TopTime

আজ ২৭ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শুভ আঢ্য’র কবিতা | কাসাহারা ও রবীন্দ্রনাথ


২৩

জাহাজডুবির তর্জমা রিলেশনশিপ বলে এতদিন জেনে আসা মেয়েটি বুঝতে পারে কাসাহারা একটি পোতাশ্রয়। সেখানে আন্দ্রেই তার জাহাজটি নিয়ে প্রতিরাতে আসে। সামান্য মদ খাবার পর, সে আর তার জাহাজ টলমল করে। মেয়েটি কাসাহারা। তার নোনা অংশে খালাসির মতো নেমে পড়ে আলো। আলো দেখতে পায় সেখানকার বালি, ধারেবাড়ের আগাছা। জাহাজডুবি নিয়ে এখানে একটি সিনেমা দেখানো হয়েছিল। দেখার পর, মেয়েটি সেবার জাহাজে চড়তে চেয়েছিল। কালাপানি পেরোনো আর সে ভ্রমণবৃত্তান্ত নিয়ে কবিগুরুর মস্ত লেখা আছে। জাহাজের এসব অংশ নিয়ে কথাবার্তা যদিও নেই। কাসাহারায় ডিম লাইটের নিচে ডিমগুলো ফাটছে। এখানে কোনো এগ-ইয়ক নেই। সামান্য মদ্যপানের পর এসব জাহাজ নিজেকে জাহাঙ্গীর ভাবে। মেয়েটিকে তর্জমা করে বোঝানো হয়, রিলেশনশিপ আসলেই একটা জাহাজডুবির ঘটনা।


২৪

এবং এইসব ব্যাপারে চরিত্রের জড়তা একটি প্রধান লক্ষণ। সেক্সুয়াল প্যাসিভনেস একটি ঘটনা, এটি সবার সাথে সবার ঘটে না। ইরোটিক ঘটনাবহুল সাদাকালো ছবি থাকলে কাসাহারাকে খাজুরাহো বলে ভুল হতে পারত। আলেকজান্দ্রা, তোমার বৃষ্টি ফল খাবে বলে সে রোদ্দুর অপেক্ষা করছে। চরিত্রের জড়তা তারও একটি প্রধান লক্ষণ। ইরোটিক ছবিতে তোমার কর্সেটের হুক ও দড়ি দেখা যায়, একটি কুকুরের মুখ সেখানে চামড়ার জালে বন্ধ। ছবিটিতে তোমার কোমরের অংশে একটি উল্কি, উল্কিটি বিছার। কাসাহারায় আচারবিচার নিয়ে কেউ ভাবে না। রবীন্দ্রনাথ মোলায়েম প্রেমের কথা বলেছেন, প্লেটোনিক লাভের কথাও। এখানকার প্লেটে রগরগে প্ল্যাটার যখন সার্ভ করা হয়, তখন ছেলেটির চোখ ঝিকমিক করে ওঠে। তবে এ বিষয়ে জড়তা অনেকের লক্ষণ। তা সবসময় ঘটে না। ঘটলে এখানে তার মূল্য ধরা হয় না। এখানকার বিলিং সিস্টেম কাস্টমারফ্রেণ্ডলি, সাথে ওয়েস্টেজ কুকুরকে দিয়ে দেওয়া হয়।


২৫

হিংসার প্ররোচনা দিতে দিতে সে আসলে ভালবেসে ফেলে। উগ্রতা জরুরি। এখানে বাতাসে উগ্রতার ধারে কেটে গেছে অনেকের চিবুক, চিঠিপত্র নিয়ে এসপার-ওসপার হয়েছে। ওপারে ওক বন। সেখানে সমাহিত রবীন্দ্রগান শুনতে পাওয়া যায়, পাখীদের কথাবার্তার মাঝে সেই গানের কোমল নি মেয়েটির কোলে এসে বসলে হিংসার প্ররোচনা আরও বাড়ে। এখানে অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও বসা হয়। কাসাহারা একটি জায়গা যেখানে যুদ্ধের সমস্ত ব্লু-প্রিন্ট টমেটো রঙে ছোপানো হয়। তার শাড়ি ব্লক প্রিন্টেড করতে সে এখানে এসেছিল, শুধু একটি ব্ল্যাক কফি ছাড়া অর্ডার করেনি কিছুই। কাঠের ব্লকের ওপর বাবুইটি ছেড়ে দিয়ে দেখেছিল, সে ছেলেটির মতোই উড়েঘুরে বেড়াচ্ছে তার অবাধ্য চুলের পাশে। তবু, উগ্রতা জরুরি। হিংসায় প্ররোচনা দিতে না পারলে কার্পাসে রঙগুলোকে স্থায়ী করতে পারা যাবে না। অন্তত সে কারণেই কাসাহারায় হিংসাতে মানুষজনকে প্রলুব্ধ করা হয়।


২৬

ভেড়াগুলো শূন্যতা নিয়ে কথা বলে। তাদের পিঠের লোম শীতের আগেভাগে ঝরিয়ে দেওয়ার সাথে 'শূন্যতা' শব্দটি ব্যবহারে মেষপালকগুলো আপত্তি জানিয়েছিল। এই আপত্তি আপাতত মেনে নিয়ে স্থগিত রাখা হয়েছে লোম ছাঁটা। এখন ভেড়াগুলোর মাংস লোলুপ মানুষের নজরের বাইরে। কাসাহারায় ল্যাম্ব খুব টেন্ডারলি পাকানো হয়। এখানে দেহাতি এক মহিলা তা পাকান৷ ভেড়াগুলোর অসীম মমতা মহিলাটির প্রতি। যারা খায়, তাদেরও তারা শত্রুর দৃষ্টিতে দেখে না। তারা শূন্যতা নিয়ে কথা শুরু করলে ক্রমেই মানুষ হয়ে ওঠে। শূন্যতা মানুষের ভেতরে যা আছে, আর কারওর মধ্যে নেই। শূন্য গ্লাস এখানে রাখা হয় না। নিদেনপক্ষে সামান্য জল ঢেলে দিয়ে যায় ওয়েটারেরা। আশেপাশে ঘাসজমি নিয়ে সোনার বাংলার কথা মনে পড়লে, ভেড়াগুলো নিজেদের পিঠের ক্রমিক সংখ্যা আর অস্তিত্ব সংকট নিয়ে ভাবে। তারা প্র‍্যাকটিস করে। ঘটকবাবুর ছবি তারা দেখেনি। শুনেছে, মানুষদের মধ্যে যারা দুই -তৃতীয়াংশ ভেড়া, তারা ও ছবি দেখে না। তবে ভেড়াদের মধ্যে যারা এক-তৃতীয়াংশ মানুষ, তাদের ছবি দেখার ব্যাপারে ঘটকবাবু কিছু বলে যাননি।


২৭

এসব সন্ধ্যের ভেতর ভাঙাচোরা রেডিও স্টেশন থেকে ফিরে আসো, যেন ফ্রকের রানে সেলাইটি গিয়ে সেই আবার এসেছে ফিরে... অথচ খুলে যাবে কফিন-ঢাকনা এমন সন্ধ্যেয়। হতে পারে, এখানে বেহালাশিল্পী ঘোড়ার পিঠে একবার হাত দিয়ে ঘুরিয়ে দেবে দাবার দান। না'ও হতে পারে, কারণ, রেডিও স্টেশনে জল জমেছে নির্বিকার। সেখানে অনাথ গানগুলো ঢুকেও পড়েছে খুব। আকাশবাণী যখন ছিল, তখনও কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনার শিকার হত কলকাতা ক এবং খ। রবীন্দ্রনাথ এসব নিয়ে দৃঢ় কিন্তু সচেতন বক্তব্য রেখেছেন হয়তো। রেডিওর খোপ, দস্তাখোলের টেকনিক্যাল ব্যাপার অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তুমি পজিটিভ থেকে এসো ফিরে নেগেটিভের দিকে। কফিন, কাসাহারার কাছাকাছিই তৈরি হয়। যিনি তৈরি করেন তাঁর আয়ু শতেকের কাছে। অনেক বেহালাশিল্পীর সুর তিনি থামিয়ে দিয়েছেন। এখানে মাঝরাতে ট্রেন থামে না, গ্যালপিন ট্রেনগুলো শুধুই শব্দ করে চলে যায়।


২৮

সেখানে গম খেত আছে, মনে করা যেতে পারে। বেছে বেছে হলুদ রঙের প্যাস্টেলগুলোই আগুনে গলানো হয়েছে। তবে আগুন সেখানে জ্বালানো হয় না। আগুন মানে ওখানকার আশেপাশের বেশ্যা। তাদের নাভিতে সময়মতো রুটি সেঁকা, বেগুন পোড়ানো, জল ডিসইনফেক্ট করা - এসব হয়ে থাকে। বেশ্যাগুলো কাসাহারায় আসতে চায় না। বেশুমার শুয়ে থাকে কাছাকাছি দোর দেওয়া ঘরে। তারা গতজন্মে ভিনসেন্টের মডেল ছিল। আগামী জন্মে ওরাই সেন্ট হবে এমন কথা শয়তান ওদের প্রাইভেটলি বলেছে। ওরা জাতে ফিরিঙ্গী। তবে ওরা কাসাহারায় আসা ছেলেগুলোর সাথে বাংলা আদবকেতাতেই ছেনালি করে। উচ্চমার্গের রবীন্দ্রচিন্তা তাদের নেই, কিন্তু জাতীয়সঙ্গীত মুখস্থ গাইতে পারে। গম খেতের কাকতাড়ুয়া এত কিছু জানেও না। সে জানে খোলা বুকের সামনে আরেকটা খোলা বুক না আসলে চার্জ বিনিময় হয় না। সে জানে যেসব ছবিতে হলুদ রঙের প্রয়োজন এখানকার আঁকার মাষ্টারেরা সে'সব ছবি বাচ্চাদের আঁকায় না। কখনও টমেটো পোড়াও চেলো কাবাবের সাথে কাসাহারায় সার্ভ করা হয়।
(টু ভিনসেন্ট, উইথ লাভ)


২৯

গুলিটি উদ্দেশ্য হিসেবে একটি শুয়োরের পেছনে ঢুকেছিল। আকাশে গোলাপি তারা, তরাই অঞ্চল জুড়ে ভেঙে পড়ে। ভেঙে পড়ে হলদে পাটের শাড়ি। গুলিটির বিধেয় ছিল কাসাহারা। সেখানে মেয়েরা ছেলেরা যৌথ জীবনযাপনের কথা ভাবছে। তাদের কোনো ইনসিওরেন্স নেই। মৃত্যুর পর পড়ে থাকা শুয়োরটি জানে কারও না কারওর পেটের ভেতর ফিতাকৃমি হয়ে সে বেঁচে থাকবে। কাসাহারায় বেহালা বাজানো নিষিদ্ধ করার পর লোক সমাগম কমতে থাকে। তার মানে এই নয় সকলেই খুব বেহালা বোদ্ধা। তাদের স্বরে কেঁপে ওঠা দুঃখ বেহালাই কেবল গোলাপি তারা অব্দি পৌঁছে দিতে পারে। বাকি কার্সিনোমা। এতেই ফৌত হয়ে যায় কাসাহারার মানুষজন। কর্কটরোগ ভারতে তখনও সেভাবে মান্যতা পায়নি বলে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য সেভাবে জানা যায় না। উদারীকরণ একটি হলদে শাড়ি। তা উড়ে যাচ্ছে, উদ্দেশ্য হিসাবে কোনো গুলির সামনে। গুলিটির পিছনে ট্রিগার করা হয়েছে। এখানে কোনো অজুহাত নেই, স্পষ্ট হাত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে দুঃখ থেকে উঠে এসেছে কোনো। তার স্বর কেঁপে উঠছে। তার আভ্যন্তরীণ আত্মাও যথাযথ কেঁপে উঠেছে।


৩০

শুধু ছবি বিশ্বাসটি হতে পারেনি বলে যারা ক্যারেকটার রোলেও অভিনয় করতে পারল না, তারাই এখানে আসে। কেউ কেউ অ্যাফিডেভিট করে নাম ছবি বিশ্বাস বা তুলসী চক্কোত্তি রাখে আর ভাবে খেজুর গাছের ট্যাটুতে তাদের নাম লেখা হবে। বিশ্বাস, বিশ্বম্ভর বলে কাউকে চেনে না। কাসাহারায় কুড়িটা বছর ফিরিয়ে দেওয়া হয় বলে দেওয়ালে বিজ্ঞাপন আছে। রবীন্দ্রনাথ কুড়ি বছর আগের যৌবন ফিরে পেতে চান নি। এখানে আসা ছেলেগুলোর প্রেমিকারা সকলেই বিগতযৌবনা। তাদের ঝুলে যাওয়া ত্বকে বলিরেখা ছত্রাকের মতো জাঁকিয়ে বসেছে যদিও তারা তুলসী চক্কোত্তির নাম শোনেনি। 'এখানে অভিনয় শেখানো হয়' বলে বিজ্ঞাপন দেওয়া লোকটি এখন দুঃখজনকভাবে বিবাহিত। শুধু বিশ্বাসের আগে নেগেটিভ ছবি তোলার জন্যই আশেপাশে ফিল্মের দোকান এখনও টিকে আছে। কুড়িটা বছর ফিরিয়ে দিতে পারে বলে এখানে যে লোকটা লিখেছিল, সে গত কুড়ি বছর ধরে নিরুদ্দেশ, তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়েছে।



শুভ আঢ্য। কবি ও গদ্যকার। কলকাতায় জন্ম কর্ম বেড়ে ওঠা। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: ‘ব্লেড রানার’, ‘আওকিগাহারা’ ও ‘জোকিং – আ – পার্ট’। গদ্যের বই: ‘বেড়ালের মকশো’। মেলোড্রামা জন্মগত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. অসম্ভব লেখা সব।। অস্তিত্বকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়।। আপনার লেখা বরাবরই খুব তীব্র।। প্যাশনেট৷ মেধাবী ও মায়াবী— প্রীতম বসাক

    উত্তরমুছুন

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।