TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

কবির হোসেনের একগুচ্ছ কবিতা


হাহাকার

কালো শ্লেটে ভাত সাদা খড়ি মাটি দিয়ে মা শেখালেন— অ। অ তে অন্ন। অন্ন বোঝার বয়স আমার ছিল না। মা বললেন— ভাত। ফুঁটে থাকা যেনো বকুল ফুল। এর গন্ধ হু হু গ্রাসী। চুম্বকের বৈশিষ্ট্য নিয়ে গভীর গাম্ভীর্য; শত শত কঙ্কালসার লোহাগুড়ো হজ্জ যাত্রীদের ক্ষীপ্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই সাদা চুম্বকে। মানুষখেকোর বিলুপ্তির গল্প শুনেছ, অথচ দেখছ এই যে মানুষ, জেনো— ভাত বিলুপ্তির ঠিক তেরোতম দিনের এক দুপুরে বিলুপ্ত হবে।

এরপর মা শেখালেন— ‘অ এর সাথে একটা আকার দিলে হয়— আ। আ তে আমি।‘ আমি স্বরে অ লিখতেই মনে পড়লো এক থালা ভাত। উঠানে রাখা। বাচ্চাসমেত একটা মুরগি মুখ লাগালো বলে। একদল কালো হাঁস প্যাঁক প্যাঁক করে এসে সাবাড় করতে লাগলো সব। মুরগি ডানার ভেতর বাচ্চা গুটিয়ে বসে থাকে দূরত্ব রেখে। এই দৃশ্য মনে করে আমি হা হা করে হেসে উঠি। মা জোর দিয়ে বলেন— ‘অ লিখেছ, এর সাথে কী হয়?’ আমার ভেতরে তখনো অনেক হাসি। হাসতে হাসতে বলি— হাহাকার।


অন্ধ—কার?

পথে পা রেখেই চিৎকার করে উঠি— কিছুই দেখতে পাচ্ছি না কেনো? অদৃশ্য এক শব্দ— যে কিনা আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, বলল— আপনি তো অন্ধ! ঘাড় মটকে দেওয়ার মতন কথা! যেখানে আমাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি— অন্ধ হই কী করে?  তবে কি চোখ উল্টে প্রত্যেক অন্ধই দেখে যাচ্ছে নিজেকে? আর নিজেকে দেখাকেই তো কেবল সর্বদ্রষ্টা বলেই জানি!— হয়তো এইসব বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত আত্মজীবনী লিখে যাচ্ছে একেক অন্ধ তাঁর হাতের ছড়ি দিয়ে মাটিতে, পথে পথে।

আমার দেহ নিয়ে সমূদয় সন্দেহের কথা সাইকিয়াট্রিস্টকে জানালে তিনি দীর্ঘশ্বাসে বলেন— জনাব, আপনি অন্ধ নন, পৃথিবীটাই অন্ধকার!


ব্লাইন্ড

যে লোকটা জানে সবুজ মরে গেলে হলুদ হয়ে যায়, আপাদমস্তক সবুজে মোড়ানো সে একদিন হলুদ ট্যাক্সি ক্যাবের ভেতরে আরামে বসে আমাকে ভুলে যেতে তাঁর ভেতরে আমাকে দুমড়ে-মুচড়ে মেরে ফেলে। আমি তখন অমাবস্যার গাঢ় অন্ধকারে একটা নীল চাদর জড়িয়ে একাকী হাঁটছিলাম টেকো জনাকীর্ণ পথে। আমার সাথে সাক্ষাৎ ঘটা লোক মাত্রই জানে আমি আপাদমস্তক একটা কালো চাদর, যেটাকে সূর্য রাত থেকে আলাদা করতে আমাদের তাড়া করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাড়া খাওয়া আমি যার সাথেই দাঁড়িয়ে কথা বলছি, হাসছি, কাঁদছি— পাশ দিয়ে যাওয়া মানুষের দল তাকে পাগল বলে ডাকছে। আমি সমস্ত ভলিউম ছেড়ে মানুষদলকে আমার উপস্থিতি জানাতে গেলে দেখি স্বর নেভানো। তখন বুঝি, আমিই তবে সেই লোক, পাগলেরা একাকী দাঁড়িয়ে যার সাথে কথা বলে!


চেয়ারম্যান

যে চেয়ার তোমাকে উপরে ঠেলে রাখছে
তোমার পতন রুখে
তোমার ওজন পরিমাপ করে—
পেশি ফুলিয়ে রেখেছে পায়া বা চতুষ্পদ
সেই চেয়ারের উপরে বসে—
প্রভূত ক্ষমতার আঙুলে রুই কাতলার ঢেঊ তোলার আগে
আরেকবার ভেবে দেখো হে চেয়ারম্যান
তোমার ভঙিতে চেয়ার বসে নাই
তুমি বসে আছো চেয়ারের ভঙিতে.....


রাজবংশ

রাজবংশ এবং প্রাসাদের সাথে, উত্তরাধিকারসূত্রে আমি একটা বন্দুক পেয়েছি । এই বন্দুকে রয়েছে রাজবংশের শিকারের তাবৎ বীরত্ব। এটা অত্যন্ত পুলকের বিষয় এই যে, আমার পূর্বপুরুষগণ অবসরও কাটাতেন বীরত্ব প্রদর্শনে। এই বন্দুকটা এখন প্রাসাদের দেয়ালে ঝুলানো— যার পাশেই রয়েছে হরিণের শুকনো খোলস আর শিং। বনের হরিণ আর পাখির হরেক গল্প আছে এই বন্দুকে— যার ট্রিগার চেপে বাবা একেকটা গল্প বলতেন এবং বন আর হরিণ সংকটে তাঁর শিকারহীনতার আফসোস ঝাড়তেন। হরিণের শুকনো খোলস আর শিং দেখিয়ে বলি— তবে কি নিরীহ শিকারে ছিলো রাজাদের প্রভূত বীরত্ব? যদিও জানি— পৃথিবীর যাবতীয় শান্তি চুক্তি ছিলো হিংস্রে হিংস্রে। আপাত, দেয়ালে হিংস্র কোনো প্রাণির খোলস অথবা নিশানা রাজবংশীয় বীরত্বের পরিচায়ক।

শুনে মা মৃদু হাসেন আর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন পাশের দেয়ালে— যেখানে আমার পূর্বপুরুষদের পোর্ট্রেইট ক্রমানুসারে।


আমি যেহেতু প্রথম বিশ্বে

কলম্বাস, চন্ডীদাসকে সাথে নিয়ে আমরা আবার দেশ খোঁজার অভিযানে নামবো। ইউরোপ আমেরিকার তলদেশে যেসব দেশ আছে, নোঙরের ফলায় খাবার গেঁথে বড়শি পেতে ধরবো। বড়শির সুঁতোটা হবে চিলির প্রতিপাদ বাংলাদেশ-এর দূরত্ব সমান । এই সমস্ত হা-ভাতে দেশ মুখে অসংখ্য ক্ষুধা নিয়ে কাঁনকো ফুলিয়ে খুঁজে যাচ্ছে নোঙরের শব্দ। একে একে নোঙর তুলে এইসব দেশ ধরবো। পতন থেকে উত্থানের কোরাস গেয়ে উন্নতির চাকচিক্য দেখিয়ে তাদের চমকে দেবো।
.
কলম্বাস, এইসব দেশ ফ্রাই করে খেয়ে কাদের উপর কারা সত্য প্রমাণ করে চন্ডীদাসকে আমরা চমকে দেবো!


পাল্কিতে চড়ছেন পথিকবর

কবরে গিয়ে তো আর মরেন না। ঘরে মরে থাকা আপনার শব, চার দুগুণে আটপা ঘাড়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এতটুকু পথ বাকি রেখেই কেনো আপনাকে মরতে হয়? পৌনে-গন্তব্যে ঘুমিয়ে পড়া খরগোশকে ঘাড়ে তুলে দৌড়ে নিয়ে যাচ্ছে যেন একজোড়া কচ্ছপ। কচ্ছপের দৌড়কে আপনার হাঁটা বলে উপহাস, ভেঙে-ভেঙে পড়ছে আপনার পায়ে, অট্টহাসিতে। ঘর থেকে কবরের দূরত্বটুকুই আপনার না-মাড়ানো পথ, ঢুকে যাচ্ছে অন্যের হিসাবে।

বাকিতে কেটে যাচ্ছে আরেকজনের জীবন; যুদ্ধে হারিয়ে ফেলা যাঁর এক পা এখনও অন্য পা’কে হাঁটা শেখাচ্ছে।


ডারউইনের বাসায় ডেভিড কপারফিল্ড

যতটুকু পেছনে এলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে, ততটুকু পৌঁছে দেখি আমার দেয়ালটা নেই। দেয়ালের খোঁজে আমি পেছন দিকে যেভাবে হাঁটছি, যে কেউ দেখে তাঁর ভেতরে বিশ্বাস গেঁড়ে নিচ্ছেন ভূতের অস্তিত্ব। হারিয়ে যাওয়া সেই দেয়াল, পিঠের কাঙ্ক্ষিত বিছানা যেন, যার ওপর বসে পা দুলিয়ে একজন ঘুড্ডিবালক সুতা গুটিয়ে নিচ্ছে আমাকে টেনে। সেই সুতার টানে, পেছন দিকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে একদিন বেখেয়ালে এক বটির উপর ধপাস করে পড়ে যাই। দ্বিখন্ডিত আমি লক্ষ্য করি, আমার কোমর থেকে পা অব্দি খণ্ডিত অংশটুকু তড়পাচ্ছে রুইমাছের মত। কিঞ্চিৎ হেসে, দরজায় বসে ঝিমানো এক মা’কে ডেকে বলি—  মাগো,  এভাবে যেখানে সেখানে বটি দাঁড় করে রাখবেন না, বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। জেগে ওঠা অপরিচিত প্রাচীন মা, মুখে ভার এনে বলেন—  বড়শি কেনার টাকা নেই বাবা, তাই দীর্ঘদিন ঘরের কোণে পড়ে থাকা অব্যবহৃত বটিটা উঠানে পেতে রেখেছিলাম।


আমার বিখ্যাত জামাটি

জামাটা পরতে পরতে সেটা আমি হয়ে গেছি, মা। বাবাকে বলে দিও সেটা পরে বের না হতে। আমাকে পরে বাবা বের হলে বন্ধুরা বাবাকে আমার নাম ধরে ডেকে বসবে। আমার ভেতরে বাবা চলে গেলে, স্বামীর খোঁজে তোমার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা বিব্রতবোধ জাগবে। তারচে বরং আমাকে তুলে রাখো ঘরের পুরনো হ্যাঙ্গারে। সেখান থেকে নামিয়ে কোলে করে মুখে খাবার তুলে দিও। ময়লা হলে কুসুম জলে স্নান করিয়ে দিও। রোদে শুকিয়ে ফের হ্যাঙ্গারে রাখতে গিয়ে যদি টের পাও তার ভেতরে বিবিধ কলুষ— দাগ, অদৃশ্য ময়লার নানাবিধ দুর্গন্ধ;  এবং এইসব কলুষ, ময়লা ধুতে গিয়ে যদি তোমার হাত নুয়ে পড়ে,  তার ভেতরে মুখ লুকিয়ে বলো শুধু……

আমি তো জামা খুলে মাছের দম নিয়ে বসে আছি নদীর তীরে। তাৎক্ষণিক নেমে পড়ব আজীবন স্নানে।


কাঁটাতার

একটা বৃষ্টির ফোঁটা কাঁটাতারে কেটে দ্বি-খণ্ডিত হয়ে জল ও পানি হয়ে যায়।


কবির হোসেন। কবি।
জন্ম ১৭ই সেপ্টেম্বর নারায়নগঞ্জে।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: ‘ব্রেকিং নিউজ’ (২০১৮), ‘ভাড়ায় চালিত পা’ (২০১৯)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ