বীজতলায় বুনেছি মানুষ এক
প্রতিটি মানুষই একেকটি বই, কালো, সাদা, শ্যাম প্রচ্ছদের বই, বইগুলোর প্রথম অধ্যায় গর্ভ আর শেষ অধ্যায় কবর
দুটোই আকর্ষণীয়, দুটোই অন্ধকার
সময়ের আঙুল উল্টে যাচ্ছে মাঝ পথের একেকটি পৃষ্ঠা, আমি পড়ে যাচ্ছি ফিল্মের রিলের মতো
কি পড়ছি কি জানছি কিছু বলতে পারছি না।
বীজতলায় বুনেছি মানুষ দুই
সতর্ক চোখ রেখে বনে জঙ্গলে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে পারি, শঙ্কাহীন সকল হিংস্র প্রাণী থেকে—
বাঘ সিংহ হায়না তো দুরভিসন্ধি জানে না
অথচ অস্ত্র হাতে মানুষের ভীড়ে যেতে পারি না
মানুষ মিষ্টি হেসে কাছে আসে, উদারতার কথা বলে, আর মনে মনে ফন্দি আঁটে, কী করে খাবে ফ্রাই না রোস্ট।
সেদিন ছিল কিস্তিবার
একটা আধখাওয়া চাঁদ আকাশে ঝুলে আছে, উঠানে দাঁড়িয়ে চাঁদটা পরখ করছে মা
ঘরে কর্ কর্ একটা শব্দ হলো, সাথে যুবতী মেয়েটাও চাপা গলায় ককিয়ে উঠল উফ!
শব্দ দুটি উড়তে লাগলো হাওয়ায়, উড়ে যেতে লাগল পূর্ব থেকে পশ্চিমে—
সাথে আধখাওয়া চাঁদটা ঢুকে যেতে লাগলো একটা ঘন কালো দীর্ঘশ্বাসের ভেতর
এর বাইরে কে যেন বেল বাজাল, কে যেন ডাকল, অন্ধকার ঘিরে ধরছে কুপির আলো
মা শুধু জ্বলজ্বল দুটি চোখের দিকে, মেয়ের আয়ের টাকাটা কম্পিত হাতে এগিয়ে দিল।
পাড়ার দোকান
পাড়ার প্রতিটি দোকানের সামনে দু’একটি ছাগল বসে থাকে, যে ছাগলেরা কোনোদিন স্কুল মাঠে ঘাস খায়নি
তারাই ওখানে কলেজ মাঠের গল্প করে
ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি পৃথিবীর প্রতিটি মাঠ সম্পর্কে তাদের অগাধ ধারণা
ঘাস সম্বন্ধীয় গল্পও তাদের কখনো ফুরোয় না
দেখি নিম পাতা, কাঁঠাল পাতা নিয়েও প্রায় ঝগড়া করে—
তাদের গল্প, ঝগড়া শুনতে শুনতে আমারও কণ্ঠে এখন ভ্যাঁ ভ্যাঁ আওয়াজ আসে
বুঝি না এখানে থেকে থেকে আমিও মনে হয় ছাগল হয়ে উঠছি!
বউ
আমার ঘরে একটা বৃক্ষ আছে, বৃক্ষটি ঝাঁকি দিলে পাতার পরিবর্তে টাকা পড়ে, আবার চার পদের ফলও ধরে
বৃক্ষটি লতিয়ে উঠছে, কয়েকটি কুমড়ো লতা, লাউ আর ধুন্দুল
রাতে ফিরে বৃক্ষটির শাখায় জামা গুছিয়ে রাখি, গায়ে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করি, আর ফলে ঠোঁট রেখে ঘুমাতে যাই
বৃক্ষটি আমার মধ্যে নিজেকে উজার করে দেয়, আমি ধীরে ধীরে হয়ে উঠি তার ঘনিষ্ঠ প্রেমিক।
সুখ ও দুঃখ
সুখিরাম ও দুঃখিরাম আমার দুই বন্ধু, আমি সুখিরামকে খুব পছন্দ করি, আর দুঃখিরাম আমাকে
দুঃখিরাম আমার দিকে এগিয়ে এলে, আমি সরে যাই সুখিরামের দিকে
মাঝে মাঝে সুখিরাম হারিয়ে যায়, লোকালয় থেকে অনেক দূরে বিরানমাঠে
অথচ দুঃখিরামকে ফেলে আমি কোথাও যেতে পারি না
অলকানন্দা পাড়ে নিবির সন্ধ্যা, আর অধরার চাঁদ,
একা একা চাঁদ দেখি, চাঁদ হেসে ওঠে, আর হেসে ওঠে দুঃখিরাম
সুখিরাম আমাকে ফাঁকি দেয় ঠিকই, আমি দুঃখিরামকে কখনোই ফাঁকি দিতে পারি না।
প্রেমিক
একটি নেড়ি কুকুরের ছোটাছুটি অথবা একটি প্রতিশ্রুতিহীন বৃক্ষের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা
কোনো প্রেমিক পুরুষের উদাহরণ হতে পারে না
প্রেমিক হতে হলে অন্ধ হতে হয়, শুধু অন্ধ নয়, অন্ধ হয়ে নরকের সূক্ষ্ম পুলসিরাত পেরিয়ে যেতে হয়।
ইনসোমনিয়া
ঘুম না এলে, হাতকে কল্পনা করি নদী, চোখকে দ্বিখণ্ডিত আকাশ, আর নিঃশ্বাস যন্ত্রণা নিবারণ যন্ত্র
কল্পনা করি একটি শান্ত নদী, একটি ছোট নৌকা, আর একই পাটাতনে শুয়ে আছি আমি ও ইরিন
মূলত এসব ডাক্তারের পরামর্শ, বাস্তবে আমার যা কিছু সত্য যা কিছু প্রকৃত, তা ভেবে আমি কখনো ঘুমাতে পারি না।
অপচয়
রাগ করে কী হয়, যখন ঠিক সময়ে জ্বলে ওঠে উনুনের আগুন, যখন মুদির দোকানের ফর্দটা পৌঁছে যায় সময়ের আগে
লবণ মরিচ পেঁয়াজ কোনো কিছুই তো অপচয় হয় না
চিরুনিতে লেগে থাকা চুল, তেলের খালি বোতল, দুধের প্যাকেট— ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসগুলোও সঞ্চয় হয় ঠিকই—
শুধু শুধু অপচয় হয়, আমাদের মহামূল্যবান কথা, স্পর্শ, চুম্বন।
কমরেড
একটি সোনা ব্যাঙ, চোখের সামনে চিবিয়ে খেল একটা দেড় ফিট জীবন্ত কাল সাপের মাথা
এমন একটি দৃশ্যের সাক্ষী হবো কখনো ভাবিনি
কখনো ভাবিনি সাপের বিষাক্ত দাঁতের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে ব্যাঙ
লাল ঝাণ্ডা উঁচিয়ে জানিয়ে দেবে বিজয়বার্তা
ব্যাঙের এই বিজয়গাঁথা যখন লিখছি, হৃদয় উতলে বেরিয়ে আসছে— লাল সালাম কমরেড, লাল সালাম।
আবু তাহের। কবি। জন্ম ১৯৯১, পঞ্চগড়, বাংলাদেশে। স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর। বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
1 মন্তব্যসমূহ
অনেক সুন্দর লাগলো, মুগ্ধতা
উত্তরমুছুনমন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।