TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

স্মৃতিতে শান্তিনিকেতন | সুলতানা শিরীন সাজি



শান্তিনিকেতনে প্রথম দিন
পরশু রাত এ ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। হাইওয়েতে গাড়ি চালানো সময় বৃষ্টি পড়লে একটা অন্যরকম শব্দ হয়। ওয়াইপার চলতে থাকে। আর মনের মধ্যে অদ্ভুত দ্যোতনার সৃষ্টি হয়। মনেহয় বৃষ্টি ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাকে। বাড়ি ফিরে দরজার সামনে লাইলাক এর ঝিম গন্ধ শুঁকি। বৃষ্টি এলে আর ঘুম আসে না। বাতাসে টুংটাং বাজে দরজার উইন্ডচাইম। জানালার কাছে বসে ঘাসের উপর বৃষ্টি পড়তে দেখি।

মন এক অচীন রেলগাড়ি। বৃষ্টি ছুঁয়ে কোথা থেকে কোথায় যে চলে যায়! মনেহয়, ফিরে গেছি। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস এ করে বীরভূম জেলার বোলপুর যাচ্ছি। অদ্ভুত এক আনন্দর মধ্যে ফিরে গেলাম লহমায়। কবে সেখানকার নাম নাকি ছিলো ভূবনডাঙা।
২০১৮ এর এপ্রিলের দুই তারিখ সকালবেলা, আমরা তিনবোন হাওড়া স্টেশনে পৌছালাম। কানাডা থেকে যাবার আগেই  আপাকে বলেছিলাম এবার তিনবোন ঘুরবো একসাথে কলকাতায় আর শান্তিনিকেতনে। আমার বন্ধু জিপসীও সাথে ছিল। ও আমাদের  আগেই পৌছে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ছোটবেলা থেকেই স্টেশনের পাশের রেলওয়ে বাংলোতে বড় হয়েছি। সেকারনে স্টেশন আর ট্রেন নিয়ে নানান অনুভব আমার ভিতর শেকড় গেড়ে বসে আছে। প্লার্টফর্মে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখা, ফেরিওয়ালাদের চিৎকার সব আমার চেনা তবু ,এ এক অন্যরকম অনুভূতি। গল্প হই এ পড়া,সিনেমায় দেখা সেই হাওড়া স্টেশন। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো,আমরা শান্তিনিকেতন যাচ্ছি।

আমার প্রার্থনায় মাচু পিচু অনেক পড়ে এসেছে। সেই ছোটবেলা থেকে শান্তিনিকেতন কি করে যেনো মাথায় ঢুকে গেছে। রবীন্দ্রসংগীত শিখতে কোনদিন ওখানে যাবো সেই স্বপ্ন ছিলো না তাই বা কি করে বলি! অনেকদিন পর আমরা তিনবোন একসাথে ট্রেনে করে কোথাও যাচ্ছি। ছোটবেলার মত। এবার সাথে জিপসী। ট্রেন এ উঠলেই একটু পর ক্ষুধা পেতে থাকে। চা ,চানাচুর খেলাম। জিপসী একটু পরপর ফেরিওয়ালা ডাকতে থাকলো। এক একটা স্টেশন পার হচ্ছে আর আনন্দ বাড়ছে। রসুলপুর,বর্ধমান সহ অনেকগুলো স্টেশন পার হয়ে গেলাম। একজন বাউল গান গাইতে শুরু করলেন,”মন চলো যাই ভ্রমনে, চলো কৃষ্ণের অনুরাগের বাগানে”। এর আগে এই গান শুনিনি। মন কেমন করা সুর। গানের সুরের মূর্ছণা থাকতেই এসে গেলো বোলপুর। স্টেশন এ নামার পর আমার ভিতর থেকে উঠে আসা সেই আনন্দ লেখার ভাষা আমার জানা নেই। আমিও ট্রেনের সেই বাউলের মত এক বাউলপনা টের পেলাম নিজের মধ্যে।
প্লাটফর্ম এ বিশাল ছবি প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।আমার বোনরা আমাকে তাকিয়ে দেখছিল। ওরা জানে আমি কি খুশি হয়েছি। আপা আর আপু হাসছিল আমার আনন্দ দেখে। জিপসীও আমাদের বোনদের সাথে মিশে গিয়েছিল গত ক’দিনে। আপা আপু তো নানাভাবে প্রমান করছিল, জিপসী আমাদের মতোই দেখতে। আমরা সবাই মঙ্গোলিয়ান টাইপ। আমাদের বোন এর মতোই দেখায় ওকে। স্টেশন এর বাইরে এসে ট্যাক্সি নেয়া হলো। পূর্বপল্লী যাবো আমরা। স্টেশন থেকে বের হতেই বেশ জমজমাট এক বাজার। রাস্তার দু’ধারে অসংখ্য দোকানপাট। এই রকম জায়গায় গেলে আমার লালমনিরহাট এর কথাই মনে পড়ে। কেমন আপন আপন। কতসব নাম দোকানগুলোর। আমি শান্তিনিকেতন আসবো, কিন্তু এই নিয়ে কোথাও কোন লেখা পড়িনি। অনেকটা ইচ্ছা করেই। আমার মাথায় আছে রবীন্দ্রনাথ। আছে বিশ্বভারতী। এখানকার নদী কোপাই। শীতের মেলা সোনাঝুরি। ছাতিম তলা। আমার চোখ দিয়ে আমি দেখতে এসেছি এগুলো এবং এখানে থাকা আমার খুব প্রিয় কবি নীলাঞ্জন বন্দোপাধ্যায়, ওর স্ত্রী অরণীকা এবং ওদের বাড়ি "কোকোরো" যা পুরো জাপানী স্টাইলে বানানো।

বিশ্বভারতীর গেস্ট হাউজ পূর্বপল্লীতে ১৮ আর ১৯ নং রুম দেয়া হলো আমাদের। নীলাঞ্জন বুকিং দিয়ে রেখেছিল। আমার জন্মতারিখ ১৯ আর আপুর ১৮। এই নিয়ে বেশ মজা হলো। করিডোর দিয়ে হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠে হাতের ডানে। জানালা খুললেই কত গাছ। বেশ গরম তাই এসি চালাতে হলো। খুব সাধারন রুম। নীচে ক্যাফেটেরিয়াতে খুব মজা করে খেলাম। পোস্ত দিয়ে শবজী। ডালা, মাছ আর ভাত। খেয়ে আর দেরী না করেই বেরিয়ে পড়লাম। একটা টো টো করে এগোলাম। এখানে চারজন বসা যায়। বাংলাদেশ এ এটাকে টেম্পো বলে। ছাতিম তলার আগেই নামতে হলো। পথ দিয়ে হাঁটছি আর মনে হচ্ছে, “এ পথে আমি যে গেছি বারবার” কেনো মনে হচ্ছিল জানি না।
টিকিট কেটে রবীন্দ্রভবন এ ঢুকে মেইন বিল্ডিং এর দিকে এগোতেই বোঝা গেলো আমাদের কথা বলা ছিল। নীলাঞ্জন এর সাথে দেখা হলো। এই প্রথম দেখা কিন্তু অনেকদিনের চেনা। আমরা কোথায় কোথায় ঘুরবো এই নিয়ে কথা হলো। প্রথমদিন আমরা গেলাম, রবি ঠাকুরের বাড়িগুলো দেখতে। সাথে ছিল পূর্বা। সুন্দর একটা মেয়ে। ঘুরে ঘুরে আমাদের সব দেখালো আর গল্প বললো। উত্তরায়ন এলাকায় দেখলাম রবী ঠাকুরের পাঁচটা বাড়ি। উদয়ন, কোনার্ক, শ্যামলী, পুনশ্চ আর উদীচী। এই বাড়িগুলোর এক একটা তৈরী হওয়া নিয়ে এক এক রকমের গল্প আছে, পড়েছিলাম। শ্যামলী তে কাজ চলছিল তাই ঢেকে রাখা হয়েছিল। মাটির ছাদ বলে মাঝে মাঝেই সংষ্কার এর প্রয়োজন হয়। এই ঘরে গান্ধীজী এসে ছিলেন। অনেকগুলো থাম দেয়া বাড়ি কোনার্ক এর বারান্দায় কোনায় ঘুরতে ঘুরতে ভাবছিলাম এখানেই কবিতার আসর বসতেন রবী ঠাকুর। আর এই বাড়িটাকে কতবার যে সাজিয়েছিলেন বিভিন্নভাবে, নিজের ভালোলাগার জন্য। একসময় গোলক ধাঁধার মত হয়ে উঠেছিল এই বাড়ি। বাড়িঘরের আসবাব বদলানো ছিলো তাঁর শখ। আর নতুন নতুন বাড়িতে থাকতে পছন্দ করতেন তিনি। উদয়ন এ থাকার সময় কবি গুরুর মনে হয়েছিল সূর্যাস্ত দেখতে হবে, তাই গোলাপ বাগান এর পাশে ছোট্ট বেলকোনি দেয়া বাড়ি উদীচী বানিয়েছিলেন। এর আগের লাল মেঝের বাড়িটা হলো পুনশ্চ। এই বাড়িতে গান বাজছিল। এক একটা বাড়িতে ঢুকি আর এক এক রকম হাওয়া বয়ে যায় মনের ভিতর। কি ভালো যে লাগে! এইসময় কখনো মনে হয় না রবী ঠাকুর নেই। শুধু মনের মধ্যে বয়ে নিয়ে বেড়াই যাঁর কথা, যাঁর গান। তিনি কোথায় থাকতেন। কী করতেন জানলে ভালো তো লাগেই। তাঁর বাড়ির ফার্ণিচারগুলো দেখে অবাক হয়ে যাই, এত সুন্দর সব। বিশেষ করে লেখার টেবিল আর চেয়ার। আর ছবির কথা কী বলবো!
রবীন্দ্রভবনের দেয়াল জুড়ে কত ছবি। কত কবিতা। কত গল্প। ভিতরে ছবি তোলা যায় না। এতকিছু সেখানে, চোখে দেখতে হয়। গান বাজছিল। আমি গলা মিলিয়ে গাইছিলাম আর ঘুরছিলাম। যারা ঘুরছিল সবাই-ই। রেজোয়ানা চৌধুরী বন্যার একটা পুরো গানের সিডি শুনলাম ঘুরতে ঘুরতে। এইসব জায়গায় গেলে বেশ কিছুক্ষণ না থাকলে হয় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু ছবি দেখেছি, যা কোনদিন কোথাও দেখিনি। অসম্ভব সুন্দর। এক একটা ছবি যেনো এক একটা দিনের গল্প। কত আয়োজন। পরিবারের ছবিতে সবার দাঁড়ানো, তাঁর বসার মধ্যে কি দারুণ স্টাইল। এটা শুধু তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। ছবিগুলোর উপস্থাপন দেখে বোঝাই যায়, এইরকম একটা জীবনের ছবি তিনি দেখেছিলেন, যখন মানুষ আসবে তাঁর এইসব কীর্তি দেখতে। ১৪০০ সাল কবিতার সেই আশা, সেই চাওয়া আমি ঘুরে ঘুরে দেখে এলাম যেনো! বাগান এ রামকিঙ্কর বেইজ এর বানানো মূর্তি দেখলাম। পরের দিন অবশ্য অনেক দেখেছি।

সোনাঝুরির পথে যেতে যেতে এইসব কথাই হচ্ছিল আমাদের। ওখানে বিশাল এক গাছের নীচে গান গাইছিলেন এক বাউল, ”মিলন হবে কতদিনে“। এটাকে বলে শনিবারের হাট। দোকান পাট তেমন কিছু ছিলো না বলা যায়। সন্ধ্যাও নেমে আসছিল তাড়াতাড়ি, এই গভীর গাছ গাছালীর ধারে। কড়ির মালা কিনলাম। একটা ফুচকার দোকান ছিল। টপাটপ কিছু ফুচকাও খেয়ে ফেললাম। এবার এই প্রথম বাইরে ফুচকা খাওয়া। টো টা দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের জন্য। আমাদের প্রথম কিন্তু অর্ধেকদিনের শান্তিনিকেতন ঘোরাঘুরি শেষে গেস্ট হাউজে ফিরলাম। আমরা শান্তিনিকেতনে আছি ফেইসবুকে দেখে কবি অতনু সিংহ ওর এক বন্ধুকে নিয়ে এলো দেখা করতে। ও বেড়াতে এসেছিল এখানে।
পরেরদিন আবারো ছাতিমতলা, প্রার্থনা ঘরসহ পাশের সবকিছু দেখা হবে। আর রাত এ নীলাঞ্জন এর এক বন্ধুর থিয়েটার ক্যাম্পাস এ আমার জন্য কবিতা আসর বসবে, সেখানে আমি কবিতা পড়বো। সেখানে বেশ কিছু বন্ধুরা আসবে। সবার সাথে দেখা হবার অপেক্ষা নিয়ে ঘুমাতে গেলাম।
একটা স্বপ্ন। একটা প্রত্যাশা পূরণের দিন আমার। নেটের কল্যাণ সব খবর জানিয়ে দিলাম। তবে শান্তিনিকেতন পৌছানোর খবরের পর, সেখানকার আর কোন পোস্ট দেইনি। মনে হচ্ছিল জমিয়ে রাখি। লিখবো সব একে একে। শান্তিনিকেতন এ গিয়ে একটা কথা বুঝেছি, এই জায়গাকে নিয়ে লিখতে হলে, জানতে হলে, থাকতে হবে। একদিন, দু’দিন দেখা শান্তিনিকেতনকে দেখে, এই জায়গাকে, এর মানুষগুলোকে মূল্যায়ন করা ঠিক না। আসলে কোন জায়গাকেই নয়। মানুষকে তো নয়ই।
বুধদেব গুহ’র “অববাহিকা” পড়ার পর একধরনের মূর্ছণা কাজ করতো। সেই মূর্ছণা ফিরে এসেছে আবার এই এপ্রিলে আমার মধ্যে। শান্তিনিকেতনই কারণ!


দ্বিতীয় দিন 
নতুন জায়গায় এলে ঘুম আসতে চায় না। কিন্তু এত ক্লান্ত ছিলাম যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বেশ আগেই। কিন্তু সকাল এ ঘুম ভাঙলো ক্ষুধা নিয়ে। আগের সন্ধ্যায় সোনাঝুরি থেকে ফিরেই গেস্ট হাউজের ক্যাফেটেরিয়ায় খেতে গিয়েছিলাম।
তৈরী হয়ে নীচে নামলাম। ক্যাফেটেরিয়ায় নাস্তা খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। টো টো করে ছাতিম তলার কাছ পর্যন্ত যেয়ে নামতে হয়। এরপর আর যেতে দেয় না ভেতরে। মনে হয় ক্লাস চলাকালীন সময় শব্দ থেকে বাঁচার জন্য এই ব্যবস্থা। যদিও ঠিক জানা হয়নি আসলে কেনো এই নিয়ম!
রবীন্দ্র সদনে যেতেই নীলাঞ্জন সব খবর জানতে চাইলো। কেমন কাটলো আগেরদিন বিকাল, গেস্ট হাউজ এ সব ঠিকঠাক আছে কিনা! সো নাইস অফ হীম। ছাত্রজীবনের অনেকটুকু সময় হোস্টেলে কাটিয়েছি। তাই কোথাও মানিয়ে নিতে আমার অন্ততঃ অসুবিধে হয় না। নীলাঞ্জন পরিচয় করিয়ে দিলো মাম্পুর সাথে। ওর বন্ধু এবং কলিগ। মিস্টি একটা নাম। অদ্ভুর সুন্দর দু’টো চোখ, এত সুন্দর দেখতে, নাম হওয়া উচিত ছিল সুনয়না না হয় সুদর্শনা। আমার বোনরা তো সে কথাই ফিসফাস করে বলছিল হাঁটতে হাঁটতে। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন এর আত্মীয়া হন মাম্পু নীলাঞ্জন বলেছিল। কী ভালো লাগলো জেনে! একটা মজার ব্যপার হলো, কলকাতা এবং শান্তিনিকেতনে পরিচয় হয়েছে এমন অনেকের বাবা মা বা আগের জেনারেশন এর বাড়ি ছিল বাংলাদেশ। যার কারণে সবার সাথে কেমন জুড়ে যাচ্ছিলাম আমরা কথাতে!
হাঁটতে হাঁটতে এই সব নিয়ে টুকটাক গল্প হচ্ছিল। জানলাম, ওর বাড়িতে অন্য সবার সাথে ওদের অনেক পশু পাখি আছে। শুনে এত ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল শান্তিনিকেতনের সাথে আমাদের লালমনিরহাট এর মানুষের অনেক মিল।

প্রথমেই আমরা গেলাম উপাসনা ঘরে। নানানরকম কাঁচের জানালা ঘেরা এই ঘর। গেট বন্ধ ছিল, তাই ভিতরটা কেমন তা অদেখা থেকে গেলো। আর সত্যি বলতে কি শান্তিনিকেতন এর সবখানেই এমন শান্তি শান্তি অনুভব, এখানে আলাদা করে কোন উপাসনা ঘর কেনো, এটা নিয়ে আমার তেমন কোন ভাবনা এলো না! অন্ততঃ তখন তো আসেনি।
এর পর গেলাম পাঠ ভবনে। স্কুলে ক্লাস চলছিল।যাবার পথে দেখি একটা ছেলে আর মেয়ে আমগাছে ডাল দিয়ে আম পাড়ার চেষ্টা করছে। মাম্পু ডেকে বারণ করলো। ব্যথা পাবে ভেবে। ওদের দিকে তাকিয়ে নিজেদের ছোটবেলা মনে পড়ছিল। স্কুল চত্ত্বরে ঢুকে আমরা একটা গাছের নীচে বসে গল্প করছিলাম। গরম ও পড়েছিল ভীষণ। কয়েকটা ছাত্র যাচ্ছিল। ওদের সাথে কথা বললাম। ওদের সাথে ছবি তুলতে চাইলাম আর বললাম, আমার তোমাদের চেয়েও বড় দুইটা ছেলে আছে। একজন আমার ছেলেদের নাম জানতে চাইলো। বললাম, রাশীক আর রাইয়ান। আমি ওদের নাম ও শুনলাম। আমি ওদের বললাম, তোমরা কি জানো তোমাদের ভাগ্য কত ভালো, তোমরা শান্তিনিকেতনে থাকো আর এখানে পড়ো। লাজুক হাসি হেসে মাথা নাড়লো। একটা মজার ব্যাপার হলো, আমিও ওদের মত হলুদ রঙ এর জামা পড়েছিলাম। ইচ্ছা করলেই সেদিন যে কোন ক্লাসে গিয়ে বসে পড়তে পারতাম। আমরা যখন পাঠ ভবন পেড়িয়ে যাচ্ছি। মাঠের মধ্যে দেখলাম অনেকগুলো বাচ্চা ক্লাস করছে। যে যার মনে লিখছে, পড়ছে। রাস্তা দিয়ে কে যাচ্ছে না যাচ্ছে তা নিয়ে ওদের কোন আগ্রহ নেই। ওরা সবাই মেতে আছে নিজেদের জগৎ নিয়ে। বই,খাতা,পেন্সিল এর এই অদ্ভুত জগত,বন্ধুদের সাথে গলা ধরে অকারণে হাসির এই জীবন নিয়ে। এই জীবনটা আমাদেরো ছিল। এইতো সেদিন, যেনো পলকেই চলে গেছে দূর থেকে দূরে!
হাঁটতে হাঁটতে কালোবাড়িতে গিয়ে পৌছলাম। মাটির তৈরি এই কালো বাড়িটা রামকিঙ্কর বেইজ এবং আরো অনেক বিখ্যাত গুনী শিল্পীর শিল্পকর্মে সজ্জিত। ছবি তুলবার জন্য থামলাম কিছুক্ষণ। কলাভবলে ঢুকলেই বোঝা যায় এ এক অন্যরকম জগত। কেউ ছবি আঁকছে। দুটো মেয়ের সাথে পরিচয় হলো। একজন গান গেয়ে শোনাল দুই লাইন। ক্লাস চলছিল, এখানে বাইরের মানুষের ঢোকা এই সময় ঠিক নয় মনে হয়। মাম্পু সাথে থাকায় এটা সম্ভব হলো।
দেয়ালে ছবি আঁকা একটা সুন্দর বিল্ডিং দেখে খুব ভালো লাগলো। ছবি কয়েকটা তুলেই বের হয়ে গেলাম। মাম্পু আমাদের “কাসাহারা” নামে একটা খাবার দোকানের কাছে পৌঁছে দিয়ে চলে যাবে। গরম ও পড়েছিল ভীষণ। আমরা আবার কালোবাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলাম। রামকিঙ্কর বেইজকে নিয়ে ভাবছিলাম, তাঁকে নিয়ে কিছু লেখা পড়েছি এইতো কিছুদিন আগে। একটা মানুষ কী করে শান্তিনিকেতন এসে থেকে গিয়েছিলেন। কলকাতাতেও যাননি তেমন। এই শিল্পীর করা অনেক ভাস্কর্য্য বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঘুরে বেড়াই আর শুধু গান গেয়ে উঠি কখনো মনে মনে, কখনো জোরেশোরেই, “আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো । তাই তো তোমার বাণী বাজে ঝর্ণ-ঝরানো ।“

হঠাৎ একজায়গা থেকে শুনি গানের সুর ভেসে আসছে। অনেক মানুষের ভীড়। একটা ট্রাক ফুল দিয়ে সাজানো। না বললেও বোঝা যায় কেউ চলে গেছে। মাম্পু খবর নিলেন। উনাদের পরিচিত একজন চলে গেছেন। নাচের শিক্ষক ছিলেন (যদি ভুল না করে থাকি)। বয়স হয়েছিল। কিছু অসুখে ভুগছিলেন। কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম গিয়ে আমারা সবাই। ভিতরে মানুষের ঢল। গানে গানে এমন বিদায় দেয়া দেখিনিতো! অপূর্ব লাগলো। মনে হলো রবি ঠাকুরের এই গানের মর্মার্থ আজ যেনো ঠিক করে বুঝলাম। ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই-
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই ।।
মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ, দুঃখ হয় সে দুঃখের কূপ,
তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ আপনার পানে চাই।“
অন্তরগ্লানি সংসারভার পলক ফেলিতে কোথা একাকার...
এই লাইনে এসে চোখ ভেসে যায় । এখন, তখন, সবসময়। এই পলকের কথাটুকু আমরা বুঝি না। আমাদের শুধু চাই। অথচ,পলকেই সব হারিয়ে যায়। সব। মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা হলো শান্তিনিকেতনে। এখানেও মৃত্যু এসে বলে গেলো, আছি। এই সত্যটাকে বুঝি বলে, জানি বলেই, জীবনটাকে এত ভালোবাসি। মনেহয় প্রতিক্ষণ বাঁচি। আনন্দে। একবার চলে গেলে আর ফেরেনাতো মানুষ।
আমাদের সবার মন বিমর্ষ হয়ে যায়। কেউ আর কথা বলি না অনেকক্ষণ।
“কাসাহারা” পৌছে একটু সহজ হই সবাই। (কাসাহারাকে নিয়ে একটা লেখা পড়লাম কাল, অনলাইনেই। জাপানের একটা মানুষ, এসে থেকে গিয়েছিলেন এখানে।)
কী সুন্দর একটা খড়ের ঘর! ভিতরে টেবিলপাতা, বেঞ্চ, চেয়ার পাতা। ছাত্রছাত্রীরা বসে কথা বলছে। পড়ছে। পরিবেশটা খুব ভালো লাগলো। আমাদের পাশের দোতলায় বসতে বললো। মাম্পু কিছুক্ষণ বসলো আমাদের সাথে। আমরা খাবার অর্ডার দিয়ে বসে গল্প করছিলাম। চারিদিকে অসংখ্য গাছ। ঘরটার চারিদিকে কাঁচের জানালা। ইলেক্ট্রিসিটি যাচ্ছিল, আসছিল, কিন্তু বাতাস থাকাতে খারাপ লাগছিল না।
আপা সুযোগ পেলেই আমাকে থ্যাঙ্কস জানাচ্ছিল এই বেড়ানোর প্লান করবার জন্য। আপুরা আগেও শান্তি নিকেতনে এসেছিল ভাবীকে নিয়ে। ভাইজান থাকলে খুব ভালো হতো। আর জিপসীতো অনেক খুশি আমাদের সাথে এখানে এসে। বলেছে আবার পৌষ মেলাতে যাবে একসাথে। মাম্পু জানালো ওর পুরো নাম, সুদর্শনা সেন। মনে ভাবছিলাম এমনই তো হবার কথা! ওকে বললাম। ও হাসলো। ও চলে যাবার পর মনে হলো একটা জীবনে কত মানুষ এসে জড়ো হয়।যেমন সুন্দর কথাবলা একটা মানুষ এর সাথে আজকে আমাদের দেখা হবার কথা ছিল। ভালো থাকেন মাম্পু। যেমন খুশি তেমন করে। আবার কোনদিন দেখা হবে আমাদের। তেমন ইচ্ছা রইলো।

রোদ মাথায় নিয়েই গেস্ট হাউজে ফিরতে হলো। একটু বিশ্রাম নিয়েই তৈরি হতে হবে। নীলাঞ্জন'র বন্ধু পার্থ গুপ্ত'র "থিয়েটার ক্যাম্পাস"-এ যাবো আমরা। শান্তিনিকেতন থেকে একটু দূরে, দ্বারন্দাতে সেই সুন্দর বিকেল থেকে শুরু করে রাতের বেলার "কবিতা আড্ডা" আর মজার খাবারের আয়োজন আর গল্প'র জন্য অপেক্ষা থাকুক।
শান্তিনিকেতনে বেড়ানোর মতোই আনন্দ পাচ্ছি লেখাতে। মনে হচ্ছে আরো দেরি করে লিখলেই ভালো হতো। মনটা এত ভালো হয়ে আছে। মনে হচ্ছে আমার চারিদিকে অজস্র বেলী ফুলের গাছে। আমি এর সুগন্ধে ভেসে বেড়াচ্ছি। এখন বুঝি কেনোইবা কবিগুরু ওখানে গিয়ে থাকার জন্য এত উতলা হয়ে থাকতেন।
একটা জায়গার যে কত মায়া থাকতে পারে, টান থাকতে পারে! আর মানুষের কথা কী বলবো! মানুষের কাছে যেয়ে যেয়েই আমি প্রতিদিন মানুষ হতে শিখি! আর ভালো লাগে তাই এই জীবন। এই বেঁচে থাকা!


শান্তিনিকেতনের দ্বারন্দায় “থিয়েটার কটেজ”-এ কবিতা সন্ধ্যা (দ্বিতীয় দিন, সন্ধ্যেবেলা)
কলকাতায় দারুণ এক কবিতা সন্ধ্যার স্মৃতি জমে আছে। এর মধ্যে শান্তিনিকেতনে কবিতা সন্ধ্যা (৪ এপ্রিল ২০১৮), এ যেনো উপড়ি পাওনা। নীলাঞ্জন কবি। ওর জাপানী স্টাইলের বাড়ি কোকোরোতে একদিন যাবো, সেখানে হয়তো আড্ডা হবে, সেইরকম ভাবনা ছিল। কিন্তু আমাকে ঘিরে একটা কবিতাসন্ধ্যার আয়োজন হবে এখানে এটা সত্যি খুব আনন্দের আমার জন্য। ভাইজানের কথা মনে পড়ছিল! অনেক বছর আগে, তখন সবে দেশ ছেড়ে কানাডায়। ভাইজান একটা চিঠিতে লিখেছিল, ”সব সময় যেখানে পারিস মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করবি। অনেকদিন পর একদিন, অন্যকোথাও দেখবি তোর পাশে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে।“ এটা শুধু ভাইজানের চিঠির কথা না। এটা আমাদের মা বাবার জীবনের আদর্শ। আব্বা মা সারাজীবন ধরে করে গেছেন। শুধু আমাদের পরিবার বা আত্মীয় স্বজন না। সমান তালে অন্য অনেক পরিবারকে। আর ভাইজান তো করেই যাচ্ছেন ।
পূর্বপল্লী গেস্ট হাউজটা সবসময় চুপচাপ। গেটের সামনে ছাড়া তেমন কাউকে চোখে পড়ে না। ক্যাফেটেরিয়াতে কিছু মানুষ থাকে সকালে। অনেকে গ্রুপে এসেছিল। আমরা চারজন (জিপসী সহ আমরা তিনবোন) তৈরী হয়ে গেস্ট হাউজের ফুল বাগানের সামনে ছবি তোলার সময়ই গাড়ি এসে পড়ে। খুব হাসিখুশি একটা ছেলে, জানায় পার্থ গুপ্ত থিয়েটার কটেজ থেকে আমাদের নিতে পাঠিয়েছে।শান্তিনিকেতন থেকে বেশ কিছুটা দূর। খুব ভালো লাগছিল ড্রাইভটা। রাস্তার দুপাশে সবুজ। দূরের গ্রামগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, আমাদের দেশের মতোই। রাস্তাঘাট, সবুজ মেঠোপথ, পাখপাখালী সবকিছুতেই মিল। এমনকি রাস্তার দু-ধারে দাঁড়ানো মানুষের সরল দৃষ্টিতেও খুব মিল।
মহাসড়ক থেকে গাড়িটা যখন মেঠোপথ দিয়ে থিয়েটার কটেজের দিকে যাচ্ছিল, সূর্যটা তখন গাছগাছালীর ফাঁক দিয়ে ডুবতে শুরু করেছে। গাড়ি থেকে নেমে সামনে এগোতেই কী ভালো যে লাগলো! মঞ্চের পিছনটা শালপাতা দিয়ে করা (এখানে নাটক করে স্থানীয়রা)। কয়েকটা মেয়ে শালপাতা দিয়ে প্লেট বানাচ্ছিল। ডান পাশ সামনে এগোতেই একটা মাটির ঘর। ওখানে দুইটা বেঞ্চ পাতা। তার পাশে বিশাল এক শিরীষ গাছের নীচে বসার গোল করে মাটি আর ইট দিয়ে বানানো বেদী। ওখানে আমাদের আগে এসে বসেছিলেন দু'জন। পরিচয় হলো। দুই জনই কবি। দুর্বা মুখোপাধ্যায় এবং সুকল্প চট্টোপাধ্যায়। কলকাতা থেকে এসেছেন। আমাদেরকে মুড়িমাখা আর চা দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো। সন্ধ্যা তখন নেমেই গেছে। এমন অন্ধকারে বসে শুধু অন্ধকারকে ছুঁতেই ভালো লাগে। আশেপাশে মানুষদের কথার গুঞ্জন, দূর থেকে আসা গাড়ির হেডলাইটে কিছুক্ষণ আলোতে ভেসে যাওয়া, মাটির রাস্তা দিয়ে একে একে অনেকেই চলে এলো। আর ততক্ষণে মাঠের সার্চ লাইটটা জ্বলে এক অদ্ভুত আবহ সৃষ্টি হয়েছে। ওইযে বলার নয়, লেখার নয়, রুপকথাতেই পরিচয়। তেমনই কিছু। একটা বারান্দাওয়ালা মাটির ঘরের সামনে ঘাসের উপর চাদর বিছানো হয়েছে।
আমার খুব ভাইজানের কথা মনে পড়ছিল। লালমনিরহাটে ভাইজানের নিজের স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সোনালী পার্ক, যেখানে অজস্র গাছ লাগিয়েছে ভাইজান। কবিতা আড্ডাও তো চলে শুনেছি সেখানে, মাঝে মাঝে দোয়েল গেস্ট হাউজের তিনতলাতেও।
যদিও আমি যাবার পর ভাইজানকে পাইনা আর। দেশের বাইরে থাকে। আর তাই কবিতা আড্ডা হয় না। মনে হচ্ছিল, এখানে ভাইজান থাকলে কত ভালো হতো! আমার বোনরাও খুব খুশি। এমন সুন্দর পরিবেশে কার না ভালো লাগে?
অরণিকা আসলো। নীলাঞ্জনের বউ। পুতুলের মত সুন্দর। ছবিতে দেখে এত চেনা। মনে হলো যেনো প্রায়ই আমাদের দেখা হয়। কখনো কোকোরোর ঘরে কখনোবা শান্তিনিকেতনের পথে কোথাও। আমাকে জানালো, আমার দেয়া উপহার খুব পছন্দ হয়েছে। খুব ভালো লাগলো। দেশে যাবার আগে ঘুরে ঘুরে সবার যাদের কথা ভেবে টুকটাক জিনিসগুলো নিয়ে যাই। সেগুলোর সাথে অনেক সময় জুড়ে থাকে। অনেক আদর থাকে। যারা সেটা বুঝতে পারে আর বলে, তখন মনেহয় এই দেয়াটুকু সার্থক হয়ে যায়।
পার্থ খুব ব্যস্ত ছিলো (একারণে তার সাথে কোন ছবি নেই)। তবু ধরে এনে পরিচয় করালো নীলাঞ্জন। পার্থ গুপ্তর সঞ্চালণায় শুরু হলো আয়োজন। প্রথমেই সাঁওতালী ট্রাডিশনাল ঢোল বাজিয়ে নাচলো ৩ জন সাঁওতাল শিল্পী । তারা হলেন, মংলা হেমব্রাম, সুকুল হেমব্রাম, জলধা মুরমু। এরপরই মাটির বারান্দায় কামিল এবং লাভরেন্ত্য নামের দুজন বিদেশী ছাত্র বাংলাতে একটা ছোট্ট নাটিক করলো। “গাছ"-এর উপর। পরিবেশের ভারসাম্য কীভাবে নষ্ট হচ্ছে এই গাছ কাঁটার জন্য, সেটা খুব সুন্দর করে উপস্থাপন করলো। ওদের ক্লাসের আর একটা মেয়েও ছিলো ওদের সাথে। (নামটা এই মুহুর্তে মনে নেই)
কবিতা আবৃত্তি করলেন, কবি সুকল্প চট্টোপাধ্যায়, আবির মুখোপাধ্যায় এবং পার্থ গুপ্ত নিজে। খুব সুন্দর গান গেয়েছিল অজন্তা জানা (পার্থর স্ত্রী), অরণিকা (নীলাঞ্জনের স্ত্রী) এবং সংঘমিত্রা দাস (কলাভবনের প্রিন্সিপাল গৌতম দাসের স্ত্রী)। এছাড়াও কৃষ্ণযাত্রার গান গেয়েছেন শিবুমাল নামের একজন শিল্পী। সবাই এত সুন্দর গাইলো! আমিও বেশ কয়েকটা কবিতা আবৃত্তি করলাম। শুরুতে কিছু কথাও বললাম। খোলা আকাশের নীচে, এতগুলো গুনী মানুষের সামনে কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়েছিলাম সংগত কারনেই। অনুষ্ঠান শেষে বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রী এসে কবিতার প্রশংসা করলো। একটা মেয়ে “আমি কিংবদন্তী হবো তোমার কবিতায়” কবিতার রেশ ধরে নানা প্রশ্ন করলো আর ওর ভালোলাগা জানালো।
বারবার মনে হয়, যে কথা বলা হয়নি সেদিন ভালো করে, আজ লিখতে বসে সেদিনের সেই সুন্দর এই আয়োজনের জন্য যতই ধন্যবাদ দেই নীলাঞ্জনকে আর পার্থকে। মনে হয় বাকি থেকে যায়। কিছু আয়োজন থাকে না প্রাণের? এছিলো মাটির খুব কাছে, প্রাণের কাছে। এখানে সবাই কত গুনী সে কথাই মনে হচ্ছিল সেদিন।
এত সুন্দর জায়গায় (থিয়েটার কটেজে), এতগুলো কবিতা প্রিয় মানুষের উপস্থিতি, আর খাবারের যে অসাধারন আয়োজন, তা কী করে লিখে প্রকাশ করি? শালপাতার প্লেটে অপূর্ব সব খাওয়া। পোস্তর অপূর্ব স্বাদ এর বড়া ছাড়াও মজার মাছ আর বিভিন্ন তরকারী দিয়ে গরম ভাত খাওয়া! কয়েকটা সাঁওতাল ছেলেমেয়ে সুন্দর পরিপাটি পোশাক পড়ে আমাদের খাবার পরিবেশন করলো। জীবনে প্রথমবার এমন সুন্দর একটা অভিজ্ঞতা হলো।
শুধু আমার জন্য এতগুলো মানুষের উপস্থিতি আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করেছে। বারবার মনে হয়েছে, ঋনী হয়ে গেলাম এদের সবার ভালোবাসার কাছে। বিশ্বভারতীর অনেকগুলো ছাত্রছাত্রীও এসেছিল। কেউ কেউ এসে জানালো তাদের কারো কারো দাদা বা নানা বাড়ি বাংলাদেশে। মনে ভাবলাম, না হলেই বা কী? এই যে একই ভাষায় কথা বলার আনন্দ। এতো পৃথিবীর আর কোথাও পাবো না। বাংলায় গান কবিতার এই যে যোগাযোগ এর কোন তুলনা হয় না। ফিরছিলাম যখন, মনে হচ্ছিল রবি ঠাকুরের এই শান্তিনিকেতনে আসার প্রার্থনা ছিল। সেখানে এসে এত আনন্দময় স্মৃতির অংশ হয়ে গেলাম। সেইদিনের সেই আনন্দ আমার সারাজীবনের একটা বিশেষ গল্প হয়ে গেলো।
সবচেয়ে বিস্ময়কর একটা কথা শুনলাম অরণীকার কাছে, আমার খুব প্রিয় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় পূর্বপল্লীর একটা রুমে থাকতেন এবং এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। নীলাঞ্জন জানালো ওটা মনেহয় ১৯ বা ১২ হতে পারে। অনেক রাত হয়ে গেলো ফিরতে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছিলাম আর কেমন এক অনুভবে ডুবে ছিলাম। ১৯ তো আমারি ঘর! ঘরের দরজার তালা খুলতে খুলতে মনে হয়, এখানেই কী তিনি ছিলেন? মনে পড়ে, তাঁর কবিতা।
অবনী বাড়ি আছো?
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে পড়েছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’
সারারাত ঘুম ভাঙলেই থিয়েটার কটেজ এর সন্ধ্যাটা মনে পড়ে। কী ভীষণ আন্তরিক মানুষগুলো। কী দারুণ আতিথেয়তা!
সেই বোহেমিয়ান কবিকে মনে পড়ে।
আরো যেনো ভালো লাগতে থাকে শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লী। সকাল বেলা ঘুম ভাঙার পরেই নীচে ক্যাফেটেরিয়াতে যাই, পুরানো অনেককে জিজ্ঞেস করি। কেউ বলতে পারে না। আমি গেস্ট হাউজের সবগুলো করিডোরে হেঁটে আসি। শুধু মনে হয় এখানেই তো তিনি ছিলেন। কত প্রিয় কবিতা লিখেছেন তিনি। যেতে পারি কিন্তু কেনো যাবো, বইটা একসময় সারাক্ষণ নিয়ে ঘুরতাম। কী ভীষণ ঘোরলাগা ছিল শক্তির কবিতায়। কত লাইন ঘুরতো মাথায় সারাক্ষণ। সেই ভালোলাগা আজ আমার কবিতার ভাষাতেই বলি,
“মাঝে মাঝে ভালোবাসা এভাবেই ঘুরে আসে।
চোখের মনিতে, হাতের তালুতে,
বুকের ভিতরে হৃদয় কুঠরীতে।
ভালোবাসা, মাঝে মাঝে রিমঝিম বৃষ্টি হয়ে যায়।
কেউ তা জানে, কেউ তা বোঝে!
কেউ তা বোঝে না!"


সুলতানা শিরীন সাজি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ। লেখেন কবিতা ও গল্প। ভালোবাসেন রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে ও কবিতা আবৃত্তি করতে। বর্তমানে কানাডা প্রবাসী।
জন্ম লালমনিরহাটে।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: 'এক জোছনায় তুমি আর আমি', 'কফির পেয়ালায় নিশুতি রাত জাগে', 'বিষণ্ণতায় একা', 'ভালোবাসার ফুলঝুরি'। পত্রকাব্য: 'অপ্রকাশিত চিঠি'। গল্প: 'রানুর আকাশ'। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. এতক্ষণ কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ থেমে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। লেখিকার কাছে এরকম আরও লেখা চাই।

    উত্তরমুছুন

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।