TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

শাহেদুজ্জামান লিংকনের গল্প ‘সদৃশ’


হবিউল্লাহ পর্ব 

গলাটা খুসখুস করে শ্বাসে টান পড়ার পূর্বাভাস দেয়। স্পঞ্জে পানি ঢুকলে যেমন করে— বুকে; ফুসফুসের মধ্যে তেমন একটা শব্দের অনুভূতি। হবিউল্লাহ সচল ডান হাতটা বালিশের তলায় ঢুকিয়ে ইনহেলারটা খোঁজে। জায়গামতো না পেয়ে ক্ষোভ ঝাড়ে তার স্ত্রীর উপর। হারামজাদী মাগি মোক মারি ফেলার জন্যে উঠিপড়ি নাগিছে। তোর কোন ইয়ার ভিতরত থুছিস। যাকে উদ্দেশ্য করে বলা সে ঘরে নেই বলে গালটা দিয়ে কোনো মজা পায় না হবিউল্লাহ। তা না হলে আরো কিছুক্ষণ চলতো। মাথাটা কাত করতেই দেখতে পায় বিছানার এককোণে পড়ে আছে ইনহেলারটা। সেটা হবিউল্লাহর হাতের নাগালের বাইরে। তাও ভালো যে ডানপাশেই আছে। নিশ্চল শরীরটাকে বিছানা-সংলগ্ন খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে কাত করতে দু’হাতের উপর ভর দিয়ে পাছাটা ছেঁচরিয়ে কোনোমতে সফল হয় সে। বুকের মধ্যে বাঁশির মতো শব্দ হতে থাকে। ডান হাতটা বাড়িয়ে ইনহেলারটা ছোঁয়ার চেষ্টা করে। অস্থিতিস্থাপক হাতের তালু বিছানায় ঠেকিয়ে আঙ্গুলগুলোকে রাবারের মতো বাড়াতে চেষ্টা করে। এদিকে বুকের টানটা বাড়তে থাকে। ইনহেলারটা একসময় ধরা দেয়। পাফ নিলে কষ্টটা কমে।

হবিউল্লাহর স্ত্রী আছিয়া সালাম সর্দার বাড়ি থেকে ফেরে হাতে একশো টাকার দশটা নোট নিয়ে। টাকাটা সর্দারের ছেলে রতনের হাতে পাঠিয়েছে তার মেয়ে জীবন্নেছা। ঘরে ফিরে দেখতে পায় হবিউল্লাহ খুঁটিতে হেলান দিয়ে ঘন ঘন শ্বাস ছাড়ছে। আবারও উঠচেলো? হবিউল্লাহ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আছিয়ার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকানোর চেষ্টা করে। এই মুহূর্তে গাল দেয়া যাচ্ছে না তাই চোখ দুটিই ভরসা। কিন্তু সে চোখে ক্রোধের পরিবর্তে ফুটে ওঠে অসহায়ত্ব। স্বামীকে খুশি করার উদ্দেশ্যে আছিয়া বলে, রতনের হাতোত একহাজার টাকা পাঠাইছে। চান রাইতোত আসপে। তোমার জন্যে বোলে সোন্দর একটা পাঞ্জাবী কিনছে। শেষোক্ত কথাটা বাড়িয়েই বলে আছিয়া। তবে একদিকে ভাবলে কথাটা মিথ্যে নয়। জীবন্নেছা বাড়ি ফিরলে বাবার জন্য পাঞ্জাবী আর মায়ের জন্য শাড়ি তো আনবেই। আছিয়া সবসময় চেষ্টা করে মেয়েকে হবিউল্লাহর ক্রর সন্দেহ থেকে রক্ষা করতে । হবিউল্লাহ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না কী করে জীবন্নেছা এতো ঘন ঘন টাকা পাঠায়। এতো টাকা সে কোথায় পায়? তাই সে এমন একটা সন্দেহ করে বসে যা বাপ হয়ে মেয়ের প্রতি কেউ করে না। কথাটা মনে মনে সে রাখে না। ঝেড়ে শুনিয়ে দেয় আছিয়াকে।
— ফির টাকা পাঠাইছে?
— হয়। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে আছিয়া।
— কোটে পায় উয়া এতো টাকা? বেইশ্যাগিরি করে? হবিউল্লাহর কণ্ঠস্বর উঁচু হতে থাকে।
— থুক্কু থুক্কু। তোমার আরো যতো কথা। গারমেন্টত চাকরি করে না জীবন্নেছা?
— থো তোর চাকরি। আর মানুষ বুঝি গারমেন্টত চাকরি করে না। হারেছ না চাকরি করে গারমেন্টত। তা উয়ার বউ-ছাওয়ার টিকা শ্যাও ক্যা?

হবিউল্লাহকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বাইরে চলে আসে আছিয়া। হবিউল্লাহ তখন আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকে। তার দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পারার কারণ যে তার মেয়ে জীবন্নেছা তা সে মেনে নিলেও মনে নিতে পারে না। মেয়ের উপার্জনের টাকায় কেনা চালের ভাত তার পেটপূর্তি করতে পারলেও মনপূর্তি করতে পারে না কোনোদিন। ভাতগুলো ধান হয়ে বুকের ভিতরে খচখচ করতে থাকে। একবার সে ভাবে— খাবে না মেয়ের উপার্জনের টাকা। কিন্তু নিমকহারাম উদর সে কথা মানতে চায় না। মেয়ের গীবত গাইতে গাইতেই সে একসময় বলে ওঠে, আনেক তো চাইরটা ভাত। প্যাটটা চো চো করেছোল।

হবিউল্লাহ প্রায়ই আছিয়াকে পরামর্শ দেয়— জীবন্নেছাক বাড়ি ডাকাও। বিয়া-শাদী দিয়া সোয়ামীর বাড়িত পাটে দে। আছিয়া বলে, বিয়াও দিলে খাইমেন কী? সোয়ামীর বাড়িত থাকলে কী আর হামাক টাকা-পাইসা দিবার পাইবে? মেয়ের উপর নির্ভর করা ছাড়া আর কোনো পথ খুঁজে পায় না আছিয়া। হবিউল্লাহ বলে, ভিক্ষা করি খামো। তেপথির মাথাত মোক শুতি থুয়া তুই ভিক্ষা চাবু। মোক দেকলে তো কতজনে ভিক্ষা দিবে। ভিক্ষার কথা শুনে জিহ্বা কাটে আছিয়া। থুক্কু থুক্কু কী কন এইল্লা। হামার চৌদ্দ গুষ্টিত কাও ভিক্ষা করে নাই। হবিউল্লাহ তখন বলে, ওর জমিদারের বেটি তোর বেটির কামাই কি সারাজীবন খাবু? বিয়াও দিবু না? আছিয়া তখন হাসে। সেটা তকন দেখা যাইবে। না হয় দুইজনে বিষ খায়া মরমো। মৃত্যুর কথা শুনতেই কতোগুলো দৃশ্যপট ঘুরপাক খায় হবিউল্লাহর চোখের সামনে।

একাত্তরে যুদ্ধের সময় যখন পাকি বাহিনী হামলা করলো তাদের গায়ে তখন হবিউল্লাহরা বাড়ির সকলে আঙ্গিনায় বসে ভাত খাচ্ছিলো। হঠাৎ শুরু হলো গোলাগুলি। ছাৎ করে একটা গুলি হবিউল্লাহর কানের পাশ দিয়ে চলে গিয়ে ফুটো করে দিলো টিনের বেড়া। মাথাটা কাত না করলেই মরছিলো সে। তারপর সবাই মাটিতে শুয়ে পড়লো।

আর একবার কী যেনো একটা বিষয় চিন্তা করতে করতে সে হাঁটছিলো বড় রাস্তা ধরে। সাথে ছিলো নজু মিয়া। পিছনেই আসছিলো একটা দানব ট্রাক। নজু মিয়া সেদিন টেনে না ধরলে ট্রাকের তলায় পিষ্ট হয়ে তার হাড়-হাড্ডি কিছুই খুঁজে পাওয়া যেতো না।

এরপর হবিউল্লাহর মনে পড়ে তিন বছর আগের ঘটনাটা। শামছুল মণ্ডলের (মণ্ডলরে) বাড়িতে তখন কারেন্ট নেয়ার কাজ চলছিলো। এ তল্লাটে শামছুল মণ্ডলের বাড়িতেই প্রথম বিদ্যুতের আগমন। শামছুল মণ্ডলের পক্ষে এটা ছিলো মামুলি ব্যাপার। তারপরেও তার বাড়িতে কারেন্ট আসলো অনেক দেরিতে। লোকজন বলতো এটাও একটা চাল। শামছুল মণ্ডল বাড়ি পাকা করতে সময় নিয়েছিলো এক বছর। একসাথে এতোগুলো টাকার উৎস কোথায় তা সম্বন্ধে যাতে কেউ সন্দেহ না করে তাই এমন উপায় অবলম্বন। শামছুল মণ্ডল চাকরি করতো জেলা প্রশাসকের অফিসে। অনেক ফাইল তার হাত দিয়ে পার হয়। আর ফাইল পার করার জন্য টেবিলের তল দিয়ে কিছু কচকচে নোট উড়ে এসে পড়ে তার পকেটে। কারো কাজ হয়, কারো হয় না। যাদের কাজ হয় না তারা টাকা ফেরত চাইলে ‘পরের বার হবে, আমি থাকতে চিন্তা কি’ বলার অজুহাতে সময় অতিবাহিত করে সে। একসময় ধার করে নেয়া কিংবা জমি-জমা বিক্রি করে দেয়া টাকাটা পানিতে চলে গেলে সর্বশান্ত লোকগুলো সরকারের লোক শামছুল মণ্ডলের সাথে পেরে ওঠে না। তখন কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে বিচার চাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।  কিন্তু এলাকার লোকজনের কাছে ‘শোনা কথা’ ছাড়া কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকায় তলে তলে বাড়তে থাকে শামছুল মণ্ডলের প্রতিপত্তি ও প্রভাব।

উপজেলা সদর থেকে আসা মিস্ত্রি বিদ্যুতের লাইন ঠিক করছিলো শামছুল মণ্ডলের বাড়িতে। গ্রামের উৎসুক ছেলে-মেয়েরা দল বাঁধিয়েছিলো সেখানে। যেখানে একটা মোটরসাইকেল দেখলে সবাই পিছনে পিছনে দৌড়াতে শুরু করে সেখানে কারেন্ট আরেক বিস্ময়! বাচ্চাদের দলে মিশে গিয়েছিলো হবিউল্লাহও। কারেন্টের মিস্ত্রি টেস্টার দিয়ে চেক করছিলো বিদ্যুত আসছে কিনা। একসময় মিস্ত্রি নাস্তা করতে গেলে অতি উৎসাহী হবিউল্লাহ একটা তার ছুঁয়ে দেখতেই শক খেলো। তৎক্ষণাৎ ঝটকিয়ে হাত সরিয়ে নিলো সে। ওরে বাপো চিন্নিত করি উঠিলরে। পাশে বসে পেপার পড়ছিলো শামছুল মণ্ডল। হবিউল্লাহর চিৎকার শুনে চশমার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগলো— হলো কী? পাশে থাকা অবোধ বালক-বালিকার দল আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে নালিশ জানালো— ওমা হাত দিছলো। পাশে পড়ে থাকা একটা বাঁশের খুঁটা হবিউল্লাহর দিকে ছুঁড়ে মেরেছিলো শামছুল মণ্ডল। মরির আসছিস এটে কনা? মইরবার আর জাগা পাইস না? সেই খুঁটা ঘুরে ঘুরে এসে সরাসরি লাগলো হবিউল্লাহর পিঠে। ডানহাতে চেপে ধরা বাহাত সরিয়ে নিয়ে দু’হাতেই এবার সে চেপে ধরলো কোমর। ককিয়ে উঠলো সে। বসে পড়লো মাটিতে। তারপর মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগলো। মরনু রে মুই মরনু। ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত শামছুল মণ্ডল। তারপর হবিউল্লাহকে নিয়ে যাওয়া হলো উপজেলা সদর হাসপাতালে। সেখানকার ডাক্তার সবকিছু শুনে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে বললো, রোগীকে রংপুর মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া লাগবে। শামছুল মণ্ডলের বেশ কিছু টাকা গচ্ছা গেলো সেখানে। কিন্তু হবিউল্লাহর কোনো উন্নতি হলো না। শরীরের নিম্নাংশ অকেজো হয়ে গেলো। আর হাঁপানী রোগটা তাকে উপহার দিয়ে গেছে পরলোকগত পিতা।

পিঠের সেই আঘাতের সাথে পায়ের কী সম্পর্ক তা আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারে নি হবিউল্লাহ। মাঝে মাঝে সে ডাক্তারকেই গাল দিয়ে বসে, চ্যাটের ডাক্তার এইল্লা। খালি গরিব মাইনষার টাকাগুলা মারি খায়। কিন্তু ডাক্তার নয়, তার বেশির ভাগ টাকা গেছে কোর্ট-কাচারিতে। সমুন্ধির কথা শুনে সে কেস করেছিলো শামছুল মণ্ডলের বিরুদ্ধে। কোর্টের টাকা যোগাতে ধানী জমিটুকু বেচে দিতে হয়েছিলো। তারপর সেই টাকা তুলে দিয়েছিলো সমুন্ধি ছাবের আলীর হাতে। ছাবের আলী তাকে আশ্বস্ত করেছিলো— দুলাভাই চিন্তা করবেন না। শামছুল মণ্ডলক এবার দেখি ছাড়মো। শেষ পর্যন্ত শামছুল মণ্ডলের কিছুই করা গেলো না। টাকা শেষ হয়ে গেলে ছাবের আলীরও আর দেখা মিললো না। সে যে তিন বছর থেকে বিছানায় পড়ে আছে একটাবারও যদি তাকে দেখতে আসে নিমকহারাম ছাবের আলী। হবিউল্লাহ ভাবে একবার যদি সে হেঁটে গিয়ে ধরতে পারতো ছাবের আলীর গলাটা। নিরুপায় হয়ে তাই সে প্রায়ই উড়ন্ত গাল ছুঁড়ে দেয় ছাবের আলীর উদ্দেশ্যে— চুদির ভাই মাইনষার পাছা মারা বুদ্ধি দিয়া বেড়ায়। অথচ ওইসব টাকা যদি সে নিজের চিকিৎসার পিছনে ব্যয় করতো তাহলে এতোদিনে দিব্যি ভালো হয়ে যেতো বলে তার বিশ্বাস।

সমুন্ধির কথা ভাবতে গিয়ে নিজের মেয়েদের কথা মনে পড়তেই হবিউল্লাহর মনের আগুনে ঘি পড়ে। তার বড় তিন তিনটা মেয়ে যাদের সে বিয়ে দিয়েছে হাড়-ভাঙ্গা পরিশ্রমের টাকায়, তারা বুড়ো বাপের কথা ভুলেই গেছে। এমন নিমকহারাম মেয়ের সে জন্মদাতা ভাবতেই একেকবার নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বসে হবিউল্লাহ। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তারা আর আসতেই চায় না। আসলেও বেশিক্ষণ থাকে না। কাজের অজুহাত দেখায়। হবিউল্লাহ তখন চেঁচিয়ে বলে, যা যা তোর ফির পোরধান মন্ত্রীর সাথে জরুরী মিটিং আছে। বাবার কথার অন্তর্নিহিত গুরুত্বের কথা ভেবে সময় নষ্ট না করে মেয়েরা ফিরে যায় প্রতিদিন পেটানো স্বামীর ঘরে। তখন ছোট মেয়ে জীবন্নেছাকে পূজা করতে ইচ্ছে হয় হবিউল্লাহর। জীবন্নেছাকে নিয়ে বিপরীতমুখী দুই ভাবনার স্রোতকে এক করতে গিয়েও পারে না সে।

পুরনো এসব কথা ভাবতে ভাবতে মাথাটা ধরে আসে হবিউল্লাহর। পেটের ভিতরে খিদাটা চাড়া দিয়ে উঠলে সে হাঁক ছাড়ে— কোটে গেলুরে আছিয়া? তুই ওজা আছিস দেখি কি মোক খাবার দিবু না? আছিয়া ঘরে ফেরে আরো কিছুক্ষণ পর। আছিয়া এক জব্বর খবর নিয়ে এসেছে। খবরটা শুনছেন? হবিউল্লাহ খেই খুুঁজে পায় না। কীসের খবর জিজ্ঞাসা করলে আছিয়া জানায়— আইজ বিয়ানবেলা লেপটিন যাবার ধরিয়া শামছুল মণ্ডল বেলে উল্টি পড়ি গেছলো। তারপর থাকি হাত-পা নড়ের পায় না। একনা আগোত মাইক্রোত করি অংপুর নিয়া গেলো। খবরটা শুনে হবিউল্লাহর মনটা খারাপ হলো না খুশি হলো তা স্বামীর মুখ দেখে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না আছিয়া। আর সেটা জানা গুরুত্বপূর্ণ ভেবে আছিয়া স্বামীকে প্রশ্ন করে, তোমার কাছোত কেমন নাগিল খবরটা? হবিউল্লাহ নিজেও ঠিক তা ঠাহর করতে পারে না। তার চোখ দু’টো পিটপিট করতে থাকে।


জীবন্নেছা পর্ব

জীবন্নেছাকে ইদানীং একটা দুঃশ্চিন্তা আচ্ছন্ন করে রাখে সারাক্ষণ। জিতু ফ্যাব্রিকসের ম্যানেজার রবিন পনের লাখ টাকা নিয়ে লাপাত্তা। এখন এসেছে নতুন ম্যানেজার। রবিন না থাকায় অনিশ্চয়তার মাঝে পড়ে আছে সে। অবশ্য গারমেন্টসের ইফতার মাহফিলে নতুন ম্যানেজার মিজান খন্দকার বলেছে, ঈদের আগে সবাই যাতে বেতন-বোনাস পায় সে ব্যবস্থা সে করবে। সে গরিব ঘর থেকে উঠে এসেছে তাই গরিবের দুঃখ বোঝে। যতোই দুঃখ বুঝুক নতুন ম্যানেজার, জীবন্নেছা আর আগের মতো নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না।  রবিন থাকাতে বেতন-বোনাস নিয়ে কোনো চিন্তা ছিলো না তার। অন্য সবার কী হয় হোক জীবন্নেছার কোনো সমস্যা ছিলো না রবিন থাকাতে।

বেতন-বোনাস ছাড়াও প্রতিমাসে একটা বাড়তি টাকা জুটতো। এর বিনিময়ে জীবন্নেছাকে যা করতে হতো তা তার কাছে এখন কিছুই মনে হয় না। শুধু প্রথমদিন একটু কষ্ট হয়েছিলো। যেনো শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ আলাদা হয়ে যাচ্ছিলো। তারপর ফ্রি হয়ে গেলে সে রবিনের দুর্বলতাটা খুঁজে পায়। রবিনও কাপুরুষের মতো স্বগতোক্তি করতো, তোমাকে দেখলেই আমার পড়ে যায়। বলেই একটা হাসি দিতো রবিন। কিন্তু সে হাসিতে বিজয় নয় পরাজয়ের গ্লানিই স্পষ্ট হয়ে উঠতো। জীবন্নেছাও হাসির সাথে তাল দিতো। রবিন তখন একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে ভরসা করার মতো উত্তরের আশায় চোখ রাখতো জীবন্নেছার চোখে— হারবাল খাইলে মনে হয় ঠিক হবে। না? কিন্তু আশাব্যঞ্জক কোনো উত্তর পাওয়া যেতো না জীবন্নেছার কাছে। আমি কী জানি! খায়া দেখেন একবার। উঠতে উঠতে জীবন্নেছার গালটা টিপে দিয়ে রবিন বলতো, তুমি যে সেক্সি সেই জন্যে বুঝি এমন হয়। জীবন্নেছা লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বলতো, যাঃ। রবিন তখন বলতো, তোমার মতো সুন্দরী আর সেক্সি মেয়ে এই গার্মেন্টসে ক্যান বাংলাদেশের আর কোনো গার্মেন্টসে যদি আরেকজন থাকে তাইলে আমি আমার কান কেটে কুত্তাকে খাওয়াবো। অতিরঞ্জিত করে কথা বলায় পটু সেই রবিন গারমেন্টসের পনের লাখ টাকা নিয়ে লাপাত্তা। এখানে-সেখানে রবিনের ছবি সম্বলিত পোস্টার সেঁটে দিয়েছে গারমেন্টসের মালিক। ‘একে ধরিয়ে দিন। ধরিয়ে দিতে পারলে বিশেষ পুরষ্কার আছে।’ রবিন কেনো এমন একটা কাজ করলো তা ভেবে পায় না জীবন্নেছা। বেতনও তো ভালো ছিলো। একদিকে রবিন যেমন তার উঠতি সম্ভাবনাকে ধুলিস্মাৎ করে দিয়ে গেছে নিজে, তেমনি জীবন্নেছার কল্পিত একটা ভবিষ্যতকেও গলা টিপে হত্যা করেছে। তবু জীবন্নেছার কাছে রবিন দেবতা। এখনো সে স্বপ্নে দেখে রবিনকে। একেকবার সে ভাবে— রবিন যদি টাকাগুলো ফেরত দিয়ে গার্মেন্টসের মালিকের পা ধরে ক্ষমা চায় তাহলে রবিন ক্ষমা পেয়ে চাকরিটাও পায় আর জীবন্নেছার বুকের উপর থেকে একটা পাথরও সরে যায়।

নতুন ম্যানেজার মিজান খন্দকার সবার কাছে কাছে গিয়ে কাজের খোঁজখবর নেয়। মেয়েরা প্রশংসা শুরু করে মিজানের। কী সুন্দর চেহারা! এক্কেবারে নায়কের মতোন। জীবন্নেছারও তাই মনে হয়। কোথায় যেনো এমন একজন নায়ক দেখেছে সে। পরে টিভিতে ছেলেদের একটা ক্রিমের বিজ্ঞাপন দেখার সময় তার অনুমানটাকে মিলিয়ে নেয়। হাসিনা বলে, শাকিব খানের মতোন চেহারা। অন্যরাও তাতে সায় দেয়। কেউ একজন ‘তোর সাথে জোড়া মিলবে’ বললে জীবন্নেছা বলে, মাগি তোর ভাতার নাই তুই বিয়া বস। ‘তোর সাথে জোড়া মিলবে’ এই কথাটা নিয়ে রাতের বেলা অনেক ভাবে জীবন্নেছা। রবিন ও তার ব্যাপারে কিছু জানতো নাকি মেয়েগুলো? যদি জানে তাহলে তো মুখ বন্ধ করে থাকার মতো অতো মানসিক শক্তি ওদের নেই। কতোদিনে তা রাষ্ট্র হয়ে যেতো। এভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের যুক্তি প্রয়োগ করে সন্দেহের সমূহ সম্ভাবনাকে অসার প্রমাণ করে জীবন্নেছা।

জীবন্নেছা তার বুকে কাজ করছিলো। তার কাজের পরিমাণ কম। এটাও রবিনের বদৌলতে। কাপড়ের ফিনিশিং দেখে সে। যেগুলোর ফিনিশিং ঠিক হয়নি সেগুলো আলাদা করে রাখে। ম্যানেজারের পিয়ন এসে বলে যায়, মিজান স্যার যাওয়ার সময় দেখা করতে বলছে। জীবন্নেছা রবিনের দেয়া হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে সময় দেখে। এখনো একঘণ্টা বাকি আছে ডিউটির।

ডিউটি শেষে জীবন্নেছা ম্যানেজারের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। রুমের ভিতরে রুম। এসি আছে সে রুমে। কাঁচের দরজাটা একটু ঠেলে জীবন্নেছা প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করে, আসতে পারি স্যার। মিজান খন্দকার ল্যাপটপে টেপাটিপি করছিলো। জীবন্নেছার মিহি কণ্ঠস্বর একবারেই তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়। জী জী আসো। কণ্ঠটা শুনতেই খটকা লাগে জীবন্নেছার। একদম রবিনের মতো! রবিনও এভাবে দুইবার ‘জী জী’ বলতো। বসো। নির্দেশ শুনে সামনের চেয়ারটাতে বসে পড়ে জীবন্নেছা। মিজান খন্দকার হাতের আঙ্গুলের ইশারায় তার ডানপাশের চেয়ারটাতে বসার নির্দেশ দিলে জীবন্নেছা কিছুটা সংকোচবোধ করে। মিজান খন্দকারের দোদুল্যমান আঙ্গুলের সাথে নিজেও দোলাচলে দুলে অবশেষে ডান পাশের চেয়ারটাতেই বসতে বাধ্য হয় সে। জীবন্নেছা একবার চোখ তুলে নতুন ম্যানেজার মিজান খন্দকারের দিকে তাকায়। বুকের দুইটা বোতাম খোলা। বিজ্ঞাপনের সেই মডেলের সাথে মেলানোর চেষ্টা করে সে। কাছ থেকে দেখতে ওরকম লাগছে না। হাসিনার কথাই ঠিক। শাকিব খানের মতো। পরক্ষণে ভাবে না শাকিব খানের বুক তো এতো চওড়া না। ইন্ডিয়ান নায়ক সালমান খানের মতো। মিজানের চোখের সাথে চোখ পড়তেই চোখটা নিচু করে সে। নতুন ম্যানেজার মৃদু হাসে। জীবন্নেচ্ছা; তার জীবনে দেখা হাসিগুলোর অভিধান থেকে এ হাসির অর্থ খোঁজার চেষ্টা করে। সঠিক অর্থ খুঁজে পেতে তেমন একটা বেগ পেতে হয় না যখন একটা হাতের হাঁটার দৃশ্য সে দেখতে পায়। পিলপিল করে একটা হাত এগিয়ে আসে। হাতের গন্তব্য কোথায় স্থির তা খেয়াল না করে হাতটির দিকে একমনে তাকিয়ে থাকতেই জীবন্নেছা দেখতে পায় এ হাত রবিনের! ঐ তো মধ্যমায় রবিনের সেই আংটিটা। কোথায় গেলো বিজ্ঞাপনের মডেল, আর কোথায় গেলো শাকিব খান কি সালমান খান, এ যে সাক্ষাৎ রবিন! জীবন্নেছা চোখ তুলে তাকানোর সাহস পায় না। পাছে রবিন আবার চলে যায় জীতু ফ্যাব্রিক্স ছেড়ে। হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস ও আস্থা ফিরে পায় জীবন্নেছা। তাই সে অস্ফূট স্বরে বলে ওঠে, রবিন ভাই আপনি?!


শাহেদুজ্জামান লিংকন। কবি ও গল্পকার। 
জন্ম ২ মে, ১৯৮৮ লালমনিরহাটের দলগ্রাম, কালীগঞ্জে।
লেখালেখির শুরু এই শতাব্দীর শূন্য দশকে। পেশায় একজন চিকিৎসক।  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।