করতে এল রেস্টুরেন্টে।
দেখা গেল, পাত্র মিয়া বেশ পাংচুয়াল। সময়ের আগেই এসে উপস্থিত। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। আজ শনিবার। ব্যাংক তো বন্ধ। বউ দেখার চেয়ে আর কোন জরুরি কাজ তো হতে পারে না। নাকি ঘড়ি দেখা তার  বাতিক। রূপার এক খালু অযথাই বারবার ঘড়ি দেখত। একবার তো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ঘড়ি দেখতে গিয়ে ম্যানহোলে পড়ে যায়। কী যে কান্ড! খালা তিনদিন আলাদা রুমে আইসোলেটেড করে রাখে রূপার খালুকে।
পাত্র মশায় রূপাকে দেখেই চেয়ার থেকে উঠে ভিক্টোরীয় যুগের জেন্টেলম্যানের  মতো দাঁড়িয়ে রূপাকে সিট অফার করল। ফরমাল আচরণ। মনে হয় ক্যালকুলেটিভ মাইন্ডেড। তবে পরিচয়ে শুধু নামটাই বলল। তাও নিকনেইম বোধ হয়। বিপু। রূপা ভাবল, যাক আগেরকার এক পাত্রের মতো বলেনি যে, “আমার নাম কায়সার হামিদ চৌধুরী। পেশায়  ব্যবসায়ী। উত্তরায় এক বিলাসবহুল বাড়ির মালিক।”

ওয়েটার খাবারের মেন্যু নিয়ে আসতেই রূপার দিকে বিপু তাকিয়ে বলল, “লেডিস ফার্স্ট। আপনিই অর্ডার করুন কী খাবেন।”
লোকটা কি ফরমালিটি করছে না কি আসলেই ভদ্র? সাধারণত মানুষ অসংখ্য মুখোশ পরে থাকে। গ্রীক, রোমান ভাষায় যেটাকে persona বলে। এটা থেকেই personality এসেছে। যে যত বেশি পার্সনালিটির অধিকারী, সে তত বেশি মুখোশধারী, কৃত্রিম। 
রূপা বলেই দিল, “ওইসব মেকি ডায়ালগ ঝারবেন না। দেখছেন না, মলগুলোর দোকানের সামনে লেখা থাকে ‘customer is always right, we are at your service.’ এইসব পূজিবাদীর কুটকৌশল। মানুষের পকেট খালি করার ধান্দা।
বিপু যেন একটা ধাক্কা খেল, “অলরাইট। কাম ডাউন।আপনি মনে হয় বামপন্থি।”
রূপা বলল, “এইতো কিছু বললেই একটা ইজমে ফেলা মানুষের  একটা স্বভাব।”

‘তা নয়’ এই বলে বিপু প্রসঙ্গ অন্যদিকে নেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু ঠিকঠাক কোন বিষয় পাচ্ছে না বেচারা।
লোকটা কি woman conscious? এরকম ছেলে প্রথম মায়ের আচল ধরে ঘুরে তারপর বিয়ের পর বউয়ের পিছন ঘুরঘুর করে। রূপার এমন ছেলে পছন্দ নয়। সে যেহেতু active voice, তাই সে প্রসঙ্গ তুলল—
“আপনি কি জানতে চাচ্ছেন আমার কোন বয়ফ্রেন্ড আছে কি না?”
“থাকাটা তো স্বাভাবিক। তবে আমার বিশ্বাস আপনার নেই।”

রূপা এবার উৎসুক হয়ে জানতে চাইল, “এরকম মনে হল কেন?”
“আমি ডেরেন ব্রাউনের মতো মাইন্ড রিড করতে পারি।” এই বলে বিপু হাসতে লাগল।
রূপা এই প্রথমবার ভালোভাবে তাকাল বিপুর দিকে। হাসিটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। হ্যাঁ, রঞ্জুর মতো। অদ্ভুত এবং রহস্যময়। আশ্চর্য! ভিন্ন দুটো  চেহারর মানুষের হাসি একরকম হতে পারে? পৃথিবীতে সাতজনের চেহারা মোটামুটি একরকম হওয়ার একটা হাইপোথিসিস আছে। যেটাকে doppelgängers বলে। হাসি  তো মিলতেই পারে। তবে এতক্ষণ আলাপ করে আবিষ্কার করল, লোকটার মাঝে গুণ যেমন আছে, দোষও আছে। 
সুন্দর চেহারাটায় অতিরিক্ত মোটা নাকটা যেন মাকড়শার মতো ঘাপটি মেরে বসে আছে। লিওনার্দোর মানুষের সৌন্দর্যের একটা গোল্ডেন রেশিও আছে। তবে পাত্র সাহেবের চেহারার ক্ষেত্রে এই রেশিও মানা হয়নি। রূপার পদার্থের শিক্ষক পাটোয়ারী স্যারের কথা মনে পড়ল যিনি কলেজের প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকেই মোটা, বড় নাকটা দেখিয়ে বলে,
“এই যে আমার নাকটা দেখছ, এটা একটা ভেক্টর রাশি।”
বিপু রূপাকে চুপচাপ দেখে মুচকি হেসে বলল, “এই মুহুর্তে আপনি কী ভাবছেন আমি বলতে পারব?” রূপার কিছু বলার আগেই বিপু বলতে লাগল
“তার আগে বলি, আপনি একজন বুদ্ধিমান প্রাণী। একটু অদ্ভুতও। আপনি ADHD এর রোগের শিকার। লিওনার্দোসহ পৃথিবীর অনেকেরই এই সমস্যা ছিল। এইসব মানুষের micro কিংবা macro সব বিষয়ে তীব্র আগ্রহ থাকে। তারা প্রেমে পড়ে না। কারণ প্রেমে পড়তে হলে একটু বোকা হতে হয়।
তবে এরা (মেয়েরা) রাণী মৌমাছির মতো। এদের প্রেমে কুপোকাত হয় অনেকেই। এরা নিরাসক্ত থাকে।”
 
রূপা বলল, “আর আমি এখন কী ভাবছি?”
বিপু মশাইয়ের মনে হল রাজ্যজয় করেছে। কনফিডেন্টলি বলল,
“আপনি আমার বিষয়ে নেতিবাচক চিন্তা করছেন। সম্ভবত নাক নিয়ে। আর হ্যাঁ ADHD এর সমস্যা হল তারা যে কোনো বিষয়ে খুব দ্রুত আগ্রহ হারিয়েও ফেলে।”
রূপার এইসব ESP-তে কোন বিশ্বাস নেই। বরং উল্টো অভিযোগ করল, “আপনার পন্ডিত রঞ্জু স্যার এইসব শিখিয়ে পাঠিয়েছে। তাই না? আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য। শুনুন, এইসব বলার জন্য ESP ক্ষমতা লাগে না। guess করেই বলা যায়। তবে পাত্র হিসেবে আপনি খারাপ না।”
“কতনম্বর পেলাম"
“প্রথম সাক্ষাৎ। সারাজীবন একসাথে বাস করেও একজন আরেকজনকে বুঝতে পারে না। দেখা যাক। তবে যদি সত্যিই আপনি রঞ্জু ভাইয়ার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে থাকেন, তাহলে পরীক্ষায় আন্ডা পাবেন।”
বিপু রূপার কথা কোন কর্ণপাত না করেই বলল
“আমার যা বলার বললাম। বিশ্বাস, অবিশ্বাস  আপনার উপর। তবে আরেকটা বিষয় বলতে পারি যেটা আপনি কিংবা রঞ্জু স্যার দুইজনের অজানা।
আপনার বিয়ে হবে এমন একজনের সাথে হবে যার দুটো সুন্দর বাচ্চা আছে।”
এই বলে বিপু রূপাকে একটা সিএনজিতে উঠিয়ে দিয়ে সুনসান রাস্তায় হাঁটা শুরু করল।

রূপা বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো। হঠাৎ করে লোকটা যেন শূন্যে মিলিয়ে গেল। কী বলে গেল বিপু!  আসলেই কি ডেরেন ব্রাউনের মতো মাইন্ড রিডার?  নাকি অতিপ্রাকৃত কোন প্রাণী। আকাশ অন্ধকার হয়ে আসল। বিকেলটাকে মনে হল এক ঘনকালো রাত। আর রূপার সামনে একটি অমীমাংসিত রহস্য।

নিকোলাই গগলের দি নৌজ গল্পের নায়ক যেমন সমস্ত জায়গায় তার হারানো নাকটা দেখতে পায়, সেই বিকেলের পর থেকে বিপুর অদ্ভুত নাকটা আর তার ভবিষ্যৎ বাণী রূপার চারপাশে ভাসতে লাগল।

রূপার সবচেয়ে খারাপ লাগার বিষয় হল, মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সে আজ নিজেই একটা গিনিপিগে পরিণত হলো। এতদিন নিজেকে প্রো-এক্টিভ সহজে কোন কিছুতে বিচলিত হয় না, এমন ভাবত। সে যে একটা রিয়ালিটির জগতে বাস করত, আজ এটায় চিড় ধরল। নিজেকে সে ভাবতে লাগল প্লেটোর সেই গুহাবন্দি মানুষের মতো যে গুহার বাইরে এসে দেখতে পায়, গুহার দুইমাত্রার ছায়ার জগতটা আসলে বিভ্রম, মিথ্যা। জগত ত্রিমাত্রিক।
তাহলে তো এর বাইরেও আরও সত্য থাকতে পারে, হয়ত আমাদের অজানা। নাকি বিপু মাইন্ড গেইম খেলেছে। বেশ কিছু সত্যের সাথে একটা অদ্ভুত মিথ্যা মিশিয়ে বলেছে। অনেকের কাছে এটা একটা আর্ট। আর্ট মানেই আর্টিফিশিয়াল। এমনতিই মানুষ সত্যের চেয়ে মিথ্যাটাকে বেশি বিশ্বাস করে। তবে এরজন্য মানুষকে অনেক কিছু সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে হয়।
বিপু কি সেই কৌশলটার আশ্রয় নিয়েছে?
অবশ্য কেউ মিথ্যা বললে ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা যায়, এটা রূপা বিহেভিয়ার সায়েন্সে পড়েছে।
এরজন্য প্রথমে মানুষকে সহজ কিছু প্রশ্ন করে তার চেহারার নাচারাল এক্সপ্রেশনটা বুঝতে হয়। তারপর কিছু অদ্ভুত জটিল প্রশ্ন করে ফেস রিড করে ওই মানুষটি মিথ্যা বলছে কি না তা নিশ্চিত করা হয়। লাই ডিটেক্টর একাজটাই করে। যেমন পিউপিল ডাইলেশন, মিনিটে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি পলক ফেলা (মিনিটে ১৫/২০বার), গলা জড়িয়ে আসা সবই একটা ভিন্ন সেনসেশন তৈরি করে, যা চেহারায় ভাসে। তবে এটাও ঠিক, mentalism যারা প্র্যাকটিস করে তারা এরকম কোন ক্লু দেয় না যার মাধ্যমে তাদের মোটিভ অন্যরা বুঝতে পারে। বিপু সবকিছু খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলেছে।

রূপার মন বর্তমানের গণ্ডি পেরিয়ে চলে গেল অতীতে। তার নানুর কথা মনে পড়ল। তার নানু স্বপ্নযোগে ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা জানতে পারতেন। তার নানার মৃত্যুর আগে তার নানু প্রায়ই স্বপ্নে দেখতেন শাদা ধবধবে পাঞ্জাবি পরে বাড়ি ফেরার সময় কে যেন রক্ত ছিটিয়ে দেয়। নানু বারবার পরিস্কার করলেও যায় না। এর কয়েকদিন পরেই নানা এক্সিডেন্টে মারা যান। আর মানুষ যখন লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরে তখন নানু নানার পাঞ্জাবি ভরা রক্ত দেখতে পান, ঠিক যেরকম স্বপ্নে দেখতেন। একইরকম ঘটনা বড়মামা মারা যাবার পরও ঘটে।
এইতো সেদিন dream premonition নিয়ে একটা বইয়ে রূপা জানতে পারে, জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর আগে তার ওয়াইফ  স্বপ্নে দেখে, সিজার সভায় যাওয়ার মুহূর্তে কে যেন পিছন থেকে এসে হত্যা করে। বারণ করা সত্ত্বেও সিজার তার স্ত্রীর কথা অবহেলা করে এবং ঠিকই আততায়ী এক সভায় যাওয়ার সময় পিছন থেকে এসে হত্যা করে চলে যায়।

আব্রাহাম লিংকনও মৃত্যুর আগে স্বপ্নে দেখতেন, একটা কফিনে করে লাশ ওয়াইট হাউসের দিকে লোকজন নিয়ে আসছে। তিনি সব ডায়রিতে লিখতেন। ঠিক গ্রেটিসবার্গ স্পিচ দেওয়ার সময় এক আততায়ীর হাতে ট্রেনে নিহত হন।

এইসব ভাবনা বিদ্যুতের বেগে রূপায় মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। রূপার মনে হলো সে আজ matrix এর জগতে বাস করছে।
আর কোনকিছু সে ভাবতে চায় না। তবে হয়তো এর সমাধান একমাত্র রঞ্জু ভাই-ই দিতে পারে।
আর এই মুহুর্তে তিনি ছাদেই থাকেন। 

বিপত্নীক হবার পর, রঞ্জুর মাঝে অনেক বিবর্তন ঘটেছে। সে স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে চাপায়ী প্রাণীতে পরিণত হয়েছে।
যখন ছাদে থাকে তখন এ্যান্ড্রয়েড ফোন কিংবা বই কিছুই থাকে না। একটা নিশ্ছিদ্র নীরবতা আর বড় একটা ফ্লাক্স ভর্তি চা থাকে। আরেকটা বাতিক হয়েছে যেটা তার মৃত স্ত্রীর কাছ থেকে জেনেটিক্যালি না হোক মিমিটিক্যালি  সে পেয়েছে। সেটা হলো, এরকম জ্যোৎস্নার রাতে একা একা বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকা। রূপা মনে করে প্রাচীন গ্রীসে বা রোমে যেমন নীরবতার মাধ্যমে বিভিন্ন ভাষা বয়ান করতো, রঞ্জুও তার মৃত স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা দেখাতেই এই ডেমো দিয়ে থাকেন আজকাল।

চল্লিশ বছরের এই মানুষটার আরেকটা বিবর্তন ঘটেছে। সেটা হলো নারী বিবর্জিত এক নিঃসঙ্গ প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। ঠিক সেলিবেসি প্লেটোর দর্শন। কর্ডাটা পর্বের প্রাণি হতে এ্যামিবা গোত্রের। সে নিজেই নিজেকে ভেঙে বিবর্তন ঘটাচ্ছে। তবে অযৌন জীবের মতো।
অথচ একসময় সবাই একসাথে ছাদে থাকলে মজার মজার aphorism বলত। যেমন:
“নারী ও চাঁদ দূর হতেই সুন্দর
কাছে গেলেই ধূলিময় প্রান্তর।”
“কবি এবং চাঁদ
উভয়ই সামবাদী জীব
কাউকেই আনফ্রেন্ড করে না”
এরকম অনেক চরণ।
এখন কেমন যেন চুপসে গেছে। একজন আউটসাইডারের মতো থাকে।
রূপার উপস্থিতি টের পেয়েও চাঁদের দিকে মনোযোগ রেখেই বলল, “বসো”।
“চা খাবে?”
রূপা বলল, “না”
“রূপা, তুমি কি জরুরি কিছু বলবে।”
রূপা ভাবছে আজকের ঘটনাটা শেয়ার করা উচিত?
রঞ্জু কিছু শোনার অপেক্ষা না করেই বলল, “আজকের জোছনা কি বিষণ্ণ সুন্দর! তাই না? তোমার আপু বেঁচে থাকলে বিভিন্ন এঙ্গেলে ছবি তুলে ফেবুতে আপলোড করত। খুব ভালো ফটোগ্রাফি করতে পারত।”
রূপা বুঝতে পারল রঞ্জুর মন আজ খারাপ। সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলল “আপুর জন্য আমাদের সবার খুব খারাপ লাগে। এতো অল্পতেই আল্লাহ নিয়ে গেল আপুকে। আম্মু তো রোজ রাতেই বাচ্চা দুটোকে কোলে রেখে কাঁদে। জানেন, আপু আর আমি ছিলাম দুই বিপরীত মেরুর। আমার ফিলোসফি বরাবরই tit for tat.
আর আপু ছিলো, একগালে কেউ আঘাত করলে, আরেকগাল বাড়িয়ে দাও। আপুর ডানমস্তিস্ক বেশি সক্রিয় আর আমার বাম মস্তিস্ক।”

রঞ্জু চশমাটা খুলে চোখ মুছতে মুছতে বলল “আসলে কী জানো! প্রকৃতি ভালো মানুষকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখে না। তোমার বোন ছিল সংসারের এক যিশু। আমার মাও এমন ছিল। চারপাশটাকে আলোকিত করে রাখত। সে যখন আমার পাশে থাকত, তখন আমার জগতটা সুশৃঙ্খল থাকত।
কিন্তু প্রকৃতি এটা মেনে নেয় না।
ত্রুটিহীন মানুষ প্রকৃতির রীতিবিরুদ্ধ।
সত্যি বলতে, আমরা একটা এনট্রপিক বিশ্বে বাস করি যেখানে প্রকৃতি শৃঙ্খলা থেকে বিশৃঙ্খলা, ধ্বংসের দিকে যায়।
এই যে চারপাশে বাড়ি-ঘর দেখছ, ভালোবাসা আর স্বপ্নের বুনন-সবই ধ্বংস হয়ে যায়।
প্রকৃতি ছোট ছোট শৃঙ্খলা তৈরি করে আসলে এনট্রপির জন্যই।
যেমন সূর্যের জীবন ক্ষয়ের জন্য এই নীলাভ পৃথিবীতে কতগুলো শৃঙ্খল জীবের সৃষ্টি। এর শক্তি আমরা ব্যবহার করি তাপ ক্ষয় হয় এবং একসময় সূর্যের জীবনও এভাবে শেষ হবে।
যে মানুষটার মাঝে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা জমা থাকে প্রকৃতির চোখে পড়ে। সে ছিনিয়ে নেয়। প্রভু এই নিয়মে বন্দি রেখেছেন। পৃথিবীতে নিখাদ ভালোবাসা তাই স্বল্পসময়ের। কিংবা ঘুরিয়ে বলা যায়—
“Our sweetest songs are those that tell of saddest thoughts.
ট্রাজেডি দেখো, তোমার আপু চলে যাবার পর, বুঝতে পারছি সে কতোটা কাছের ছিল।”
রূপা থামিয়ে বলল, “এইজন্যই কি আপনি বিয়ে করছেন না? নাকি বাচ্চা দু'টোর জন্য?”
“বলতে পারো এই দুইটা কারণেই। কিংবা এর চেয়ে কোন আরেক কারণ যেটা আমি প্রতিদিন এই নিসঃঙ্গতায়, নিস্তব্ধতায় খুঁজে ফিরি।”

রূপা প্রসঙ্গ এড়িয়ে বিপুর কথা তুলল “ভাইয়া, একটা  কথা শেয়ার করতে চাচ্ছি।  বিপুর কথা।”
এইটুকু বলা শেষ করতে না করতেই রন্জু বলে উঠল, “আরে, আসল বিষয়টা বলা হলো না। সারাদিন মিটিং এ বিজি ছিলাম। ফোনও নাকি বাসায় ফেলে গেছ আজ। বিপু তো গ্রামের বাড়ি গেছে। তার মা অসুস্থ।”
রূপা নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
“কী বলছেন ভাইয়া। তাহলে আমি কার সাথে দেখা করলাম।”

"Have you gone nuts? সে তো গ্রামে। দেখার তো  প্রশ্নই আসে না। তোমার কোনো বন্ধু মনে হয় prank game খেলেছে। তুমি তো সবার সাথে মাইন্ড গেইম খেলো। sweet revenge হয় কেউ তোমার উপর নিয়েছে।”
 
রপার যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। রুমে এসে ভাবতে লাগল, আসলেই কি কেউ মজা করেছে?
নাকি অলীক সব ঘটনা ঘটছে তার সাথে? 
টেলিফোনের রিংটোন বেজে উঠল। রূপা রিসিভ করতেই ওইপ্রান্ত থেকে একটা অদ্ভুত কন্ঠের আওয়াজ ভেসে এল। 
“রূপা বলছেন? আমি বিপু।” রূপার কাছে মনে হল এই কন্ঠ সে চিনে না। এই গ্রহের কোন কন্ঠও না। যেন দূর নক্ষত্রের ওপার থেকে কেউ বলছে। “আমি বিপু। কথা শুনুন।” রূপা লাইন কেটে দিল। তারপরও কণ্ঠের আওয়াজ বাজছে পুরো রুম জুড়ে।
“রূপা বলছেন? আমি বিপু। একটিবার কথা বলুন।”
রূপা বিবশ, নিশ্চল পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।


মাহবুবুল ইসলাম। গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। ইংরেজি প্রভাষক, শাহজালাল সরকারি কলেজ। পৈতৃক নিবাস: মাধবপুর, হবিগঞ্জ। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘জল ও জলোচ্ছ্বাস’ (চয়ন প্রকাশন, ২০১৮), ‘শিশির হরফ’ (চারবাক,২০১৯)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।