TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

‘কয়েকজন গদ্যশিল্পী নিয়া কবীর রানার লগে আত্মজৈবনিক’ বয়ান: ০১ | শিমুল মাহমুদ



আড্ডা দিচ্ছিলাম বগুড়ায়। সঙ্গে ছিল পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি থেকে আসা কবিবন্ধু গৌতমগুহ রায়। এর আগে, দুপুরের খাওয়া যাকে বলে সেটা হয়ে ওঠেনি। দিনাজপুর কান্তজিউর মন্দির সফর শেষে রংপুরে আমার রুমে ভর দুপুরে লাঞ্চের পরিবর্তে অ্যাবসলিউড ভদকা পান শেষে মহাস্থানগড়ের প্রাচীনতার সঙ্গে বিস্তর কথাবার্তার পর সন্ধ্যার একটিমাত্র পুরোনো চাঁদকে পকেটে আটকে নিয়ে আমরা কবীর রানার বাসভবনে ঢুকে পড়েছিলাম। রাতের খাবার শেষে আমাদের বন্ধু গীতিকার মাইনুল ইসলামের গাড়িতে গৌতম ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দিলে কবীর রানা আমাকে ঝাপটে রেখেছিল ওর কাছে, ওর নিজের বানানো পাঁচতলা বিল্ডিঙে। এই পাঁচতলা ফ্লাট নিয়ে কবীর গল্প লিখেছে, ‘তোমার গ্রামের নাম কী’। নাড়িপোতা শেকড় কীভাবে কবীর রানাকে নির্মাণনির্ভর ফাঁপা জীবনের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজ বাসভূম থেকে দীর্ঘশ্বাস কুড়িয়ে আনে, সেই কুড়িয়ে আনা দীর্ঘশ্বাসের শেকড় ধরে টান দিয়েছিল কবীর রানা এই গল্পে।

কথায় কথায় বেশ কয়েকবার এই গল্পটির কথা উচ্চারণ করি আমি। গল্পের চরিত্র হয়ে আসে পাখি, গল্পের চরিত্র হয়ে আসে বিল্ডিয়ের জোড়বন্ধনে গজিয়ে ওঠা শিশু বটবৃক্ষ, গল্পের চরিত্র হয়ে আসে কবীরপুত্র সুকথক, গল্পের অনুষঙ্গ হয়ে হাজির হয় আমাদের এক্কেবারে এলামেলো করে দেয়, ভেঙে তছনছ করে দেয় ভূমিকম্প, আতঙ্ক, ট্রমা। তখন আমার মগজে পাঠপ্রক্রিয়া, ‘রাতে লোডশেডিং হলে আমাদের বাড়িতে প্রাচীন একটা রাত আসে মোমবাতির আলোয়। আমি, আমার স্ত্রী, আমার সন্তান সে আলোর কাছে ফর্ম পূরণ করতে বসি। সে মোমবাতির আলো বেয়ে বেয়ে ছাদে আসি যখন ভীষণ গরম গৃহের ভেতর। দেখি মোমের আলোয় বটগাছটা ছাদের উপরে আরো ফাটল তৈরি করেছে। তৈরি করেছে তার নিজস্ব ছায়া। সেখানে বড় হচ্ছে আমাদের তিনটা পোষা পাখি। আমরা আমাদের গ্রামের নামের সন্ধানে গিয়ে দেখি তার নাম হরিণগাছী।’

আজ কবীর রানাকে নিয়ে লিখতে বসে মনে হচ্ছে সারাটা জীবন ভালো লেখাগুলো নিয়ে কথা বলেছি, অথচ কবীর রানাকে নিয়ে তেমন কিছু বলা হয়নি। কেন বলা হয়নি? অনেস্টলি বলছি, ওকে নিয়ে বিস্তারিত কাজ করবো ভেবে আজও ওকে নিয়ে লেখা হয়ে ওঠেনি। এখন যখন ইসলাম রফিক ওকে নিয়ে লেখার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে তখন আমি কি দায়সারা কিছু লিখে দিচ্ছি? বিব্রত হচ্ছি, বিস্তারিত লেখা শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠছে না। তবে সততার সঙ্গে স্পর্ধা নিয়েই বলছি বন্ধুর জন্য একপেশে পিঠচাপড়ানো কিছু বলছি না। বরং যা বলছি তা তার জন্য কমই বলা হচ্ছে। সীমাবদ্ধতা তো কবীরের আছে, কবীর গল্প বলতে জানে না, আখ্যান লিখতে পারে না, কাহিনি ফাঁদতে পারে না, সংলাপের ধার দিয়েও হাঁটে না, নাকি সংলাপে তার অক্ষমতা?

তা হলে কবীর রানা পারেটা কী? ওর প্রতি আমার এতো আগ্রহ কেন? এটা কি ব্যক্তিগত সম্পর্কের জন্য? না মোটেও ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে তাকে নিয়ে কথা বলছি না। আমাকে সবাই দুর্মুখো বলেই জানে, ঠোঁটকাটা বলেই জানে। সাহিত্যের আয়োজন আর মঞ্চ এড়িয়ে চলি। যাদের লেখা ভালো লাগে না তারা তাদের বিষয়ে বেশি চাপাচাপি করলে বলে দেই তাদের লেখা ভালো লাগে নাই, কাজেই ওগুলো নিয়ে বলার কিছু নাই। আর যাদের লেখা ভালো লাগে তাদেরকে না চিনলেও যোগাযোগ না থাকলেও নিজের ভিতরে যদি তাড়না বোধ করি তাহলে দুচার কথা বলার বা লেখার চেষ্টা করি, কোনো রকম লিঁয়াজো মেইনটেন না করেই। এমন অনেককে নিয়েই লিখেছি যাদের কাছে সেই লেখা আজও পৌঁছেনি। দরকারও নাই, পাঠক পড়লেই যথেষ্ট, পাঠকের কাছে ভালো লেখাগুলো পৌঁছে দেবার তাড়না পাঠকদের থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। এটা সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, সৎ চিন্তার মধ্যে সৎ যাপনের মধ্যে পড়ে বলে আমি স্পর্ধা নিয়ে বলে থাকি।

শিক্ষকের কাজ শুধু শেখানো নয়, আত্মবোধকে জাগিয়ে তোলাই যেমন মহৎ শিক্ষকের লক্ষণ তেমনই কবীর রানা ব্যক্তিজীবনে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হলেও ভালো করেই জানে লেখকের কাজ শিক্ষকের মতো না। লেখকের কাজ শিক্ষকের মতো শেখানো নয়; বরং কিছুটা হতে পারে মহৎ শিক্ষকের মতো পাঠকের আত্মবোধকে জাগিয়ে তোলা। কিন্তু প্রশ্ন হলো কী এই আত্মবোধ? কেমন এই আত্মবোধ? এই জিজ্ঞাসার কোনো উত্তর হয় না। আত্মবোধ নির্দিষ্ট করে কোনো লেখক লিখতে বসেন বলে আমার মনে হয়নি কখনো। বরং লেখকের লেখাই আপনাকে বলে দিবে আত্মবোধ জিনিসটা ঠিক কেমন। যাকে কিনা ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না। যা লুকিয়ে থাকে লেখকের সত্ত্বায়। যার সত্ত্বায় আত্মবোধ নেই তিনি যত চমৎকারই লেখেন না কেনো তাকে ঠিক লেখক বলতে আমার করুণা হয়। হ্যাঁ আত্মবোধ সম্পন্ন মহৎ শিল্প ব্যাখ্যাযোগ্য নয়। তার ব্যাখ্যা কখনো শেষ হবার নয়। ফলে অমীমাংসিত। কেমন এই অমীমাংসিত আত্মবোধ? আত্মবোধের সন্ধানে কবীর রানার কাছে ফিরতে হচ্ছে, ‘ইঁদুর থাকে দূরে, দূরে থাকে মাঠ, মাঠে থাকে ফসল; এখন দেখি আমাদের সকল ফসলের নিকটে ইঁদুর। নিকটে থাকে গৃহ, গৃহে থাকি আমরা। আমরা আমাদের গৃহের প্রতিরক্ষায় যাই রৌদ্রের অন্বেষণে, বৃষ্টির অন্বেষণে। বৃষ্টির ভেতর মাঠ চাষ করে, রৌদ্রের ভেতর মাঠ চাষ করে ফসল আনি। দূরকে নিকটে আনি। ফসল গৃহে এলে মাঠকে বলি আরো দীর্ঘ দীর্ঘকাল ঋণী হতে দাও। আর নিকটের ভেতর জীবিকা এলে আমরা ঘুমাতে পারি আমাদের গৃহে। ঘুম কি যে তা ভাঙে, জোড়া লাগে, নতুন হয়। প্রতিরাতে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। গৃহের কোথাও ইঁদুর। খুট খুট খুট। এই খুট খুটে আমাদের ঘুম কেটে যায়, জীবিকা কেটে যায়। সাহস কেটে যায়। যতোগুলো জ্ঞান লিখিত, যতোগুলো জ্ঞান অলিখিত সকলি কেটে যায়। ঘুমের যদি মাথা থাকে, সাহসের যদি মাথা থাকে, জ্ঞানের যদি মাথা থাকে তবে এখন সে সব মাথাহীন। ইঁদুরেরা কি ভীষণ কর্তনকারী যে তারা সকল মাথা ছিন্ন করে শরীরের।’

এইভাবে ভীষণ কর্তনকারীর কর্তনক্রিয়ায় আমরা যখন ক্রমশ ছিন্ন হতে থাকি, তখন আত্মবোধের অভিঘাতে কবীর রানাকে চিহ্নিত করতে গিয়ে, নির্দিষ্ট করতে গিয়ে, তার টেক্সটের চোখে আঙুল ঢুকিয়ে আপনাকে উসকে দেবার অভিপ্রায়ে আমাকে এই লেখাটির শিরোনাম দিতে হয়েছিল, ‘দরজা খুলতেই দেখতে পেলাম কবীর রানা হেঁটে যাচ্ছে ইঁদুর হাতে’। কবীর রানা জগতের তাবৎ মাথা ছিন্ন করে ইঁদুর হাতে হেঁটে চলেছেন তার গল্পের অলিতে গলিতে, চিন্তনের কাদাপথে, থকথকে যেন বা বৃষ্টিস্নাত হওয়া সত্ত্বেও কোথাও একটা অস্বস্তি দানা বেঁধে ওঠে। এই অস্বস্তি আপনাকে ঘুমোতে দেবে না; যেভাবে সভ্যতার ইঁদুর আপনাকে স্বস্তি দেয় না, আপনার বিবেককে ক্রমাগত চপিং করতে থাকে।

গল্পকার কবীর রানার বই কিনতে গিয়ে কোথাও খুঁজে না পেয়ে তাকে অনুরোধ করেছিলাম পাঠিয়ে দেবার জন্য। চতুর্থ বই ‘বিড়াল পোষা প্রতিবেশিনীরা’, প্রকাশ পেয়েছে গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ তে। বইটি হাতে পেয়ে ২৮ অক্টোবরে পোস্ট দিয়েছিলাম, ‘বন্ধু বই পেয়েছি। আবারও তোমাকে নতুন করে পাঠ করতে শুরু করেছি। সমকালে বাংলা ভাষায় তোমার পাশাপাশি গল্পকার গুটিকয়েক থাকলেও তুমি একেবারেই পৃথক। তুমি হয়তো নিজেও জানো না তুমি কতটা উচ্চতায় পৌঁছে দিতে শুরু করেছো বাংলা ভাষার গল্পকে। আর সবচেয়ে বড় কথা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তুমি আপাদমস্তক একজন শক্তিশালী কবি। শুভকামনা।’
এর আগে ‘জল আসে মানুষের দীঘিতে’ পড়ে ভয়ানক তাড়না থেকে ওর গল্পের কিছু অংশ পোস্ট দিয়েছিলাম। এরও আগে গত বছরে কবীর রানাকে পড়ে পোস্ট দিয়েছিলাম, ‘পিঠ চাপড়ানো বাদ দিয়া কবীর রানা-র গল্পগুলা পইড়া দেখেন, গল্পগুলার ভিত্রে মানবস্বভাবের জন্মসূত্র আছে।’ এরপর আরেকটি পোস্টে বলেছিলাম, বলার কারণ তাকে নিয়ে লেখা শুরু করবো, তার আগে সিরিয়াস পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা, ‘বন্ধুকে নয়, লেখাকে মূল্যায়ন করতে চাই। অকপটে সত্য বলতে চাই। লেখালেখির জগতে অধিকাংশই বুঝে/না-বুঝে পিঠচাপড়ে মিথ্যে বলে; কেউ কাউকে জায়গা দিতে চায় না। এইসব লেখক-রাজনীতি বিষয়ক বাকোয়াজি নিয়ে মাথা ঘামানোর স্বভাব আমার নাই। তাই আজীবন আড়ালে থাকতেই অভ্যস্থ। দায়িত্ব নিয়েই বলছি, লেখালেখির ক্ষেত্রে এমনকি ব্যক্তি মানুষ হিসেবেও স্বভাবজাত কারণেই আমি নিজেকে অনেস্ট হিসেবেই দেখে আসছি। সেই অনেস্টলির জায়গা থেকে যাদেরকে আমি আমার পাঠযোগ্যতায় সিরিয়াস বলে মনে করি তাদেরকে নিয়ে কথা বলে আসছি শুরু থেকেই। সেজন্য আমি বিস্তর পাঠের ভেতরই জীবন কাটাই। কাউকে না পড়ে মন্তব্য করি না। তোমাকে নিয়েও আমি কথা বলতে চাই। তুমি লিখতে থাকো। তোমাকে দিয়ে ছোটগল্পের জগৎটাই চেঞ্জ করে দেওয়া সম্ভব। তোমার ভাষাবোধের ডিপস্ট্রাকচার সেই ইশারাই দিচ্ছে। আর ভালো কথা, তুমি কী লিখতে পেরেছো সেটা তুমি ভালোভাবেই বোঝো। তুমি না বুঝে লিখছো না। সমকালে তোমাকে পাঠ করার যোগ্যতা অধিকাংশেরই নেই। যাদের আছে তারা জেলাসির কারণে কথা বলে না। লেখকদের এই জেলাসি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এটাই বাস্তবতা। এ অবস্থা অতিক্রম করতে চাইলে দরকার ধান্ধাবাজি। বাট, এই ধান্ধাবাজির যোগ্যতায় আমরা পিছিয়ে আছি।’ ‘আমাদের গ্রামে একটা পাখিচোর আছে’ (২০১৬) এবং ‘মানচিত্রকর’ (২০১৪) বই দুটো পড়ার পর এই কথাগুলো আমার টাইমলাইনে ভাসিয়ে তুলেছিলাম আমি।

গল্পকার শফিক আশরাফ আমাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছিল, আপনার সুইসাইড নোটের প্রকাশকৌশল নিয়ে এক কথায় কোন যুতসই মন্তব্য লিখতে পারছি না, আপনাকে যদি বলতে বলা হয় আপনি কী বলবেন? আমি বলেছিলাম, আমি আমার গল্প-উপন্যাসে আখ্যান নির্মাণ করি না, নির্মাণ করি চিন্তা। আর আশ্চর্য যে চিন্তাগুলো, যা কিনা আমার আশৈশব আযৌবনের প্রভাবক; সেই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন, কবীর রানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জসীম উদ্দীন হলে আর আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে প্রতিনিয়ত প্রাত্যহিকতা; প্রতিনিয়ত জীবনকে নতুন করে আবিষ্কার; কবীর রানা আবিষ্কার করেছিল আমাকে, আমি আবিষ্কার করেছিলাম কবীর রানাকে। কবীর আবিষ্কার করেছিল গল্পের দর্শন, দর্শনের জীবন। আমি আবিষ্কার করেছিলাম কবিতা, কবিতা মানে বুঝতে না পারা ছুঁতে না পারা জান্তব জীবনের ইশারা।
এই ইশারা, আখ্যানে সন্তুষ্ট নয়। এই ইশারা, প্রাত্যহিক ধারাবাহিকতায় তুষ্ট নয়। এই ইশারা চিন্তায় প্রসারিত, চিন্তায় প্ররোচিত, সম্ভাবনায় পোয়াতি। বচনে প্রকাশে এই ভর পোয়াতি জীবনকে খালাস করতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়। প্রতিনিয়ত খুঁজতে হয় নতুন পথ, অলি গলি, নতুন ভাষা। তারপরও মনুষ্য ভাষায় বলা যায় না, বরং না-বলা অনুভব, দম আটকে যাওয়া, হাসফাস চিন্তাস্রোতকে কীভাবে যে শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে চালান করে দেওয়া যায়, কীভাবে যে বেঁচে থাকার সমান্তরালে প্রকাশকে অপরের মগজে চালান করে দেওয়া যায়; সেই প্রকাশতাড়নার কারুরেখা খুঁজতে খুঁজতে কবীর রানা গোপনে অগোচরে লিখে রাখতে থাকে সমষ্টিকে জীবনকে পৃথিবীকে, তোমাকে আপনাকে তাকে তাহাকে। আমি অবাক হয়ে দেখি, রাতের পর রাত একত্রে, জসীম উদ্দীন হলে এক বিছানায় দুই বন্ধু শুয়ে, কবীর রানা চকির নিচে রাখা টিনের ট্রাংক থেকে বের করে আনে গুটি গুটি হাতে লেখা কাগজ। পাঠ হয় সেই অলৌকিক কাগজ, তাবিজ-কবজ। যে কাগজে যে তাবিজ কবজে আমি খুঁজে পাই উড়তে থাকা, থামতে থাকা, শ্বাস নিতে থাকা, ক্রমশ চিনতে থাকা, ক্রমশ চিন্তায় এলোমেলো হতে থাকা, ক্রমশ অচেনা হতে থাকা, ক্রমশ অচেনা গন্ধে ভাসতে থাকা, ক্রমশ পরিচিত গন্ধে মোহমুগ্ধ হতে থাকা জীবনের শতস্তর।

পাঠ শেষে আমি নিজেকে উগলে দিতে আবারো হাসফাস। ওর মতো করে বেধে যাওয়া কণ্ঠস্বরে আমি কথা বলতে পারি না। ওর বেধে যাওয়া কণ্ঠস্বরের পেছনে লুকিয়ে থাকে ভরাট চেতনার থোকা থোকা আঙুর, টক তেঁতো ও উপাদেয়। আমার আলমডাঙ্গা মেশানো কৈশোর, আমার শ্বাসপ্রশ্বাস থেকে কোনো এক ঘুটে কুড়োনি কিশোরীর অভিজ্ঞান শ্রবণে কবীর রানা নির্মোহ শ্বাসে আমাকে বলতে থাকে, ওইগুলো তোমার কৈশোরের লিবিডো। আমি হোঁচট খাই, কষ্ট পাই। অথচ আজ এত বছর পর বুঝতে পারি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে কী নির্মোহভাবে কবীর রানা জীবনকে দেখতে শিখেছিল। আর আমি কী অসম্ভব রকমের রোমান্টিকতায় আক্রান্ত। জীবনভর আমার লেখায় অবচেতনে লুকিয়ে উঁকি দিয়েছে আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া অথবা কবীরের সঙ্গে সহসা ঘোরলাগা বিশ্ববিদ্যালয়জীবন।


[ধারাবাহিক: আগামী শনিবার পাওয়া যাবে বয়ান: ০২]


শিমুল মাহমুদ। কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক। 
জন্ম ৩ মে ১৯৬৭, সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পাঠ গ্রহণ শেষে ইউজিসি-র স্কলার হিসেবে পৌরাণিক বিষয়াদির ওপর গবেষণা করে অর্জন করেছেন ডক্টরেট ডিগ্রি। বর্তমানে তিনি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
নেশা: অধ্যাপনা। পছন্দ: পাঠগ্রহণ, ভ্রমণ ও একাকিত্ব। অপছন্দ: মঞ্চলোলুপ আঁতলামো।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: ‘মস্তিষ্কে দিনরাত্রি’ (কারুজ, ঢাকা: ১৯৯০), ‘সাদাঘোড়ার স্রোত’ (নিত্যপ্রকাশ, ঢাকা: ১৯৯৮), ‘প্রাকৃত ঈশ্বর’ (শ্রাবণ প্রকাশন, ঢাকা: ২০০০), ‘জীবাতবে ন মৃত্যবে’ (শ্রাবণ প্রকাশন, ঢাকা: ২০০১), ‘কন্যাকমলসংহিতা’ (ইত্যাদি, ঢাকা: ২০০৭), ‘অধিবিদ্যাকে না বলুন’ (ইত্যাদি, ঢাকা: ২০০৯), ‘আবহাওয়াবিদগণ জানেন’ (চিহ্ন, রাজশাহী: ২০১২), ‘কবিতাসংগ্রহ : সপ্তহস্ত সমুদ্রসংলাপ’ (রোদেলা, ঢাকা: ২০১৪), ‘স্তন্যপায়ী ক্ষেত্রউত্তম’ (অচেনা যাত্রী, উত্তর ২৪ পরগণা: ২০১৫), ‘বস্তুজৈবনিক’ (নাগরী, সিলেট: ২০১৬), ‘সমূহ দৃশ্যের জাদু’ (চৈতন্য, সিলেট: ২০১৮),   ‘ভাষাদের শষ্যদানা’ (বেহুলা বাংলা, ২০১৯)। 
গল্পগ্রন্থ: ‘ইলিশখাড়ি ও অন্যান্য গল্প’ (নিত্যপ্রকাশ, ঢাকা: ১৯৯৯), ‘মিথ মমি অথবা অনিবার্য মানব’ (পুন্ড্র প্রকাশন, বগুড়া: ২০০৩), ‘হয়তো আমরা সকলেই অপরাধী’ (গতিধারা, ঢাকা: ২০০৮), ‘ইস্টেশনের গহনজনা’ (আশালয়, ঢাকা: ২০১৫), ‘নির্বাচিত গল্প’ (নাগরী, সিলেট: ২০১৬), ‘অগ্নিপুরাণ ও অন্যান্য গল্প’ (চৈতন্য, সিলেট: ২০১৬)।
উপন্যাস: ‘শীলবাড়ির চিরায়ত কাহিনী’ (ইত্যাদি, ঢাকা: ২০০৭), ‘শীলবাড়ির চিরায়ত কাহিনী’ (ধানসিড়ি, কলকাতা: ২০১৪), ‘শীলবাড়ির চিরায়ত কাহিনি’ (চৈতন্য সংস্করণ, ২০১৬), ‘সুইসাইড নোট’ (নাগরী, ২০১৯)।
প্রবন্ধ: ‘কবিতাশিল্পের জটিলতা’ (গতিধারা, ঢাকা: ২০০৭), ‘নজরুল সাহিত্যে পুরাণ প্রসঙ্গ’ (বাংলা একাডেমী, ঢাকা: ২০০৯), ‘জীবনানন্দ দাশ : মিথ ও সমকাল’ (গতিধারা, ঢাকা: ২০১০), ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ধারার কবিতা’ (গতিধারা, ঢাকা: ২০১২), ‘মিথ-পুরাণের পরিচয়’ (রোদেলা, ঢাকা: ২০১৬)। তিন দশক যাবৎ সম্পাদনা করছেন সাহিত্যের ছোট-কাগজ: ‘কারুজ’। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. বা! অনবদ্য, সরল, সাবলীল ভাষা৷ পাঠশেষে এক অনাবিল তৃপ্তি অনুভব করলাম৷

    উত্তরমুছুন

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।