এরপর মৃতদের হাসি
ঝড়ের আভাস পেলে সব লোক
একসাথে গাড়ি ধরে, বাড়ি যাবে;
সবগুলি বাগানের জ্বর, কুল করে
গান গুঁজে ফুলে, হাওয়া দম নেবে!
মেঘের স্বরাজ আর ধূলাজর্জর সন্ধ্যার দিকে
আমাদের কথা কাটাকাটি, আমাদের দোলনাকে
যেভাবে দোলায় মাটি; মানুষের মুখে গিয়ে বসে
এরপর মৃতদের হাসি, বলো আজ যাবে কোনদিকে?
কোনদিকে হাওয়ার বাদল-ঝরা, চাইছো তুমি?
সৈকতে ফিরবে ছায়া, বুনো স্বর, অথই বনানী?
রাত শেষে রক্তজবার
(উৎসর্গ- কবি ও প্রিয় বড়ভাই, মেন্টর আহমেদ স্বপন মাহমুদকে, সত্যে ও সৌরভে, আপোষহীনতায়)
এসেছি মৃগয়া থেকে, এসে পথে ভারবাহী রোদ, আজ নিজে পথের শিকার;
বিক্ষত হৃদয় হতে, কতোসব মেঘপুঞ্জ, পথে এসে গলে গলে পড়ে
স্বরগ্রামে বর্ষা নামায়-
কাছে বসে তামাশা-ভঙিমা, শান দেয় আমার শহর; .
এসে পথে হাওয়ার গায়ে, হেলে আছে যে বাক্যেরা
কিছু লেখা পানপাত্রে, নকশাতে তামার আঁচর;
দূরে কিছু আত্ম জিজ্ঞাসা, কিছু কথা ‘মিমাংসা’ লাগে!
তোমার চাহনী থেকে স্নায়বিক দ্বিধা, সমানে ঝাকায় মাথা!
সামনে আহত ছায়া, পেছনে সাঁতার জড়ো, লুটায়ে পড়েছে দীঘি, মর্ত্যে মিরর;
এর ধারে আত্মজিজ্ঞাসা, কই তুমি উড়ায়ে গিয়েছো ঘুড়ি, করোনাবিধুর গাঁয়ে?
সারাদিন মাথার ভিতর, টোল-পড়া পাথর গড়ালো
সারাদিন উদর টেনে, একলা পাথার-শামুক!
মাড় দেয়া সুতায়-ঘুড়িতে, কাটা গেলো ভয় ধরা বুক;
এসেছি তেভাগা হতে, মেঘ কেনো কান্না থামালো!
থেকে গেছে ঝরা-পাতা-ধূলি, হৃদয়ে অবুঝ পড়ে
পথে নেমে পথের শিকার আমি, একা হয়ে প্রত্যুত্তরে
আমি পীঠ বোঝাই গাধার, ছানি পড়া দু'চোখ আবার
কলি হয়ে ফুটছি একাই , রাত শেষে রক্তজবার!
লকডাউন– বন্ধুর মায়ের মৃত্যুতে
(উৎসর্গ- সাবেরের আম্মাকে, মৃত্যদিনে)
এখন শান্ত শিষ্ট দিন, গৃহবন্দী দম, হাই জাম্পে
মেডেল জিতছে বাতাস, পানি ছিটিয়ে, খাতায় লিখিয়ে
আমাদের সাবকনশাস;
যে সকল দুপুর আমি ডুবিয়েছি ক্ষারে ও বিষাদে
যে সকল কবিতা আমি টুকে রেখে রেখে
শ্যামা থেকে হয়েছি বিবর্ণ, এসব কিছুই চাই না ফিরে;
পা বাড়াই পায়ের গন্তব্যে, ঘরের দুয়ারে, ঔষধি গানে, আপাতস্বস্তির দিকে;
এখন দুপুর পুরা চুপ, আলাপ হয় রৌদ্রের সাথে
অস্তগামী সূর্যের সাথে, উটের খুট বাঁধা ফোরাত নদীর সাথে
তাঁর আসন্ন স্বর্ণগল্প নিয়ে;
কথা হয় ফুটফুটে ফুলটিরও সাথে, যার নাম স্মৃতি
যার কাছে ঘুরঘুর করে আর মাটি ভাঁজ করে খাল বানায় আমার কৈশোর!
তারও পরে, আথকা বৃষ্টির রাতে, খুলে যাওয়া জানালা হাওয়ায়
তোমাকে চমকে দেয় নাকি? যেমন সাবের হারালো মা’কে, আমাকে মাইগ্রেন
কি ভেবে রপ্ত করছে বিষে!
আর প্রেম? দূরত্বে উজ্জ্বল নাকি? চেয়ে থাকে হাওয়া, খোঁপাটার দিকে
গালে টোল; হাসিমুখ-টোনে 'শান্ত পিয়ানো' লাগে! বৃষ্টিবাদ্য নিয়ে ধ্বনিত দু'ঠোঁট
তোমার; নিক্তি-নিক্তি মাপা সোনালি সংসারে!
এইসব মন-মরা দিনে সাঁতারের পোশাক পরে, মনে হয়
সাগরে নামি, ঢেউয়ের করাতে নামি; প্রতিদিন ব্যাক পেইন জাগে, প্রতিদিন
এনজাইটি!
আর যারা আমার ক্লিকে, ছবি হয়ে ফুটে গ্যাছে বাংলা কবিতা নিয়ে;
আর যারা সমবেদনা, পুতুল খেলার আলো; তাঁদের সুবাদে রিভো, ঘোলা হলো
চশমাটিও;
এখন চিনতে পারি সকল মুখের ড্রামা, মনে রাখি জিহ্বা-তাড়া, সরীসৃপ!
থাকতে এসেছি ভাষায়
বাবার সানগ্লাস থেকে বাঁয়ে সরে গিয়ে সূর্য পৃথিবীর বাগান-কিনারে থামে!
এই ফাকে ভাবছি নাগরদোলা, এই ফাকে দেখছি কচুরিপানায়
ফুটছে পত্র-ফুল, মায়ের আঁচল থেকে উপচে আসছে ফুল!
স্মৃতির ভিতর বসে, এ'ই দেখা বহুদিন পর, বাবা;
এ'ই দেশে পিছলাবে পা, কোভিড?
বন্ধুরা আড্ডায় বলে ট্যুর, সাধে হাস্যরস
অথচ নাইতে এসেছি ঘাসে, হৃদয় সমাসে
নিজেকে নিজের ভিতর রেখে, আত্মগোপণে;
বন্ধুরা হ্যাজাক বাতি, কেউ সাধে পেস্ট্রির জুঁই;
এর পাশে নিমডাল জোরে, নড়ছে যে মাতৃভাষায়
আমারে প্যাঁচায় তাঁর ছায়া, লোমহীন রোদ;
দুনিয়াতে ক্ষুধাই বিপ্লব এখনো,, ক্ষুধাই সশস্ত্র শ্লোগান!
শূন্যতা, পাই-পাই করে চিনিয়ে দিচ্ছে জীবন;
আমি কি ঘুরে চেয়ে দেখি নাই চাঁদ, এতোদিন?
আমি কি বন্ধুর ঘাড়ে, হাত রেখে স্বপ্নের টার্বাইন
ঘুরিয়ে বিফল নাবিক? থাকতে এসেছি বলে
ভাগ্যরেখার বাইরে এসে দাঁড়াই, আর কে সে
মনোযোগী নয় প্রেমে? হৃদয়ে ঢোকার আগে মন চায় একটু দাঁড়াই;
দুই পাশে ঝাউ-জংলা, দুই চোখে শস্য মাড়াই, সারাদিন চাতাল ফুঁড়ছে ধান!
দূরে কেউ ‘চাপ চাপ হেডেক’ নিয়ে
ডায়াল করছে আমায়, তবু ঝিল মাতৃভাষায় করে
‘লু-হাওয়া’, উপঢৌকন দেয়, থাকতে এসেছি ভাষায়!
স্বপ্নে ঢুকেছে ঝড়, ঘুমহীনতার স্মৃতি, দৌড়ে আসছে কুকুর;
তবু যে মনোযোগী নয় প্রেমে, ডানা থেকে শিশির ঝরায় ফিঙে;
তাঁর দিকে অতিশয়োক্তির মাছি। গ্রাম থেকে শহরের আলো
ক্ষীণ হচ্ছে, তাহা, টের পাই;
শুধু এক নির্দয় পাথর এসে, প্রেমহীন যুবকের ভাষা নিয়ে, বসে আছে
হৃদয়ের জলপথে! যেনো শুধু আমাকেই, রৌদ্র লক্ষ্য করে, কাঠবিড়ালি তাকায়;
বানের উজান ডাকে; ঘুরপথে অসুখ-নিদান ডাকে, ক্রল করে; ঘাপটি মেরে থাকে
বিষন্ন হাসপাতাল, শিশুজন্মের ভোর!
স্রেফ আমি থাকতে এসেছি বলে, তাড়াহুড়া করছি বাংলা ভাষায়;
ছিমছাম নিচে, অনিদ্রা পাক খায়; ফুল থেকে ঝরে মানুষের হাসিখুশি
কারাজীবন পায়, আর তা ছিন্নভিন্ন করে যুদ্ধ-শতাব্দী।
গাছতলা, আয়োজন করে ডাকে, শ্যামল ঘুঙুরে;
মেঘলা পিয়ানো ডাকে, শ্রেণীসাম্যে, জাগছে পিটুইটারি;
মায়ের ভাষায় থাকতে যদি-বা পারি!
মন খারাপ ধ্বনি
প্রশ্নের দিকে ফিরে, জানালাটি খোলা পেয়ে
ঢুকেছিলো চাঁদনী-পসর, ঘরে!
প্রশ্নচিহ্নের লেজ থেকে
উঁকি দিচ্ছে তোমার 'মন খারাপ'-ধ্বনি!
এরকম বাঁচা, সমীচিন, বলো?
এতোসব প্রশ্নে দীর্ণ কূটনীতি, যাবজ্জীবন সাধনার ভার;
এরকম জড়সড় মুখ, মানায় তোমাকে?
স্বপ্ন আমার বন্ধুর নাম, কত দূর দূর গ্রাম থেকে, রোজ রোজ আসে;
সবুজ, সম্ভাবনাময়!
ঘোরানো সিঁড়িতে গানের গুঞ্জন শুনে
দ্বিধা ও প্রতিজ্ঞার মতো, আমাদের সমস্ত বাক্য
শুধুমাত্র স্বপ্ন কামনা করে; কে জানে, বৃষ্টি হবে নাকি!
ঝড় হবে এদিকে? চৈত্র ফুরালো হেসে, চোখের চারিপাশে।
অড়হর ক্ষেত, ফুঁড়ে আসে মেঘ-লাগা ধুলি।
চৌচির সব ক'টা জানালা সজোরে
সব ক'টা ঝাপটাকে, সয়ে নেয় বাতাসের, বিস্মৃতির!
করোনা এসেছে ভেসে
স্মৃতির ভিতর হতে জুঁইফুল, ন্যাড়া এক মাঠের ছবিতে বুক
ভরে নিয়ে এইদিকে আছে চেয়ে, হৃদয়ের মানে ধুকপুক;
নিস্তার বহিয়া যায়-
হাত নাই, ধুলা পাঞ্জায়!
করোনা এসেছে ভেসে
এইসবে মন রুজু, সেইদিন হতে!
দেখো ‘নিঝু’, মিহি ফুলেদের ক্ষত
ঘুমহীন চারদিক যেনো নফসের ব্রত
সমীহ ঝরালো দূরে! মায়ের গজল বাজে;
শোনো আর ভাবো, করোনাকাল, সংগত?
এই লেখকের অন্যান্য লেখা:
• পাণ্ডুলিপির কবিতা: ‘করোনা সিরিজ’ পর্ব এক | সাজ্জাদ সাঈফ
• সাজ্জাদ সাঈফের ‘ভাষার সি-বিচে’ হইতে দশটি কবিতা
• সাজ্জাদ সাঈফের কবিতাভাবনা, সাক্ষাৎকার ও ‘বহুদিন ব্যাকফুটে এসে’ বই থেকে কবিতা
সাজ্জাদ সাঈফ। কবি। জন্ম ১৯৮৪ সালে
যাত্রাবাড়ি, ঢাকা।
এসএসসি ও এইচএসসি ঢাকায় এবং শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়াতে। চিকিৎসা বিদ্যায় গ্রাজুয়েশন, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পাবলিক হেলথ বিভাগে পোস্ট গ্রাজুয়েশন (থিসিস পার্ট অন অ্যাডিকশন সাইকোসিস এন্ড ইটস ডিজিজ প্রোসেস ইভ্যালুয়েশন ইন এসপেক্ট অফ মেন্টাল হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার সেন্টারস ইন বগুড়া সদর এরিয়া)।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: ‘কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা’ (২০১৭), ‘মায়ার মলাট’ (২০১৯), ‘ভাষার সি-বিচে’ (২০১৯, ভারত), ‘বহুদিন ব্যাকফুটে এসে’ (২০২০)।
যাত্রাবাড়ি, ঢাকা।
এসএসসি ও এইচএসসি ঢাকায় এবং শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়াতে। চিকিৎসা বিদ্যায় গ্রাজুয়েশন, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পাবলিক হেলথ বিভাগে পোস্ট গ্রাজুয়েশন (থিসিস পার্ট অন অ্যাডিকশন সাইকোসিস এন্ড ইটস ডিজিজ প্রোসেস ইভ্যালুয়েশন ইন এসপেক্ট অফ মেন্টাল হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার সেন্টারস ইন বগুড়া সদর এরিয়া)।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: ‘কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা’ (২০১৭), ‘মায়ার মলাট’ (২০১৯), ‘ভাষার সি-বিচে’ (২০১৯, ভারত), ‘বহুদিন ব্যাকফুটে এসে’ (২০২০)।
0 মন্তব্যসমূহ
মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।