TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

সৌর শাইনের গল্প ‘দর্পণ যাপিত (অ)সুখগুল্ম’


একটু একটু নিজেকে মেলে ধরে রাজকুমারী। সোনালি শরীরের উজ্জ্বল আলোক রশ্মি ছড়িয়ে পড়ে দর্পণের গায়ে। রাজকুমারীর চোখ জ্বলজ্বলে। কামনাশিখা যখন ঘিরে ধরে গোটা শরীরকে, তখন সে ডান হাতে চেপে ধরে একখণ্ড স্তন! রগড়াতে রগড়াতে খুঁজে ফেরে ঘ্রাণ! কামনার সুঘ্রাণে ঘর মউ মউ রাজকুমারী কেঁপে ওঠে! দোলাচালের পরশ গ্রাস করে পুরো পৃথিবী!


আত্মপরাগে এত সুমিষ্ট ঘ্রাণ তা কে কতটুকু জানে? যতটা জানে রাজকুমারী! রাজকুমারীর প্রতিটি বিকেল ভরপুর এই সুখ তৃপ্তির ঢেঁকুরে। সঙ্গমানন্দে স্বর্ণরঙের দেহটা বসন্ত বাতাসে গুলবাগের পুষ্পের মতো নৃত্যপাগল হয়ে ওঠে। নৃত্যে কম্পনের ছড়াছড়ি! আর এ কম্পনের মাত্রা অতল গভীর, কুয়াশাচ্ছন্ন! জগত প্রেম ও কামের কাঙাল, প্রিয় অস্তিত্বকে কাছে পেতে ত্যাগের মহিমা গড়ে তোলে ইতিহাস! ইতিহাসের রূপরেখা স্তর ভেদে বিচিত্র!

প্রকাণ্ড বাড়িটার নাম চৌধুরীপুরী। রাজহাসান চৌধুরীর বিত্তশালী গাম্ভীর্য বহন করছে এই স্থাপত্য। শহরের সুনামধন্য শিল্পপতি হিশেবে ও উঁচু বংশ গৌরবের আভিজাত্যে ভরপুর বাড়িটির ভেতর বাহির। রাজহাসানের একমাত্র কন্যা বিউটি কুইন রাজকুমারী। তার রূপের রোশনাই নিয়ে আজকে গল্পের অবতারণা। রাজহাসানের পরলোকগত স্ত্রী আবিদা দস্তি ছিলেন একজন ঈজিপ্টিয়ান সুন্দরী। রাজহাসান ও আবিদার পরিচয় ঘটে মরোক্কোতে, দুজনই সেখানে গিয়েছিলেন ট্যুরিস্ট হিশেবে। প্রথম দেখাতে প্রেম, গভীর প্রেম! তারপর ঘটা করে পিড়ামিডের দেশে বিয়ে। মধুরাতের মাধুর্যে সেখানে দিন পেরুতে থাকে। এক সময় দু’জনই ফিরে আসে চৌধুরীপুরীতে। কয়েক বছর পর রাজকুমারীর জন্ম, আর সে-মুহূর্তেই আবিদা দস্তি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তারপর থেকে একাকিত্বকে সঙ্গী করে নীরব নিশ্চুপ জীবন-যাপন করছেন রাজহাসান। আর রাজকুমারী বেড়ে উঠেছে নিজের মতো একা ও বাড়ির চাকরবাকরদের সীমাহীন আদর আতিশয্যে।

রাজকুমারীর রূপের আলো শিশুকাল থেকেই ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। শৈশবে সে একটা টিভি বিজ্ঞাপনে অভিনয়ও করে। আত্মীয়-স্বজন ও বাড়ির কাজের লোক সবাই রাজকুমারীর রূপে পঞ্চমুখ! প্রশংসার ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে ওর বেড়ে ওঠা। পেরিয়েছে বয়সঃসন্ধি কাল। রাজকুমারীর পড়াশোনা হয়েছে এক বিচিত্র কায়দায়। ধনী ঘরের কন্যা, সেই জন্য সবখানেই একটা দূরত্বকে সে অভ্যাসে পরিণত করেছে। একা থাকতে পছন্দ করে, স্কুলের সহপাঠিদের সাথেও মিশতে চায় না। তাই গৃহ শিক্ষকের মাধ্যমে পেরিয়েছে ক্লাসের গণ্ডি। শিল্পপতির মেয়ে হওয়াতে পেয়েছে আলাদা মর্যাদা, প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষাগুলো দিয়েছে স্পেশাল এক্সাম হলে একা। তবে ফলাফল আশানুরূপ হয়েছে বরাবরই।

সুন্দর কাকে বলে? এই সংজ্ঞা প্লেটো যেভাবেই দিয়ে থাকুক না কেন, রাজকুমারীর কাছে সুন্দর মানে কেবল সে। রূপের প্রশংসায় চারদিক মুগ্ধ যখন, রাজকুমারী নিজেও প্রচণ্ড মুগ্ধ তার মিষ্টি মুখশ্রীর প্রতি! এক অপরিমিত আকর্ষণ গোটা শরীর ঘিরে। চুম্বকের প্রতি চুম্বকের আকর্ষণ যেমন। প্রচুর সাজগোজ করে দিনকাটায় সে, নিজেকে ভালবেসে নিজের প্রতি সর্বোচ্চ যত্নে বিভোর থাকে। নানা কোয়ালিটির আকর্ষণীয় কাপড়-চোপড়, ফুল ও গহনা দিয়ে নিজেকে সাজায়। তারপর দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, শুয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা! খাবারের সময় হলে কাজের লোকেরা ডাকতে আসে। তখন রাজকুমারী তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করে, দেখো তো আজকে নীল ড্রেসে আমাকে কেমন দেখাচ্ছে? কদমফুলগুলো চুলে পরতে কেমন লাগছে?
রাজকুমারীর এই প্রশ্নের জবাবে সবাই বলে, অপূর্ব রাজকুমারী অপূর্ব..! তোমার মতো সুন্দরী জগতে আর কেউ নেই! চৌধুরীপুরিতে যারাই কাজ করতে আসে সবাইকেই রাজকুমারীর প্রশ্নোত্তর এভাবে দেওয়ার ট্রেইনিং দেওয়া হয়ে থাকে। এটা রাজহাসানের নির্দেশ। তিনি চান না মা মরা মেয়ে কোনোভাবে আঘাত পাক বা তার ইচ্ছার ব্যত্যয় ঘটুক। তাই সবাই রাজকুমারীর রূপের প্রশংসা করে যেত সবসময়।

রাজকুমারীর ভালোলাগার সবচেয়ে বড় উৎস ছবি তোলা। একটা সময় বিদেশি অটোমেটিক ক্যামেরার যুগ ছিল, এখন রাজকুমারীর হাতে স্মার্টফোনের কারিশমা ও সেলফির নেশা। চৌধুরীপুরির অন্দরে রাজকুমারীর শত শত বাঁধাই করা ছবি কয়েকটা ঘরের দেওয়াল জুড়ে টানানো। দেখলে যে-কারোর মনে হবে, আলোকচিত্র প্রদর্শনী চলছে। বিভিন্ন সময়ের জন্মদিনের ছবিগুলো আলাদা ঘরে সাজানো, স্পেশাল কর্ণারে। রাজকুমারী বিদেশি বিকিনি পরে যে-ছবিগুলো তুলেছিল সেগুলো বিকিনি কর্ণারে সাজানো। নিজের রূপের প্রদর্শনী রাজকুমারীরকে অপরিমিত নেশাত্বক আনন্দ দেয়।

রাজকুমারীর শয়নকক্ষ ও স্নানাগারের দেওয়ালে কারুকাজ করা আয়নায় রাজত্ব! এই চোখ ধাঁধানো দর্পণের দুনিয়া বিদেশ থেকে আমদানি করে এনেছেন রাজহাসান। কন্যার প্রতিটি আবদারকে তিনি অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। রাজকুমারীর বিছানা এক বিস্ময়ের আঁধার, কারণ ওটা অত্যাধুনিক নরোম কাপড়ে তৈরি। অনেকেই সে বিছানা দেখে ভুল করে, মনে হয় এক টুকরো স্বচ্ছ জলাশয়। কাপড়ের রূপালি রঙের প্রভাবে দর্পণের মতো আবহ তৈরি হয়। মুখ বাড়িয়ে দেখা মাত্র ভেসে ওঠে ছবি। রাজকুমারীর বালিশ, পাশবালিশ, কোলবালিশও সেই একই মখমল কাপড়ে তৈরি।

রাজকুমারী দর্পণে আপন প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সংলাপে মেতে ওঠে। দর্পণে ভেসে ওঠা রাজকুমারীর ঠোঁটে সে চুমু খায়। সুখের জোয়ার এনে কামনার শিখা জ্বালিয়ে তোলে দু’চোখে। আত্মপ্রেম ও নগ্নতার খেলায় সবকিছু ভুলে যায় রাজকুমারী। গ্রীবার বাম পাশে ছোট্ট একটি ঝকঝকে তিল! আরো বেশ কিছু তিলের অবস্থান শরীর জুড়ে। ডান স্তনের খানিকটা নিচে, উদরের শেষপ্রান্তে নাভি ছুঁই ছুঁই, আরো দুটো তিল যোনির পাশে ভগাঙ্কুরের ঠিক দু’ইঞ্চি উপরে।

রাজকুমারী মাথার চুল ছেড়ে দর্পণে তাকায়। মেতে ওঠে সংলাপের সমুদ্রে।
রাজকুমারী বলে, তুমি এত সুন্দর কেন? তোমার রূপে এত যাদু কেন?
দর্পণ বলে, তুমি সুন্দর বলেই তো আমি এত সুন্দর!
—তুমি হাসলে যেন মুক্তার বৃষ্টি ঝরে।
—হাসতে ভালবাসো বলেই তো হাসি।
—তোমার চুমুতে যত মধু।
—তোমার ঠোঁটে এতো সুখ আছে বলেই মধুময় সব।
—তোমার রূপে ক্রাশ খাই বার বার।
—সে ক্রাশ আমাকেও গ্রাস করে।
—দেখো আমার ফেসবুক বন্ধুরা তোমার ছবিতে কত্ত লাইক, লাভ রিএক্ট, কত্ত সেক্সি সেক্সি কমেন্ট করেছে..ওয়াও। আসলে ওরা তোমার প্রতি খুব জেলাস ফিল করে।
—ওরা যা খুশি তা করুক, তুমি আমি ভালোবাসার সমুদ্রে ভাসবো, এতেই সুখ!

এইসব সংলাপ কখনো শেষ প্রান্তে যায় না। রাজকুমারীর কাছে এর সুখ পরিধি খুবই ক্ষীণ, কারোর ডাকে ব্যাঘাত ঘটলেই মনে হয়, শেষ হয়েও হলো না শেষ, যেন মধু সঙ্গমের আরম্ভ লগ্নেই বিপত্তি এসে দাঁড়াল।

রাজহাসান এবার মেয়ের তেইশতম জন্মদিনে উপহার দিলো একটা বিদেশি ব্রান্ডের গাড়ি। তারপর বলল: মা, রাজকুমারী, এ-বছরই তোমাকে একজন সুপাত্রের সাথে বিয়ে দিতে চাই, তারপর তোমাদের বিদেশে পাঠাবো হানিমুনে। উত্তরে রাজকুমারী সেই আগের মতো নারাজ। রাজহাসান মেয়েকে আদর করে বলে, মা, তোমাকে তো কোনো অপাত্রে তুলে দেবো না, পাত্র তোমার পছন্দ হলেই কেবল বিয়ে হবে নয় তো হবে না। রাজকুমারী শুধু মুচকি হাসলো।

রাজহাসান পাত্র চাই বিজ্ঞাপন দিতে লাগলেন বিভিন্ন পত্রিকাতে। কদিন পর থেকে চৌধুরীপুরীতে উৎসবের ধুম লাগল। প্রতিদিন ডজন খানেক পাত্রের ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু হলো। ইন্টারভিউর তিনটা ধাপ, প্রাথমিক পর্যায়ে পাত্র বাছাই করেন রাজহাসানের সেক্রেটারি মুনীর আহমেদ, তারপর রাজহাসান স্বয়ং! তারপর রাজকুমারী সবাইকে গণহারে বিদায় জানিয়ে গোটা দিনের পরিশ্রমটাই মাটি করে দেয়। কয়েকজন পাত্রকে রাজহাসানের খুব পছন্দ হলেও মেয়েকে তিনি বুঝাতে অক্ষম হোন। তাই সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। রাজহাসান অতি আদুরে মা মরা কন্যার ইচ্ছার বাইরে কোনো কিছু করতে চান না। তারপর রাজহাসান এক এক করে বেশ কয়েকজন সুপুরুষ যুবক এনে রাজকুমারীর সামনে হাজির করান। কারোর রূপে রাজকুমারী সন্তুষ্ট নয়, পিতাকে কেবল বলে, পৃথিবীর কোনো পুরুষই আমার উপযুক্ত নয়, বাবা। রাজহাসান আর কথা বাড়ায় না, পিছু হটেন, কন্যাকে তার নিজের মতো থাকতে দেন।

কিছুদিন বাদে রাজকুমারীর জন্য সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব আসে। রাজকুমারী এককথায় রাজি হলেও, কোনো নায়ককে ওর পছন্দ হয়নি। রাজকুমারী সোজাসাপ্টা বলে, এইসব ছাইপাশ হিরো রাজকুমারীর সাথে অভিনয়ের যোগ্য নয়। হতাশ হতে হয় পরিচালক ও প্রযোজককে। রাজকুমারীর রূপে মুগ্ধ প্রযোজক রাজকুমারীকে একা অভিনীত একটি মিউজিক ভিডিয়োতে বলে কয়ে রাজি করায়। অভিনয় পর্ব এখানেই ইতি টানে।

হঠাৎ রাজকুমারীর ভাবনায় নতুন শখের আবির্ভাব ঘটে। চৌধুরীপুরিতে ডাক পড়ে কয়েকজন কবি ও ভাস্করের। কবিগণ সম্মানীর বিনিময়ে রাজকুমারীর রূপ বর্ণনা করে কবিতা রচনা করেন। ভাস্করেরা রাজকুমারীর আবক্ষ ভাস্কর্য তৈরি করে। ‘স্বর্ণরঙের স্তন’ নামে নির্বাচিত সেরা কবিতাটি ঠাঁই পায় রাজকুমারীর স্নানকক্ষে টাইলসে বাঁধাই সৌন্দর্যে। সেরা শ্বেতপাথরের ভাস্কর্যটি বসানো হয় রাজকুমারীর রুম ঘেঁষা বেলকনিতে। যখন খুশি সে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তোলে ভাস্কর্যের চিবুক!

কবি ও ভাস্করের প্রসঙ্গ যাবার পর, চিত্রশিল্পীর ডাক পড়লো। চিত্রকর্মের দক্ষতা যাচাই করে রাজকুমারী একজন তরুণ শিল্পীকে বাছাই করল। শুরু করল এক সিক্রেট মিশন। রাজকুমারী নিজের নগ্ন প্রতিকৃতি আঁকাতে চায়। শিল্পীকে ডাকা হলো, রাজকুমারীর ঘরে। রাজকুমারী নগ্ন চিত্র অঙ্কনের প্রস্তাব ও উঁচু দরের ইনাম জানালো। শিল্পী প্রথমে কিছুটা ভড়কে গেলেও কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক করে বলল, বহু ন্যুড স্ট্যাচুর ছবি আঁকার অভিজ্ঞতা আমার আছে, সুতরাং আঁকতে অসুবিধে হবে না, মেডাম।
—তাহলে আঁকা শুরু করে দিন। আমি প্রস্তুত হচ্ছি।
  
বদ্ধঘরে রাজকুমারী এক এক করে দেহের প্রতিটি বস্ত্র খুলে নিজেকে উন্মুক্ত করলো। ইলেক্ট্রিক্যাল ল্যাম্পের উজ্জ্বল আভায় রাজকুমারীর জ্বলজ্বলে শরীর গোটা ঘর ধাঁধিয়ে তুলল। চিত্রশিল্পীর দু’চোখ যন্ত্রণাময় প্রশান্তিতে কাঁপতে থাকে। ইজেল সেট করে, আর্ট পেপারে পেন্সিলের আঁচড় কাটতে লাগল। অন্যদিকে শিল্পীর শরীর মোচড়ে উঠলো, কামনার জোয়ারে, কিছুতেই অঙ্কনে মনোযোগ তৈরি হচ্ছে না। বনের ভেতর পথ হারানো পথিকের মতো গ্রাফাইটের আঁচড় একদিক থেকে অন্যদিকে সরে যাচ্ছে ভুলভাবে। এক সময় চিত্রশিল্পী চোখ বন্ধ করে নিশ্চুপ বসে পড়ল।

রাজকুমারী শিল্পীর কামার্ত অবস্থা বুঝতে পেরে রাগমাখা স্বরে বলল, হ্যালো, আনকট্রোল ম্যান! বহুত পেরেশান হচ্ছো তুমি! হাতের কাজ সেড়ে নিজেকে শান্ত করে এসো। আমি ততক্ষণ অপেক্ষা করছি। বাইরের ওদিকে ওয়াশরুম আছে, সুপার পারফিউমের লুব্রিকেন্টও আছে ওখানে।
চির লজ্জ্বিত হয়ে বাধ্য বালকের মতো চিত্রশিল্পী রাজকুমারীর আদেশ পালনে ওয়াশরুমমুখী হলো। 
এক সময় শিল্পী ফিরে এল। ততক্ষণে রাজকুমারী জামা জড়িয়ে নিয়েছে। বলল, আজকের মতো ছুটি তোমার, আবার যখন ডাকবো তখন এসো। আমি ভেবে দেখছি তোমার এই সমস্যার কীভাবে সমাধান করা যায়। জোড়াচোখে অফুরন্ত বিস্ময় ও কপালে প্রশ্ন কৌতূহলের রেখা এঁকে চিত্রশিল্পী চৌধুরীপুরী ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

রাজকুমারী কদিন পর অতিগোপনে পতিতালয় থেকে এক সুন্দরী নারীকে চৌধুরিপুরীতে নিয়ে আসে। সুন্দরী মেয়েটির নাম আদ্রিতা। সপ্তাহখানেক পরে ডাকা হয় চিত্রশিল্পীকে। সেই আগের মতো ছবি আঁকার মুহূর্ত শুরু হয়। নগ্নতার আভিজাত্যে অঙ্কন শৈলী জেগে উঠে চারুশিল্পের বুননে। এরই মাঝে শিল্পীকে গ্রাস করে কামের ফাঁদ। অঙ্কন থেকে মনোযোগ সরে যায় রাজকুমারীর সোনালি দেহভোগের ইচ্ছায়। শিল্পী অতি মাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে উঠলে, রাজকুমারী আদ্রিতাকে ডেকে আনে। শিল্পীকে উদ্দেশ্য করে বলে, এই যে অনেক ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছো, এখন এই সুন্দরী মেয়ের সাথে সেক্স করে নাও। আমি পাশের রুমে যাচ্ছি, তোমাদের এসব আমার কাছে উপভোগ্য নয়, বরং বিশ্রী লাগবে।
শিল্পী বলে ওঠে, না, না, আপনি উঠবেন না, প্লিজ পজিশন চেঞ্জ করবেন না। নয়তো ছবিটা আবার শুরু করতে হবে।
—প্রয়োজনে আবার শুরু করবে। আমি তো তোমাকে পুষিয়ে দেবো। যতটা সম্ভব দ্রুত ক্ষুধা মেটাও। তোমাদের সাধারণ সেক্সে আমার কোনো আনন্দ নেই।
এভাবে কয়েকমাস চলতে থাকে। একটা দুটো নয় চল্লিশটি নগ্ন চিত্রকর্ম নির্মিত হয়। রাজকুমারীর খুশি আকাশছোঁয়া রূপ পায়।

কন্যার এইসব পাগলামির খবর যে রাজহাসান রাখে না, তা নয়। সব জেনেশুনে এক অপরিমিত দুশ্চিতায় ভুগেন পিতা। এক বন্ধুর পরামর্শে রাজহাসান মেয়েকে বলে কয়ে একজন সাইকোলজিস্টের কাছে নিয়ে যান। ডাক্তার ডিটেইলস শুনে জানায় রাজকুমারী নার্সিসিজম রোগে আক্রান্ত! নার্সিসিজম কী তাও রাজহাসানকে ব্যাখ্যা করে বোঝায় ডাক্তার। মেয়ের মানসিক আচরণ পাল্টানোর নানা উপায়, পথ পদ্ধতিও বলে দেন। রাজহাসানে মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও কোনো ফল হয়নি, সেই আগের মতোই খাপছাড়া ইচ্ছায় অটল।

ডাক্তারের ট্রিটমেন্ট যখন ব্যর্থ, তখন বাড়ির বৃদ্ধ কাজের লোকের পরামর্শে রাজহাসান এক দরবেশের দরবারে উপস্থিত হয়। মেয়ে সম্পর্কিত সবকিছু দরবেশকে খুলে বলে। আয়না প্রেমের এই কীর্তি শুনে দরবেশ নিজেই অবাক বনে যায়। দরবেশ বলে, আপনার কন্যা, খোদার দিদার পেয়ে গেছে। এই দেহের মাঝে ব্রহ্মাণ্ডের খেলা, এই দেহটাই ব্রহ্মরূপ। সে নিজের প্রেমে মশগুল, নিজের মাঝে খোদার বসত, তাই তো এতো দেওয়ানা। দরবেশের এই আচরণে রাজহাসান উল্টো মনোক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে আসেন।

অপরিমিত সম্পদের স্তুপ ভারসাম্য ও সামঞ্জস্যতা বিঘ্নিত করে। অতি প্রাপ্তি বা অতি অভাব, অতি আদরের ধাক্কা সহ্য না হওয়াটাই সহজ সত্য। প্রশংসার অপ্রতুলতা অহংকারে রূপান্তরিত হয়। রাজকুমারীর প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির জাল জটিলভাবে জড়িয়ে আছে, তা বিশ্লেষণ বড় কঠিন। প্রাচুর্য যেখানে ঔদার্যহীন, সৌন্দর্য সেখানে মাধুর্য শূন্য। 

তবে ছোট্ট একটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে এই গল্প থমকে যাবার কারণ হবে তা হয়তো কেউ জানতো না। সুখ কখনোই সীমাহীন নয়। সীমান্তের ওপারে শেষ দৃশ্য অপেক্ষা করে।

দেবকুণ্ডের ঝর্ণা দেখতে গিয়েছিল রাজকুমারী। প্রকৃতির রহস্যময় রূপের সাথে নিজের রূপের ঢেউ মিশিয়ে অজস্র সেলফির বন্যা বইয়ে দিলো। দুঃসাহসিকতা হাতছানি দিতে লাগল রাজকুমারীর ভেতর। পাহাড়ে চড়ে একটু একটু উপরে উঠতে লাগল। এক সময় রাজকুমারী নিচে তাকিয়ে চারপাশটা দেখল। পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ওপাশ থেকে আসা ঝর্ণার স্বচ্ছ জলধারা, সেই ধীরস্থির জলদর্পণে রাজকুমারীর ছবি প্রতিফলিত হয়েছে। রাজকুমারী আগ্রহভরে সে ছবিটাই দেখতে চাচ্ছে, উপর থেকে কেবল দুটো চোখ দেখা যাচ্ছে, আরেকটু এগিয়ে তাকালে পুরো মুখটা দেখা যেত। জলের তলে ভেসে ওঠা মুখচ্ছবির একটা সেলফি নিতে পারলে মন্দ হতো না। রাজকুমারী বাম হাতে একটি পাহাড়ি গাছ জড়িয়ে ধরে ডানহাতে স্মার্টফোনটা তাক করে ধরল। একের পর এক ক্লিক করে যাচ্ছে। হঠাৎ পা ফসকে পাহাড়ের ঢাল থেকে রাজকুমারী গড়িয়ে পড়লো। জলধারা যেদিক দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল ওখানে ছিল বড় বড় পাথরের স্তুপ। রাজকুমারীর মাথায় পাথরের আঘাত লাগল ভীষণরকম। মুহূর্তে সে অজ্ঞান! গড়িয়ে পড়ার সময় চিবুকে ধারালো পাথর ও গাছের গুঁড়ির আঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল মুখ!

হাসপাতাল থেকে রাজকুমারীকে চৌধুরীপুরিতে নিয়ে আসা হলো। মুখে, হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ! দুদিনেই রাজকুমারীর রূপের দরিয়ায় ভাটা নামে। একি হয়ে গেল! চারপাশটা অন্ধকারে জড়িয়ে ধরতে থাকে। দুঃখে কষ্টে দিশেহারা হয়ে যায় রাজকুমারী। আয়নায় তাকিয়ে ব্যান্ডেজ করা বিকট মুখটা দেখে ক্ষোভে পুড়তে থাকে। এটা কী হলো? এটা কেন হলো?

কার সাথে অভিমান করবে রাজকুমারী? আহার ওষুধ কিছুই মুখে তোলে না সে। দিনব্যাপী কান্না! রাজহাসান বার বার বুঝানোর চেষ্টা করছেন, সে আগের মতো সুন্দর রূপ ফিরে পাবে। অথচ, রাজকুমারীকে কোনো অভয় সান্ত্বনাই স্পর্শ করেনি। 
কয়েকদিন চলতে থাকে এভাবে। নাওয়া খাওয়া প্রায় বন্ধ!

পঞ্চমদিন রাজকুমারীর ব্রেইন স্ট্রোক হয়। শরীরের অর্ধেক অংশ অবশ! চৌধুরি দুয়ারে এক নির্মম কঠিন সময় হাজির। রাজহাসান পাগলের মতো হয়ে যান, ডাক্তার ডেকে আনা হয়। পরবর্তীতে রাজকুমারীকে নিউরো সায়েন্স স্পেশাল হাসপাতালে নেওয়া হয়।

দীর্ঘদিন ট্রিটমেন্টের পর বাকজড়তা নিয়ে রাজকুমারী কথা বলতে শুরু করে। অন্যের সাহায্য নিয়ে হাঁটতে পারার শক্তি পায়।
চিকিৎসক এর চেয়ে উন্নতি বা আশার কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। রাজহাসানকে সবকিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতে বললেন। রাজহাসানের করুণ মুখ দেখে ডাক্তার নরোম গলায় বলেন, শুনুন চৌধুরী সাহেব, নেগেটিভ নার্সিসিজম একটি পুঁজিবাদী রোগ! রোগটা মাত্রাতিরিক্ত হলে ভীষণরকম ক্ষতিকর! আপনার বিউটি কুইন ডটার যদি ওর মায়ের দেশ মিশরে থাকতো, তবে হয়তো এতটা ক্ষতিগ্রস্থ হতো না। বাহ্যিক সৌন্দর্যের মানদণ্ডে এখানে কালো-শ্যামাঙ্গ বাঙালি তরুণ-তরুণীদের মাঝে সে তারকার মতো উজ্জ্বল, কিন্তু মিশরে অন্যসব সুন্দরীদের মাঝে সে তুচ্ছ খরকুটো ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। এই বোধটুকু ওখানে গেলে ঠিকই জাগ্রত হতো। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, মননে সঠিক মূল্যবোধ নির্মাণে ঘাটতি হলেই এমন বিপর্যয় ঘটে।
রাজহাসান ডাক্তারের কথা শুনে করুণ চোখে তাকিয়ে রইলেন।

রাজকুমারী তার পুরনো ছবিগুলো নিয়ে দিন কাটায় রাত পোহায়। অপার মুগ্ধতায় তাকিয়ে দেখে আত্মপ্রেমের চাহনি! ঝাপ্টা বাতাসে চারপাশে ঝড় তোলে যায় (অ)সুখগুল্ম! আত্মকামের লেলিহান শিখায় পুড়ে জমতে থাকে দেহভস্ম।


 লেখকের অন্যান্য লেখা: 



সৌর শাইন। গল্পকার। জন্ম ১৯৯৫ সালের ২৫ জানুয়ারি, গাজীপুর জেলার কাপাসিয়ায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক। ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখতে ও বয়ান-বুনন কৌশল নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন। পাশাপাশি কবিতা ও শিশুসাহিত্যেও বিচরণ রয়েছে তার। প্রকাশিত কিশোর উপন্যাস ‘শিপু যাবে মহাকাশে’ (২০১৭)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. অসাধারণ চিন্তা শক্তি আপনার দাদা..ছোট্ট একটা চরিত্রকে অনবদ্ধ করে তুলেছেন...আশা করি আপনার কলম কখনো থামবে না

    উত্তরমুছুন

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।