TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

উকিল বউয়ের দুই নম্বর হাসবেন্ড | খোকন কায়সার

প্রচ্ছদ: নাজমুল হোসাইন

উকিল বউয়ের জেরার মুখে পড়ে ঠিক কাঠগড়ার আসামীর মতই মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রইল লোকটা। লোকটা উকিল ম্যামের সেকেন্ড হাজবেন্ড। এসব নার্ভাস মুহূর্তে তার চকচকে টাকে শিশির বিন্দুর মত ঘাম জমে। ভারী গোঁফের নিচে ঠোঁট জোড়া মৃদু লয়ে কাঁপতে থাকে। ছোট বেলায় তোতলানোর অভ্যাস জিহবার নিচে সীসা রেখে অনেকটা সারিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। সেটা আবার ফিরে আসে। কথা বলতে গেলে মুখ গহবরে কোথায় যেন জড়াজড়ি হয়ে যায়।   
—কোথায় ফেলে আসছিলা এগুলা? 
উকিল বউয়ের হাতে ধরা এক বান্ডেল ভিজিটিং কার্ড। ভিজিটিং কার্ডের বান্ডেলটার দিকে এক   পলক তাকিয়েই হৃদপিণ্ড ব্যাঙের মত একটা লাফ দিল। তোতলানোর ব্যামোটা দ্বিগুণ উৎসাহ  নিয়ে হাজির হল।
—কেকেকেকোকোকো কোথায়, কে দিল?
—এক টেক্সি ড্রাইভার দিয়া গেছে।  
চট করে সব কিছু মনে পড়তে শুরু করল। বউয়ের চেম্বারের ভিজিটিং কার্ড ছাপার পরে প্রেস থেকে সে নিজেই নিয়ে এসেছিল। তাহলে টেক্সিতে ফেলে এসেছিল সে এগুলো? আর সে গত মুহূর্ত পর্যন্ত বেমালুম ভুলে ছিল ব্যাপারটা!  
—ট্যাটেটেক্সিতে ফালায় আসছিলাম তাইলে!  
—তাতো বোঝাই যাচ্ছে, নাইলে টেক্সিঅলা পাইলো ক্যামতে! 
বউয়ের কথাগুলো এখন আর কানে ঢুকছে না। সে এখন অনেক দূরে। প্রেস থেকে ভিজিটিং কার্ড ডেলিভারি নিয়ে সে ব্যস্ত রাস্তায় নেমে এল। টেক্সি খুঁজছে। দালানকোঠার ফাঁকফোকর দিয়ে   গলে গলে পড়ছে শেষ বিকালের সোনালি রোদ। এসব ছায়াছবির মত তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। 
—কি অইল? কথা কানে যাচ্ছে?   
—টেক্সিঅলা কিভাবে খুঁজে পেল তোমারে? 
প্রশ্নের ভিতর বিষ্ময় চাপা থাকে না। কণ্ঠস্বর একটু কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে।   
—তোমার মত ব্যাক্কল হইলে তো আর আমারে সে খুঁইজা বাইর করতে পারত না। ভিজিটিং কার্ড থেকেই ঠিকানা বাইর করছে। লোকটারে বকশিশ দিতে চাইলাম তাও সে নেয় নাই। 
টেক্সিঅলার চেহারাটা আবছা মনে পড়ছে। মাঝবয়সী সৌম্যকান্তি চেহারা। মুখভর্তি কাঁচাপাকা চাপ দাড়ি। ফর্সা মুখখানির দিকে তাকালে প্রথমেই যে কারোর চোখের সামনে ইলিশ অথবা চাপিলা মাছের ছবি ভেসে উঠবে। 
বউয়ের চেহারাটা হয়েছে দেখার মতো। যেন একটা মরা ইঁদুর ঝুলে আছে তার নাকের সামনে। বিস্ফারিত চক্ষুগোলক, স্ফীত নাসারন্ধ্র, কুচকানো কপাল, বাঁকানো ওষ্ঠযুগল-সেই সাথে সিনা  টানটান মারমুখী ভঙ্গি। এই রুদ্র মূর্তি যে কারোর বুকেই কাঁপন ধরিয়ে দেবে। স্বামী রত্নটি মরা ইঁদুর হয়ে ঝুলে রইল। যেন অপেক্ষা করছে কখন লাঠির ডগা দিয়া খোঁচা মেরে ফেলে দেবে তাকে নিকটস্থ কোন নর্দমায়।   
টেক্সিঅলাকে দেখেই বোঝা গেছিল পরহেজগার লোক। ব্যাটা অনেস্টের বাচ্চা অনেস্ট— তোর কি ঠ্যাকা পড়ছে প্যাকেট খুইলা ঠিকানা বাইর কইরা কার্ডগুলা পৌঁছায়া দেওনের! এখন দিলি তো  সংসারের মইদ্যে পেজগি লাগায়া!  
রিকশা-টেক্সি নেওনের সময় সে প্রায়শ ড্রাইভারের চেহারাটা মেপে নেওয়ার চেষ্টা করে। চোখে সুরমা লাগানো হুজুর টাইপের ড্রাইভারটাকে নেবে কি নেবে না এ নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগলেও  আশে পাশে আর কোন টেক্সি না পেয়ে হুজুরের টেক্সিতেই চড়ে বসেছিল। 
বিকালটা ছিল মনোরম। মনটাও ফুরফুরে। আশেপাশে কোথাও থেকে বেলী ফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল। আজকাল কি মেয়েছেলেরা খোপায় বেলী ফুলের মালা বান্ধে! কারো কাপড়চোপড়ে লেগে থাকা পার্ফিউমও হতে পারে। 
—টেক্সি কইরা কই থিকা কই যাইতাছিলা?
উকিল আবার তার জেরা শুরু করেছে। চমকে উঠেই পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিতে পারল মনে হচ্ছে এ যাত্রা। কিন্তু চোখ তুলে উকিলের মুখের দিকে তাকানোর সাহস হলো না। প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে স্বাভাবিক থাকার। আর তাতেই ঘেমে নেয়ে ওঠার যোগাড়। বিড়বিড় করে বলতে চাইল,
—আরে বাবা এত জেরা করার কি আছে। ভুলে ফালাইয়া আসছি টেক্সিতে, টেক্সিঅলা দিয়া গেছে ব্যাস— এইটুকুতেই ক্ষেমা দে না বাপ। 
বউয়ের মুখের দিকে তাকানোর সাহস নাই। থাকবেই বা কি করে, শুধু কার্ড ফেলে আসার দোষে অভিযুক্ত আসামী তো সে নয়। আরো অনেক কিছু এর সাথে জড়িয়ে আছে। হুজুর ব্যাটা কতখানি বমি করে গেছে— তা বোঝার জন্য উকিলের চোখের দিকে একটিবার তাকানো দরকার। 
তবে ভাবেচক্করে মনে হচ্ছে মনিরা জান্নাতের বিষয়টা উকিলের কানে পৌঁছায় নাই। তাহলে জেরার ধরণ অন্যরকম হত। 
বিকালটা কি সুন্দরই না ছিল। এক পশলা বৃষ্টির পরে নির্মল প্রকৃতিতে গোধুলির নরোম আলোর ছোঁয়ায় মায়াময় হয়ে উঠেছিল চারদিক।   
মুনিরা যখন তার টেক্সিতে উঠে বসেছিল তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। নগরীর স্ট্রিট লাইটগুলো আগেই জ্বলে উঠেছে। মোড়ে মোড়ে নিয়ন বাতি আর দোকানে দোকানে রঙ বেরঙের আলো ঝলমল করছে।  
ডান দিকে বক্সিরবিট বাম দিকে হাজারিগলি সামনে লালদীঘি। এই জায়গাটায় হাঙ্গামা-হুজ্জোত সবসময় লেগেই থাকে। রিক্সা, টেক্সি, বাস, টেম্পু, কার, ঠ্যালা, ভ্যান, হকার, পাইকার, দোকানদার, কাস্টমার, পকেটমার, ভিক্ষুক, টোকাই, কেরানি, অফিসার, পুলিশ, উকিল আরো হরেক কিসিমের জটলা।                                        ঠ্যালাগুঁতাখিস্তি চোদানিরপোয়ামাগীরপোয়া রাজাকারবিম্পিজামাতআম্লিগ পোন্মারিদিয়েদেগবমেন্ট  ইত্যাকার শব্দরাজি ভদ্রলোকদের কানে গরম সিসা আর অভদ্রলোকদের কানে মধু বর্ষণ করতে থাকে।   
পাশে বসা খুশবু ছড়ানো নারীর সাথে তার এমন সম্পর্ক যে চাইলেই কামিজের নিচে হাত ঢুকিয়ে  সেমিজ ঘেঁটে দিতে পারে। অথচ গুটিশুটি মেরে বসে আছে— থানার দারোগার ভুড়ির তলায় দলা হয়ে ধরাখাওয়া পকেটমার যেমন বসে থাকে।  
এই জটলা থেকে বের হয়ে লালদিঘি-কোর্টবিল্ডিং-কোতোয়ালী-ফিরিঙ্গিবাজার পার হয়ে টেক্সি গতি পেল। ড্রাইভার উড়াল দিতে চাইতেছে মনে হচ্ছে। ফিশারি ঘাটের নির্জন রাস্তায় একটু চুমুটুমু না খেলে কি চলে? ডান দিকে কর্ণফুলি। ফিশিংবোট টাগবোট স্পিডবোট গানবোট কার্গো  ফিডারভেসেল সাম্পান এসব থেকে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মি নদীর জলে নানা বর্ণের প্রতিফলন তৈরি করেছে।
প্রায়অন্ধকার-নির্জন রাস্তায় মুনিরাকে জাপটে ধরে চুকচুক শব্দ তুলে চুমু খেতে গিয়ে ঠিকই সে টের পেয়েছিল হুজুরের চোখজোড়া রেয়ারভিউ মিররে সেঁটে আছে। আরে হারামজাদা এক্সিডেন্ট  করবি তো! জোড় করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে মুনিরা জান্নাত।  
—তুমি যে কি না! বলছি না টেক্সিতে আমারে ধরবা না। খাচ্চোড় ড্রাইবারগুলা তাকায় থাকে।  
—ধুর। কিছু অইতো না। দেখলে দেখবে আরকি। বলেই সে আবার মুনিরাকে জাপটে ধরে। এবার কামিজের গলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দেয়। আর মুনিরা যতটা পারে ঢেকেঢুকে রাখার চেষ্টা করে। 
গোপন প্রেমিকাকে নামিয়ে দিয়ে তাড়াহুড়া করে নিজেও নেমে যায় টেক্সি থেকে। আর ভুল করে বউয়ের ভিজিটিং কার্ডের বান্ডেলটা ফেলে আসে টেক্সিতে। 
—কি অইলো তব্দা খাইয়া গেলা কি জন্য? কই থিকা কই যাইতেছিলা?  
—কই যামু! প্রেস থিকা বাসায় আসছি। আরে ভাই, ভুলে টেক্সিতে মালটা ফালায় আসছি। টেক্সিঅলা দিয়া গেছে। ব্যাস হইছে তো। থামো না এইবার।  
—থাইমা তো যাইতেই চাইছিলাম। তোমার কথাবার্তার ধরনেই তো সন্দেহজনক। তোমার সাথে টেক্সিতে কি আর কেউ ছিল?
পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। কপালে আর নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। গরম ভাপ বের হচ্ছে মাথার তালু দিয়ে। এই রে, শ্লা খাই দিছে রে! ব্যাটা বাঞ্চোত ধরিয়ে দিয়ে গেল  নাকি? মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা চালালো সে। 
—আরে ধ্যাত! তোমার এই এক ওক্লাতি স্বভাব। কে থাকব? কেউ তো আছিল না। তোমারে ঐ টুণ্ডা হুজুরে কি বুঝাই গ্যাছে আল্লা মালুম। কাকে নাড়তে কারে নাড়ছে দ্যাখ গা। তুমি তো উকিল মানুষ, বুঝাইয়া কইলে বুঝবা। ধর ড্রাইবার ব্যাটা আমারে নামাইয়া দিয়া আরেকটা ক্ষ্যাপ মারল তারপর আরেকটা। তারপর একসময় খুঁইজা পাইল আমার হারাইয়া যাওয়া ভিজিটিং কার্ডের পোডলা। যখন খুঁইজা পাইল তার ইমিডিয়েট আগে টেক্সি থেকে ধর দুইজন প্রেমিক প্রেমিকারে নামাইয়া দিল। ধর তারা টেক্সির মইদ্দে লটরপটর করতে ছিল। তাইলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াইল। অই হুজুর তাইলে কারে কি ভাবল, কি গোলটা পাকাইল— তোমার উকালতি বুদ্ধি খাটাও এইবার।   
এই পর্যন্ত দীর্ঘ বক্তব্য উপস্থাপনের পর উকিল বউয়ের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা না করে সে  বাথরুমের দিকে রওয়ানা হয়ে গেল। বাথরুমের দরজা আটকানোর ফাঁকে বৌয়ের প্রসন্ন মুখখানি একপলক দর্শনে খানিকটা নির্ভার হলো এবং দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে তলপেট খালি করে পুরোপুরি নির্ভার হয়ে নিল।




খোকন কায়সার। গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১৮৬৭ সালে, পটুয়াখালীতে। মূলত গল্প লেখেন। শখ ভ্রমণ। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: ‘রাজার কবিলা’ (২০০১), ‘চোখে চশমা বগলে ইট’ (২০০৫), ‘হারানো বিজ্ঞপ্তি সাউন্ড ইফেক্ট বাঙালিসমগ্র জবানপির কচুখাইন এবং সোনাদিয়াগুচ্ছ’ (২০০৮), ‘রুব্বতি পিঞ্চুকরাই ও কোলারুরে’ (২০১৭)। ‘যুগান্তর’ ও ‘সমস্বর’ নামে দুটো ছোটকাগজ সম্পাদনা করেছেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ