TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা

প্রচ্ছদ: নাজমুল হোসাইন   

 তোমার তামাটে পা

তোমার পায়ের দিকে চেয়ে থাকি, একদৃষ্টে সম্ভব নয় চেয়ে থাকা
কী বলে এই দৃশ্য ও অদৃশ্যের মাঝে দ্রুত ঝরোয়ার তামাটে গোড়ালিকে?
পুরবীকল্যাণ, কামেশ্বরী, চারুকোষ, জনসন্মোহিনী আঙুলগুলোকে?
পায়ের অবিস্মরণীয় স্মৃতিশক্তি আর কারোর দেখিনি কখনো
মনে হয় রেক্যুইয়েমের ইঙ্গিতবাহী তামাটে ঘনশ্যামা মন্দ্র সপ্তক
অথচ শব্দ নেই, বাতাসও নিথর, কেবল তোমার
দুটি তামাটে পায়ের স্পর্শে পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরেই চলেছে


ইন্দ্রাণীর জন্য প্রেমের কবিতা

অসহ্য সুন্দরী, আমার নিজের আলো ছিল না
তোর আলো চুরি করে অন্ধকারে তোরই ছায়া হয়ে থাকি
তোর আর তোর বরের নাঝে শ্বাসের ইনফ্যাচুয়েশানে
অসহ্য সুন্দরী, বেহালার কোন তারে তোর জ্বর, তা জানিস?
জানি না কেমন করে রেমব্রাঁর তুলি থেকে পিকাসোর তুলিতে চলে গেলি!
তোর মাতৃতান্ত্রিক ইতিহাসের চেতনায়
তিনশো বছর পড়ে আছি সমুদ্রের গভীরতম জলে ভাঙা জাহাজে শেকলবাঁধা
সময়কালকে যে স্বরলিপিতে বেঁধে ফেলিস তা বলেছিস তোর বরকে?
বলেছিস পরস্ত্রীকাতরতার প্রেমিককে মগজে চাকর করে রেখেছিস?
সাঁতারু যেমন জলে সহজ তেমন তুই সময়কালে
অসহ্য সুন্দরী, আমাকে গড়ে নিয়েছিস ভয় যন্ত্রণা আনন্দের মিশেলে
অ্যানার্কিস্ট করে দিয়েছিস আমাকে—
মনে রাখি ব্যথা আর দুঃখই আগুন, হে অসহ্য সুন্দরী
তোর আর তোর বরের মাঝে পরস্ত্রীকাতরতার শ্বাস
শুনতে পাচ্ছিস? শোন, কান পেতে শোন…


অবন্তিকার শতনাম

আমি অবন্তিকার দুটো মাইয়ের নাম দিয়েছি কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া...বাঁদিকেরটা আদর করলেই গোলাপি হয়ে যায়...ডানদিকেরটা আদর করলেই হলদেটে রঙ ধরে...বাঁদিকের বোঁটার নাম করেছি কুন্দনন্দিনী...বঙ্কিমের বিষবৃক্ষ তখন ও পড়ছিল চিৎ শুয়ে...ডানদিকের বোঁটার নাম ও নিজেই রেখেছে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার যে লোকটা সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের ডিটেকটিভ...ডিটেকটিভ বই পড়তে ওর জুড়ি নেই...ছুঁলেই কাঁটা দিয়ে ওঠে তাই...যোগেন চৌধুরীর আঁকা ঝোলা মাই ওর পছন্দ নয়...প্রকাশ কর্মকারের আঁকা কালো কুচকুচে মাই ওর পছন্দ নয়...পেইনটিঙের নাম রাখা গেল না...যোনির কি নাম রাখবো চিন্তা করছিলুম...অবন্তিকা চেঁচিয়ে উঠলো পিকাসো পিকাসো পিকাসো...পিকাসোর যোনির কোনো আদল-আদরা নেই...কখনও বাদামি চুল কখনও কালো কখনও কিউবিক রহস্য...তাহলে ভগাঙ্কুরের...ও বলল সেটা আবার কি জিনিস...ওর হাত দিয়ে ছুঁইয়ে দিতে বলল অমঅমঅমঅম কি দেয়া যায় বলতো...পান্তুয়া চলবে...ধ্যুৎ...রস পানেই পান্তুয়া নাকি আরও কতো রকম মিষ্টি হয়...ছানার পায়েস...নারকেল নাড়ু...রসমালাই...নকশি পিঠা...রাজভোগ...লবঙ্গলতিকা...হলদিরামে ভালো লবঙ্গলতিকা পাওয়া যায়...আমি বললুম স্বাদ কিছুটা নোনতা...ও বলল দুর ছাই আমি নিজে টেস্ট করেছি নাকি যাকগে বাদ দে...হ্যাঁ...এগোই...পাছার কি দুটো নাম হবে...ডিসাইড কর...ডিসাইড কর...তুই কর আমি তো দেখতে পাচ্ছি না...না না ফের ফের...লাবিয়া নোনতা হলেও ওটার নাম দিলুম গোলাপসুন্দরী...পারফেক্ট হয়েছে...তাহলে পাছার একটাই নাম দিই...নরম নরম কোনো নাম...পাসওয়র্ড...ঠিক...এর নাম দেয়া যাক পাসওয়র্ড...ধ্যাৎ...পুরো রোমান্টিক আবহাওয়া ফর্দাফাঁই করে দিচ্ছিস......গ্যাস পাস হয় বলে পাসইয়র্ড হতে যাবে কেন...ছিঃ...তাহলে এর নাম হোক গরমের ছুটি...গরমে বেশ ভাল্লাগে পাউডার মাখিয়ে পাছায় হাত বোলাতে...ওক্কে...তারপর...ঘুমোবো কখন...বাঁ উরুর নাম দিই ককেশিয়া...ডান উরুর নাম দিই লিথুয়ানিয়া...রাশিয়ানদের উরু দারুণ হয় বিশেষ করে শীতকালে যখন ওরা চান করে না...ভোদকা খেয়ে ভরভরিয়ে প্রতিটি রোমকুপ দিয়ে গন্ধ ছাড়ে...শুয়েছিস নাকি কখনও রাশিয়ান মেয়ের সঙ্গে...না কল্পনার যুবতীদের ইচ্ছেমতন হ্যাণ্ডল করা যায়...ছাড় ছাড়...এগো...মানে নামতে থাক...তাড়াতাড়ি কর নইলে গাধার দুলাত্তি দেবো...তা্হলে পায়ের নাম রাখছি জিরাফ...বামপন্হী জিরাফ আর দক্ষিণপন্হী জিরাফ...এবার ওপরে আয়,,,মুখে...ঠোঁট...ঠোঁটের নাম দিই আফ্রিকান সাফারি...আচ্ছা...ঠোঁটের নাম আফীকান সাফারি...ব্লোজবে খণ্ড খণ্ড মাংস ছিঁড়ে খাবো...খাস...থুতনিতে সেকেন্ড চিন...পিৎজা কোক খাওয়া থামা...থুতনির নাম দিই গোলাপজাম...কেন কেন কেন...পরে বলব...এখন দুচোখের নামদিই...শতনাম হলো না তো...চোখ বোজ চোখ বোজ...তুই তো একশোসমগ্র আবার শতনামের কী দরকার...তাহলে আয়...আজ তুই ওপরে না নিচে ?


নেভো মোম নেভো

আপনি আমার প্রিয় নারী, যদিও শুধুই শুনেছি ঘুমন্ত কন্ঠের কালো
ফিল্মে দেখেছি, আগুন নগ্নিকা, বুক দুটো অতো ছোটো কেন
দুঃখ হয় নাকি? আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল বুক ছোটো বলে
হত্যা করতে গিয়ে কিছুটা ঝুঁকলেন, নয়তো বুক উঁচু করে বলতেন
যা করি তা কারি, প্রেত তোর তাতে কী, তুই কি ঘুমের ইন্দ্রজালে
শুধু বুক খুঁজে বেড়াস নাকি! সত্যিই তাই, আপনার ঘুমে ঢুকে
তাছাড়া কি খুঁজবো বলুন? ফেরার ট্যাক্সিভাড়া? গ্যাসের রসিদ?
যা ইচ্ছে করুন আপনি, জেনে নেবো, চলন্ত গাছেরা বলে দেবে,
না জানলেও আকাশ তো ভেঙে পড়ছে না; আপনি আমার প্রিয় নারী,
মন খারাপ করে দিলেন আজকে বৃষ্টির দিনে, ছাতাও আনিনি,
আপনার পাশ দিয়ে যেতে-যেতে ছাতার আড়াল থেকে আপনার
ছোট্টো দুটো বুক জরিপ করে নিতে পারি, ব্র্যাঙ্কোর প্রেত আমি,
ছোরা দুটো নিলেন দুহাতে তুলে, মনে হয়েছিল বুকের গরবিনি, হত্যা
নেহাতই অজুহাত, কেউ তো আর মনে রাখবে না, উনিও জানেন
তোমাকে দেখেই চুমু খেতে ইচ্ছে করেছিল, না না, হাঁ-মুখের ঠোঁটে নয়
পাছার দু-ঠোঁটে, আহা কি মসৃণ হতো রাজরানি হওয়া, যেন ইস্কাপন
নষ্ট করে নেচে উঠছে বিদ্যুতের খ্যাতি, যার অস্তিত্বে আমি বিশ্বাস করি না
খুলে বলি আপনাকে, আমি কীরকমভাবে নারীকে খুঁজি তা বলছি শুনুন,
যেমন ঘোড়দৌড়ের জুয়াড়িরা ঘোড়ার রেসবই খুঁটে খুঁটে পড়ে
আমার ভেতর সেরকমই পোষা আছে কয়েকটা অসুখ
বুঝলেন, যখন প্রথম পড়ি, প্রেমে পড়ে গিসলুম নগ্ন আপনার!
লেডি ম্যাকবেথ! আহা কি শঙ্খিনী নারী, কি ডাগর রক্তময়ী চোখ
ঘুমন্ত হেঁটে যাচ্ছো মৃত্যুর মসলিনে সম্পূর্ণ পোশাকহীন, কোনো খেয়াল নেই,
চেয়েছি জড়িয়ে ধরতে, বলতে চেয়েছি, লেডি, লেডি, নগ্ন পশ্চিমে
একটা চুমু শেষবার দাও, পুরস্কার নিয়ে ডাইনিরা দাঁড়িয়ে রয়েছে
রক্তাক্ত ছোরার সঙ্গে কথা বলো, বুকের নির্দয় ওঠা-নামা, লেডি
ম্যাকবেথ, ওই যিনি ছোটো বুকে মনটা খারাপ করে ফিরছেন বাড়ি
ওনাকে উৎসাহিত করো, বড়ো, আরবের সমস্ত আতর ধুতে পারবে না
হত্যার মিষ্টি গন্ধ, যেমনই লোক হোক সে তো তার নিজস্ব দৈত্যের সৃষ্টি,
তেমন নারীও, আত্মজীবনীতে লিখবেন কিন্তু প্রথম হস্তমৈথুনের স্বাহা
ক্লিটোরিসে অঙ্গুলিবাজনার মৃদু উগরে-তোলা ঝর্ণাঝংকার
আপনার নগ্নতার ব্যক্তিগত ছন্দ লেডি ম্যাকবেথের মতো হাঁটছেন
কলকাতার রাস্তা দিয়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ, আমাকে চিনতে পেরেছেন?
আমি ব্যাঙ্কোর প্রেত, প্রতিটি হত্যাদৃশ্যে উপস্হিত থেকে
বুকের বর্তুলতা মাপি, যবে থেকে স্কুলপাঠ্য বইয়ে দুরূহ লেগেছিল
লেডি ম্যাকবেথের লোভ সিংহাসনে রাজমহিষীর মতো উঁচু বুকে
বসে আছো, স্কুল-ফেরত সম্পূর্ণ উলঙ্গ তুমি হাঁটছো পাশাপাশি
ঘুমন্তকে নয়, ঘুমকে খুন করেছিলে তুমি, চিৎকার করছিলে
‘কে জানতো বুড়ো লোকটার গায়ে এতো রক্ত এতো রক্ত ছিল!’
এসবই আপনার নারীত্বের রক্ত, ছোট্টো দুটো বুকের দুঃখের
ভাববেন না বেশি, যৌবন ফুরোবার সঙ্গে এই দুঃখ চলে যাবে
তখন দেখবেন ক্লিটোরিস সাড়া দিচ্ছে না, রসশাস্ত্রহীন দেহ
আদিরস প্রথমে লোপাট, ঘুমন্ত হাঁটবার আহ্লাদ নামছে দুঃস্বপ্নে
আপনার ছোট্টো বুক ছোট্টোই থেকে যাবে যতোই উদার ওন
ভিখিরি দেখলেই বটুয়াতে কয়েনের ওজন কমান, লেডি ম্যাকবেথ
ছাড়বে না, উচ্চাশার কি দুর্দশা, হাতে রক্ত, নেভো মোম নেভো


কপিরাইট

অবন্তিকা, অতি-নারী, অধুনান্তিকা
পঞ্চান্ন বছর আগে চৈত্রের কোনারকে
লোডশেডিঙের রাতে হোটেলের ছাদে
ঠোঁটের ওপরে ঠোঁট রেখে বলেছিলি
চুমু প্রিন্ট করে দিচ্ছি সারা নোনা গায়ে
ম্যাজেন্টা-গোলাপি ভিজে লিপ্সটিকে
গুনেগুনে একশোটা, লিমিটেড এডিশান
কপিরাইট উল্লঙ্ঘন করলে চলবে না।

অবন্তিকা, সাংবাদিকা, অধুনান্তিকা
এ-চুক্তি উভয়েরই ক্ষেত্রে লাগু ছিল
কিন্তু দুজনেই এর-তার কাছে থেকে
শুনেছি কখন কবে কার সাথে শুয়ে
ভেঙেছি ভঙ্গুর চুক্তি কেননা মজাটা
ঠোঁটের ফাইনপ্রিন্টে লিখেছিলি তুই।



মলয় রায়চৌধুরী। হাংরি আন্দোলনের প্রধানতম এই কবির জন্ম ২৯ অক্টোবর, ১৯৩৯। বিশিষ্ট বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সাংবাদিক। মলয় রায়চৌধুরীর ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ৪টি উপন্যাস, ১০টি সমালোচনা গ্রন্থ এবং কয়েকটি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে ‘শয়তানের মুখ’, ‘জখম’, ‘ডুব জলে যেটুকু প্রশ্বাস’, ‘নামগন্ধ চিৎকার সমগ্র’, ‘কৌণপের লুচিমাংস’, ‘অ্যালেন গিন্সবার্গের ক্যাডিশ গ্রন্থের অনুবাদ’ প্রভৃতি অন্যতম। তিনি ২০০৩ সালে অনুবাদ সাহিত্যে, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।