TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

‘কয়েকজন গদ্যশিল্পী নিয়া কবীর রানার লগে আত্মজৈবনিক’ বয়ান: ০৩ | শিমুল মাহমুদ


বয়ান: ০২ -এর পর:

যাই হোক, কবীর রানার প্রথম বইয়ের গল্পগুলোর নামপরিচয় বলতে হচ্ছে, কেননা আমার জানা মতে অধিকাংশই তার গল্প পড়েননি, আপাতত তার গল্পের শিরোনামগুলো অন্তত জেনে রাখুন। জল আসে মানুষের দীঘিতে। জ্ঞান। মারিয়া, মারিয়া, মারিয়া-- তিনজন রূপকথা। আম কুড়ানো কাল। তালা। উর্বিতা মুমু। যত বড় রাজধানী। পাখি খেলা। আমাদের দরজাগুলো আমাদের তালাগুলো। সংগম-নিঃসংগম। টুপি। টয়লেট নগরী। পতাকা। টবের গল্প। সাঁতার। স্নান।

কবীর রানার গল্প ম্যাজিক এবং লজিকের মিলমিশে বিবৃতিপ্রধান নয় বরং ইশারানির্ভর ভাষায় ভর দিয়ে ভাষিক রিপিটেশনের আশ্রয়ে পরাবাস্তব আবহ তৈরির ক্ষমতা রাখে। এখানে রানা একেবারেই নিজের মতো। তার ভাষিক প্রতীতির ডিপস্ট্রাকচারের গঠনটাও ঠিক এমনই যেভাবে সে তার গল্পে নিজেকে প্রকাশ করেছে; ওই প্রকাশ-ধরনটা তার কষ্টকল্পিত প্রকাশ নয় বরং আবারও বলছি তার ভাষিক চেতনাটাই অনেকটা ওই রকম। কেমন? যেমন ধরুন, ধান কুড়িয়ে দুচার টাকা রোজগেরে বালিকাদের প্রাত্যহিকতা নিয়ে তো আর গল্প হতে পারে না; তো কবীর রানা তাদেরকে নিয়ে আরোপিত কোনো গল্প ফাঁদতেও রাজি নয়; বরং কবীর রানা সৃজন করে চলে মারিয়া, মারিয়া, মরিয়া-- তিনজন রূপকথা, ‘এখন দেখো, দেখে তারা, বিল থেকে বিল পালায়, জল থেকে জল পালায়, ধান থেকে ধান পালায়, গ্রাম থেকে গ্রাম এবং মানুষ থেকে মানুষ পালাতে থাকলে তারা দৌড় দিল বকগুলো ধরতে অথবা নিজেদের থেকে পালাতে। নিজেরা কি যে-- হো হো হাসি। পরস্পরকে স্পর্শ, মাছ খোঁজা শুরু হয়ে যায়। বকগুলো উড়তে থাকলে তারা কোথাও আশ্রয় খুঁজে পায় না। বেনী খুলে যায়-- বেনীর ভেতর থেকে পলায়ন বেড়ে যায়। দীর্ঘ পথ ঝরে পড়ে বেনী থেকে।’

এইভাবে কিশোরীর বেনী যখন গল্পের রিয়েলিটিতে এসে জীবন অভিজ্ঞানকে উন্মুক্ত করে দিতে থাকে তখন আমরা পাঠকেরা জীবনের ভিতর ডুবে থেকেই জীবন নিয়ে হাবুডুবু খাই; বুঝতে পারি না কী করবো এই জীবন দিয়ে। কোন দিকে হাঁটতে হবে। না কোনো দিকে নয়, বরং আপনি না চাইলেও জীবন নিজেই আপনাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবে উদ্দেশ্যহীন; বরং শুধুই টিকে থাকার খেসারত। এই টিকে থাকার খেসারতের নাম জীবন। তখন কবীর রানা আমাদের আম কুড়ানো কালের সঙ্গে পক্ষান্তরে পেশাভিত্তিক সমাজ-মনস্তত্ত্বের পরিবর্তন-প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, ‘প্রতিটি বাগান তবে লিজ দেওয়া আছে কর্তনের কাছে’, পক্ষান্তরে এই বয়ানের ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়, প্রতিটি জীবন তবে লিজ দেওয়া আছে কর্তনের কাছে। এই খানেই কবীর রানার চিন্তার সঙ্গে ভাষিক চেতনার সহযাত্রা, সহপ্রকাশ। ফলে প্রসঙ্গত কবীর রানার গল্প নয় বরং বয়ানকৌশলই তার লেখার তীর্থ।

কবীর রানা আর সবার মতো সভ্যতার ময়লা নিয়ে ভাবলেও সেই ভাবনা প্রাত্যহিক ময়লায় এসে আঘাত করে। এই আঘাতের অভিঘাত ‘যত বড় রাজধানী’গল্পে উচ্চকিত, তৈরি হতে থাকে রূপক-পরম্পরা, আবারও প্রাত্যহিকতা, যে প্রাত্যহিকতা থেকে মুক্তি নেই আমাদের। প্রাত্যহিকতা জেগে ওঠে কবীরের কল্পনাশক্তিতে। কবীর বরাবরই বলে এসেছে একজন লেখকের সবচেয়ে বড় পুঁজি তার কল্পনাশক্তি। আর আমি বলি, তুমি যতদূর পর্যন্ত কল্পনা করতে পারবে ততদূর পর্যন্ত ভাষাকে এগিয়ে রাখতে পারবে; জীবন দিতে পারবে ইঙ্গিতময়তাকে; সতর্ক অথচ প্রচল গদ্যকাঠামো পরিহার করে মনোজগতের জাদু পরিবেশন করতে পারবে। পক্ষান্তরে মনোজগত হয়ে উঠবে সমাজমনস্তত্ত্বের ক্যানভাস। এইভাবে অনুভব করা সম্ভব গোষ্ঠীমনস্তত্ত্ব, প্রবেশ করা সম্ভব ব্যক্তি মনস্তত্ত্বের অমীমাংসিত জটিলতায়। আর এই অমীমাংসিত জটিলতার ময়দানে এক সময় তুমি নিজেই রিল্যাক্স মুডে এগিয়ে যেতে বাধ্য হবে নতুন ভাষাকাঠামোর দিকে; যেখানে লুকিয়ে থাকে চিন্তাকাঠামো।

কবীরের সাথে আড্ডা প্রসঙ্গে উঠে এসেছিল ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রসঙ্গ। কথাসাহিত্যিক। দেশের অধিকাংশ বড় পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে প্রথম আলো থেকে শুরু করে অধিকাংশ গোষ্ঠীর এওয়ার্ড/সম্মাননা/বিবিধ পুরস্কারের নির্বাচক/বিচারক/মতামত প্রদায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছেন। পণ্ডিতজন। বলছিলাম, হ্যাঁ ব্যক্তি হিসেবেও কিছুটা জানার সুযোগ হয়েছিল তাকে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক-নিয়োগ বোর্ডে তাকে কয়েকবার থাকতে হয়েছিল। আমি কলা অনুষদের ডিন হিসেবে দু’বার তার সঙ্গে বোর্ডে উপস্থিত ছিলাম। বোঝা গেল তার ভিতরে কিছু উদ্দেশ্য লুক্কায়িত থাকে, যা তিনি যে কোনো ভাবেই প্রতিষ্ঠিত করতে পছন্দ করেন। তাকে আমার লেখকজীবনের পরিচয় দেইনি এই কারণে যে, আমি ধরে নিয়েছিলাম তিনি শিমুল মাহমুদের কোনো লেখা পড়েননি। নিজেকে নিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমি এইভাবে ভাবতে অভ্যস্থ যে আমার লেখা কেউ পড়েন না। যাই হোক, তিনি আমাকে সাইদুল ভাই হিসেবে প্রাসঙ্গিক কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আমিও মনজুরুল ভাই বলেই আলোচনা করছিলাম। আমি তার লেখালেখি বিষয়ে জানতে চাইলে বলেছিলেন, খুব কম লেখেন তিনি, একেবারেই সিলেকটেড নিরীক্ষানির্ভর। তার প্রতি আমার আকাঙ্ক্ষা বেড়ে গিয়েছিল। আমি তার বৈশ্বিক জ্ঞান ও পঠনপাঠনের সাথে পরিচিত থাকার চেষ্টা করেছি নিজের প্রয়োজনে। দুর্ভাগ্য মনজুরুল ভাইয়ের কথাসাহিত্য তেমন একটা পড়া হয়নি; যাকে বলে তার সব লেখা সংগ্রহ করে একান্তে পাঠ। তো এরপর রকমারি ডটকমের মাধ্যমে তার বেশকিছু বই সংগ্রহ করেছিলাম। তার মধ্যে একটি ছিল ‘কয়লাতলা ও অন্যান্য গল্প’। মারাত্মক রকম ব্যয়বহুল প্রোডাকশন। ১৬৮ পৃষ্ঠার বইয়ের দাম ৩৮০ টাকা। বইটি ঘিরে এমন এক ধরনের আভিজাত্যের আবহ জড়িয়ে আছে যে আমার ভিতর তাকে নিয়ে এক ধরনের শ্রদ্ধা মেশানো ভয় কাজ করতে থাকলো। পড়লাম। হতাশ হয়েছি। ছক কেটে পূর্বপরিকল্পনা নির্ভর কাহিনি নির্মাণের প্রচেষ্টা। আমি হোঁচট খেলাম তিনি আসলে নিরীক্ষাপ্রবণ লেখা বলতে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন। বরং কিছুদিন আগে শামসুল কিবরিয়ার ‘বৃত্তাবদ্ধ জীবনের প্রতিবিম্ব’ পড়েছিলাম। নিরীক্ষাপ্রবণ না হলেও, কিবরিয়ার গল্প বলার ঝোঁক আছে; আর আছে সেই ঝোঁককে কীভাবে পাঠযোগ্য করে তুলতে হবে তার জন্য সতর্ক প্রচেষ্টা।

শামসুল কিবরিয়াকে যখন প্রথম দেখি, যুবকটি তখন তার লাজুক স্বভাবের কারণে আমার কাছে পৃথক বৈশিষ্ট্যে মানসজৈবিকতায় স্থায়ী হয়ে উঠেছে। তাকে বুঝতে দেইনি, আমার চোখে সে তখন অর্থবোধক বোধ ও তাড়না। আমি অবাক চোখে কেবলি মানুষ দেখি। এইটা আমার আজন্মের নেশা। নেশাতাড়িত হয়ে যখন কিবরিয়ার গল্পগুলো পাঠ করছিলাম তখন বিস্ময়ে উপলব্ধি করলাম মানুষ দেখার এই চোখ আছে বলেই কিবরিয়া আমার আত্মজ। কিবরিয়া জীবনকে শুধু দেখতেই পারঙ্গম নয় বরং সেই দেখাকে সাবলীল দীর্ঘশ্বাসে ভাষার ভেতর চালান করে দেয়ার মুন্সিয়ানায় নিরিবিলি সাধক। আর তার এই সাধনা আপনাকে স্বস্তিতে থাকতে দেবে না; যখন আপনি পাঠ করতে থাকবেন, এভাবেই হারিয়ে যায়, বৃত্তাবদ্ধ, অন্তরালে, জলশূন্য শেকড়, উল্টোপথে যাত্রা, ধানলগ্ন জীবন, কেন্দ্রীভূত, বিকৃত প্রতিবিম্ব, আমার মাঝে আমি। এ সব কিছুই পক্ষান্তরে দমবদ্ধ জীবনের ক্ষরণ; চিরায়ত এক প্রেসার। যে প্রেসার ও প্রেষণা আপনাকে ঘুমোতে দেবে না মোটেও। কিবরিয়ার গল্প বলার শৈলীতে বহমানতা আছে, আছে তার নিজের শ্বাসগ্রহণের শব্দ; আছে চিন্তন ও আখ্যান; যা ছোটগল্পকে পৃথক চৈতন্যে ভাবাতে বাধ্য করে। পাঠককে এই বাধ্য করানোর সহজাত তাড়না শাসমুল কিবরিয়ার পূঁজি। কিবরিয়ার সঙ্গে আরো কিছু জীবন কাটানোর ইচ্ছে আছে।

প্রসঙ্গক্রমে মোহিত কামালের কথা উঠে এলে, আমার কাছে মোহিত ভাই ব্যক্তি মানুষ হিসেবে বেশ পছন্দের। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন বলে আমার এ বিষয়ে কোনো আক্ষেপ নেই; কেননা তার চেয়েও দুর্বল লেখক ইতিপূর্বে এই পুরস্কার পেয়েছেন। মোহিত ভাই আর মনজুরুল ভাই অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ করে ডেলিভারেশনের জায়গাটায় একই ঘরানার লেখক বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। তবে মন খারাপ হয় তখন, যখন গল্পপাঠ ওয়েভম্যাগের গল্পকার রুকসানা কাজল যার লেখা আমি প্রথম ‘ঐহিক’ ওয়েভম্যাগে পড়ে চমকে উঠেছিলাম, বয়ানের নাম ‘সোনারঘাট’। আরেব্বাস, কোনো ধারাক্রম নেই, এলোমেলো চিন্তাক্রমের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে এক ডুব-লড়াইয়ের আখ্যান, ডুব-সাঁতারের আখ্যান, ভাষার ম্যাজিক সহসা আমাকে বাস্তব থেকে অতিবাস্তবে নিয়ে চিন্তার রূপকল্পে ঠেলে দিচ্ছে, হাবুডুবু খাচ্ছি। নিজেকে আহাম্মক জ্ঞান হয়েছিল, সমকালে কত সিরিয়াস লেখক আছেন কয়জনের লেখা আমি পড়ছি, খোঁজ রাখছি? এই রুকসানা কাজল যখন আমাকে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের ওপর (একজন লেখক আরেকজন লেখককে কেন ‘স্যার’ বলেছিলেন তা আমার বোধগম্য হয়নি; হয়তো তিনি মনজুরুল ভাইয়ের সরাসরি ছাত্রী হবেন) আমাকে আলোচনা লেখার জন্য অনুরোধ করেন তখন আমি বিমর্ষ বোধ করি। কিছুদিন পর দেখলাম, কুলদা রায় যে কুলদা রায় ‘বৃষ্টি চিহ্নিত জল’ লিখেছেন, যার গল্পগুলা নিয়া আমার নিজের ভিতর বিস্তর বোঝাপড়া রয়েছে, যাকে নিয়া লেখার তাড়না ক্রমাগত আমাকে বিব্রত করে তোলে, যে কুলদা রায় সমকালে আমার কাছে নিরীক্ষায় পঠনে ও বোদ্ধাজন হিসেবে ভালোলাগার মানুষদের মধ্যে একজন; যার লেখার আমি সতর্ক ভক্ত; যে মানুষটি দুর্মুখো হিসেবে, ঠোঁটকাটা অপ্রিয় কথক হিসেবেই আমার বন্ধু বটে, যার শিল্প বিষয়ক বোধ ধারণ করার লেবেলটা আমার বিবেচনায় বেশ উপরে সেই কুলদা রায় যখন ইনবক্সে অনুরোধ করেন, ‘কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বেশ কয়েকটি গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। লিখেছেন বিশ্বসাহিত্যের কথাসাহিত্য নিয়ে নানা প্রবন্ধ। কিন্তু বাংলাদেশে সেভাবে আলোচিত নন বলেই মনে হয়। আপনি কি সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্প উপন্যাস পড়েছেন? পড়ে থাকলে আপনার পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখে জানানোর অনুরোধ করছি। সর্বনিম্ন ৫০০ শব্দের মধ্যে প্লিজ।’ তখন আমি বিমর্ষ বোধ করি। আমি বন্ধু কুলদা রায়ের অনুরোধ মোতাবেক, বলে রাখছি এক্ষেত্রে তার ওপর আস্থা রয়েছে, তিনি যাদেরকে পাঠের জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন তাদের পাঠ করে খুব একটা ঠকিনি। যাই হোক, তার কথা মতো শামীম আহমেদের ‘সাত আসমান’ নিয়ে কাজ করেছি, করে আনন্দ পেয়েছি। বুঝতে পেরেছি এই কাজটা অন্তত ক্রাইমের পর্যায়ে পড়ে না (আমি দুর্বল গ্রন্থগুলো এগিয়ে নেওয়াকে ক্রাইম বিবেচনা করি)। শামীম আহমেদকে আমার কাছে সত্যিকার অর্থেই শক্তিশালী লেখক বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখছি গল্পপাঠে কুলদাকেও মাঝে মধ্যেই দুর্বল লেখা উপস্থাপন করতে দেখেছি। তো কী বলবো? লেখালেখির প্রতিটি প্লাটফর্মই কি আসলে লিঁয়াজোনির্ভর, গিভ এন্ড টেকের জায়গা? সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্প-উপন্যাস নিয়ে আপাতত কিছু বলার যৌক্তিকতা দেখছি না, তবে বন্ধু কুলদা রায়ের গল্পের ভাষা বিষয়ে এক লাইন নির্মোহভাবেই বলা প্রাসঙ্গিক জ্ঞান করছি, বাংলা ভাষার চিরায়ত মায়ালাগা অনুভব যা সহজাত শ্বাসপ্রশ্বাসের ইশারায় ভাষিক স্তরের একাধিক মাত্রাকে উন্মোচন করার স্পর্ধা রাখে; ভাষার এই চিরায়ত স্পর্ধা কুলদা রায়ের জন্মগত ক্ষমতা; এই ক্ষমতার চোখ আমাদের দেখিয়ে দেয় কী দেখতে হবে, কীভাবে দেখতে হবে; কী ভাবতে হবে, কীভাবে ভাবতে হবে; কোন ভাবনাগুলো আমার আর কোন ভাবনাগুলোর ভেতর রয়েছে জাদু।

যখন আমাদের আড্ডা ক্রমশ খোলামেলা হয়ে উঠতে থাকলো তখন কবীরের কাছে জানতে চাইলাম, তুমি কুলদার গল্পপাঠে লেখা দেও না কেন? কবীর রানা পরিষ্কার জানিয়ে দিলো লেখা না চাইলে লেখা দিব কেন? একাধিকবার চাইতে হবে, আমি বিবেচনা করবো সেখানে লেখা দেওয়া উচিত হবে কিনা; লেখকের অহঙ্কার না থাকলে তো তিনি কাঙালে লেখক হয়ে উঠতে থাকবেন; জনপ্রিয়তার দুর্গন্ধে হারিয়ে যাবেন। বুঝতে পারলাম কবীরের লেখায় রিয়েলিটির প্রতীকী উদ্ভাসন যেভাবে কাজ করে সেভাবে তার অর্জিত অভিজ্ঞান ও জ্ঞাননির্ভর অহঙ্কার বাস্তবতার যথার্থ ব্যার্থতা চিহ্নিত করার যোগ্যতা রাখে। এভাবেই হয়তো শিক্ষিত হয়ে উঠেছে কবীর রানার দেখার চোখ; শিক্ষিত হয়ে উঠেছে হারানোর কদর্যতা। এই দেখার যোগ্যতা হারানোর কদর্যতা যখন সে পেয়ে যায় তখন কবীরের কোনো হাঁটা থাকে না, পথ থাকে না, বিশ্রাম থাকে না, গৃহ থাকে না, তখন কবীরের ওড়া নেই, আকাশ নেই, অতীত নেই, অর্জন নেই; তাই কবীর বিকৃত ভবিষ্যতের বাস্তবতায় লড়াইরত; এই লড়াই জাগিয়ে রাখে জ্ঞান আর জ্ঞানের বস্তি, বস্তিবাসী মানুষ। এইভাবে কবীরের গল্প স্বগত উচ্চারণে কবীরকে সঙ্গে নিয়েই হাঁটতে থাকে। এইগুলো কবীরের ‘জ্ঞান’গল্প থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞান।

এবং আরো আরো গল্পের অভিজ্ঞান ঘেটে পেয়ে যাই, কবীর গল্প বলে না, গল্পের ঘোর তৈরি করে। সেই ঘোর লাগা কুহুক বিবেককে জাগ্রত করে শেকড়শুদ্ধ টান দিয়ে কালহীন বাস্তবতার আখ্যান উন্মোচন করে। ক্রমশ কবিতা ও ব্যাখ্যাতীত মানব অনুভূতি গোষ্ঠী অভিজ্ঞতায় পূঞ্জিভূত হতে থাকলে দীর্ঘশ্বাস অথবা মুঠো মুঠো মেঘতুল্য আনন্দ মেডিটেশন, যেমন মেডিটেশনের আওতায় ‘জল আসে মানুষের দীঘিতে’গল্পে বার্কির জায়গায় সহসা কখন যেনো নিজের নাম বসিয়ে পক্ষান্তরে আমিই ইতিহাস ভ্রমণে ঝাপিয়ে পড়লে সহসা বুঝে যাই আমি নিজেই কবীর রানা হয়ে ক্রমশ লিখতে লিখতে নিজেকে উন্মোচন করছি প্রকৃতি আর ইতিহাসের সমান্তরালে। এইভাবে ক্রমশ কবীর রানা দখল করে ফেলে পাঠকের বোধের জগৎ, সজ্ঞার জগৎ, ঘোর লাগা অহমের জগৎ।


[ধারাবাহিক: আগামী শনিবার পাওয়া যাবে বয়ান: ০৪]


বয়ান: ০১ পড়তে এই লেখাটিকে স্পর্শ করুন


শিমুল মাহমুদ। কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক। 
জন্ম ৩ মে ১৯৬৭, সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পাঠ গ্রহণ শেষে ইউজিসি-র স্কলার হিসেবে পৌরাণিক বিষয়াদির ওপর গবেষণা করে অর্জন করেছেন ডক্টরেট ডিগ্রি। বর্তমানে তিনি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
নেশা: অধ্যাপনা। পছন্দ: পাঠগ্রহণ, ভ্রমণ ও একাকিত্ব। অপছন্দ: মঞ্চলোলুপ আঁতলামো।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: ‘মস্তিষ্কে দিনরাত্রি’ (কারুজ, ঢাকা: ১৯৯০), ‘সাদাঘোড়ার স্রোত’ (নিত্যপ্রকাশ, ঢাকা: ১৯৯৮), ‘প্রাকৃত ঈশ্বর’ (শ্রাবণ প্রকাশন, ঢাকা: ২০০০), ‘জীবাতবে ন মৃত্যবে’ (শ্রাবণ প্রকাশন, ঢাকা: ২০০১), ‘কন্যাকমলসংহিতা’ (ইত্যাদি, ঢাকা: ২০০৭), ‘অধিবিদ্যাকে না বলুন’ (ইত্যাদি, ঢাকা: ২০০৯), ‘আবহাওয়াবিদগণ জানেন’ (চিহ্ন, রাজশাহী: ২০১২), ‘কবিতাসংগ্রহ : সপ্তহস্ত সমুদ্রসংলাপ’ (রোদেলা, ঢাকা: ২০১৪), ‘স্তন্যপায়ী ক্ষেত্রউত্তম’ (অচেনা যাত্রী, উত্তর ২৪ পরগণা: ২০১৫), ‘বস্তুজৈবনিক’ (নাগরী, সিলেট: ২০১৬), ‘সমূহ দৃশ্যের জাদু’ (চৈতন্য, সিলেট: ২০১৮),   ‘ভাষাদের শষ্যদানা’ (বেহুলা বাংলা, ২০১৯)। 
গল্পগ্রন্থ: ‘ইলিশখাড়ি ও অন্যান্য গল্প’ (নিত্যপ্রকাশ, ঢাকা: ১৯৯৯), ‘মিথ মমি অথবা অনিবার্য মানব’ (পুন্ড্র প্রকাশন, বগুড়া: ২০০৩), ‘হয়তো আমরা সকলেই অপরাধী’ (গতিধারা, ঢাকা: ২০০৮), ‘ইস্টেশনের গহনজনা’ (আশালয়, ঢাকা: ২০১৫), ‘নির্বাচিত গল্প’ (নাগরী, সিলেট: ২০১৬), ‘অগ্নিপুরাণ ও অন্যান্য গল্প’ (চৈতন্য, সিলেট: ২০১৬)।
উপন্যাস: ‘শীলবাড়ির চিরায়ত কাহিনী’ (ইত্যাদি, ঢাকা: ২০০৭), ‘শীলবাড়ির চিরায়ত কাহিনী’ (ধানসিড়ি, কলকাতা: ২০১৪), ‘শীলবাড়ির চিরায়ত কাহিনি’ (চৈতন্য সংস্করণ, ২০১৬), ‘সুইসাইড নোট’ (নাগরী, ২০১৯)।
প্রবন্ধ: ‘কবিতাশিল্পের জটিলতা’ (গতিধারা, ঢাকা: ২০০৭), ‘নজরুল সাহিত্যে পুরাণ প্রসঙ্গ’ (বাংলা একাডেমী, ঢাকা: ২০০৯), ‘জীবনানন্দ দাশ : মিথ ও সমকাল’ (গতিধারা, ঢাকা: ২০১০), ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ধারার কবিতা’ (গতিধারা, ঢাকা: ২০১২), ‘মিথ-পুরাণের পরিচয়’ (রোদেলা, ঢাকা: ২০১৬)। তিন দশক যাবৎ সম্পাদনা করছেন সাহিত্যের ছোট-কাগজ: ‘কারুজ’। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ