
তড়িৎ দেবের আবির্ভাবে গ্রাম-গঞ্জের কালোরূপ আলোকিত হয়েছে আরো অনেক আগেই। এখন গ্রাম মানেই সন্ধ্যেবেলায় ঝুম অন্ধকার আর নিঝুম নির্জন নয়। এখন সন্ধ্যেবেলায় সন্ধ্যা-তারা'র মতোই প্রতিটি ঘরে টুপটাপ জ্বলে ওঠে তড়িৎ-দেব মানে বৈদ্যুতিক বাল্ব। ছেলেমেয়েরা এখন রাত জাগায় অভ্যস্ত, তাই রাত দশটা এগারোটা এখন আর গভীর রাত নয়। সড়কপরিবহন-দেবও পৌঁছে গিয়েছেন প্রায় সবার বাড়িতেই, গ্রামের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে আছে কাঁচা-পাকা রাস্তা। ফলে যাতায়াত বেড়েছে পাড়ায়-পাড়ায়, খানাখন্দ ভরাটের ফলে দূরত্ব কমে গেছে এ-বাড়ি ও-বাড়ির। গ্রামের চিত্র বলতে এখন যত্রতত্র পুকুর, এঁদোডোবা নয়, 'তড়িৎ-দেব' আর 'যোগাযোগ-দেব' গ্রামগুলোকে সাজিয়ে দিয়েছেন 'বিউটিশিয়ান'দের মতো! 'নয়গ্রাম' তেমনই একটি গ্রাম। এই গ্রামের লোকজনদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালই। তাই সারা গ্রামেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পাকাবাড়ি, দালানকোঠা । জেলে কুমার মজুরের পাশাপাশি আছে ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীও। তবে এসবের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আছে প্রবাসীর সংখ্যাও। তাই এই গ্রামে না-খেয়ে থাকা পরিবারের সংখ্যা নেই বললেই চলে। বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার পরে এই গ্রামের মানুষের জীবনযাপনকে সর্বাধিক এগিয়ে দিয়েছে যে প্রযুক্তি তার নাম মোবাইলফোন ও ইন্টারনেট ব্যবস্থা।
রাত প্রায় দশটা বাজে। কুদ্দুস বেপারীর বাড়ির উঠান লোকে লোকারণ্য। কুদ্দুস বেপারীর চার ছেলের মধ্যে তিন ছেলে প্রবাসে থাকলেও তাদের বউ বাচ্চা নিয়ে কুদ্দুস বেপারীর বিশাল পরিবার! হঠাৎ তাদের 'চোর চোর' চিৎকার আর হৈ-হুল্লোড়ে আশপাশের সব লোকজন এসে জড়ো হয়েছে চোর ধরতে আর চোরকে ফ্রি পিটুনি দিয়ে হাতের জড়তা ভাংতে। কিন্তু চোর দেখে সবাই হতাশ, এ তো বাচ্চা! সতেরো আঠারো বছর বয়স, ভদ্রঘরের ছেলে বলেই মনে হচ্ছে! সবাই একটা করে কিল দিলেও তো দেহে ধরবে না, কিল পড়বে মাটিতে! তবু অনেকেই হাতের ব্যায়াম সেরে নিলেন।
চোরকে ধরা হয়েছে কুদ্দুস বেপারীর ছোটছেলের বউয়ের দালানের সিঁড়ি থেকে! সিঁড়ি দিয়ে ছাদে যাবার সময় কুদ্দুস ব্যাপারীর সেজো ছেলের দশ বছরের কন্যা টুম্পা চোরকে দেখে ফেলে। টুম্পারা (টুম্পার মা ও দুই বোন ) আর ছোট বউ একই দালানে থাকে। টুম্পা ছোট চাচীর কামরায় এসেছিলো একটা মেয়েবাবু (পুতুল) বানানোর জন্য! যদিও টুম্পা পলকহীন চোখেই মেয়েবাবু বানানো দেখছিল, কিন্তু তার দুরন্ত-চঞ্চলা চোখ ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পড়ে যায়ে সিঁড়ির উপর। এজন্য তার ছোটচাচীর খাটই দায়ী। ছোট বউয়ের কামরার খাটে উঠে বসলেই সিঁড়ি দেখা যায়। টুম্পা চোর দেখেই ভয়ার্ত কণ্ঠে চুপিচাপি চাচীকে বলে, "ছোট চাচী, ছাদে চোর যাচ্ছে!" ছোট বউ থতমত খেয়ে ওঠে! "কী বলিস? মেইনগেট তো আটকানো, চোর আসবে কী করে?" টুম্পা তবু বলে, "আমি দেখেছি চাচী, চোর সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে!" ছোট বউ সানজিদা জাহান বেশ সাহসী, সংসারের ছোটবউ'রা একটু সাহসী আর আপডেটেড হয়, তাই বাচ্চা মেয়ের কথায় কান দিলো না। টুম্পাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য একটু উঁকিঝুঁকি দিয়ে বলল, "নাহ! কেউ তো নেই! শোনো টুম্পা সোনা, তুমি হয়তো ভুল দেখেছ! এই নাও, তোমার মেয়েবাবু বানানো হয়ে গেছে! যাও, এবার খেলো গে।" টুম্পা আর কথা বাড়ায় না, কিন্তু তার কচি মনের সন্দেহ দূর হয়নি! সে স্পষ্ট দেখেছে, একটা চোর সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠেছে। এমন সময় সেজোবউ টুম্পাকে নিতে আসে সানজিদার কামরায়, ছোটবউকে উদ্দেশ্য করে বলে, "কি রে সানজিদা তোর নাতনী বানানো হলো? যেমন টুম্পা তেমনি তুই, পারিসও বাবা!"
আর বলো না ভাবী, তোমার মেয়ে আমাকে ছড়বেই না মেয়েবাবু বানিয়ে না দিলে, তাই দিলাম বানিয়ে। এবার সে হ্যাপি!
চলো টুম্পাসোনা, এবার তো তোমাকে ঘুমাতে যেতে হবে।
সে তার মায়ের কাছে নালিশ দিলো, "জানো মা, একটা চোর সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠেছে। আমি চাচীকে বললাম, কিন্তু চাচী খুঁজেই পেলো না! ও মা! তুমি একটু দেখো না, যদি সত্যি চোর আসে, আর যদি আমার বেবীদের সব গয়না চুরি করে নিয়ে যায়, আমি কিন্তু খুব কান্না করবো।" সেজো বউ প্রথমে টুম্পার কথা বুঝতে পারেনি, তাই সে সানজিদার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো!
আর বলো না ভাবী, তোমার মেয়ে নাকি সিঁড়ি দিয়ে কাকে উপরে যেতে দেখেছে। আমি তো দেখলাম, কেউ নেই। কিন্তু তবু তোমার মেয়ে বুঝতেই চাইছে না। মা আমি সত্যি দেখেছি একটা লোক সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলো! তুমি চলো না, দেখবে! সেজোবউ একটু চিন্তিত হলো, ছোটবউকে বলল, "চল না হয়, আমরা একটু দেখে আসি?" ওহ ভাবী! তুমিও কি পাগল হলে? মেইনগেট তো বন্ধ, চোর আসবে কী করে?
তবু যেনো সেজোবউয়ের মনে একটা খটকা লেগেই থাকে, টুম্পা তো অযথা বানিয়ে কথা বলে না! তাই সে আমতাআমতা করে আবার বলল, "তবু একবার দেখলে তো ক্ষতি নেই! "
সামজিদা তখন মোবাইলে চ্যাটিং-এ ব্যস্ত। তাই অনেকটা বিরক্তি নিয়েই বলল, "ওহ ভাবী! আচ্ছা তুমি যাও, দেখে এসো। আমি তো দেখেছি! কিচ্ছু নেই, কেউ নেই সিঁড়িতে! তাছাড়া ছাদের গেটেও তো তালা দেয়া, চোর আর পালাবে কই বল? আচ্ছা ভাবী, বাচ্চাদের সব কথা কী শুনতে হয়? হয়তো বিড়াল-টিড়াল কিছু দেখেছে, তুমিই বল, এত বছর তো হয়েছে এই গ্রামে এসেছো, কখনো দেখেছো কারো বাড়ি চুরি-ডাকাতি কিছু হয়েছে?"
না, তা হয়নি।কিন্তু টুম্পা এমনভাবে বলেছে, তাই আমারো একটু সন্দেহ হচ্ছে! তাছাড়া তোর তো মেয়ে নেই, তাই বুঝবি না, মেয়ের মায়েদের কতরকমের চিন্তা হয়! ঘরে সেয়ানা মেয়ে, আল্লাহ না করুক, কিছু হলে কলঙ্কের আর শেষ থাকবে না! আচ্ছা, তুই না গেলি, আমিই বরং দেখে আসি!"
গ্রামের অনেক কিছুই বদলেছে, কিন্তু সেই 'কুড়িতে মেয়ে বুড়ি' এই ধারণা বা মানসিকতা এখনো বদলায়নি! গ্রামে এখনো অধিকাংশ মেয়েদেরই এসএসসি পরীক্ষার পর বা পনেরো ষোল বছরেই বিয়ে হয়ে যায়। মেয়ে দেখতে শুনতে সুশ্রী হলে তো কথাই নেই। তাই গ্রামে পনেরোতেই মেয়ে সেয়ানা বা বড় হয়ে যায়। বাল্যবিবাহ আইন থাকলেও তা অভিভাবকদের আটকাতে পারে না, নানারকম 'চালাকি' করে আইনের চোখে ধূলা দিয়ে মহাসমারোহে বিয়ের অনুষ্ঠান করেন । কেউ লেখাপড়ায় ভাল হলে আর দেখতে যদি তেমন নজর না কাড়ে তবে সে পড়ালেখায় এগিয়ে যেতে পারে ভালই যদি তার পরিবার তা না-ও চায়। এক্ষেত্রে সুপাত্র পাওয়া কেবল ভাগ্যের উপর বা পরিবারের আর্থিক অবস্থার উপর অনেকটাই নির্ভর করে। এই ধারা পরিবর্তন হয়নি ডিজিটাল যুগেও।
সানজিদা কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারল না, সেজোবউ একাই চলে গেল!
ছাদের দরজা ছিল তালাবন্ধ। তাই চোর দরজা খুলে ছাদে যেতে পারেনি, গুটিসুটি মেরে দরজার কাছেই বসে আছে। সেজোবউ সিঁড়ির মাঝে উঠেই ছাদের গেটের কোণায় চোরকে দেখে চিৎকার শুরু করে দেয়! সাথে সাথেই পাশের ঘর থেকে কুদ্দুস বেপারী ও তার গিন্নী এবং বাড়ির বউ-ঝি'রা সবাই এসে হাজির হয় ছোটবউয়ের দালানের কলাপসিবল গেটে। সেজোবউয়ের বড় মেয়ে তামান্না দরজা খুলে দেয়!তামান্না সবে এসএসসি পাশ করেছে।
বড় ছেলে হাসিম চোরকে মারতে মারতে দুয়ারে এনে ফেলে! কুদ্দুস বেপারীর বড়মেয়ের বিয়ে হয়েছে পাশের বাড়িতেই। চিৎকার চেঁচামেচিতে তারাও হাজির হয়েছে। এই বাড়ির হর্তাকর্তা মূলত এই বড়জামাই। তার কথা ও প্যাঁচে সবাই হার মানে। বাড়ির গোমস্তা, বড় ছেলে আর বড়জামাই চোরকে মারতে মারতে ঘেমেনেয়ে একসা! এমনিতেই ছিলো ভাদ্রের খরার সময় তার উপরে আবার চোর নিয়ে ধস্তাধস্তি! ততক্ষণে আশপাশের সবাই চলে এসেছে!
সেই থেকে সানজিদা ভয়েই বারবার মূর্ছা যাচ্ছে। জ্ঞান ফিরলেই আবার চোর চোর বলে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। বাড়ি ও আশপাশের বেশকিছু মহিলার জটলা সানজিদাকে ঘিরে! "ভাগ্যিস টুম্পা চোরটাকে দেখেছিল! নয়তো কী সর্বনাশই আজ হতো গো! একেবারে ছোট বউয়ের ঘরেই প্রথম চুরি করতো!"
শুধু কি ছোটবউয়ের ঘরেই ঢুকত, ঘরে সোমত্ত মেয়ে-বউ ভরা, আজকাল চারদিকে যা হচ্ছে, এ নিশ্চয়ই ডাকাত দলের লোক, প্রথমে ওকে ঘরে পাঠিয়েছে রাতে ডাকাতদের জন্য দরজা খুলে রাখতে! আজ আল্লাহ খুব বাঁচান বাঁচাইছে!"
ওদিকে চোরকে বেদম প্রহার করা হচ্ছে। কুদ্দুস বেপারীর বড় জামাই মকবুল নানা কসরত করছে চোরের পেটে থেকে কথা বের করার জন্য!
'বল তোর নাম কী' বলেই গালে কষে এক ঘুষি মেরে দিলো।
আমার নাম তুষার , চোর বারবার বলছে, "বিশ্বাস করুন আমি চোর না! আমি ভদ্র ঘরের ছেলে!"
ওরে আমার ভদ্রঘরের ছেলে রে! বল, ক্যান ঘরে ঢুকেছিস? তুই কোন ডাকাতদলের লোক, বল। উপর্যুপরি কিল-ঘুষিতে চোরের নাক মুখ ফেটে রক্ত ঝরছে! তার একই কথা, 'আমি চোর না। আমাকে আর মাইরেন না! আমাকে ছড়ে দেন!'
'কথায় আছে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়', কুদ্দুস বেপারীর গোমস্তা বলল, ' দুলামিয়া, এইভাবে কাম হইবো না, হালায় মুখ খুলতাছে না, দেহেন না? অন্য সিস্টেম চালু করেন!'
হ, তুই ঠিকই কইছছ। অই যা তো ঘর থিকা তারপ্লাসটা নিয়া আয়! শালার হাড্ডিগুড্ডি আলাদা কইরা দিমু!
চোর হাতে পায়ে ধরছে, "আপনাদের পায়ে পড়ি, আমাকে ছেড়ে দেন।" আঘাতে জর্জরিত ক্লান্ত চোখ মেলে সে এদিক ওদিক খুঁজে ফিরছে কোন ভরসার মুখ! যে মুখ এসে বলবে, সে তো চোর না, আমার বন্ধু, আমি তারে আসতে বলেছিলাম। কিন্তু হায়! এখানে কোন ভরসার মুখ নেই, এখানে কোন মমতার ছায়া নেই, আছে কেবল ভয়ংকর, হিংস্র, বোধহীন, মায়াহীন কিছু মানুষের অবয়ব। যাদের কাছে সে কাকুতিমিনতি করছে তারা মানুষ নামের দানব।
মকবুল তারপ্লাস দিয়ে হাতের আঙুল টানছে আর বলছে, বল তুই কোন দলের সদস্য? কে তরে পাঠাইছে?
কান্নায়, আঘাতে, কষ্টে ক্ষয়ে আসা কণ্ঠে চোর শুধু বলছে, আমি চোর না, বিশ্বাস করেন আপনারা! আমাকে আর মাইরেন না, বলেই জ্ঞান হারালো। মকবুল যেনো কিছুটা হতাশ হলো, 'হালায় মইরা গেলনি? তাইলে ক্যামনে খবর বাইর করুম' বলেই নাকের কাছে হাত দিয়ে পরখ করল! নাহ্, মরে নাই, জ্ঞান হারাইছে! তাই নাক টিপে ধরল নিঃশ্বাস বন্ধ করার জন্য যাতে জ্ঞান ফিরে আসে।
শরীরে অসহ্য ব্যথা নিয়ে চোরের জ্ঞান ফিরল, চোখ খুলে দেখার শক্তিও যেনো নেই তার!ভাবছে এতো মানুষের জটলা, অথচ এখানে কোন মায়ের মন নেই, প্রেমিকার মুখ নেই, বন্ধুর হাত নেই, কেউ বলছে না, আহারে বাচ্চা ছেলে, ওকে এভাবে মেরো না, ওর কথা শোনো, ও কী বলতে চায় তোমরা শোনো! মানুষের পৃথিবীতে আজ মানুষেরই সবচে বেশি অভাব! কেনো মানুষগুলো এমন দানব হয়ে গেলো? তার চোখে ভেসে ওঠে মমতাময়ী মায়ের মুখ,অঝরে অশ্রু ঝরে, চিৎকার দিয়ে উঠে 'মা' বলে! আবার নিস্তেজ হয়ে যায়। আরো একটা মুখ ভেসে ওঠে আবছা হয়ে! কিন্তু সেই মুখ মনে হতেই এবার তার চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে, কিছু বলতে যেয়েই আবার জ্ঞান হারায়!এইটুকু দেহে আর কত আঘাতই বা সয়! তার উপরে মনের আঘাতটাই তাকে আরো বেশি মেরে ফেলেছে। আবছায়া মনে পড়ে সেই রিনিঝিনি হাসি, সেই প্রেমময় আদর! কতো মন ভুলানো ভালবাসার কথা, ভরসার কথা! একসাথে ঘোরাফেরা, রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়া। হায়! আজ কোথায় সে! কোথায় সেই আশ্বাস, আরে তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেনো, আমি আছি না?
ছোট বউ কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে। তাকে বুঝানো হয়েছে যে আর ভয়ের কিছু নেই। চোর ধরা পড়েছে, তাকে মেরে তক্তা বানানো হয়েছে। তাকে আরো স্বাভাবিক করার জন্য বড়বউ, সেজোবউ চোরের কাছে নিয়ে গেলো, যাতে নিজ চোখে সব দেখে স্বাভাবিক হয়। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে গেলো! সবাই সানজিদাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করছে! এমন সাহসী মেয়ে, কী ভয়টাই পেয়েছে!
ছোট বউ উঠানের অর্ধেক যেয়েই পিছন ফিরে এলো, ' মাগো! আমার ঘরে চোর! আমি এই ঘরে থাকবো কী করে? আমি তো ভয়েই মরে যাবো!' আবার সবাই মিলে সান্ত্বনা দিয়ে বুঝিয়ে চোর দেখাতে নিয়ে এলো! আরে চোর তো ধরা পড়েছে, তোমার ভয়ের কিচ্ছু নাই। এই দেখো চোরের কী হাল করেছে! সানজিদা চোর দেখে আবার মূর্ছা গেলো। ওদিকে তামান্নাও ভয়ে গুটিসুটি হয়ে আছে। ঘরের এককোণায় চুপচাপ বসে আসে। সে কিচ্ছু ভাবতে পারছে না, যদি চোর উলটাপালটা কিছু বলে, যদি সবাই তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে তবে সে কী বলবে? কেউ কি তার কথা বিশ্বাস করবে? আরো কত কথা যে ভাবছে! টুনি তো আমেরিকায় জয়ের আনন্দে আছে, 'দেখেছ! আমি বলেছিলাম না চোর ঢুকেছে ঘরে! চাচী তো আমার কথা বিশ্বাসই করছিলো না! চাচীর এবার জ্ঞান ফিরুক, তাকে বলব যে সে হেরে গেছে!'
তামান্নাকে দেখতে না পেয়ে বেপারীগিন্নী তার খোঁজ করলেন! সুফিয়া, রত্না, রাহেলা সবাই তো আছে, তামান্না কই? তিনি খুঁজতে খুঁজতে সেজোবউয়ের কামরায় গেলেন! তামান্নাকে চুপচাপ খাটে বসে থাকতে দেখে তিনি অবাক হলেন,'কী রে তামান্না,সবাই চোর দেখছে, তুই এখানে একা বসে আছিস ক্যান! চল আমার সাথে উঠানে! দাদীর বয়স হয়েছে, তিনি যেনো কিছু একটা আন্দাজ করছেন মনে মনে! তামান্না কিছুই বলল না, চুপচাপ দাদীর সাথে গেলো।
মকবুল এইবার চেয়ারম্যানকে কল দিলো! সব বলার পর বলল, চেয়ারম্যান সাব, আপনে আসেন। এলাকার মেম্বারদেরও কল দিলো! আর আশপাশ গ্রামের লোকজন মান্যগণ্যরা তো এরমধ্যে এসেই পড়েছেন।
নিস্তেজ নির্লিপ্ত চোরের চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে তবু সেই চোখ একটা ছায়া দেখতে ভুল করে না! ষষ্ঠইন্দ্রীয় যেন কিছু অনুভব করে! উদগ্রীব হয় কিছু শোনার জন্য! কিন্তু হায়, একদল জানোয়ারের 'হাউকাউ' ছাড়া সে আর কিছুই শুনে না! নিস্তেজ হয়ে অঘোর ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে।
চেয়ারম্যান সাহেব এসেছেন! চোরকে প্যারাসিটামল খাওয়ানো হয়েছে! কোনরকমে তাকে বসানো হয়েছে, যদিও তার সোজা হয়ে বসার হাড়গোড় ভেঙে দেয়া হয়েছে। আবার শুরু হয়েছে জিজ্ঞাসা পর্ব, চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, বল তোর নাম কী?
চোর ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, তুষার।
মাঝখান থেকে কথা বলে মকবুল, এইটা কী তর আসল নাম?
—আমি সত্য বলছি।
—তোর বাড়ি কোথায়?
—এই গ্রামের পরের গ্রাম কমলডাঙায় !
—তুই কি কোন ডাকাতদলের লোক?
—বিশ্বাস করেন চেয়ারম্যান সাহেব আমি চোর না!
—তবে কে তুই? কেন এসেছিস এখানে?
এবার চোর নীরব! এতক্ষণ এত মার, এত আঘাত সহ্য করেও তুষার মুখ খুলেনি, সব নীরবে সহ্য করেছে যার জন্য, তার নীরবতা— চিনেও না চেনার ভান করা তুষারকে ভিতর থেকে ভেঙে আরো খানখান করে দিয়েছে। শরীরের হাড়গোড় ভেঙেছে ভাঙুক কিন্তু তার বিশ্বাস ভরসা ভালবাসা যে ভেঙে দিয়েছে তাকে কি ক্ষমা করা ঠিক হবে! অন্যায় তো সে একা করেনি, তবে কেনো সব দায় সে একা নিবে? কেনো সে তাকে আসতে বলেছিল! আর কেনো সে একবারো বলল না যে 'একে আমিই আসতে বলেছি'!
এমনি ভাবনার মাঝে সে চমকে উঠে মকবুলের ধমকে! বল বেটা, ক্যান আসছিলি?
চেয়ারম্যান সাহেব, ওরে পুলিশে দিয়া দেন!পুলিশের ডাণ্ডা না খাইলে শালায় মুখ খুলব না!
চেয়ারম্যান সাহেব বিরক্ত হলেন। চেয়ারম্যান সাহেবের মনে হচ্ছে না যে এই ছেলে কোন ডাকাতের দলের বা চোর।
তুষার এবার চেয়ারম্যানের পায়ে ধরল, চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে পুলিশে দিয়েন না, বিশ্বাস করেন আমি চোর না,আমি নিজের ইচ্ছায় এই বাড়িতে আসি নাই, আমারে এই বাড়ির মেয়েই আসতে বলেছে।
মুহূর্তে যেনো সেখানে পিনপতন নিরবতা নেমে এলো, সবাই স্তব্ধ!
এবার শুরু হলো কানাকানি, ফিসফিসানি! সবার আগে যার নাম নিচ্ছে সবাই তার নাম 'তামান্না'
মুখ খুলল মকবুলই। মিথ্যা কথা, এই বাড়ির কোন মেয়ে এই কাজ করতেই পারে না।
তুষার খুব স্পষ্ট করে বলল, 'এবাড়ির মেয়ে সানজিদা জাহান আমাকে আসতে বলেছিল।'
সবার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ল! কী অসম্ভব কথা!
শালা, ধান্দাবাজি করার আর জায়গা পাও না?সানজিদা এ বাড়ির মেয়ে? ভেবেছ উলটাপালটা একটা বলে দিলেই হলো? চুলের মুঠি ধরে জোরে ঝাঁকানি দিলো মকবুল।
'বিশ্বাস করুন, সানজিদা আমাকে বলেছে সে এ-বাড়ির মেয়ে। সে-ই আমাকে আসতে বলেছে! সে-ই আমাকে সন্ধ্যাবেলা ঘরে ঢুকাইছে, সিঁড়ির পাশে স্টোররুমে আমি লুকিয়ে ছিলাম। আমার ছাদে যেয়ে থাকার কথা ছিল তাই সিঁড়ি দিয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সানজিদা ছাদের দরজার তালা খুলতে ভুলে যায়, তাই আমি ছাদে যেতে পারিনি!' তুষার হাপাতে হাপাতে, ভেঙভেঙে কথাগুলি বলল! আমি জানতাম না যে সানজিদা এবাড়ির বউ!
সব অপরাধেরই কিছু সাক্ষী থাকে, কিছু চিহ্ন থাকে যা অপরাধী অজান্তেই পুষে রাখে! যদিও সানজিদা তুষারের অভিযোগ অস্বীকার করে কিন্তু তার মোবাইল চেক করে তুষারের কথার সত্যতা মেলে!সানজিদা এত লোকের গ্যাঞ্জামে মোবাইলের ম্যাসেঞ্জারের এত এত ম্যাসেজ আর কললিস্ট ডিলিট করার সুযোগ পায়নি!
সীমা শামীমা। কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক। জন্ম ১৯৭৭ সালের ০১ জুলাই মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার মদনখালি গ্রামে।প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: নীরবে নিভৃতে।
1 মন্তব্যসমূহ
এটা গল্প?
উত্তরমুছুনমন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।