TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

সৌর শাইনের গল্প— 'সর্পিল রক্ত রেখা'


মনজিত যে দিকে তাকায় সেদিকেই দেখতে পায় রক্তের স্রোত! এঁকেবেঁকে ছুটে এসে সাপের মতো ছোবল দিতে চায় ওর শরীরে! রক্ত তাকে গ্রাস করতে চায়, বার বার পুনর্বার! বিষাক্ত দাঁত বসিয়ে দিতে চায় শরীরে, মাংসের ভেতর, হাড়ের ভেতর! চোখ বন্ধ করলেও সেই একই অবস্থা দৃশ্যমান হয়! চোখের সামনে আকাশ-জমিন সবই রক্তে একাকার! প্রকৃতি এভাবে রক্তাক্ত হয়ে সাজতে পারে আগে কখনোই সে ভাবতে পারেনি।

রক্তিমতাকে মনজিত কিছুতেই ভুলতে পারছে না। এক সময় তার চোখে ভাসত মুক্ত দিগন্ত, আদিম উন্মত্তা, পাওলিদাম, জয়া আহসান, কিংবা শাকিরা-সানি লিওনের দেহ সৌকর্য! তার কাছে এ সবই ছিল নব্য পৃথিবীর আসবাব অথবা কৌতূহলের আঁধার। যে আঁধার থেকে আরো অন্ধকার, মাদক-রাজনীতিবিদদের কুকুর হয়ে জীবন যাপন করা, এসবই তাকে টেনে এনেছে লাল রঙের মৃত্যুময় মালভূমিতে।

চির পথভ্রষ্ট পথিক মনজিত! কিশোরকাল পেরিয়ে এক উত্তাল উদ্ভান্ত ঢেউ তাকে চেপে ধরে। পারিবারিক শাসনের গণ্ডি পেরিয়ে সে হয়ে ওঠে বহির্মুখী! উত্তেজনা ও মারমুখী ভাব তাকে এনে দেয় চরম সাহস ও যেকোনো বাধা ডিঙিয়ে যাবার দাপট! বাহুশক্তির কারিশমা দেখে সে একদিন পরিণত হয় স্থানীয় রাজনীতিবিদদের ডান হাত। আন্ডারগ্রাউন্ডের কুকাজ মনজিতের মাধ্যমে অনায়াসে করিয়ে নেওয়া যায় বলে, নেতারা তাকে সম্মোহনী সুখের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। ইয়াবার স্পর্শে সে ভেসে যায় বাধ্যতার অতল গভীরে! সীমাহীন নানা অপকর্ম দফারফার মাধ্যমে সে সম্পন্ন করে থাকে। খুন ও ধর্ষণ তার কাছে দিন দিন হয়ে ওঠে অতিসহজ সামগ্রী।

মেয়েটি স্কুলে পড়ত, কোন ক্লাসে পড়ত তা নিয়ে একেকটা পত্রিকা একেকটা ক্লাস প্রকাশ করেছে। সেভেন, এইট, নাইন এই তিনটি ক্লাসের কথাই ওঠে এসেছে। লাল কালির হেড লাইন ছিল ‘ট্রেন লাইনে ঝাঁপ দিয়ে স্কুল ছাত্রীর আত্মহত্যা’। কেন এই আত্মহত্যা?

বর্ষার এক বিকেলে মেয়েটি কদম ফুল হাতে ফিরছিল। ওর নাম রাজমিন। তখনো শৈশবের ছাপ কাটেনি শরীর থেকে, তবু কৈশোরের ঢেউ লেগেছে অনেকটা। মনজিতের দৃষ্টি কেড়ে নেয়, নাদুসনুদুস শরীর ও জোড়া স্তনের জেগে ওঠা কাঁচা সকাল। মনজিত ও তার চামচারা একটা সিএনজিতে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। রাজমিনকে ডেকে কাছে আসতে ইশারা করে মনজিত। সরলা রাজমিন পা বাড়ায় সেদিকে, সে তখনো জানত না, এটা মৃত্যুকূপ। সাথে থাকা চামচারা মেয়েটির মুখ বেঁধে নিয়ে যায় গাঁয়ের প্রাইমারির স্কুলে। দরোজা ভাঙা ঘরে জানালার গ্রিলে বেঁধে রাখে। অচেতন দেহ মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে রাত পর্যন্ত। রাত গভীর হলে রাজমিনকে বেঞ্চে শুইয়ে দেয়, আর মনজিত হামলে পড়ে কিশোরীর অপক্ক শরীরে। স্তন খামচে পৈশাচিক আনন্দ শব্দে খলবলিয়ে ওঠে চারদেয়াল। অন্ধকারে কেঁপে ওঠে ভাঙা টেবিল-চেয়ার, ঘরের মেঝে। চিৎকার দেবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় মেয়েটি। ওর মুখ চেপে ধরে রেখেছিল বাকিরা। শরীরে দাঁত বসিয়ে কামড়াতে কামড়াতে মানুষ হয়ে কত সহজে হয়ে ওঠে কাঁচা মাংশাসী জন্তু, তা মনজিতকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। লবণাক্ত রক্ত মনুষ্য হৃদয়কে হিংস্রতার শিখরে পৌঁছে দেয়। কাপড় ছিঁড়তে ছিঁড়তে মনজিতের দু’হাত নেমে আসে রাজমিনের পেটে, নাভিতে। নখের আঁচড় লাঙলের ফলার মতো জমিন চিড়ে যেতে থাকে। ক্ষত থেকে নামে রক্তগঙ্গা। সালোয়ার ছিঁড়ে মনজিতের থাবা নামে নাভির নিচে। কিশোরীর কালো কেশাবৃত নয়া সকালকে দুমড়ে মুচড়ে কচলিয়ে টেপা ফলের মতো চিবুতে চায় মনজিতের পিশাচ মন। অপুষ্ট যোনীতে ধর্ষক কামুকের মূল কামড়টা বসিয়ে দেয় মনজিত হিংস্রতার অস্ত্রে। গলা ফেটে হেঁচকি দিয়ে কেঁপে ওঠে রাজমিনের নিরুপায় শরীর। ধারালো উত্তপ্ত শলাকা সবকিছু কেটে-কুটে ফালা ফালা করতে থাকে। একসময় নির্দয় শলাকা তীব্র রোষানলে জমিন ছিদ্র করতে ওঠে পড়ে লাগে। কুৎসিত ক্ষুধায় কাতর মনজিত ভেতরটাকে দয়াহীনতার সুখে ভিজিয়ে নিতে মাতাল। কিন্তু হঠাৎ থমকে যেতে হয়, গলগলে স্রোত তার পা বেয়ে নেমে যাচ্ছে। শীতল সুঁড়সুঁড়ে অনুভূতিতে চমকে ওঠে মনজিত। টর্চের আলোয় দেখতে পায় খুনে একাকার চারদিক। রাজমিনের ছোট্ট যোনী থেকে নেমে আসছে রক্ত প্রবাহ! ভাঙা টেবিল থেকে নেমে রক্তে ভেসে যাচ্ছে ঘরের মেঝে।

একটা-দুটো নয়, সংখ্যাতীত নারীর শরীর খুবলে খেয়েছে মনজিত, কিন্তু কখনো বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি কোনোদিন। এমন রক্ত সে আগে দেখেনি! নারীর শরীর থেকে যে রক্তের বৃষ্টি নামতে পারে, তা কল্পনাও করতে পারেনি। সাধারণত তার খুনি চোখ রক্ত দেখে মোটেও ভয় পায় না, বরং আনন্দ ধরে। খুনের রক্ত আর এই রক্ত এক নয়। ছেদ আর ছিঁড়ে যাওয়া সতীচ্ছেদ ভিন্ন অস্তিত্ব! মনজিতের শরীর গুলিয়ে ওঠে, একটা ঘিনঘিনে মেজাজ চোখ-মুখ বিদ্ধ করে। অজানা কারণে পিছিয়ে আসে শরীর। হেঁচকা টানে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে। নড়তে গিয়েও পারে না। পায়ের তালু আটকে আছে জুতার সাথে জমাট বাঁধা রক্তে।

মনজিত ছুটে যায় পানির সন্ধানে। স্কুলের টিউবওয়েলটা মাঠ থেকে পঁতাল্লিশ ফুট নিচে। উঁচু টিলার ঢালু নামতে গিয়ে সে গড়িয়ে পড়ে। ঘন্টাখানেক আগে খাওয়া মোরগ-পোলাও মুখগহ্বর দিয়ে গরগর করে বেরিয়ে আসে। ক্লান্তি তাকে বেশ কিছুক্ষণ জাপটে ধরে রাখে। এক সময় মনজিত দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে স্কুলঘরে ফিরে। দেখতে পায় বাকিরা রক্ত মাংশ বীর্য একাকার করে চেটেপুটে খাচ্ছে। মনজিতকে দেখে ওরা থামে, বুঝতে পারে অস্বাভাবিক কিছু। প্রায় অচেতন অবস্থায় মনজিতকে ওরা বাড়ি পৌঁছে দেয়। আর রাতভর হাড়-মাংশ চিবিয়ে অচেতন রাজমিনকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ঝোপের ভেতর। ভেবেছিল মেয়েটা মরে গেছে, কিন্তু মৃত্যু বড় দুষ্প্রাপ্য এখানে।

মনজিতের ভেতরে এক অজানা ভয় বাসা বাঁধে। যোনী থেকে প্রবাহিত রক্ত ওকে অতিপ্রাকৃত শক্তিতে গ্রাস করতে চায়। ছোটোবেলার এক ভয়ানক গল্পস্মৃতি তার মনে পড়ে, স্মৃতিক‚ট মাথার ভেতর ভয় হয়ে ঠোঁকরায় বার বার। যত ভাবে ততই ভয় ভয়ঙ্কর রূপে অগ্রসর হয়।

শিশুকালে মনজিত ভূতের গল্প শুনতে চাইতো, ঠাকুরমার কাছে। একদিন ঠাকুরমা সত্যি ভূতের এক গল্প শুনায়। এ গাঁয়েরই এক বালক, নাম শাহজাদ। দেখতে সুন্দর তবে ভীষণ দুষ্টু! একদিন শাহজাদ দুপুরবেলা নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ওর হাতে ছিল একটা কাস্তে, সামনে যা পাচ্ছে তৃণ-লতা সবকিছু সে খেলার ছলে কেটে কুটি কুটি করে চলেছে। হঠাৎ তার চোখ পড়ে ঘাটের কাছে ইপিলইপিল গাছে। ওখানে একটা সাদা রঙের সাপ ডাল প্যাঁচিয়ে বসে আছে। সাপের গায়ে ফোঁটা ফোঁটা নকশা আঁকা। সে নকশার বাকি অংশ দুধের মতো ধবধবে, রোদের আলোয় ঝলমল করছে। শাহজাদ সাপটাকে লক্ষ্য করে কাস্তে চালিয়ে দেয়। মুহূর্তে সাপটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। আর রক্তে ছুটে ফিনকি দিয়ে। এখানেই থেমে যায়নি, শাহজাদ সাপটাকে সে আরো খণ্ডখণ্ড করে কাটে। আর রক্তে চারদিক ভেসে যেতে থাকে, যেন একটি পশু কোরবানি দেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওই রক্ত সাপের মতো এঁকেবেঁকে শাহজাদের দিকে এগিয়ে আসে, সে যত পিছু নেয়, রক্তও এগোতে থাকে। এক সময় দৌড়াতে থাকে, তবু রক্তের হাত থেকে রক্ষা পায় না। শাহজাদ বমি করে গড়াগড়ি খেতে থাকে মাঠের মধ্যে। দৌড়ে হাঁপিয়ে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরোয়। শাহজাদ সাতদিন পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। গাঁয়ের সবার ধারণা, ঐ সাপটা ছিলো জ্বীন কুমারী, সাপের রূপ নিয়ে হাওয়া খাচ্ছিল। এ গল্পটা বার বার মনজিতের মস্তিষ্ককে সুঁচ হয়ে আঘাত করছে। অজানা আশঙ্কা পিছু ছাড়তে চায় না। তবু মনোবল শক্ত করে কদিন পর কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে মনজিত। বাইরে বেরুবার ইচ্ছা জেগে ওঠে।

দলবল নিয়ে বিকেলে আড্ডায় মগ্ন হয় স্টেশনের পাশে। কথা হচ্ছিল ঐ মেয়েটা নিয়ে, যার কারণে মনজিতকে অসুস্থ হয়ে বিছানা অবধি যেতে হলো। মনজিত জানতে চাইলো, মেয়েটা কোথায়? বাকিরা জানায়, মেরে গুম করে দিয়েছে। এতদিনে হয়তো, হাড়-মাংশ আলাদা হয়ে গেছে। আনন্দে সবাই চায়ের কাপে চুমুক দেয়।

ট্রেন আসছে ট্রেন যাচ্ছে, আড্ডার ভেতরে আড্ডা হারাচ্ছে। হঠাৎ মানুষজনের ভিড় দেখে ওরা উঠে যায়। দেখতে পায় রেললাইনের উপর রক্তাক্ত দেহ কাতরাচ্ছে। মাথা আলাদা হয়ে পাতের একপাশে পড়ে আছে, অন্যপাশে বাকি অংশ ছিঁড়ে যাওয়া টিকটিকির লেজের মতো নৃত্য করছে। শরীর খিঁচিয়ে ওঠে হাত-পা। মনজিত দেখতে পায়, ডান হাতটা গলা স্পর্শ করে একমুঠো রক্ত ছিঁটিয়ে দিচ্ছে তার মুখে। আগুনের মতো গমগমে গরম রক্তে পুড়ে যেতে থাকে মুখমণ্ডল। জ্বলে ওঠে ত্বক! হতবাক মনজিত দেখে, কাটা মাথাটা হেসে ওঠেছে, চোখদুটো বেরিয়ে এসে মনজিতকে গিলে খেতে চায়। আর টিকতে পারে না মনজিত, রেললাইন থেকে সরে আসে।

এই সেই কিশোরী রাজমিন। ধর্ষিত হয়ে মেয়েটা ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়েছে, রক্তে ভাসিয়েছে রেললাইন। ঝাঁপ দেবার সে দৃশ্য দেখেনি মনজিত। অথচ, কে যেন তার কানে সে মৃত্যুর বর্ণনা বার বার বয়ান করে বেড়ায়। কল্পনার চক্ষুতে সে দেখতে পায় ট্রেন আসছে আর মেয়েটি ঝাঁপ দিচ্ছে! রক্তে রাঙিয়ে দিচ্ছে মনজিতের মুখ!

মনজিত যেখানে যায় সেখানেই রক্ত দেখতে পায়। ঠাকুরমার মুখে শোনা গল্পের মতো, রক্তের রেখা সর্পিল রূপে এঁকেবেঁকে তাকে ঘিরে ধরে। দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকে। স্বপ্নে সে দেখতে পায় মেয়েটি তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে ট্রেনের চাকার তলে। রাত হলে তার পুরুষাঙ্গ কামড়ে ধরে রক্তাক্ত তরল! প্রায় পাগল হয়ে ওঠে মনজিত, পাপের খতিয়ান চিৎকার করে বলতে থাকে। বেরিয়ে আসে সমাজের মুখোশধারী বহু নাম।
অনুশোচনায় মাটিতে গড়াগড়ি করে কাতরাতে থাকে মনজিত! ক্ষমা ভিখারী হয়ে হাত পাতে নানাজনের কাছে। নিরুপায় হয়ে অন্তরে অনুশোচনা জাগলেই কি ফিরিয়ে দেয়া যাবে ঐ প্রাণপাখি? না, তা সম্ভব নয়!

মুক্তির পথ রুদ্ধ! আবদ্ধ অন্ধকার! আত্মহত্যা অপেক্ষমান! চারদিক থেকে সকল কপাট বন্ধ হয়ে আছে। অভিশপ্ত দু’চোখে লোহিত জালিকার আবরণ! ভয়ে জীবন অতিষ্ঠ! এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চায় মনজিত। মৃত্যুই কি এর শেষ ঠিকানা! সে হয়তো আত্মহত্যাই করবে।

তীব্র যন্ত্রণায় বেশ কিছু দিন কাটে। না, মনজিতকে আত্মহত্যা করতে হয়নি। সমাজপতিরা তার বিরূপ আচরণ ও অসংলগ্ন স্বীকারোক্তি সহ্য করতে পারেনি। কিছুদিন পর রেললাইনে মনজিতের কাটা লাশ পাওয়া যায়।

সৌর শাইন। গল্পকার।
জন্ম ১৯৯৫ সালের ২৫ জানুয়ারি, গাজীপুর জেলার কাপাসিয়ায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক। ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখতে ও বয়ান-বুনন কৌশল নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন। পাশাপাশি কবিতা ও শিশুসাহিত্যেও বিচরণ রয়েছে তার।
প্রকাশিত কিশোর উপন্যাস 'শিপু যাবে মহাকাশে' (২০১৭)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ