TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী সাহিত্যিক আব্দুলরাজাক গুরনাহ’র সংক্ষিপ্ত ফোনালাপ

২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী সাহিত্যিক আব্দুলরাজাক গুরনাহ’র সংক্ষিপ্ত ফোনালাপ
প্রচ্ছদ: Niklas Elmehed’র আঁকা ছবি অবলম্বনে



 ভাষান্তর: সুশান্ত বর্মণ 


[২০২১ সালের সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার ৭ অক্টোবর ঘোষণা করা হয়েছে। এবারের পুরস্কার পেলেন তানজানিয়ার বংশদ্ভূত ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ও ঔপন্যাসিক আব্দুলরাজাক গুরনাহ (Abdulrazak Gurnah)। পুরস্কার কমিটির প্রধানের ভাষ্যমতে - বিভিন্ন সংস্কৃতি ও মহাদেশের প্রান্তসীমায় উদ্বাস্তুদের ভাগ্য এবং ঔপনিবেশিক প্রভাবের কারণে তাঁর হৃদয়ে জন্ম নেয়া অবিচল ও দরদী আন্তরিকতা নিয়ে সাহিত্য রচনার জন্য তিনি এই পুরস্কার পান।

গুরনাহ জন্ম নেন ১৯৪৮ সালে। ১৮ বৎসর বয়স পর্যন্ত তৎকালীন জান্জিবারে (বর্তমান তানজানিয়া) বেড়ে ওঠেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশ ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে আসেন। ইংরেজি ও ঔপনিবেশিক সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মজীবন শেষ করে বর্তমানে অবসরে আছেন। তাঁর রচনায় শরণার্থী জীবনের যন্ত্রণা তথা শিকড়চ্যুত অভিবাসী মানুষের লড়াই ও হাহাকারের কাহিনিই প্রধান। রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ তাঁর নিজের জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলেছে, তাঁর দেশ ও আফ্রিকার অন্যান্য অংশে কীরকম পরিবর্তন ঘটিয়েছে এই বিবরণগুলো তিনি রচনা করেছেন একের পর এক উপন্যাস। ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কীভাবে নিষ্পেষিত হয়েছে, যা তিনি তার গল্প বলেন। ইতিহাসের বিনির্মাণ বিশেষত রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ তাঁর উপন্যাসের শরীর বেয়ে পৌঁছে যায় আধুনিক পাঠকের হাতে। এখানেই তিনি সার্থক।

গুরনাহ কয়েকটি ছোটগল্প, দশটি উপন্যাস ও বিশটির অধিক সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। ফরাসী, সুইডিশ ও জার্মান ভাষাতেও তাঁর সাহিত্য সমালোচনা রয়েছে। উদ্বাস্তু জীবনের বিধ্বস্থ অবস্থা, এর স্বরূপ অন্বেষণ এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রতিবেশ তাঁর আগ্রহের প্রধান দিক। তাঁর মানস গঠনে শেক্সপীয়র থেকে ভি. এস নাইপল, নাইজেরিয়ার লেখক ওলে সোয়াঙ্কা, কেনিয়ার লেখক নগোয়ি ওয়া থিয়ংও, ব্রিটিশ-ভারতীয় লেখক সালমান রুশদী সকলের প্রভাব রয়েছে।

১৯৯৪ সালে তিনি বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিলেন। নিজের রচনা নিয়ে তিনি বলেন এগুলো হল 'আমাদের সময়ের এক গল্প'।

নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পরপর নোবেলপ্রাইজ.অর্গ ওয়েবসাইটের পক্ষ থেকে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এডাম স্মিথ ফোনে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকারের আবহ ঠিক রাখার জন্য কথা বলার ভঙ্গি পরিবর্তন করা হয়নি।]


“কিছু একটার ভিতর থেকে পাওয়া… অন্যকে তৃপ্তি দেয়া, কোন ঘটনা তৈরি করা, বিশ্বাস্য করে তোলা” 
—আব্দুলরাজাক গুরনাহ


আব্দুলরাজাক গুরনাহ: হাই

এডাম স্মিথ: হ্যালো। আমি কি আব্দুলরাজাক গুরনাহের সাথে কথা বলছি?

আব্দুলরাজাক গুরনাহ: হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, হ্যাঁ।

এডাম স্মিথ: হাই, আমার নাম…

আব্দুলরাজাক গুরনাহ: আমি কম্পিউটারে ঘোষণাটি দেখতেছিলাম। আপনি কে বলছেন?

এডাম স্মিথ: আমার নাম এডাম স্মিথ। আমি নোবেল প্রাইজ এর ওয়েবসাইট থেকে বলছি। যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে একটু কথা বলবেন, অথবা ঘোষণাটি দেখতে থাকবেন কি? আমি মাঝপথে বাগড়া দিতে চাই না।

আব্দুলরাজাক গুরনাহ: আচ্ছা, ঠিক আছে। কীভাবে এটা করতে চাচ্ছেন? কারণ রিপোর্টারদের কথা শোনার কোন কারণ নেই। আমাকে এসব পরেও শুনতে হবে।

এডাম স্মিথ: যথার্থ বলেছেন। আমার ধারণা এটাই। আপনার জীবন স্বল্প সময়ের মধ্যে পাল্টে যাবে- এটা সেই বার্তা, তাই নয় কি? একটি প্লাবন আসতে যাচ্ছে – এই সম্ভাবনাকে আপনি কেমন অনুভব করছেন?

আব্দুলরাজাক গুরনাহ: আচ্ছা। আমি এই অবস্থার মধ্যেই রয়েছি। হ্যাঁ, এটাকে অনিবার্য বলেই মনে করি। এটা এমনই, এমনই একটি বড় পুরস্কার। কিন্তু হ্যাঁ, এটা অবশ্যম্ভাবী। ঠিক আছে, আচ্ছা, আমি এর চাপ নিতে পারব।

এডাম স্মিথ: আর খবরটা ঠিক কীভাবে আপনার কাছে পৌঁছাল?

আব্দুলরাজাক গুরনাহ: তিনি ফোন করেছিলেন। আমি দুঃখিত স্থায়ী সচিবের নামটা যেন কী?

এডাম স্মিথ: ম্যাট্‌স মাল্ম।

আব্দুলরাজাক গুরনাহ: হ্যাঁ, তিনি এই ১০ মিনিট, ১৫ মিনিট আগে ফোন করেছিলেন। আমি এটাকে তামাশা ভেবেছিলাম। সত্যি তাই ভেবেছিলাম। কারণ, আপনি জানেন এই বিষয়টা কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস আগে থেকেই ভেসে বেড়ায়, কে সেই ব্যক্তি? আপনি জানেন, কে সেই ব্যক্তি - এরকম, অতএব আমার মনে এরকম কিছুই ছিলনা। আমি শুধু ভাবছিলাম কোন সেই ব্যক্তি এটা পেতে যাচ্ছে।

এডাম স্মিথ: তা বটে। ঠিক বলেছেন। আর হ্যাঁ, আপনাকে বিশ্বাস করতে হয়েছে। তিনি কীভাবে আপনাকে প্রভাবিত করলেন?

আব্দুলরাজাক গুরনাহ: আচ্ছা। তিনি শান্তস্বরে বলছিলেন। আর আমি… আর আমি… তখন তিনি আমাকে ওটা সম্পর্কে, সেই ওয়েবসাইট, সুইডিশ একাডেমির ওয়েবসাইট সম্পর্কে বললেন আর আমি বলেছিলাম, আচ্ছা আমি এক মিনিটের মধ্যে সেখানে গিয়ে পরীক্ষা করে নেব। কিন্তু এখন আমাকে আরও কিছু বলুন। সুতরাং তিনি শান্তভাবে কথা বলে যাচ্ছিলেন এবং আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত 'যতক্ষণ দেখিনি বা শুনিনি' – এরকম ভেবে যাচ্ছিলাম। এখন পর্যন্ত এই হল ঘটনা, অতএব...

এডাম স্মিথ: আচ্ছা, এই হল ঘটনা, এটাই সত্যি।

আব্দুলরাজাক গুরনাহ: হ্যাঁ, যা বলেছেন, এটাই বাস্তব, হ্যাঁ।

এডাম স্মিথ: আপনি জানেন… আমি ঠিক… নোবেল পুরস্কারটি…

আব্দুলরাজাক গুরনাহ: দুঃখিত, ফোন কল আসতেই আছে।

এডাম স্মিথ: তা তো আসবেই। সেজন্যই আমি আপনাকে খুব তাড়াতাড়ি পাওয়ার চেষ্টা করেছি। আশা করি কিছু মনে করবেন না। যদি আরও কয়েক মিনিট আমার সাথে থাকেন, তাহলে দারুণ হয়।

আব্দুলরাজাক গুরনাহ: আমি কি এই লোকের সাথে একটু কথা বলতে পারি?

এডাম স্মিথ: অবশ্যই পারেন। নিশ্চয়।

আব্দুলরাজাক গুরনাহ: হাই… আমি কি… মনে করি এই মাত্র খবরটা শুনেছেন। আমি এখন সুইডিশ একাডেমির সাথে কথা বলছি। পাঁচ মিনিট পরে ফোন করিয়েন, ঠিক আছে বাই বাই। হাই, আপনি কি এখনও আছেন? ওদেরকে বিবিসি মনে হল।

এডাম স্মিথ: হ্যাঁ, তা তো বটেই, তারা আপনার সাথে কথা বলতে চাইবে। কিন্তু আপনার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে আপনি 'উদ্বাস্তুর ভাগ্য' এবং 'সংস্কৃতি ও অঞ্চলের প্রান্তসীমা' নিয়ে কাজ করছেন। আমরা যে অভিবাসী সমস্যার মাঝে রয়েছি এটা সমকালে বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু সংস্কৃতিগুলোর মধ্যে রয়ে যাওয়া পার্থক্য নিয়ে এখন আপনি কিছু বলবেন কি? কোন কিছুকে এখন অনেক ভাবেই চিহ্নিত করা যায়।

আব্দুলরাজাক গুরনাহ: এই পার্থক্যগুলোকে ভিন্নরকম মনে করি না। আপনি জানেন এগুলো স্থায়ী ও কখনও দুর্লঙ্ঘ্য অথবা এমন কিছু একটা। মানুষ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি মনে করি এটা একটা… আফ্রিকা থেকে ইউরোপে আসার এই ব্যাপারটা তুলনামূলকভাবে নতুন। আর অবশ্যই ইউরোপীয়দের বিশ্বের অন্য জায়গায় চলে যাওয়াটাও নতুন নয়। শতকের পর শতক ধরে এটা ঘটছে।

অতএব, আমি এর কারণকে মনে করি ইউরোপীয় ধরনের সাথে মেলানো কঠিন। ইউরোপের অনেক মানুষের জন্য, ইউরোপীয় রাষ্ট্রের জন্য, এর বৈশিষ্ট্যের কাছাকাছি আসা, হয়ত এক প্রকারের… আচ্ছা, লম্বা গল্পকে কেটে ছোট করা এক ধরণের কৃপণতা, যেন এতে অভ্যস্ত থাকা যথেষ্ট নয়। যখন এই ধরনের অনেক মানুষ প্রাথমিক প্রয়োজনের জন্য চলে আসে, আর কারণ তাদের কাছে অন্যদের কিছু দেয়ার আন্তরিকতা ছিল, না, তারা খালি হাতে আসেনি। ওদের মধ্যে অনেকে মেধাবী, উৎসাহী মানুষ, যাদের কাছে কিছু দেয়ার মত ছিল।

অতএব, এই সম্পর্কে অন্যভাবে ভাবতে হবে। আপনি নিশ্চয় তারা যেমন আছে তেমনভাবেই তাদের গ্রহণ করতেন না। আপনি জানেন দারিদ্র্যের পীড়ন কিছুনা, কিন্তু, হ্যাঁ, মনে করুন, আপনি প্রথম, যাদের প্রয়োজন এবং যারা কিছু ভূমিকা রাখতে পারে তাদের ত্রাণ দিচ্ছেন।

এডাম স্মিথ: একথা বলার জন্য ধন্যবাদ। এবং আর একটা বিষয়, নোবেল পুরস্কার প্রত্যেক বৎসর এই ঘোষণার সপ্তাহে বিজ্ঞানী ও শিল্পীদের একসূত্রে বেঁধে ফেলে। বিজ্ঞানীরা তাঁদের কাজকে অভিযাত্রার আনন্দের মত করে বর্ণনা করে। যখন আপনি লেখালেখি করেন, তখন কি এরকম কিছু অনুভব করেন?

আব্দুলরাজাক গুরনাহ: আচ্ছা, যখন শেষ করি তখন আমি আনন্দ অনুভব করি (হাসি) আর হ্যাঁ, এর অনেককিছুই অমোঘ, অনিবার্য এই জাতীয় কিছু। আপনি জানেন, লেখকরা যুগ থেকে যুগান্তরে সক্রিয় থাকে। যদি আপনি কোন কিছু ঘৃণা করেন, তাহলে সেটা করতে পারবেন না। কিন্তু আমি মনে করি এটা তৈরি করার আনন্দ ও ঠিকঠাকভাবে অলংকৃত করা দুটোই, অবশ্য এটা কিছু একটার ভিতর থেকে পাওয়া… অন্যকে তৃপ্তি দেয়া, কোন ঘটনা তৈরি করা, বিশ্বাস্য করে তোলা এবং এই ধরনের সব বিষয় থেকে আসা আনন্দ।

এডাম স্মিথ: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এই মুহুর্তে যারা আপনার সান্নিধ্য তীব্রভাবে পেতে চাইছে, তাদের সকলের সামনে আপনি সহজপ্রাপ্য হোন এটাই আমি চাইব, অতএব ধন্যবাদ।

আব্দুলরাজাক গুরনাহ: আচ্ছা ঠিক আছে, ধন্যবাদ, বাই।

এডাম স্মিথ: আমি আশা করি আমাদের অন্য কোন সময়ে আরো কথা বলার সুযোগ হবে। সেই সময় পর্যন্ত আপনাকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই।

আব্দুলরাজাক গুরনাহ: আচ্ছা, ধন্যবাদ। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, ধন্যবাদ।

এডাম স্মিথ: আজকের এই দিন সৌভাগ্যময় হোক।

আব্দুলরাজাক গুরনাহ: বাই বাই।

এডাম স্মিথ: বাই।


 লেখকের অন্যান্য লেখা: 


সুশান্ত বর্মণ। প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। জন্ম ‘আর কে রোড’-এর অদূরে, কুড়িগ্রামে। শিক্ষকতার চাকরি করেন। উদ্যোক্তা ও পরিচালক: বই আলোচনার ওয়েবসাইট ‘গ্রন্থগত’ (www.granthagata.com)। পাশাপাশি সম্পাদনা করছেন কুড়িগ্রামের লেখকদের নিয়ে আলোচনার পত্রিকা ‘তীব্র কুড়িগ্রাম’। একসময় সম্পাদনা করতেন প্রবন্ধের পত্রিকা ‘ব্যবচ্ছেদ’। প্রকাশিত অনুবাদগ্রন্থ: দুই হাজার বছর আগের তামিল সাহিত্য ‘থিরুক্কুরল’।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ