TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

পুতুলখেলা | ফয়জুল ইসলাম

প্রচ্ছদ: নাজমুল হোসাইন 

কলিকাতা এবং নোয়াখালিতে সংঘটিত জাতিগত দাঙ্গার সূত্র ধরে বিহারের ছাপড়া, সারান, মুঙ্গের এবং ভাগলপুরের পরে ১৯৪৬ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে পাটনা ও পূর্ণিয়া শহরও দাঙ্গার আশঙ্কায় কাঁপতে থাকবে। তখন আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে পড়বে পূর্ণিয়া জেলার অন্তর্গত রাণীনগরের মতো ছোট্ট একটা মফস্বল শহরের মানুষজন। এদিকে রাণীনগর নিবাসী মোহাম্মদ সুজার দ্বিতীয় পুত্র মোহাম্মদ সেলিম—পাটনা কলেজের ইন্টারমিডিয়েট পর্বের ছাত্র—আর সব তরুণের মতো করে পাটনার জাতিগত দাঙ্গায় অংশ নেবে; সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মানুষজনকে কতল করবে; এবং একসময় নিজেই কতল হয়ে যাবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে। সে খবর রাণীনগরে পৌঁছালে রাণীনগরবাসীদের আতঙ্ক আরও বৃদ্ধি পাবে। বড় ভাইয়ের মৃত্যুতে স্বভাবতই শোকে কাতর হয়ে পড়বে মোহাম্মদ সুজার তৃতীয় পুত্র, পূর্ণিয়া জেলা স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র, মোহাম্মদ দারা। তবু সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে তার স্বজনদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য মহল্লার মানুষজনদের সাথে মোহাম্মদ দারা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দিনের পরদিন মহল্লা পাহারা দেবে। তখন মৃত্যুর গভীর আতঙ্ক তার সামনে ঝুলে থাকবে সর্বদাই। রাণীনগরের নিকটবর্তী পূর্ণিয়া শহরে সংখ্যালঘিষ্ঠ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বার তিনেক খণ্ডযুদ্ধ হবে বটে। তা’তে আহতও হবে কেউ কেউ। কিন্তু মৃত্যু ঘটবে না কারোরই। তবে দৈবক্রমে পূর্ণিয়া শহর থেকে রাণীনগর এলাকায় জাতিগত দাঙ্গার আগুন আর ছড়িয়ে পড়বে না শেষপর্যন্ত। 
এ গল্পটা অবশ্য ভারতবর্ষে ঘটে যাওয়া রক্তক্ষয়ী দেশবিভাগ এবং তদ্সঙ্গে জড়িত জাতিগত দাঙ্গা নিয়ে নয়। দেশবিভাগ এবং জাতিগত দাঙ্গা এ গল্পটার নেপথ্যের একটা ঘটনা মাত্র কেননা রাণীনগরের মোহাম্মদ দারা ১৯৪৭ সালে পূর্ণিয়া জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করবে; দেশবিভাগের পরে সে পাটনা না-গিয়ে ভর্তি হবে কাছেপিঠের পূর্ণিয়া কলেজেই; ১৯৪৯ সালে সে কৃতিত্বের সাথে সমাপ্ত করবে ইন্টারমিডিয়েট পর্ব; তারপর সে তার পিতা-মাতা, ভাই-বোন এবং বন্ধুবান্ধব ফেলে বিহারের আরও অনেকের মতোই স্বেচ্ছায় পূর্ব পাকিস্তান নামের নতুন একটা ভূখণ্ডে ঘটাবে নিজের অভিবাসন; এবং সে ভর্তি হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শণ বিভাগে। মোহাম্মদ দারা এ গল্পের মূল চরিত্র নয় বটে কিন্তু যেহেতু সে লাডলি বেগমের পিতা হবে কাজেই তার সম্পর্কে এখানে আরও কিছু তথ্য দেয়া প্রয়োজন।   
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ওয়েস্ট হাউজের ১০৪ নম্বর রুম কালক্রমে মোহাম্মদ দারার নিজের জগত হয়ে উঠবে। একদা বিহারের দাঙ্গায় ঘটে যাওয়া তার বড় ভাইয়ের মৃত্যুর শোক সে একেবারেই সামলাতে পারবে না এবং সে ভুলতে পারবে না রাণীনগর থাকাকালীন দাঙ্গাজনিত আতঙ্কের অনুভূতিটাও। পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ার সুবিধের কারণে কোনও দাঙ্গায় পড়ে গিয়ে মৃত্যুর আশঙ্কা না-থাকলেও সারাটা ক্ষণ সে ভয়ে ভয়ে থাকবে—কখন কে তেড়ে এসে ছুরি বসিয়ে দেয় তার শরীরে! তা’ছাড়া জন্মভূমি ফেলে এসে সে পূর্ব পাকিস্তানকে নিজের দেশ ভাবতেও ব্যর্থ হবে এবং আশপাশের সমস্ত মানুষজনকে তার গভীর ষড়যন্ত্রকারী ও শত্রু ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। এতে করে মোহাম্মদ দারা ভেতরে ভেতরে খুব অস্থির হয়ে পড়বে। এসব  কারণে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের কারোর সাথেই তার কোনও ঘনিষ্ঠতাও তৈরি হবে না শেষপর্যন্ত। পরবর্তীকালে তার ঢাকাইয়া স্ত্রী’র দৌর্দণ্ড প্রতাপ সত্ত্বেও মোহাম্মদ দারা কিছুটা হলেও তার সেই আতঙ্ক এবং অস্থিরতা সঞ্চার করে ফেলবে তার নিজের সন্তানদের মনোজগতেও। তাই অনেক পরে মোহাম্মদ দারার কনিষ্ঠ কন্যা লাডলি বেগম কাতর হয়ে অনুরোধ করবে তার বদরাগী জামাইকে: তোমারে খুইলা কই—সবকিছুতেই না আমার খুব ডর লাগতে থাকে! প্লিজ আমার লগে তুমি কুনু দিন চিল্লাপাল্লা কইরও না! আমি কিন্তুক লইতে পারুম না সেই সব! আগের থেইকাই কইয়া রাখলাম তোমারে!   
মোহাম্মদ দারা সম্পর্কে আরও একটু বলে রাখা দরকার যে পূর্ব পাকিস্তানে অভিবাসিত হওয়ার অব্যবহিত পরে ঢাকা শহরে মোহাম্মদ দারার একটাই মাত্র পরিচিত পরিবার থাকবে। সূত্রাপুরের আলুপট্টি মহল্লার মাহাবুব আলির পরিবার সেটা।  ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের সময় এ পরিবারটা সম্পত্তি বিনিময় করে বিহারের কাটিহার থেকে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসবে। উল্লেখ্য, মাহাবুব আলি থাকবে মোহাম্মদ দারার পিতার ফুপাতো বোনের দেবর। মাহাবুব আলির আলুপট্টির বাসার পাশেই থাকবে লৌহজং থানার ফিরোজ মাহমুদের বাসা। সে বাসার ছাদে আনমনে হেঁটে বেড়াবে আর ঘুড্ডি কাটাকাটি দেখবে ফিরোজ মাহমুদের মেঝমেয়ে লায়লি বেগম (অর্থাৎ লাডলি বেগমের মা) যদিও তা কখনোই লক্ষ করবে না মোহাম্মদ দারা। ১৯৫৪ সালে জগন্নাথ কলেজের দর্শণ বিভাগে প্রভাষক-পদে চাকরি পাওয়ার পর পূর্ণিয়া জেলার রাণীনগরে তার পিতা-মাতা-ভাই-বোনদেরকে সে দেখতে যাবে প্রায় সাত বছর পর। রাণীনগর থেকে ফিরে এসে বিষণ্ণ মোহাম্মদ দারা এক দিন বিকেলে সিগারেট খাওয়ার জন্য মাহাবুব আলিদের আলুপট্টির বাসার ছাদে উঠবে। সে সময় মাহমুদসাবের বাসার ছাদে পায়চারিরত লায়লি বেগমকে মনে ধরবে তার। কিছু দিন পরেই মাহাবুব আলির মধ্যস্ততায় তার সাথে শুভপরিণয় ঘটবে লায়লি বেগমের। বিয়ের আগেই আগামসি লেনের মেস ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনা করবে মোহাম্মদ দারা এবং সে ভাড়া নেবে সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদের পশ্চিম-মহল্লার একমাত্র কাঠের দো’তলা বাসাটা (১০৬ নম্বর সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোড)। বিয়ের পরপরই সেই বাসাতে উঠে যাবে নবদম্পতি। কালক্রমে লায়লি বেগমের অবস্থাপন্ন পিতা ফিরোজ মাহমুদ নবদম্পতিকে সেই কাঠের দো’তলাটা কিনে দেবে। কাঠের দো’তলাতেই জন্ম হবে লায়লি বেগম এবং মোহাম্মদ দারার সন্তান—মোহাম্মদ শাহজাহান, মমতাজ বেগম, জাহানারা বেগম, মোহাম্মদ আলমগীর এবং লাডলি বেগমের (যাদের নামের সাথে ভারতবর্ষের মুঘল রাজপরিবারের সদস্যদের নামের যোগ থাকবে)। তার সন্তানদেরকে এক বার বিহারে বেড়াতেও নিয়ে যাবে মোহাম্মদ দারা। 
এ গল্পের বুননের জন্য এই কাঠের দো’তলাটা খুবই জরুরি কেননা এ বাসাতেই খেলতে আসবে মোহাম্মদ দারার প্রতিবেশী বালক-বয়সের মুনশি ফারুক আলি এবং তার সাথে পুতুল খেলতে তৎপর হবে তার চাইতে তিন বছরের ছোট লাডলি বেগম। ১৯৮৭ সালে যখন চব্বিশ বছরের মুনশি ফারুক আলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্স পর্বের ছাত্র এবং যখন লাডলি বেগমের বয়স একুশ তখনও আমরা লাডলি বেগমের ভেতরে পুতুলখেলার এই প্রবণতা লক্ষ করব।     
মুনশি ফারুক আলিদের পরিবার নিয়ে যদি কথা বলতে হয় তবে বলতে হবে যে বুড়িগঙ্গা নদীর দক্ষিণপারের কালিগঞ্জে থাকবে তাদের আদি বাড়ি। মুনশি ফারুক আলির পিতা মুনশি আমজাদ আলি সেগুনবাগিচার নারকোটিক্স ডিপার্টমেন্টে চাকরি করবে ইনসপেক্টর হিসেবে। সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদ সংলগ্ন এলাকার পুকুরটার দক্ষিণপারের ১১১ নম্বর বাসাটায় বসবাস করবে তারা। আর মোহাম্মদ দারার ১০৬ নম্বর বাসাটা থাকবে পুকুরের ঠিক পূর্ব দিকে। প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় মুনশি আমজাদ আলি আর মোহাম্মদ দারা আড্ডা দিতে দিতে হয় তাস না-হয় দাবা খেলবে মোহাম্মদ দারার কাঠের দো’তলার নিচতলায়। ভোরবেলাতে একসঙ্গে রমনাপার্কে হাঁটতে যাবে তারা দু’জন। ছুটির দিনগুলোতে তারা শান্তিনগর বাজারে যাবে একসঙ্গে এবং বড় আকারের সব মাছ যেমন, রুই, কাতল, পাঙ্গাস ইত্যাদি তারা ভাগেযোগে কিনে ফেলবে। সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদের পশ্চিম-মহল্লায় সর্বজনবিদিত হবে তাদের এই সখ্য। মহল্লার এ দু’টো পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও স্থাপিত হবে সুগভীর মানবিক যোগাযোগ। ফলে রান্নাবাটি খেলার সময় অন্যান্য বালিকারা তাদের নিজেদের পছন্দ প্রকাশ করার আগেই ঢ্যাঙা আর স্বাস্থ্যহীন বালিকা লাডলি বেগম তার চাইতে তিন বছরের বড় মুনশি ফারুক আলিকে প্রতিবারই বলবে: লও যাই মুনশি! শান্তিনগর থিকা বাজার কইরা নিয়া আসি গিয়া। রান্নাবান্না করতে হইব তো! তারপর তারা পুকুরপারে ঘুরে ঘুরে আগাছা সংগ্রহ তুলে আনবে শাকপাতা ভাজবে বলে; ইটের গুঁড়ো সংগ্রহ করবে আটার রুটি বানানোর জন্য; চাউল হিসেবে পিচ্চি পিচ্চি পাথর জোগাড় করবে তারা; তারা মাটিতে গর্ত করে চুলো বানাবে; লাকড়ি বানাবে বিভিন্ন গাছের ছোট ছোট সব ডাল দিয়ে।  চৈত্রসংক্রান্তির সময় সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ির সামনের মেলা থেকে কিনে আনা এনামেলের ছোট ছোট হাঁড়িকুড়িতে তারা রান্না করবে এবং মজা করে দুপুরের খানা খাবে দু’জনে মিলে। ফিডারে দুধ ভরে লাডলি বেগমের কাপড়ের পুতুলগুলোকেও খাওয়াবে তারা। রান্নাবান্না এবং বাচ্চাকাচ্চা সামলিয়ে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়বে লাডলি বেগম। হাই তুলতে তুলতে সে মুনশি ফারুক আলিকে বলবে: লও যাই মুনশি! শুইয়া শুইয়া ঘুমাইগা। তখন তারা পুতুলখেলার আর সব জোড়ের মতো করে কাঠের দো’তলার সামনের মাঠের ওপরে পাশাপাশি শুয়ে পড়বে। সবুজ, নরম ঘাসের ছোঁয়ায় তখন সত্যি সত্যি ঘুম পেয়ে যাবে বালক মুনশি ফারুক আলির। খেলার ফাঁকে কোনও এক দিন বালিকা লাডলি বেগমের কানে কানে বালক মুনশি ফারুক আলি বলবে: তুই বড় হইলে না আমি তরে বিয়া করুম! না-করিস না কিন্তুক! মুচকি হেসে নিজের প্রতিক্রিয়া জানাবে বালিকা লাডলি বেগম: আচ্ছা না-করুম না যাও! তয় আমার লগে তোমারে কিন্তুক পুতুল খেলতে হইব তহন! আর আমারে স্বর্ণের গয়নাগাটি দিতে হইব অনেকগুলা, আর বেনারসি শাড়ি! কোনও কিছু না-ভেবেই বালক মুনশি ফারুক আলি তখন উত্তর দেবে: যা চাইবি তাইই দিমুনে!    
কিন্তু বাল্যকাল শেষ হয়ে গেলে পরে বালক-বালিকাদের আর পুতুল-পুতুল, দারিয়াবান্ধা, সাতচাড়া অথবা গোল্লাছুট খেলা হয় না, এক্ষেত্রেও তা আর হবে না। কৈশোরে এসে শীতকালের দিনগুলোতে মাঝে মাঝে তারা ১১১ সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডের মস্ত বড় মাঠটায় এক সাথে ব্যাডমিন্টন খেলবে মাত্র। তখন একটু একটু করে গায়েগতরে বাড়তে থাকবে ঢ্যাঙা আর স্বাস্থ্যহীন লাডলি বেগম এবং সে এক জন অপরূপ কিশোরীতে পরিণত হবে জলদিই। ফ্রক ছেড়ে তাকে পরতে হবে সালোয়ার-কামিজ-ওড়না। কাজেই সে ক্রমশ আবদ্ধ হয়ে পড়বে তাদের কাঠের দো’তলার অন্তঃপুরে। সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের মাঠে ফুটবল এবং ক্রিকেটখেলা নিয়ে তখন মেতে থাকবে কিশোর মুনশি ফারুক আলি। স্কুলের সূত্রে তার বন্ধুবৃত্তের আকার বাড়তে থাকবে ক্রমশ। তা’ছাড়া সে তার আর সকল বন্ধুদের মতো প্রেম করার ধান্ধায় মালিবাগ, মগবাজার, শান্তিনগর এবং শাহজাহানপুর এলাকাগুলোর মেয়েদের পেছনে অবিরত ঘুরতে থাকবে। মেয়েদের পেছনে বেকার ঘুরতে ঘুরতে তখন অন্তর্হিত হয়ে যাবে মুনশি ফারুক আলিদের বাল্যকালের বিভিন্ন স্মৃতি। 
সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদের পশ্চিম-মহল্লার কাঠের দো’তলা নিয়ে পরবর্তী গল্প বলার আগে আমরা আরও কিছু কথা স্মরণ করতে চাই। যেমন, ১৯৮০ সালে লাডলি বেগম সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে ক্লাস এইটে পড়বে। ঢাকা কলেজ আর নটরডেম কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ঢুকতে না-পেরে লক্ষ্মীবাজারের কবি নজরুল কলেজে পড়তে যাবে আশাহত মুনশি ফারুক আলি। কবি নজরুল কলেজে পড়ার সুবাদে পুরান ঢাকায় মুনশি ফারুক আলির নতুন নতুন বন্ধু জুটবে অনেক এবং সে কারণে সংকুচিত হয়ে যেতে থাকবে সিদ্ধেশ্বরী, মালিবাগ, মগবাজার, শান্তিনগর এবং শাহজাহানপুর এলাকার তার প্রথাগত আড্ডাগুলো। তা’ছাড়া লক্ষ্মীবাজার এলাকাতেই সে বিকেল আর সন্ধ্যেবেলায় ফিজিক্স, কেমেস্ট্রি এবং ম্যাথমেটিক্স-এর কোচিংক্লাস করতে শুরু করবে। সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে লক্ষ্মীবাজার অনেক দূরে বিধায় দুপুরের ক্লাস শেষ হলে পরে সে আর খাওয়ার জন্য নিজেদের বাসাতে ফিরে যেতে পারবে না। উপায়ান্তর না-দেখে কলেজের আশপাশের রেস্টুরেন্টগুলো থেকেই সে তখন খেয়ে নেবে সিঙ্গারা বা ডাইলপুরি। কোচিং শেষ করে সহপাঠীদের সাথে সে একটু আড্ডাও দেবে। তারপর বাসে চেপে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ন’টা বেজে যাবে তার। ততক্ষণে সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুল মাঠের আড্ডাটা যথারীতি ভেঙে যেতে শুরু করবে। এভাবে বাল্যবন্ধুদের সাথে তার খুব একটা দেখা হবে না তখন। 
এদিকে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের সহপাঠীদের কাছ থেকে ধার করে গোগ্রাসে রোমেনা আফাজ-এর ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজের বই পড়তে শুরু করবে ক্লাস সেভেনের ছাত্রি লাডলি বেগম। পড়াশোনার প্রতি লাডলি বেগমের অমনোযোগ ধরা পড়ে যাবে অচিরেই এবং তার মা’র সঙ্গানুযায়ী ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজের বইগুলো বড়দের জন্য লেখা বিধায় সে তার মা’র হাতে পিটানিও খাবে বিস্তর। ‘দস্যু বনহুর’ পড়া ব্যহত হলে সে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর ‘দেবদাস’ এবং নিমাই ভট্টাচার্য-এর ‘মেমসাহেব’ সহ বিভিন্ন জনপ্রিয় বই বাসায় নিয়ে আসতে শুরু করবে। লুকিয়ে লুকিয়ে সে পড়েও ফেলতে থাকবে বইগুলো। সে যে পাঠ্যবই নিয়ে পড়তে বসবে না একেবারেই—তেমনটা নয় মোটেই। কিন্তু পড়াশোনাতে তার মনোযোগ সংকুচিত হয়ে যাবে ভয়ঙ্করভাবে এবং সে কারণে ক্লাস সেভেনের সমাপণী পরীক্ষায় সে অঙ্ক আর ইংরেজির মতো জরুরি দু’টো বিষয়ে ফেল করে বসবে। এমন একটা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে সেই ১৯৮০ সালে তৎপর হয়ে উঠবে লাডলি বেগমের মা। মাগ্না থাকাখাওয়া ও পকেটমানির চুক্তিতে তখন লাডলি বেগমের গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হবে লাডলি বেগমের মা’র কাপাসিয়াস্থ দূর-সম্পর্কের এক আত্মীয়ের পুত্রসন্তানকে। এই গৃহশক্ষককেই আমরা পরবর্তীতে আলতাফ হোসেন নামে চিনব। সেই মুহূর্তে জগন্নাথ কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আলতাফ হোসেন পাটুয়াটুলি মসজিদ সংলগ্ন একটা মেসে ভাড়া থাকবে। গৃহশিক্ষকের চাকরি পাওয়াতে তার খুব স্বস্তি লাগবে এই ভেবে যে সে এবার একাকী নিরুপদ্রবে থাকতে পারবে—তিন জন বোর্ডারের সাথে তাকে আর ছোট্ট একটা মেসঘর ভাগ করে নিতে হবে না এবং পাকসাক নিয়েও তাকে দুঃশ্চিন্তা করতে হবে না আর। কাজে কাজেই কালবিলম্ব না-করে ১০৬ নম্বর সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোড-এর বাসাটাতে উঠে পড়বে কাপাসিয়ার আলতাফ হোসেন। তাকে থাকতে দেয়া হবে কাঠের দো’তলার পেছন দিকে যে গুদামঘর থাকবে তার লাগোয়া মাঝারি আকারের ঘরটায়। মা’র চাপাচাপির কারণে প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলায় সেই ঘরটাতেই বই-খাতা হাতে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে ঢুকতে বাধ্য হবে ক্লাস এইটের ছাত্রী লাডলি বেগম।  
তারপর আমরা দেখব, ক্লাস এইট শেষ করার আগেই মুনশি ফারুক আলির বাল্যবন্ধু লাডলি বেগম তার গৃহশিক্ষক আলতাফ হোসেনের হাত ধরে ভেগে যাবে কোথাও। চৌদ্দ বছরের নাবালিকাকে ঢাকা শহরের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না কেননা ততক্ষণে সে আর আলতাফ হোসেন মাধবদির এক কাজি-অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলবে এবং নবদম্পতি লুকিয়ে থাকবে মনোহরদি এলাকায় আলতাফ হোসেনদের জনৈক আত্মীয়ের বাসায়। লাডলি বেগমের বড় ভাই ঢাকাস্থ ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির ছাত্র মোহাম্মদ শাহজাহান তার কাপাসিয়ার বন্ধুদের মারফত নবদম্পতির খবর সংগ্রহ করবে এবং লাডলি বেগম পালিয়ে যাওয়ার দিন বিশেক পর সে গিয়ে হাজির হবে নবদম্পতির গোপন আস্তানায়। লাডলি বেগম তখন তার বড় ভাইকে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে জানাবে: আমি নিজের ইচ্ছায় হের লগে বাইর হইছি। আমরা বিয়া কইরাও ফালাইছি। কেসকুস করলেও আমি হেরে ছাইড়া যামু না, কইলাম। ছোট বোনের একাগ্রতা এবং সংকল্প দেখে মোহাম্মদ শাহজাহান ভাববে: টাইম নিয়া দেখি যে হেয় মত বদল করে কিনা! মোহাম্মদ শাহজাহান ঢাকায় ফিরে তাদের মা লাইলি বেগমকে এসব  কথা জানালে লাইলি বেগম হুঙ্কার দিয়ে উঠবে: তা হইলে বন্দুক ল! আলুপট্টিতে গিয়া আহমেদ জানরে খবর দে (নবাবপুরের ইলেকট্রিক ফিটিংসের ব্যবসায়ী আহমেদ জান তাদের ছোট মামা যে কিনা সূত্রাপুর এলাকার এক জন ডাকসেটে মস্তান হিসেবে সুপরিচিত থাকবে তখন)। নিমকহারাম আলতাইফ্যারে আমি গুলি কইরা মাইরা ফালামু! লাডলিরে আমি ভালা পোলা দেইখা শাদি করামু আবার। ভাইগা গিয়া কাজি-অফিসে শাদি করছে! বাপ-মা’য়ে জানল না হের কিছু! এইডা কুন কিসিমের শাদি হইল? মান-সম্মান সব বুড়িগঙ্গায় ডুইবা গেল আমার!
নিরন্তর সিগারেট টানতে টানতে বিমর্ষ মোহাম্মদ দারা তখন তার স্ত্রী লাইলি বেগমকে বোঝাবে: লাডলি তো গলতি কিয়া। ও তুমহারা বিটিয়া হ্যায়। উসকো মাফ কার দো না! কেয়া ফায়দা মামলা করনেকা? খুনখারাবি করনেকা? বাস কর! আগার বুড়া হো যায়ে তো গুড়িয়াকো? তখন লাইলি বেগম তার স্বামীর আজীবনের কাপুরষতার দিকে পুণর্বার অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলবে: কীল্লিগা যে সুন্দর একখান খোমা দেইখা এই হালার বিহারির লগে বিয়া বইতে গেছিলাম! হারাডা জনম খালি ডরে কাঁপতে থাকল! মুইতা দিল টিকটিকি দেইখা! স্বামীকে তিরস্কার করার পরে জেদ ধরবে লাইলি বেগম: ঠিক হ্যায়! কেসকুস কিচ্ছু হইব না, খুনখারাবিভি হইব না। তয় লাডলি আর এই বাইড়তে ঢুকার পারব না, কইলাম! লাডলি বেগম অবশ্য তার মা’র সাথে পাল্টা জেদ ধরবে না কিছুতেই। বরং সে নানাজনের মাধ্যমে তার মা’র কাছে তার নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমাই চাইবে বারংবার। তবে ১৯৮৬ সালে আন্ত্রিক ক্যান্সারে তার পিতা মোহাম্মদ দারার মত্যুর আগপর্যন্ত সে আর কাঠের দো’তলায় ঢোকার অনুমতি পাবে না। ছ’বছর পরে সে যখন তার মালিবাগ চৌধুরিপাড়ার বাসা থেকে ফের কাঠের দো’তলায় পা রাখবে তখন তার বয়স হবে কুড়ি এবং তার কোলে থাকবে পাঁচ বছরের পুত্রসন্তান।  
এক্ষণে স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৮৪ সালে ফকিরাপুলের একটা শিপিংলাইনে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেবে লাডলি বেগমের ডিগ্রি পাশ দেয়া জামাই আলতাফ হোসেন। মালিবাগ চৌধুরিপাড়ায় সে দু’রুমের একটা বাসা ভাড়া নেবে এবং কাপাসিয়া থেকে তার পরিবার নিয়ে এসে সে উঠে পড়বে নতুন বাসাটায়। স্বল্প বেতনের কারণে স্বভাবতই তাদের সংসারের নিয়মই হবে আর্থিক অনটন। এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন তুল্লেই লাডলি বেগমের ওপরে ক্ষিপ্ত হয়ে যাবে আলতাফ হোসেন। সে প্রায়শই চিৎকার দিয়ে উঠবে এভাবে: এর বেশি আর পারতাম না আমি! সংসার চালাইতে তুমার যুদি এতই অসুবিধা হয় তা হইলে তোমাগো সিদ্ধেশ^ীরর কাঠের দুই তলা বেইচা ট্যাকা নিয়া আস গিয়া! লাডলি বেগম তখন আবারও তার জামাইকে অনুরোধ করবে: তুমি আর চিল্লাউল্লা কইরো না প্লিজ! আমার ডর লাগতাছে কইলাম! তারপরের দিনগুলোতে প্রায়শই মধ্যরাতে বাড়িতে ফিরতে থাকবে আলতাফ হোসেন; সে দারু খাবে অল্পবিস্তর; দাপ্তরিক ট্যুরে চট্টগ্রাম শহরে যেতে থাকবে ঘন ঘন; এবং স্ত্রী’র সাথে তার খেচরমেচরের মাত্রাটা বৃদ্ধি পাবে আরও। লাডলি বেগম হাত জোড় করে বারবার তার জামাইকে বলবে: তুমি থাম! তুমার লাল চক্ষু দেইখা আমার ডর করতাছে! 
কালক্রমে ১৯৮৬ সালে লাডলি বেগম জানতে পারবে যে তার জামাই আলতাফ হোসেন মোসলেমা নামের এক জন মেয়ের সাথে অনেক দিন ধরেই সম্পর্কে জড়িত। লাডলি বেগমের জামাইয়ের জনৈক সহকর্মীর শ্যালিকা থাকবে এই মোসলেমা খাতুন। মোসলেমাদের বাসা থাকবে কুড়িলের কাজিবাড়ি মসজিদের আশপাশে কোথাও। জামাইয়ের জীবনে দ্বিতীয় নারীর উপস্থিতি কিছুতেই মেনে নেবে না লাডলি বেগম। ঘটনাটা জানার পর তাই তীব্র প্রতিবাদ জানাবে সে। তবে মোসলেমার সাথে সম্পর্কের ব্যাপারটা কিছুতেই স্বীকার যাবে না আলতাফ হোসেন। লাগাতার চার দিন ধরে চলতে থাকবে তাদের দু’জনের ঝগড়াঝাটি। তখন জীবনে প্রথম লাডলি বেগমের গায়ে হাত তুলবে তার স্বামী। রক্তাক্ত, আহত লাডলি বেগম তার জামাইকে বারবার অনুরোধ করতে থাকবে: তুমি আমারে আর মাইরো না! আমার খুব ডর লাগতাছে! লাডলি বেগমের অনুরোধ উপেক্ষা করে আলতাফ হোসেন তাকে চড়-ঘুষি মেরেই চলবে এবং সে বলতে থাকবে একই কথা: সে নিজের পছন্দ মতো চলবে। তাকে কিছুই বলতে পারবে না লাডলি বেগম। আর এ নিয়ে লাডলি বেগম যদি ঝামেলা করে তা’হলে সে অবশ্যই তালাক দেবে লাডলি বেগমকে। এ কথা শোনার পর চুপ করে যাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় লাডলি বেগম। কথায় কথায় শারীরিক অত্যাচার এবং অস্বস্তিকর পরিবেশের ভেতরে পড়ে গিয়ে খাবি খেতে খেতে দিন চালাতে থাকবে সে। যেহেতু সন্তান উৎপাদনের জন্য স্বামী  বা স্ত্রী’র মাঝের প্রেম মোটেই আবশ্যকীয় নয় কাজেই এমন একটা দুঃসহ অবস্থাতে না-চাইলেও দ্বিতীয় বারের মতো গর্ভধারণ করে বসবে লাডলি বেগম। একুশ বছর বয়সী মেয়েটা যখন গর্ভবতী তখনও তার ওপরে তার স্বামীর শারীরিক অত্যাচার থামবে না মোটেই। এক সময় এক জন কন্যাসন্তানের জন্ম দেবে হতাশ ও বিষণ্ণ লাডলি বেগম।   
লাডলি বেগমকে তার জামাই আর পুছে না উপরন্তু শারীরিক নির্যাতন করে—এ খবরটা অবশ্য বেশি দিন চাপা থাকবে না। লাডলি বেগমের পিঠোপিঠি ভাই মোহাম্মদ আলমগীরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আসাদুন্নবী মালিবাগ চৌধুরিপাড়ারই মানুষ থাকবে (মোহাম্মদ আলমগীর এবং আসাদুন্নবী একদা আবু জর গিফারি কলেজে এক সাথে ডিগ্রি ক্লাসে পড়েছিল)। সেই আসাদুন্নবী এক দিন তাদের চৌধুরিপাড়া মহল্লার কোনও এক দোকানে ওষুধ কিনতে গেলে তার সাথে কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে যাবে লাডলি বেগমের। তখন ফোলা ফোলা থাকবে লাডলি বেগমের আহত চোখ-মুখ। তার কপালে এবং ডান চোখের নিচে জখমের রক্তাভ চিহ্নগুলোও পরিষ্কার দেখা যাবে। আসাদুন্নবীর সামনে পড়ে গিয়ে লাডলি বেগম প্যারাসিটমিল এবং স্যাভলনের বোতল লুকোতে ব্যস্ত হয় পড়বে। ব্যাপারটা চোখ এড়াবে না আসাদুন্নবীর। লাডলি বেগমকে তার জামাই পিটিয়েছে—এমনটাই সন্দেহ করবে আসাদুন্নবী (যেহেতু সে নিজেই তার বউকে ধরে পেটায় তাই মারপিটের চিহ্ন বুঝতে পারাটা তার জন্য কঠিন হবে না!)। তবে অস্বস্তির কারণে আসাদুন্নবী তার বন্ধুর ছোট বোনকে কিছুই জিজ্ঞাসা করবে না সেই মুহূর্তে। লাডলি বেগমের সাথে সে কেবল কুশল বিনিময় করে ওষুধ কিনে দোকান থেকে চলে যাবে। 
সেদিনই সন্ধ্যেবেলায় মৌচাক মার্কেটে মোহাম্মদ আলমগীরের কনফেকশনারিতে যাবে আসাদুন্নবী এবং গম্ভীর মুখে সে মোহাম্মদ আলমগীরকে জিজ্ঞাসা করবে: লাডলি রিকশা থিকা পইড়া টইড়া গেছিল নেকি? হের চোখ-মুখে জখম দেখলাম কেন? জানস কিছু? মোহাম্মদ আলমগীর তখন হিসেব মিলিয়ে দেখতে পাবে যে গেল প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে তার ছোট বোন লাডলি বেগম সিদ্ধেশ্বরীতে তাদের বাসায় এক বারের জন্যেও বেড়াতে আসেনি। মা’র সাথে সম্পর্ক সহজীকরণের পর থেকে প্রতিসপ্তাহে অন্তত এক বার সিদ্ধেশ্বরীতে এসে ঘুরে যেত লাডলি বেগম। এই ধাঁধাঁর কোনও সমাধান করতে না-পেরে ব্যাপারটা নিজের মা লাইলি বেগমকে খুলে বলবে মোহাম্মদ আলমগীর। 
‘কী কত ক্ষণ ধইরা মিউ মিউ করবার লাগছস! তোগো দিয়া কুনু কাম হইব না!—এই বলে সাথে সাথেই লাইলি বেগম ফোন করবে তার ছোট ভাই আলুপট্টির আহমেদ জানকে। আহমেদ জান তার লড়াকু ভাইগ্না-ভাতিজাদের নিয়ে মালিবাগ চৌধুরিপাড়ায় লাডলি বেগমের বাসায় হামলা করবে তখন তখনই। লাডলি বেগমের জামাই আলতাফ হোসেনের বুকে পিস্তল ধরে রেখে লাডলি বেগমকে জিজ্ঞাসা করবে তার ছোট মামা আহমেদ জান: ঠিক কিইরা ক, তর জামাই তর গায়ে হাত তুলছে নিহি! মাথা নিচু করে তখন চুপ করে থাকবে লাডলি বেগম। লাডলি বেগমের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে তার ছোট মামা বলবে: পনের মিনিটের ভিতরে জরুরি মালসামানা গুছাইয়া নিচে গিয়া গাড়িতে উঠবি! বুঝছস? তার ছোট মামার ক্রোধ দেখে লাডলি বেগম ডরে কাঁপতে থাকবে এবং সে মালসামানা কিছুই আর গুছিয়ে উঠতে পারবে না। তখন তার ভাই-বেরাদারদের কেউ এক জন পুরনো একটা বড় স্যুটকেস আবিষ্কার করে তার ভেতরে ঠেসে ঠেসে ঢোকাবে সামনে যা পায়। দশ মিনিটের ভেতরেই তারা লাডলি বেগম আর তার দুই সন্তানকে নিয়ে মাইক্রোবাসে উঠে মালিবাগ চৌধুরিপাড়া থেকে সিদ্ধেশ্বরীর দিকে রওয়ানা দেবে। সিদ্ধেশ্বরীতে পৌঁছাতে পনের মিনিটও লাগবে না তাদের। তারপর লাডলি বেগমের অনুপস্থিতিতে তার স্বামীকে বেধরক পেটাবে তার বড় খালাম্মার সেঝ ছেলে এবং তার ছোট মামা।  
১৯৮৭ সালের ডিসম্বের মাসে পাষণ্ড স্বামীর হাত থেকে একুশ বছর বয়সী লাডলি বেগমকে উদ্ধার করার পরে এ গল্পটা বিবাহবিচ্ছেদ দিয়ে শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু তা’তে বাঁধ সাধবে লাডলি বেগম স্বয়ং। সে তার জ্ঞাতিগোষ্ঠিকে বলবে: আর কয়ডা দিন দেহি যে হ্যায় শুধরায় কিনা! লাডলি বেগমের মা ক্ষিপ্ত হয়ে যাবে সে কথা শুনে এবং সে তার মেয়েকে প্রশ্ন করবে: দুই বচ্ছর ধইরা তো তুমি দেখলা আর বইসা বইসা মাইর খাইলা জামাইয়ের হাতে! আমগো গুষ্টির ভিতরে এইসব ইজ্জত যাওনের কাম হয় নাই কুনু দিন! আর কী দেখবার চাও তুমি? পারছিলা জামাইরে টাইট দিতে? পার নাই। অহন আবার তুমার জুবানে এত কথা আহে কই থিকা? অবশ্য সেসব প্রশ্নের কোনও উত্তর করবে না লাডলি বেগম। এদিকে পুরো পরিস্থিতির ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে লাডলি বেগমের ছোট মামা আহমেদ জান। সে তার ভাগ্নিকে জানিয়ে যাবে: তরে তিন মাস টাইম দিলাম। হয় তুই ডিভোর্স লবি না-হইলে জিন্দেগিতে তুই আমগোরে তর চেহারামুবারক দেখাইতে আবি না! 
তারপর সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদের পশ্চিম-মহল্লায় নিজের পিত্রালয়েই থেকে যাবে লাডলি বেগম। তার মা লায়লি বেগম তখন আলুপট্টির একটা দোকান থেকে ভাড়া তুলে খাবে যথারীতি। তার বড় ভাই তখন বান্ধা বেতনের সরকারি চাকরি করবে। মা’র পুঞ্জি ভাঙিয়ে মৌচাক মার্কেটের একটা চালু কনফেকশনারির দোকান কিনে কেক-পেস্ট্রির বিক্রিবাটা চালিয়ে যাবে লাডলি বেগমের ছোট ভাই। মা আর দু’ভাইয়ের মিলিত উদ্যোগের ফলে তাই লাডলি বেগম আর তার দুই সন্তানের চলতে এক ফোঁটাও অসুবিধে হবে না।
লাডলি বেগমের বদনসিব নিয়ে তখন সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদের পশ্চিম-মহল্লার মানুষজনের ভেতরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। কেউ বলবে: যে জামাই হালায় জেনা করে তারে বন্দুক দিয়া শ্যুট কইরা মাইরা ফালানো উচিত! কেউবা শঙ্কিত হয়ে বলবে: তা বুঝলাম। কিন্তুক দুই বাচ্চা লইয়া মোহাম্মদ দারার মাইয়াডা যাইবটা কই? ট্যাকাপয়সাই তো আর সব না! বাপ ছাড়া হেয় দুই বাচ্চা মানুষ করব কেমনে? লাডলি বেগমের বদনসিবের কথাটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্স পর্বের ছাত্র মুনশি ফারুক আলির কানেও যাবে। বাল্যবন্ধু লাডলি বেগমের ওপরে দীর্ঘ দিন ধরে বিরক্তি পুষে রাখা মুনশি ফারুক আলি ভাববে: খুব তো লেঙ্গুর তুইলা ভাইগা গেছিলিগা আলতাইফ্যার লগে! অহন তুই বুঝ গিয়া যে তুই তর পেয়ারের জামাই লয়া কী করবি! তর জামাই পিটায়া তর হাত-পা ভাইঙ্গা দিলে আমার কী যাইব-আসব?  
তারপর ১৯৮৮ সালের জানুয়ারি মাসের কোনও এক শুক্রবার সকালে লাডলি বেগম মুনশি ফারুক আলিদের ১১১ নম্বর সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডের বাসাটাতে বেড়াতে যাবে। এক পর্যায়ে যখন মুনশি ফারুক আলির ঘরে ঢুকে তার ঘুম ভাঙাবে তার বাল্যবন্ধু লাডলি বেগম তখন বিস্মিতই হবে মুনশি ফারুক আলি। লেপের ভেতর থেকে বের হয়ে সে লাডলি বেগমকে বলবে: আট বচ্ছর পর তর লগে দেখা হইল! ভাবতে পারস তুই? ত্ইু ব। আমি মুখ ধুইয়া আসি গিয়া। অতঃপর দাঁত ব্রাশ করে, মুখেচোখে পানি দিয়ে ঘরে ফিরবে মুনশি ফারুক আলি। ঘরে ঢুকে সে দেখতে পাবে, তার বিছানায় পা তুলে বসে একটা প্লেটে পারাঠা আর বুটের ডাউল নিয়ে নাশতা করছে লাডলি বেগম আর সে মুনশি ফারুক আলির মা’র সাথে গল্প করছে এন্তার। পড়ার টেবিলের চেয়ারে বসে নাশত করতে করতে সেসব এলেবেলে গল্প শুনতে থাকবে মুনশি ফারুক আলি এবং লাডলি বেগমের ওপরে তার পুঞ্জীভূত রাগটা ক্রমশ পানি হয়ে যেতে থাকবে। এক সময়ে একুশ বছর বয়সী লাডলি বেগমের দিকে ভাল করে তাকালে লম্বা আর ছিপছিপে গড়নের সুন্দর মেয়েটার দুধ-সাদা রঙের ত্বক ঝলসে উঠবে সেই বালক-বয়সের মতো করেই। সূর্যের আলো পড়ে তেমনই চিকচিক করতে থাকবে তার নরম, বাদামি চুল। কিন্তু তার আয়ত চোখের বাদামি মণিটা আর উচ্ছ¡সিত হবে না আগের মতো। তখন বাল্যবন্ধু লাডলি বেগমকে নিয়ে ভয়ানক দুশ্চিন্তিত হয়ে পড়বে মুনশি ফারুক আলি। তাই স্নায়বিক চাপের বশে ধাম করে সে একটা প্রশ্ন করে বসবে লাডলি বেগমকে: তা হইলে তুই কী করবি অহন? 
এমন প্রশ্নের সাথে সাথেই চেহারাতে প্রভ‚ত অস্বস্তি নিয়ে সেখান থেকে উঠে যাবে মুনশি ফারুক আলির মা। তারপর বাল্যকালের দুই বন্ধুর ভেতরে নিম্নোক্ত কথোপোকথন সংগঠিত হবে:    
মুনশি ফারুক আলি: একটা কিছু তো করন লাগব লাডলি! যা হইছে, হইছে! তর জামাইয়ের কাছে ফিরত যাইবি নেকি? 
লাডলি বেগম (হতাশা নিয়ে): জানি না মুনশি! 
মুনশি ফারুক আলি (বিরক্ত হয়ে): তুই না জানলে জানবডা কেডা?
লাডলি বেগম (হতাশা নিয়ে): জানি না! 
মুনশি ফারুক আলি (জলদি একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার তাগিদে): তুই তর জামাইরে আর ভালবাসস না—তাই না রে লাডলি? 
লাডলি বেগম (হতাশা নিয়ে): জানি না! 
মুনশি ফারুক আলি: আচ্ছা, ঠিক আছে! আমারে এই সব কইতে হইব না তর। তুই খালি একখান পুরানা কথা কয়া যা আমারে—হেই আট বচ্ছর আগে ব্যাঙ্গের লাহান চিহারার আলতাইফ্যার প্রেমে পড়তে গেছিলি কোন দুঃখে? মহল্লায় কি আর কুনু পোলা আছিল না? হারুইন্যারে মনে আছে না তর? সবুজ রঙ্গের চোখ আছিল হের? তর পিছে পিছে ঘুরত? হারুইন্যা অহন আমেরিকায় থাহে। আর কাউওে না-হোক, তারে তো পাত্তা দিতে পারতি তুই! 
লাডলি বেগম (একটু চুপ থেকে, দাঁতে নখ কাটতে কাটতে): আমার তো কেলাশের পড়া পড়তে ইচ্ছা হইত না। তাই আলতাফের লগে আমি পুতুল লয়া খেলতে লইছিলাম। আমি অনেকগুলা কাপড়ের পুতুল বানাইছিলাম; পুতুলগুলারে জামাকাপড় পরাইছিলাম—মনে আছে না তুমার? 
মুনশি ফারুক আলি (বিস্মিত হয়ে): মাইনে? এইডা কী কস তুই? চোদ্দ বচ্ছর বয়সের পোলাপাইনেরা আবার পুতুল দিয়া খেলে নেকি? 
লাডলি বেগম (কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে): কেন? পুতুল খেল্লে কি ইজ্জত যাইব নেকি? 
মুনশি ফারুক আলি (বিব্রত হয়ে; মূল প্রশ্নের কোনও উত্তর না-দিয়েই): আচ্ছা ঠিক আছে! আলতাইফ্যার লগে পুতুল খেলছস, ভালা করছস। কিন্তু বাসার হগ্গলরে দাগা দিয়া ভাইগা গেলি কী করতে তুই? ভাইগা যাওনডা কী ভালা কাম হইছিল? বাপ-মা’র কথা ভাবলি না তুই? ইজ্জত যাওনের কথা বাদ দে তুই! তারা কানতে কানতে হয়রান হয়া গেছিলগা! 
লাডলি বেগম (মাথা নিচু করে, বেশ খানিকটা চুপ থেকে): পুতুল খেলতে খেলতে পেঁচায়া গেছিলামগা আমি। ছুটনের কুনু রাস্তাই আর আছিল না! তুমি এইসব বুঝবা না মুনশি! 
এর পর প্রচণ্ড বিবমিষা জাগবে মুনশি ফারুক আলির মনে এবং সে চিৎকার দিয়ে বলে উঠবে: তোমারে পেঁচায়া যাইতে কইছিল কেডা? অহন দেহ, দুই দুইডা বাচ্চা লইয়া কেমুন ফ্যাসাদে পড়ছ? পড়শুনাডাও তো আর করলা না তুমি! তা হইলে তো বুকে বলডা পাইতা! তর মতন ফাজিলের চিহারা দেখতে চাই না আমি! লাডলি বেগমের সাথে আর কোনও কথা না-বলে তখন মুনশি ফারুক আলি গায়ে জামা চাপিয়ে দুরদার করে ঘর থেকে বরিয়ে যাবে। নিশ্চুপ লাডলি বেগম তার পথরোধ করবে না।   
দু’দিন পরের সকালে মুনশি ফারুক আলির উত্তেজনা কমে আসবে এবং তার মনে হবে—খামাখা লাডলির লগে ক্যাচাল কইরা লাভ নাই! যা হইছে, হইছে! অরে অহন সাহস দেওন দরকার! তাই নির্ঘুম চোখ আর প্রচণ্ড মাথা ধরা নিয়ে দীর্ঘ আট বছর পর মুনশি ফারুক আলি পায়ে পায়ে ১০৬ নম্বরের কাঠের দো’তলায় যাবে। তখন বাসার ভেতরের দালানের একটা ঘরের বিছানায় বসে লাডলি বেগমের দুই বাচ্চা নিয়ে বসে থাকবে লাডলি বেগমের মা লায়লি বেগম। মুনশি ফারুক আলিকে দেখে খুব খুশি হয়ে লায়লি বেগম বলবে: আমগো কথা তাইলে তর মনে হইল ফারুইক্যা? কত্ত দিন আসস না তুই! 
অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর করবে মুনশি ফারুক আলি: ভার্সিটির কিলাশ করা নিয়া ব্যস্ত থাকি চাচি আম্মা! 
চাচি আম্মার বাড়তি জেরা থেকে বাঁচার জন্য তাড়াতাড়ি সে ঘরটা থেকে বের হয়ে যাবে তখন। বারান্দার মোড়ায় চুপচাপ বসে থাকা তার বাল্যবন্ধু লাডলি বেগম তাকে বলবে: চিহারার যে হাল হইছে না তুমার! ঘুমটুম যে হয় নাই—তা তো বুঝাই যাইতেছে! ইকটু চা কইরা দেই, খাও। ভাল লাগব। 
এই বলে মুনশি ফারুক আলিকে তাদের রান্নাঘরে নিয়ে যাবে লাডলি বেগম। চা বানাতে বানাতে দরজায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা মুনশি ফারুক আলিকে উদ্দেশ্য করে হাসতে হাসতে সে বলবে: তুমি কিন্তুক ভাল টাইমেই আসছ মুনশি! আমি তো শান্তিনগর বাজারে যাইতে লইছিলাম। বাজার-সদাই না-কইরা দিয়াই দুই ভাইয়ে আইজ কামে চইলা গেছেগা। ফিরিজে কিচ্ছু নাই। বাড়ির দুই বউয়ে মিল্লা গেছে নিউ মার্কেটে ডেরেস কিনতে। তাদেরে তো আর আনাজপাতি কিননের কথা কওন যায় না! তুমি চা খায়া বাজারটা কইরা দিয়া যাও। অসুবিধে হইব তুমার?
তা’তে সহজেই সম্মত হবে মুনশি ফারুক আলি। তারপর সে লাডলি বেগমদের রান্নাঘরের সিঁড়িতে বসবে অনেক দিন পর এবং রাত্রি জাগরণ হেতু মাথা ধরা দূর করার জন্য সে আরাম করে চা খাবে। তার পাশে বসে একটা কাগজের টুকরোতে মনোযোগ দিয়ে বাজারের লিস্টি লিখবে লাডলি বেগম। মুনশি ফারুক আলিকে সে স্মরণ করিয়ে দেবে: যা যা লিখছি—সব আনবা। তোমারে কই মুনশি, ফুলকপির গোছ যিন শক্ত না-হয়! তা হইলে কিন্তুক ফালায়া দিমু, কইলাম! আর যেইডি লিখা হয় নাই—জলখাবার থিকা আধা সের লালমোহন কিন্না আনবা। ভুইল না কিন্তুক!   
লাডলি বেগমের লিস্টি মোতাবেক শান্তিনগর বাজার থেকে মুনশি ফারুক আলি যা যা কিনবে তা হ’ল: চাউল, ডাউল, আলু, বরবটি, ফুলকপি, পুঁইশাক, মৌরালামাছ, গরমমশল্লা, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ আর নুন। জলখাবারে গিয়ে আধা সের লালমোহনও কিনে ফেলবে সে। তারপর লাডলি বেগমের কথা মতো রান্নাঘরে মেঝেতে বসে বটি দিয়ে কুটাবাছা করতে শুরু করবে মুনশি ফারুক আলি এবং একটু পরেই দুনিয়ার বিরক্তি নিয়ে সে লাডলি বেগমকে বলবে: ধুর! ছুরি দে তো একখান! বটি দিয়া কাজ করবার পারতাছি না! লাডলি বেগম তাকে একটা ভোঁতা ছুরি খুঁজে এনে দেবে। সুচারুভাবে না-হলেও ছুরি দিয়ে আলু ছিলবে এবং বরবটি আর পুঁইশাক কুটবে মুনশি ফারুক আলি। তারপর চাউল-ডাউল পাতিলে নিয়ে ভাল করে ধুয়ে ফেলবে সে। 
লাডলি বেগম তখন মৌরালামাছ কুটতে কুটতে মুনশি ফারুক আলিকে খোঁচা মারবে: বাজারে কি এর থিকা আর ছোট সাইজের মাছ আছিল না? এত ছোট ছোট মাছ কুটাবাছা করণ যায় নেকি? 
মুনশি ফারুক আলি উত্তর করবে: বাজারে গিয়া দেখগা তুই! আইজ তো মাছের আমদানিই নাই! 
একটা কেরসিনের চুলায় মৌরালামাছ তুলে দিয়ে আরেকটা কেরসিনের চুলায় বরবটি ভাজি করবে লাডলি বেগম। তারপর সে রাঁধবে পুঁইশাকের চচ্চরি আর আলু-কপির ঝোল। সব শেষে সে ভাত চড়িয়ে দিয়ে ডাউল পাকাবে বাগাড় দিয়ে। আর সিগারেট টানতে টানতে লাডলি বেগমের এসব  কর্মযজ্ঞ দেখতে থাকবে রান্নাঘরের দরজায় মোড়ার ওপরে বসে থাকা মুনশি ফারুক আলি। রান্নাবান্না করতে করতে লাডলি বেগম নিজের বাচ্চাদের নিয়ে অনেক গল্প করবে তখন। আর মুনশি ফারুক আলি বলবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনের কথা। সহপাঠী ইরার প্রতি তার অনুরাগের বিষয়টাও লাডলি বেগমের কাছে প্রকাশ করবে সে। হাসতে হাসতে লাডলি বেগম তাকে পরামর্শ দেবে: ঝুইলা পড়! কহন পক্ষী উড়াল দিব তা কি কইতে পারে কেউ? 
রান্না শেষ হলে পরে গোসলে যাবে লাডলি বেগম। গোসল থেকে ফিরে এসে সে তার শিশুপুত্রকে আলু-কপির ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়াবে। এক পর্যায়ে সে মুনশি ফারুক আলিকে বলবে: এক গেলাস পানি নিয়া আসতো। পোলাডার হিক্কা উঠতাছে। তরকারিতে ঝাল বেশি হইছে মনে কয়! 
রান্নাঘরের জগ থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসবে মুনশি ফারুক আলি। ছেলেকে খাওয়ানো শেষ করে লাডলি বেগম পাটি পাতবে রান্নাঘরের বারিন্দায়। রান্নাঘর থেকে তরিতরকারির পাতিলগুলো সব সেখানে নিয়ে যাবে তারা দু’জন মিলে। লাডলি বেগমের মা লায়লি বেগম তাদেরকে বলবে: তরা খা। আমি পরে খামুনে। তারপর খুব স্বাদ করে অনেক ক্ষণ ধরে খাবে মুনশি ফারুক আলি এবং সে বারবার লাডলি বেগমকে বলতে থাকবে: মাস্টার্স পাশ দিয়া আমার যুদি চাকরি উকরি কিছু না-হয় তা হইলে, কসম খোদার, আমি আর তুই মিল্লা মৌচাকমোড়ে একখান হোটেল খুলুম! আর সেই পরিকল্পনা শুনে হাসিতে ভেঙে পড়বে লাডলি বেগম। 
যেহেতু সন্ধ্যেবেলাতে মাতারি কাজে আসবে তাই আর তারা তখন হাড়িপাতিল ধোয়াপাকলা করবে না। এঁটো হাড়িপাতিল রান্নাঘরে রাখতে গিয়ে হাসতে হাসতে লাডলি বেগম মুনশি ফারুক আলিকে বলবে: মনে কইরা একটা মিষ্টি পান তো আনতে পারতা আমার জন্যে! কয়া না-দিলে তুমার কি আর কিছু মনে থাকব? স্বভাব বদলাইল না তুমার! 
এ কথার পরে কি আর পান না-আনলে চলবে? তাই আউটার সার্কুলার রোডের মোড়ে গিয়ে দু’টো মিষ্টি পান কিনে নিয়ে আসবে মুনশি ফারুক আলি। বারিন্দার মোড়ায় বসে শীতের রোদে ভেজা চুল শুকোতে শুকোতে পান খাবে লাডলি বেগম। আর মুনশি ফারুক আলি বারিন্দার সিঁড়িতে বসে মুখে পান ঢুকিয়ে তখন আরামে সিগারেট টানতে থাকবে। গল্প করতে করতে এক সময় ক্লান্তিতে হাই তুলবে লাডলি বেগম এবং সে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে মুনশি ফারুক আলিকে বলবে: লও যাই মুনশি! ঘরে বসি গিয়া। 
তারপর কাঠের দো’তলায় উঠে দক্ষিণের ঘরটাতে গিয়ে লাডলি বেগমের বিছানায় বসবে মুনশি ফারুক আলি। তার হাত ধরে চুপচাপ বসে থাকবে লাডলি বেগম। কয়েক মিনিটের নৈঃশব্দের পর লাডলি বেগম তাকে বলবে: আমার খুব ডর করতাছে মুনশি! আমার জামাইয়ের যে রাগ! ডিভোর্সের কথা উঠলে হেয় আমারে মাইরাই ফালাইব! সব কিছু কেমুন যিন আউলা ঝাউলা লাগতাছে আমার!  
মুনশি ফারুক আলি তার বাল্যবন্ধুকে অভয় দিতে চাইবে এই বলে: তুই না বড় হইছস? তর না বয়স অহন একুশ? এত ডর খাস কেন তুই? অস্থির হস কেন? মাথা ঠান্ডা রাখ। সব ঠিক হয়া যাইব ইনশাল্লাহ! আল্লাহতালা যেমুন মুশকিল দিছেন, আহসানও দিছেন তেমুন! 
লাডলি বেগম উত্তর করবে: তুমি তো আর আমার মতন কইরা এই দুনিয়ার কঠিন রাস্তা দিয়া হাঁট নাই মুনশি! তুমি কী বুঝবা? 
মুনশি ফারুক আলি সেই প্রশ্নের কোনও জবাব খুঁজে পাবে না। আর তখন নিজস্ব দুঃখে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকবে লাডলি বেগম। কী করা উচিত তা বুঝতে না-পেরে বিষণ্ণ মুনশি ফারুক আলি তার বাল্যবন্ধুর নরম চুলে ক্রমাগত আঙুল বুলিয়েই চলবে। একটু ধাতস্থ হয়ে চা বানাবে লাডলি বেগম। চা খেয়ে বিযুক্ত হবে তারা।
তারপর আমরা দেখব, তার দিন পনের পরে মালিবাগ চৌধুরিপাড়ায় তার স্বামীর কাছে ফিরে যাবে লাডলি বেগম। মাস ছয়েক পরে আমরা আরও দেখব যে ঢাকা মেডিকাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে অগ্নিদগ্ধ লাডলি বেগমকে। শতকরা নব্বুই ভাগ বার্নের এ রোগীকে বেবিট্যিাক্সিতে করে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে আসবে তার স্বামী এবং চৌধুরিপাড়ার তাদের জনৈক প্রতিবেশী। রোগীর অবস্থা সঙ্গীন বিধায় তাকে ইমার্জেন্সি থেকে স্থানান্তরিত করা হবে বার্ন ইউনিটে। হাসপাতালে ভর্তির এগার দিন পরে তার শরীরে ছড়াতে থাকবে ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশন। অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দেয়ার পরেও ইনফেকশন অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়বে এবং উনিশ দিনের মাথায় রাতের বেলায় মৃত্যুবরণ করবে বাইশ বছরের লাডলি বেগম। তখন নানা জনের কথা থেকে আমরা মোটামুটি একটা উপসংহার টানতে পারব যে লাডলি বেগমের গায়ে কেরসিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল তার স্বামী আলতাফ হোসেন স্বয়ং। মেয়েটা তখন সিনথেটিক শাড়ি পরে ছিল বলে খুব সহজেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল তার সারা গায়ে। তবে আলতাফ হোসেন কাঁদো কাঁদো গলায় সবাইকে বলে বেড়াবে—এটা আসলে আত্মহত্যা। সে দাবি করবে, ঝগড়াঝাটির এক পর্যায়ে নিজেই নিজের গায়ে কেরসিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল লাডলি বেগম। আলতাফ হোসেন তখন ঘরে ছিল না। সে সিগারেট কিনতে নিচের দোকানে গিয়েছিল। তাদের দুই সন্তান তখন খেলছিল শোবার ঘরে বসে। 
পোস্ট মোর্টেমের পর ঢাকা মেডিকাল কলেজ হাসপাতাল থেকে লাডলি বেগমের অগ্নিদগ্ধ লাশ নিয়ে আসা হবে সিদ্ধেশ্বরীতে তাদের কাঠের দো’তলায়। মুর্দাকে জুরাইন গোরস্থানে দাফন করে ফেরার পরে লাডলি বেগমের মামারা আলতাফ হোসেনের বিরুদ্ধে হত্যা অথবা আত্মহত্যায় প্ররোচনার কারণে মমলা করার প্রস্তুতি নেবে। সে খবর পেয়ে আলতাফ হোসেন বাড়ি বয়ে এসে মিমাংসা করতে চাইবে লাডলি বেগমের ভাই-বোন মোহাম্মদ শাহজাহান, মমতাজ বেগম, জাহানারা বেগম এবং মোহাম্মদ আলমগীরের সাথে। আলতাফ হোসেন তাদেরকে যুক্তি দেবে, মামলা করা হলে প্রথমে তাকে হাজতে থাকতে হবে এবং বিচারের পরে তার ফাঁসিও হয়ে যেতে পারে। তখন লাডলি বেগমের সন্তানদেরকে দেখাভাল করার আর কেউ থাকবে না। মোহাম্মদ শাহজাহান সেই সমস্যার সমাধান দেবে এভাবে: লাডলির বাচ্চাদেরে আমরা ভাই-বোনেরাই দেখুমনে! মইরা গেছি নেকি আমরা! যুক্তিতে কুলাতে না-পেরে তারপর বোম মেরে মোহাম্মদ শাহজাহানদের কাঠের দো’তলাটা উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেবে আলতাফ হোসেন। 
তখন খুব ভরকে যাবে লাডলি বেগমের ভাই-বোনেরা। তাদের মনে হতে থাকবে, তারা যেন ১৯৪৬ সালের দাঙ্গাবিক্ষুব্ধ বিহারের কোনও একটা কাল্পনিক রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে আর বোম হাতে করে তাদেরকে আক্রমণ করতে ধেয়ে আসছে হাজার হাজার ক্রুদ্ধ আলতাফ হোসেন অথবা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে জিঞ্জিরায় তাদের দিকে মেশিনগানের গুলি ছুঁড়ছে হানাদার আলতাফ হোসেনদের দল এবং জান বাঁচাতে একটা মাঠের ভেতর দিয়ে তারা দৌড়াচ্ছে দিগি¦দিক। এসব  ভাবতে ভাবতে ক্রমশ অস্থির হয়ে পড়বে লাডলি বেগমের ভাই-বোনেরা। তারা তাদের লড়াকু মামাদেরকে বোঝাবে: বোম পড়লে তো আমগো বাইড়তেই পড়ব, আপনেগো সূত্রাপুরের বাইড়তে তো আর পড়ব না! এমন কাপুরুষতায় বিরক্ত হয়ে যাবে তাদের মামারা এবং তারা আফসোস করবে এই বলে: তরাও শেষপর্যন্ত তগো বাপের লাহান ইন্দুর হইলি? তাদের মা লায়লি বেগম ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে তখন একটা সমাধান দেবে: আমি নিজেই আমার মাইয়ার খুনের মামলা রজু করুমনে।  নেমকহারামের দল! তগোরে আমার লাগব না, যাহ্!  
লাডলি বেগমের স্বামী আলতাফ হোসেনের কী হ’ল, কী না-হ’ল তা নিয়ে আমরা অবশ্য কালক্রমে আগ্রহ হারিয়ে ফেলব। লাডলি বেগমের অকাল মৃত্যুতে তীব্র শোকে কাতর পঁচিশ বছরের মুনশি ফারুক আলিকে আমরা কেবল লক্ষ করব দীর্ঘ সময় ধরে। আমরা দেখব, বাল্যবন্ধুর মৃত্যুর শোক সামলাতে তার লেগে যাবে চার-চারটা বছর। তারপর এনজিও কর্মকর্তা মুনশি ফারুক আলি তার বন্ধুদের আড্ডায় আবারও নিয়মিতভাবে যোগ দিতে শুরু করবে। তা’ছাড়া তার প্রতি আগ্রহী তিন জন মেয়েকেই মুনশি ফারুক আলি জিজ্ঞাসা করবে: পুতুল খেলতে পার তুমি? তাদের তিন জনই চরম বিরক্তি নিয়ে ভাববে: এই ব্যাটা তো দেহি বদ্ধ উন্মাদ! এর লগে বিয়া বইলে সারাডাক্ষণ পাবনা মেন্টাল হাসপাতালে ডিউটি দিতে হইব, সংসার করন লাগব না আর! তাদের এই ভাবনা যতই স্বাভাবিক হোক না কেন শেষপর্যন্ত মুনশি ফারুক আলির সাথে তাদের দুরত্বই তৈরি হবে। এভাবে মেয়েদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের ব্যাপারে একেবারেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে মুনশি ফারুক আলি।     
লাডলি বেগমের মৃত্যুর তের বছর পরে জনৈক সহকর্মীর বিবাহযজ্ঞে ভূতের গলির সুরাইয়া খানমের সাথে পরিচয় ঘটবে মুনশি ফারুক আলির। পানচিনি, গায়েহলুদ, বরযাত্রা এবং বউভাতের ফাঁকে ফাঁকে অনেক লঘু গল্প করবে তারা দু’জন। ছাব্বিশ বছর বয়সী সুরাইয়া খানম তখন ইন্টেরিয়র ডিজাইনের একটা ফার্মে চাকরি করবে। তার কাজ হবে ইনিডোর প্ল্যান্ট দিয়ে বিভিন্ন বাসাবাড়ি আর অফিস সাজানো। সেই রূপসী যুবতির ছিপছিপে গড়ন, দুধ-সাদা গাত্রবর্ণ, বাদামি চুল আর আয়ত চোখ ভয়ানকভাবে আকর্ষণ করবে মুনশি ফারুক আলিকে। এবং অনেক দিন পর তার খুব মনে পড়তে থাকবে তার মৃত বন্ধু লাডলি বেগমের কথা। 
এক দিন কাকতালীয়ভাবে সুরাইয়া খানমের সাথে নিউ মার্কেটে দেখা হয়ে গেলে পর একটা রেস্টুরেন্টে কফি খেতে বসবে তারা দু’জন। আড্ডার ফাঁকে সুরাইয়া খানম হাসতে হাসতে মুনশি ফারুক আলিকে জিজ্ঞাসা করবে: শোনেন মুনশি! আপনি আমার সাথে পুতুল খেলবেন? আমার অনেকগুলো কাপড়ের পুতুল আছে। আমি নিজে বানিয়েছি। ধরেন, আমরা এক সাথে বাজার করলাম, রান্না করলাম, পুতুলদেরকে আমরা গোসল করালাম, কাপড়চোপড় পরালাম, ফিডার দিয়ে দুধ খাওয়ালাম তারপর। তা’ছাড়া ধরেন, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতেও গেলাম আমরা। বলাকাহলে গিয়ে সিনেমাও দেখা যেতে পারে। কী বলেন? 
সুরাইয়া খানমের এহেন প্রস্তাব শুনে পয়লাতে খুব খুশি হলেও ভীষণ অবাকই হবে মুনশি ফারুক আলি। তাই সে প্রশ্ন করে ফেলবে সুরাইয়া খানমকে: আপনি পুতুল খেলার কথা ভাবেন? কী আশ্চর্য! সচরাচর কেউ তো পুতুল খেলতে চায় না। 
তখন হাসিতে ভেঙে পড়ে পাল্টা প্রশ্ন করবে সুরাইয়া খানম: কেন? পুতুলখেলা কি কোনও দোষের কাজ নাকি? 
তবে সেই প্রশ্নের কোনও উত্তর দেবে না গম্ভীর মুনশি ফারুক আলি। সুরাইয়া খানমের চোখে চোখ রেখে সে কেবল বলবে: আমার কিন্তু বাগান করার সখ! তার কী হবে?  
সুরাইয়া খানম উত্তর দেবে: ঠিক আছে। আমরা বাগানও করলাম। অসুবিধা কী? আমার বাসায় অনেক পদের গাছ আছে।
তারপর এই পৃথিবীতে সহস্র বছর ধরে মুনশি ফারুক আলির সাথে পুতুল খেলতে থাকবে ভূতের গলির সুরাইয়া খানম।




ফয়জুল ইসলাম। কথাশিল্পী, ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক গবেষক এবং প্রাবন্ধিক। জন্ম ২৪ নভেম্বর ১৯৬৩ সালে, ঢাকা শহরের সিদ্ধেশ্বরীতে। তার প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের ভেতরে রয়েছে: ‘নক্ষত্রের ঘোড়া’, ‘খোয়াজ খিজিরের সিন্দুক’, ‘আয়না’, ‘নীলক্ষেতে কেন যাই’ এবং ‘বখতিয়ার খানের সাইকেল’। উপন্যাস: ‘বয়েজ স্কুল ব্যান্ড’। তার গল্পগ্রন্থ ‘খোয়াজ খিজিরের সিন্দুক’ প্রথম আলো বর্ষসেরা বই: ১৪২২-এর সৃজনশীল শাখায় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়ামস কলেজ থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে তিনি স্নাতকোত্তর। বর্তমানে তিনি উন্নয়ন-পরিকল্পনা এবং সামাজিক সুরক্ষার সংস্কারের কাজে জড়িত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ