TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

লোহাকামার | আবু হেনা মোস্তফা এনাম

প্রচ্ছদ: নাজমুল হোসাইন

আমাদের গ্রাম এবং পৃথিবীর সমস্ত লোহার ভেতর ইমাদুল কামারের প্রাণ গেঁথে ছিল। 
অনেক অনেকদিন পর, সকালের স্বচ্ছ আলো আর নীল মেঘের ভেতর ঘরের নিরাপত্তায় ব্যবহৃত লোহার পেরেকগুলো উঠোনে ছড়িয়ে পড়লে গ্রামের লোকেরা দেখে তাদের জীবনে একদিন নদী নেই, তখন, তাদের আকাশে একদিন পাখি নেই। তাদের গ্রামের নদী হারিয়ে গেলে তারা দেখে গ্রামের একমাত্র জেলের গৃহে কোনো লোহার পেরেক নেই;—তারা, স্বামী-স্ত্রীর সংসারে জানেনি কখনো লোহার গান, শোনেনি কখনো লোহার উজ্জ্বলতা। নদীর ছায়ায় তাদের গৃহের পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ; নদীর জলঘূর্ণিস্রোতে তাদের গৃহের উঠোন। জেলেবউ পোয়াতি হলে, তখন, গ্রামের লোকেরা বলে, ভূতের আছর থেকে নিরাপত্তার জন্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মাথার নিচে রাখতে হবে লোহার টুকরো। কোথায় পাবে তারা লোহা? তারা কেবল জানত নদীর জলের ভ্রুকুটিবিদ্যা, জানত মাছের লাফ। জেলে মাছ ধরা খেপলা জালে, মাটির গৃহের খড়ের চালে, বাঁশের ছায়ায় খুঁজে খুঁজে দেখে—কোথাও লুকিয়ে নেই একখণ্ড পেরেক অথবা লোহার তার। প্রতিটি বাঁশ গেঁথে আছে খড়ের সোনালি ছায়ায়, প্রতিটি খড় ছায়া হয়ে আছে নদীর স্রোতের ভাষায়। গ্রামের লোকেরা বলে, লোহা না পেয়ে, এখন, যখন, জেলের ভয়, নদীর ছায়ায় প্রকাণ্ড শেওড়া গাছ উঠোনের সবুজ ছুঁয়ে নিষ্ঠুর হাসে। এতদিন, এত সকাল, এত রাত তাদের গৃহে লোহা নেই—কেমন করে তারা জয় করবে ভূতের ভয়! একখণ্ড লোহার জন্য আকাঙ্ক্ষা তাদের জীবনসমগ্রের ভেতর বৃক্ষবীজের মতো অঙ্কুরিত হলে অদৃশ্য ভয়ে তাদের শরীর শিহরিত, রক্তের কণায় কণায় ভয় লাফালাফি করে, ঘুমের ভেতর ভয়ে তারা লাফিয়ে ওঠে; অথবা তাদের ঘুম নেই, নিষ্পলক চোখে জেগে থাকে অন্ধকার নদী। তখন, তাদের নিদ্রাহীন নিষ্পলক চোখ চারটে মাছ হয়ে লাফিয়ে উঠলে তাদের মনে হয় সমগ্র জীবনই তো তাদের লাফ; তারা লাফিয়ে ঘর থেকে উঠোনে নামে, লাফিয়ে ঝাঁপ দেয় নদীর জলস্রোতে, কথা বলে লাফিয়ে; আর তারা ভালোবাসে মাছের লাফ। তখন, তারা ভূতের ভয় ভুলে গিয়ে দেখে মেছোভূত তাদের জীবনে এইসব লাফ সেলাই করে দিয়েছে! আর মেছোভূতের জীবন তাদের সংসারে তাদের গৃহে তাদের জীবনে প্রেমের ভেতর আয়ুষ্মান হয়ে আছে! কী আশ্চর্য এইসব মেছোভূত যে এমন তবে তার শরীরের ভেতর সহজ চলাচল, যেন হাওয়ার ভেতর সাঁতার। মেছোভূতের লাফের আনন্দের ভেতর সাঁতার দিতে দিতে নদী, নদীর ভেতর মাছে। মাছ তাদের পায়ে এবং চোখে। পায়ে এবং চোখের দিকে তাকালে মাছের নির্ভয় আনন্দ—যেখানে খুশি লাফাও, লাফিয়ে লাফিয়ে নদীর তলায়, নদীর উপরে। লাফিয়ে লাফিয়ে তারা মাছের হাটে যায়। মাছের হাটে মাছের দাম কোথায়? মাছের হাটে মাছের কদর কোথায়? মাছের হাটে মাছ চেনে কে? হাটে রোদ, বৃষ্টি, ধুলো, কাদা, ছায়া, ঘাম, হাঁকাহাঁকি, দরদাম, ডাকডাকি এবং এসবের ধ্বনিময় লাফ। লাফ তাদের পায়ের ভেতর হাটের ধুলোয় গড়াগড়ি, লাফ তাদের চোখের তলায় হাটের রোদে লুটোপুটি। তখন তারা হাটে যায় না আর, মাছ কে চেনে জানে না আর। তারা তখন তাদের ছায়ার দিকে তাকায়, গোধূলিপ্রস্তুতির ম্লান আলো—ছায়া নেই, ছায়ার পা নেই, পায়ের চোখ নেই, চোখের দৃশ্য নেই—দৃশ্যের ভেতর কেবলই অদৃশ্য ইশারা, কুরকুট্টি ছায়ার উল্লম্ফন, পরোক্ষ স্পর্শের রোমাঞ্চিত অনুভূতি। ভয় উড়ে গিয়ে, তখন, তাদের চোখের ভেতর জেগে ওঠে ছায়াহীন হাসির রেখা—তারা হাসে আর হাসির ভেতর চোখমাছ লাফিয়ে পড়ে, তার আর তার বউয়ের হাসি থামে না। তবে এমন আশ্চর্য কী যে, মেছোভূতের হাসির ভেতর তাদের সহজ চলাচল, তারা তাদের হাসির দিকে তাকায়, সেখানে মাছের সাঁতার অজস্র। হাসি এমন যে তাদের সকল শরীর ও হৃদয়ের অনুভূতির ভেতর খেলা করে মাছের হাসি, হাসি এমন যে তাদের চোখের ভেতর লাফিয়ে ওঠে মাছ। গ্রামের লোকেরা বলে, তখন, চোখমাছের লাফালাফি তাদের শরীরের ভেতর রোমাঞ্চিত হলে জেলে দেখে তার বউ ঝিকমিক দাঁতে মাছ কুটছে, কামারের গড়ে দেয়া বটি তাদের চোখে পড়ে না, ঝকঝক বটি উঠোনের কোণে পড়ে আছে—তাদের বটির ধার মাছের পেট মনে হয়। তারা, স্বামী-স্ত্রীর সংসারে জানেনি কখনো লোহার গান, শোনেনি কখনো লোহার ধার। লোহার হাটে লোহার দাম কোথায়? লোহার হাটে কে চেনে লোহা? লোহার হাটে লোহার কদর নেই তো তারা দেখে ঝিকমিক দাঁতে একটা মাছ কুটতেই পোয়াতি বউয়ের ডাঁই পেটের ভেতর থেকে অজস্র মাছ লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে নেচে নাচের বৃত্ত তৈরি করে; মাছের লাফে মাছের নাচের আনন্দে উঠোনে জলঘূর্ণিস্রোতের ভেতর তাদের প্রেম নেচে ওঠে, তাদের আকাশ নেচে ওঠে, তাদের গৃহের পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ নেচে ওঠে, তাদের শেওড়া গাছ নেচে ওঠে, তাদের মাছ ধরা জাল নেচে ওঠে। গ্রামের লোকেরা বলে, তখন, এমন যে, নাচের ছন্দে নদীর সকল মাছ উঠে আসে উঠোনে; মাছেরা লাফায় বাতাসের ছায়ায়। নাচ আর বাতাসের ছন্দের ভেতর জেলে আর তার বউয়ের শরীরে মাছের রূপালি আঁশ গজায়, নির্ভার পাখনা ফুলকা প্রস্ফুটিত হয়। তখন তারা শরীরের দিকে তাকালে সেখানে নদী দেখে। নদী তাদের শরীরের পাড় ভাঙে, সেখানে নৌকার বিস্ময়; নদী তাদের শরীরের কাশফুল, উলুখড়, সেখানে পলিমাটির নরম। শরীরের ভেতর তখন তারা নৌকা দেখে—নৌকা চলেছে জলস্রোতের ফেনায় দূরে দূরে, নৌকার তলায় মাছের ঝাঁক, মাছের লাফ; মাছের শরীরে নদীর স্রোতের বালিবালি ঢেউ, ঢেউয়ের তলায় শ্যাওলাবালির বাঁকাচোরা। তারা স্বামীস্ত্রী শরীর থেকে শরীরের ভেতর লাফিয়ে পড়ে নদীর জলস্রোতে। অনেক অনেকদিন পর, হয়ত, গ্রামের লোকেরা দেখে, পাখনায় ভেসে ভেসে নদীর গভীর জলস্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে দুটি সোনালি যুগল মাছ।
গ্রামের লোকেরা বলে, নারী মাছটি একটি স্থির নৌকার বেরিয়ে থাকা লোহার পেরেকের উপর লাফিয়ে পড়লে তার পেট চিরে যায়, মাছের রক্ত আর আঁশের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ফুটফুটে একটি শিশু। নৌকার মাঝি নদীর জলে ভিজে ভিজে শ্যাওলাবালিতে কালো লোহার পেরেকে আটকে যাওয়া লাউফুলের মতো শুভ্র শিশুর নরম শরীর কোলে তুলে নেয়, মাঝি হয়ত নৌকার পাটাতনের নিচে মাছ কুটা বটি নদীর পানিতে ধুয়েছিল, নাড়ি কাটতে লোহার শ্যাওলাবালি গন্ধ; গ্রামের লোকেরা বলে, বটিতে তবু হয়ত লেগে থাকা মাছ আর পানিতে ভেজা কালো পেরেকের গন্ধের ভেতর শিশুটি চোখ মেলে তাকায়।
গ্রামের লোকেরা এই শিশুটির স্মৃতি ভোলে না, অথবা তারা নিজেদের কর্মব্যস্ত জীবনের বিবিধ অবলম্বনহীনতা ও অনিশ্চয়তার ভেতর শিশুটিকে লক্ষ করে না। অথবা তারা একদিন দেখে, জগতের সকল প্রাণির মতোই শিশুটিও ক্রমশ পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখেছে। তখন, অনেক অনেকদিন গত হয়ে গেলে, গ্রামের লোকেরা আশ্চর্য বিস্ময়ে লক্ষ করে কী যে, তাদের স্মৃতি এবং স্মৃতিশূন্য হয়ে যাওয়া বিভ্রমের ভেতর শিশু ইমাদুলের নিদ্রা ও জাগরণে লেগে আছে লোহার গন্ধ। তখন, তাদের পুনরায় হয়ত শিশুটির জন্মের স্মৃতি মনে পড়ে, এবং তারা বলে, পেরেকের ভেতর থেইকি কেমনে টাইনি বাইর করছিল ওরে। পিতৃমাতৃহীন অনাথ এই শিশুটিকে তারা দেখে, সে হয়ত বৃক্ষের ছায়ার ভেতর, গৃহস্থের উঠোনে অথবা হয়ত হাটে যায়। হাটের রোদ, বৃষ্টি, ধুলো, কাদা, ঘাম তার শরীরে জমা করে; এসবের ধ্বনিপ্রতিধ্বনির ভেতর সে ভাবুক বিস্ময়ে দেখে এবং ভাঙা হাটের বিষণ্ণ গোধূলির ভেতর খুঁজে খুঁজে জমা করে ছোটবড়ো পেরেক। সে প্রতিটি পেরেক হৃদয়ের অনুতাপে জমা রাখে আর নিরাপত্তা বোধ করে। সে সুখী হয়। যেন এইসব লোহার পেরেকের ভেতর জমা আছে তার কতকিছু, তার কতকাল, তার গতকাল, তার আগামীকাল, তার আনন্দ, তার বেদনা। এমন যে, প্রতিটি প্রভাতে আঁধারপ্রস্থানের ভেতর এইসব নিরাপত্তাপেরেক ছড়িয়ে গেলে, সে নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তার দুর্বিসহ ভয় অতিক্রম করে আর তার নিঃসহায় কচি নরম মেরুদণ্ডের রক্তমজ্জায় শিহরিত হয় টুকরো টুকরো লোহার গন্ধ, লোহার গোপন স্ফুলিঙ্গ। এই অনুভূতির রোমাঞ্চ নিয়ে সে হাঁটতে থাকে দিগন্তবৃত্তের ধূসর সবুজতার ভেতর, সেখানে নিঃসঙ্গ রেললাইন চলে গেছে নক্ষত্রের দিকে। অথবা, গ্রামের লোকেরা বলে, শিশু ইমাদুল দিগন্তের ধূসরতার ভেতর মিশে যাওয়া নদীর দিকে যায়; নদীর নিস্তরঙ্গ পানির উপর ফুটে ওঠা মাছের বুদবুদের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেক অনেকদিন পর, তখন, গ্রামের ভাঙা হাটের বিষণ্ণ গোধূলির ভেতর পেরেকের সঙ্গে সে সাইকেলের স্পোক, পুরোনো নাটবল্টু অথবা ছোট ছোট চাকতি কুড়িয়ে পেলে একদিন সে জানে তার জন্মের ইতিহাস, এবং তখন নদীর গোধূলির ভেতর বসে এইসব লোহার গন্ধ আর ফেটে যাওয়া মাছের বুদবুদ দেখতে তার ভালো লাগে। এইসব বুদবুদে লেগে থাকে বিকেল ও গোধূলি। বিকেলগোধূলির বুদবুদ। সে গোধূলির দিকে দেখে পাখিরা উড়ছে দূরে, তাদের ঠোঁটে মাছের বুদবুদ। সে বিকেলের দিকে দেখে নৌকা ডুবে আছে বালির ঝিকমিকে, তার মরিচা-ধরা গজালে মাছের আঁশ। সে এইসব বস্তু ও প্রাণের মধ্যে একটা অদৃশ্য অবলম্বন গড়ে তোলে। তখন, হয়ত তার এই একা একা নদীর বিকেলগোধূলির ভেতর বসে থাকা নিয়ে গ্রামের লোকেরা বলে, পোলাডা বোধহয় পাগল নাকি! গ্রামের লোকদের এই ভাবনা, অথবা গ্রামের লোকদের হয়ত একা একা ঘুরে বেড়ানো শিশু ইমাদুলের প্রতি মমতা হলে তারা তার সঙ্গে খেলায় মেতে ওঠে। তারা বলে, কিরে আইজ কয়ডা পেরেক পেইলি? অথবা তারা বলে, কিরে আইজ কয়ডা নাটবল্টু পেইলি? অথবা গ্রামের লোকেরা বলে কী যে, কিরে তোর শরীল থেইকি নাটবল্টুর গন্ধ আসে দেখি! গ্রামের লোকদের এসব কথা শুনে, তার পালক বাবা, অনেক অনেকদিন পর, তাকে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার নাম, তার বাবার নাম, তার মায়ের নাম, তার গ্রামের নাম জানতে চাইলে সে বলে, লোহার গন্ধের ভেতর তার বাবার নাম; মাছের আঁশের ভেতর তার মায়ের মুখ; এবং বলে, নদীর জলঘূর্ণিস্রোতের পূর্ব-পশ্চিমে-উত্তর-দক্ষিণে বিকেলগোধূলির ভেতর তাদের গৃহের উঠোন। 
তখন, অনেকদিন, অনেককাল গত হলে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে ইমাদুল নদীর বিকেলগোধূলির দিকে যায়, দেখে নদী চলে গেছে ধূসর দিগন্তের ছায়ার ভেতর—মাছ মরে গেছে। তখন, অনেক অনেকদিন পর সে হয়ত নদী হারিয়ে মাছের গন্ধ ভুলে যায়, অথবা সে কিছুই হয়ত ভোলে না; এবং সে হয়ত তার মুঠোর ভেতর লোহার পেরেকের অস্তিত্ব টের পায়। সে দেখে লোহার ভেতর মানুষের জন্ম ও মৃত্যুর গন্ধ মেঘ হয়ে আছে; দেখে নীল দিগন্তের চঞ্চল ছায়ার ভেতর, পাখি ও বৃক্ষের গানের ভেতর মেঘের চিত্রপট। তখন, অনেক অনেকদিন পর, ঘুরতে ঘুরতে পায়ে পায়ে পথের ধুলো নিয়ে দূর কোনো গ্রামের পথে কামারশালায় সে দেখে কাঠকয়লার গনগনে আগুনের ভেতর থেকে লোহার টুকরোগুলো লাল-নীল মায়াবি পাখি হয়ে উড়ে যাচ্ছে মেঘে, আর বিকেলগোধূলির পুঞ্জ পুঞ্জ লালকালো মেঘের ভেতর দেখে হাপরের নিঃশ্বাস, দেখে লোহাগুলো ঘষে ঘষে পুড়িয়ে পিটিয়ে চকচকে চাঁদ অথবা রূপালি মাছের তড়িৎ লাফ। তখন, সে দেখে তার জন্মের ভেতর জেগে আছে লোহার গন্ধ, লোহার গন্ধের ভেতর তার সকল শরীর বিছিয়ে আছে। ঘুমের ভেতর গনগনে লাল আগুনের ফুলকি হয়ে সে উড়ে উড়ে সকালের সমস্ত স্বরলিপির ভেতর পৌঁছে যায় কামারশালায়, তার পায়ে লেগে থাকে লোহার গন্ধ, ধুলোর গন্ধ। ধুলোর ভেতর হাটের রোদ, বৃষ্টি, কাদা, ছায়া, মেঘ, ঘাম এবং পায়ের তলায় আনন্দ। পায়ের ধুলো তার শরীরে ছড়িয়ে গেলে সে তখন দেখে তার হৃদয়ে ধুলোর ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে সকল গ্রামের গন্ধ, সকল মানুষের গন্ধ, সকল জন্মের গন্ধ। তখন, গ্রামের লোকেরা বলে, কামারশালার নতুন বিদ্যালয়ে ইমাদুল শিখে নেয় লোহার জ্যামিতি। গনগনে আগুনের ফুলকির ভেতর লাল তেতে ওঠা লোহার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঝিকমিক জোনাকি নেচে ওঠে তার চোখের ভেতর, তার বুকের ভেতর, তার পায়ের ভেতর; তখন লোহা তার পাঠ্যসূচি। কত কত প্রাচীন কালে সে শিখেছিল লোহা যত ঘষবে ততই তার ধার আর দৃষ্টিধাঁধানো রূপের ঝিলিক। অতঃপর সে লোহার জগতে প্রবেশ করে, লোহার নিঃশব্দ মর্মের ভেতর অস্ফুটে কথা বলে ওঠে তার সকল অনুভূতি। এইসব অনুভূতি নিয়ে সে কোথায় যাবে? কাকে বলবে লোহার গন্ধের সারমর্ম! লোহার গন্ধের নিঃশব্দ! তখন, গ্রামের লোকেরা বলাবলি করে যে, গ্রামের প্রান্তরের কাছে এইসব অনুভূতির রং সে ছড়িয়ে দেয় পতঙ্গের লুব্ধ বিকেলে, লাউয়ের উজ্জ্বল পাতায়। এইসব অনুভূতি তার শরীরে পুষ্পছায়া নিয়ে। ছায়ার ভেতর মাঠের শস্যরা তাকে নিঃশব্দে ডাকে। সে শস্যের সকল শরীরে লোহার গন্ধ পায়, দেখে শস্যের নিশ্চুপ রঙের ভেতর অস্ফুট প্রজাপতি উড়ে উড়ে তার জন্মের ভেতর, প্রজাপতির চুপিচুপি লাফালাফির ভেতর সে দেখে তার জন্মের গন্ধে চঞ্চল মাছের সোনালি নিঃশব্দ। ছায়ার ভেতর সে, এইখানে, যখন, দূর দূর গ্রাম সবুজ গন্ধে নিঃশব্দ, যোজন যোজন মাঠ সোনালি ছায়ায় নিঃশব্দ; অনেক অনেকদিন গত হলে, গ্রামের লোকেরা এইসব নিঃশব্দের ভেতর একদিন বলে,—সে ইমাদুল নয়, তাদের গ্রামের লোহাকামার।
এমন কী যে, তখন, লোহার গন্ধে পৃথিবীর সমস্ত দুপুর জেগে ওঠে; লোহার গন্ধে লোহাকামারের হাঁটার সকল ছন্দ ছড়িয়ে পড়লে, সে, যে হয় ইমাদুল কামার, এই সামান্য পথের অভিজ্ঞতার ভেতর সকল দূর, সকল মেঘ, সকল শস্যের মাঠ, সকল নদীর সমাবেশ দেখে গভীর আনন্দে। সে মাঠ থেকে মাঠে যায় লোহার ধার ছড়িয়ে যাওয়া দেখতে, সে পথ থেকে পথে যায় মানুষের কান্নার মানে খুঁজতে, সে নদী থেকে নদীতে যায় মাছ এবং মানুষের সম্পর্ক জানতে। সে দেখে নদী চলে গেছে দূরে হারিয়ে, মাঠ শুকিয়ে গেছে শস্যের কান্না ছড়িয়ে। সে তার শৈশবের দিকে তাকায়; তখন, হয়ত, লোহার গন্ধে ছায়াগুঞ্জরিত লুব্ধ বিকেল নেমে আসে হাপরের পিঠে। রাতের সকল সম্ভাবনা বাদুড়ের চঞ্চল ডানায় মিশে গেলে কামারশালার টুকরো টুকরো লোহার অমিত্রাক্ষর ছন্দের ভেতর তার পৃথিবীর বিদ্যাপাঠ সমাপ্ত হয়। লোহার গাণিত, লোহার পাঠ্যসূচি তার জীবনের সকল সম্ভাবনা এবং তার জন্মের স্মৃতি জাগিয়ে তুললে পৃথিবীর সকল দূর যেন তার পেশল করতলে ভেসে ওঠে, ফসলের সকল সবুজ ও সোনালি হৃদয় তার করোটির ভেতর লাফালাফি করে। তখন, বাল্যকালে, বিদ্যালয় ছেড়ে সে গড়তে শেখে দা, বটি, কাস্তে, হেঁসো, নিড়ানি, কোদাল, কুড়াল, লাঙলের হল, গজাল।
বিদ্যালয় ছেড়ে ইমাদুল কামার—হয়ত তখনও সে কামার নয়—পৃথিবীর সকল দূর, সকল নদী, সকল সবুজ, সকল আকাশ, সকল পাখির সুর নিয়ে মেঘের কাছে যায়—উড়ছে লোহার ঝিকমিক জ্যোৎস্না। রৌদ্রের কাছে যায়—দেখে ধারালো লোহার চিকন রেখা। তখন, তার বিদ্যালয় ভেসে যায় মেঘে, নদীতে; এবং তখন, গ্রামের লোকেরা তার এই লেখাপড়া বিসর্জন দিয়ে উচ্ছন্নে যাবার নিন্দা করে, অথবা তারা ভাবে—পোলাডা বোধহয় পাগল হইব। কিন্তু গ্রামের লোকদের সকল ভয় ও ভাবনার ভেতর, ঘুম ও স্বপ্নের ভেতর সে জীবনের নতুন এক অবলম্বন খুঁজে পায়। 
গ্রামের লোকেরা, যারা একদা, ইমাদুল কামারের বাল্যকালে তাকে গৃহস্থের উঠোনে অথবা ভাঙা হাটের বিষণ্ণতার ভেতর পেরেক নাটবল্টু স্পোক খুঁজে বেড়াতে দেখেছিল, গ্রামের লোকেরা তখন তার পাগলে রূপান্তরিত হওয়ার ভয় পেয়েছিল; তাদের কাছে এ এক অহংকারের অবতারণা হয়। সেই কথা স্মরণ করে তারা হয়ত হাসে, ভাবে—ভালোই, গাঁয়ে একখান কামার দরকার ছিল। অথবা তারা ভাবে—তাদের গ্রামে জেলে আছে, মাঝি আছে, সাইকেল মেকার আছে, নাপিত আছে, মুদি আছে, ছুতার আছে, মোবাইলের ফ্ল্যাক্সিলোড আছে, বিকাশ আছে; আর এখন তাহলে একজন কামার আছে! হয় কী, যোজন যোজন দূর গ্রামের লোকেরা যখন কামারশালায় আসে, তখন, তাদের ভালো লাগে। ভালো লাগে এই ভেবে যে, ইমাদুল তাদের গ্রামের কামার, আর যোজন যোজন দূর গ্রামের লোকেরা এলে এই গ্রাম যেন পৃথিবীর সকল আকাশ, সকল নদী, সকল বাতাস লোহার গন্ধে ভরে ওঠে। দূর দূর গ্রামের লোকের পায়ে পায়ে কত কত প্রান্তরের ধুলোর গন্ধ তাদের গ্রামে ছড়িয়ে গেলে তারা বৃক্ষের দিকে দেখে, পাখির দিকে দেখে, মাছের দিকে দেখে, পতঙ্গের দিকে দেখে। আনন্দে নেচে ওঠে তাদের মন, যেন তাদের মনের বিকেলের ভেতর উড়ছে কামারশালার সুবাসিত ছাইয়ের গন্ধ, লোহার গন্ধ।
কামার দূর দূর গ্রামের লোকদের দা বটি হেঁসো গড়ে দেয়; তারা দেখে কামারের হাতের ভয়ঙ্কর পেশিগুলো বেজে চলেছে ছোটবড়ো হাতুড়ির আঘাতে। লোহাকামার দা বটি গড়ে, বটির চকচকে ধার মনে হয় মাছের পেট। লোহাকামার বটিমাছ গড়ে আর অনেকদিন পর মাছের গন্ধের স্মৃতি মনে পড়লে তার মুখে শান্তি রোমাঞ্চিত হয়। গ্রামের লোকেরা বটিমাছের রোমাঞ্চ নিয়ে যায় দূর দূর গ্রামে, যায় মাঠের সকল বৃক্ষে, সকল শস্যে, নদীর সকল ভ্রমণে; তারা দেখে তাদের গৃহের সকল হৃদয়ে ছড়িয়ে আছে লোহার প্রতিভা। তারা যারা যারা দেখে তাদের গৃহের সকল নির্ভয় দিয়ে চলেছে লোহা, তাদের মাঠের সকল ফসলে মিশে আছে লোহার গান, নদীর সকল ভ্রমণে গেঁথে আছে লোহার ধার; তারা আবিষ্কার করে লোহর গান, লোহার ধার, লোহার ছন্দ ব্যতীত তাদের জীবন অন্ধকার। তখন, গ্রামের লোকেরা তাদের গ্রামের লোহাকামারের জন্মের দিকে ফেরে, এবং তারা গ্রামের ভাঙা হাটের বিষণ্ণ বিকেলগোধূলির ভেতর লোহার পেরেক, সাইকেলের স্পোক, নাটবল্টু খুঁজতে থাকে। কিন্তু তাদের বিস্ময় কী যে, তারা কেউই কোনো পেরেক অথবা নাটবল্টু অথবা সাইকেলের স্পোক অথবা ছোট ছোট চাকতি খুঁজে পায় না; তখন, তারা বলে, পোলাডার কাছে মনে হয় চুম্বক আছে! অথবা গ্রামের লোকেরা এইসব লোহালক্কড় না পেলে তারা তাদের গ্রামের নদীর দিকে যায়, এবং তারা দেখে নদী সরে গেছে দূরে, দিগন্তের ধূসরতার ভেতর একটা চিকন লোহার পাতের মতো পানির প্রবাহ আর দুই দিকে মাছের চকচকে পেটের মতো বালির চর পড়ে আছে। গ্রামের দুপুর হয়ত দোফালি বালির ঝুরঝুর চরে প্রহেলিকা ঝিকমিক করে উঠলে গ্রামের লোকেরা ফিরে আসে, তখন, তাদের মনে হয়, তাদের গ্রামের মাছ হয়ে যাওয়া জেলে আর তার বউ হয়ত অনেক অনেকদিন পর নদীর দুই তীরে ভেসে উঠেছে। অথবা গ্রামের লোকদের মনে হয়, যুগল মাছের সোনালি পাখনায় রোদের রোমাঞ্চে তাদের নদী হারিয়ে যাচ্ছে।
তখন, গ্রামের লোকদের মনে মেছোভূতের ভয় ঢুকে পড়ে, এবং এই নিরুদ্দেশ নদী দূর দূর গ্রামের হৃদয়ে অপার বেদনার সুর গোপনে আকুল কান্নার অশ্রয় হয়ে এলে গ্রামের লোকেরা গৃহ নির্ভয় করতে কামারশালায় যায়। কিন্তু তারা তাদের ভয়ের কথা বলে না, অথবা বলে। অথবা তারা নিজেদের পায়ের দিকে তাকায়; পায়ের ছায়া খোঁজে, চোখ খোঁজে। এবং তারা দেখে যে তাদের পায়ের চোখ নেই, আনন্দ নেই। তাহলে এমন কী যে তারা কীভাবে যাবে মাঠে লাফিয়ে; অথবা কীভাবে যাবে বিকেলগোধূলির হাটে। হাটের রোদ, বৃষ্টি, কাদা, ছায়া, ঘামের ভেতর! হাটের বিষণ্ণ বিকেলগোধূলির ভেতর নাটবল্টু, চাকতি, সাইকেলের স্পোক না পেলে তারা বলে, ইমাদুল কামার আমাদের বন্ধু, আমাদের ভাই। আমাদের শস্য আবিষ্কারের দিনে, বৃক্ষরোপণের প্রথম সকালে সে আমাদের লাঙলের হল গড়ে দেয়, কোদাল গড়ে দেয়। এইসব বিবিধ অস্ত্র গড়তে গড়তে একটা হল তৈরি হলে সে সৃষ্টির বেদনা অনুভব করে, লোহার গন্ধ নিয়ে সে জানে কোন লোহার ধার হবে কতটা ধারালো, কোন লোহার কদর কত, কোন লোহার দাম কীভাবে; এইসব লোহা তার হাতের ভেতর ঠাঁই নিলে সে সকল জন্মের মুহূর্ত, সকল মৃত্যুর বিস্ময় জানে। সকল জন্ম ও মৃত্যু জানা হলে তার ভয় নেই জীবনে এবং ঘুমে। গ্রামের লোকেরা, তখন, এইসব কোদাল কাস্তে হেঁসো লাঙলের হল নিয়ে ক্ষেতে গেলে তারা মেছোভূতের ভয় দূর করতে পারে; অথবা তারা শস্যের উৎসবে মেতে উঠলে তাদের জীবনে মেছোভূত হারিয়ে যায়। তারা দেখে তাদের শস্যের দিনে আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে বৃষ্টির সবুজ ছায়া—এখন মেঘের উৎসব, শস্যের সকল মাটির অন্তরে পৌরাণিক চন্দ্রালোকে ফুটে ওঠে শস্যের বিনম্র গন্ধ। 
বৃষ্টির শিশিরের ভেতর, তখন, একটা নিরিহ লাউলতা ইমাদুলের কামারশালার দরজায় উঁকি দিলে সে লোহার ছায়া এবং গন্ধের বিবিধ রং নিয়ে তার জন্মের ভেতর প্রবেশ করে, হয়ত সে অনুভব করে তার জন্মের ভেতর লোহার গন্ধের সঙ্গে লাউপাতাফুলের গন্ধ মিশে আছে। এইসব গন্ধের ছায়ায় ছায়ায় লাউফুলের জ্যোৎস্না নামে, এইসব ছায়া এবং গন্ধের বিবিধ রঙের ভেতর গনগনে নীল কয়লার উৎপ্রেক্ষা ফেলে রেখে সে বেরিয়ে আসে ঝিঁঝিঁগানের প্রান্তরে। লাউফুলের জ্যোৎস্নায় গ্রামের সকল কন্যার মুখ ভেসে ওঠে, দুর্বাঘাসের শিশিরে সকল ছেলের মুখ। ইমাদুল কামার দেখে গ্রামের ছেলেমেয়েরা মেঘের ছায়া ছুঁয়ে শস্যের উৎসবে, শস্যের বর্ণমালা আর লুব্ধ সারমর্মের সকল অনুভূতি তাদের হৃদয়ে। তাদের সকল অনুভূতি, সকল সংগীত সকল ইন্দ্রিয়ের নিঃশব্দের ভেতর ইমাদুল কামার দেখে, মাটির রুক্ষ উগ্রতা ফাটিয়ে অঙ্কুরিত বীজ ডানা মেলে দেয় নিরঞ্জন হাওয়ায়; সে মেঘের পারিজাত দেখে, শিশুদের দিকে তাকায়, শিশুর জন্মের দিকে দেখে; নদীর দিকে তাকায়, নদীর গানের দিকে দেখে। তখন, তার মনে হয়, লোহার ঝিকমিক ধার জন্মনাড়ি কাটে আর জীবনের স্পন্দন ছড়িয়ে পড়ছে মাঠে মাঠে, বৃক্ষে বৃক্ষে, শস্যে শস্যে। তখন, তার মনে হয়, পৃথিবীর সকল জন্মের ভেতর অথবা সকল মৃত্যুর ভেতর অথবা সকল জন্মের ভেতর এবং মৃত্যুর ভেতর তার জন্মের গন্ধ ছড়িয়ে আছে। অনেক অনেকদিন গত হয়ে গেলে, তখন, পিতৃমাতৃহীন এতিম ইমাদুল; তার বাবামা নেই, জমি নেই, শস্য নেই—তবু সে তার জন্মের ভেতর লোহার গন্ধ পায়, এবং তখন সে কামারশালার দরজায় উঁকি দেয়া লাউলতার দিকে ফেরে; তার হয়ত মনে হয়, তখন, গ্রামের সকল ক্ষেত, সকল শস্য, সকল বৃক্ষ থেকে ভেসে আসছে লোহার গন্ধ, অথবা সকল শস্যে তার শরীরের ঘাম লোহার গন্ধ নিয়ে বিকেলগোধূলির গানের ভেতর উড়ছে।
গ্রামের সকল জমি আর শস্যে ইমাদুল কামারের শরীর, শরীরের ঘাম, ঘামের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়লে সে প্রান্তরের ছায়া ছেড়ে ফিরে আসে কামারশালায়। ঘামের অনুভূতির ভেতর শস্যের গন্ধ, মেঘের গন্ধ; গন্ধের ছায়ায় মাটির চৌবাচ্চায় ঠান্ডা পানি, স্থির হাপরের ছায়া আর নিভে যাওয়া কয়লার অন্ধকারে কামারশালার অনুপম নৈঃশব্দ্যের মধ্যে তার হৃদয় জেগে ওঠে। দূরে দূরে শহর থেকে শহরে চলে যাওয়া গাড়ির শব্দগুলো বিলীন গোধূলি হয়ে যাচ্ছে। এইসব হারিয়ে যাওয়া ধ্বনিতরঙ্গের ভেতর সে হাপর টানলে নিশ্চুপ কয়লাগুলো অন্ধকারে জেগে ওঠে বিসর্পিল অগ্নিস্ফুলিঙ্গে। খণ্ড খণ্ড লোহা তেতে লাল। তখন, তার মনে হয়, লাল লোহা হাতুড়ির ছন্দে একেকটা প্রতিভা; তাতানো লাল লোহার ভেতর থেকে অগ্নিময়ূর পেখম ছড়িয়ে দেয়। রেতির ঘর্ষণে ধার প্রস্ফুটিত হলে চকচকে অস্ত্রের তুঙ্গতরঙ্গ ঝনঝন বেজে ওঠে তার শরীরে, পেশির মর্মে, ঘাড়ের কুঞ্চিত কেশকুঞ্জ লাফিয়ে লাফিয়ে শূন্যে নাচে, অগ্নিময়ূর ছুটে চলে তার অশ্বকরোটির ছায়ায়। কয়লার গন্ধ, আগুনের উজ্জ্বল বাষ্পবিন্দু; লোহার লাল প্রতিবিম্বিত বর্ণিল স্রোত এবং আলোছায়ার শূন্যতর গভীরতায় শব্দব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে অস্ফুট তার হাসির রেখা। বাঁশের মাচায় হারিকেনের মৃদু আলো দেখে গ্রামের লোকেরা বিমূঢ় প্রশ্ন করে—কাজ কইরছ না কি ভাই!—এসব প্রসঙ্গহীন অপাঙ্গদর্শিত প্রশ্নে কামারের স্বরকে আস্ফালন ও বিবিক্ত করে হয়ত; সে হয়ত কটু কথা বলতে প্রস্তুত ছিল, হয়ত রগড় দৃষ্টিপাতে ভয়ঙ্কর খিস্তি বলতেই নিরুপায়; তথাপি এ মুহূর্তে তার আনন্দিত হৃদয় অস্ত্রের ধার এবং প্রতিভা আবিষ্কারে স্পন্দিত, ফলত, কাজ না করলে সে কি চুরি করে খাবে!—এমন বাক্যবিন্যাসে তার মুখভঙ্গি ও স্বভাব নির্ঝঞ্ঝাট। এই যে বিনম্র গোধূলি; এখন, যখন, আঁধার অনন্ত; জোনাকির আলোর ভেতর দিয়ে ঝিঁঝিঁর মুখরিত টোড়ি প্রভাত হয়ে যাচ্ছিল, তখন সে তো কামার না, নয়! হয়ত সে তখন অন্যমনষ্ক। সন্ধ্যায় গ্রামের লোকেরা মৃদু আলোছায়ায় বসে কামারশালার বাঁশের মাচায়, প্রতিদিন এইসব লোহার ধার আবিষ্কারের পর সে, ইমাদুল, তার হাপরের শব্দের পিছনে একতারার আওয়াজ প্রতীক হয়ে আছে। তখন, প্রতিদিন ধ্যানিসন্ধ্যায় কামারশালার বাঁশের মাচায় এসে বসে বাউলের গান।

তখন, গ্রামের লোকেরা একদিন আসে, দুইদিন আসে, তিনদিন আসে, চারদিন আসে; এবং তারা, তখন, যখন, প্রতিদিন কামারশালার সন্ধ্যায় বাঁশের মাচা দখল নিয়ে বসে, তখন, হাপরের পিছনে একজন বাউল একতারা বাজিয়ে গান করে। গ্রামের লোকেরা বলে, তার নাম কেরামত আলী সাঁই; অথবা তারা বলে, তার নাম ছিয়ামদ্দি মণ্ডল; অথবা গ্রামের লোকেরা বলে, হয়ত সে অখিলেশ দাশ বাউল। গ্রামের লোকেরা, তখন, হয়ত নাম নিয়ে বিভ্রম করতে উৎসাহী, বলে, গান শুইনচ নাকি ইমাদুল? এই অনর্থক প্রশ্নে ইমাদুল হয়ত বলে, এইসু, গানই শুইনচি গো! অথবা সে হয়ত কিছুই বলে না। অথবা এমন যে, ইমাদুল কামার তার মৌনতার ভেতর গ্রামের লোকদের বাঁশের মাচায় বসতে বলে, সে হয়ত, তখন, আগুনে পোড়া অস্ত্রের ধার পরীক্ষা করে আঙুলে, হয়ত অস্ত্র উল্টেপাল্টে দেখে, টেম্পার দেয়, এবং অনেকদিন পর সে হয়ত বাউলের এইসব গান আর অস্ত্রের ধার নিয়ে যায় পৃথিবীর প্রান্তরের দিকে, গৃহের দিকে; যেন তার গৃহ পৃথিবীর প্রান্তে। সেখানে, গৃহে, শস্যের গন্ধ বুকে নিয়ে প্রতীক্ষায় তার বউ। সেখানে, গৃহে, মাঠের রংধনু ছুঁয়ে থাকে তার ছেলেমেয়ে। পৃথিবীর কোথাও যাওয়া হয়নি তার, গ্রামের কোথাও না, নদীর স্রোতেও না। তখন, তার অখিলেশ দাশ বাউলের কথা মনে পড়ে; অথবা, তখন, হয়ত ছিয়ামদ্দি মণ্ডলের গান ভেসে আসে; হয়ত এমন হতে পারে কী যে, তার মনে হয়, সে কেরামত আলী সাঁইয়ের গানে ডুবে গেছে পৃথিবীর সবুজ ছায়ার ভেতর, ভেসে গেছে গ্রামের সকল মেঘে। অথবা তার মনে হয়, বাউলরা কত কত পৃথিবীর ধুলোর ভেতর নিয়ে এসেছে মানুষের পৃথিবীর ইতিহাস, মানুষের পৃথিবীর সুরের নদী, মানুষের পৃথিবীতে মাছের জীবন—কী নিশ্চিন্ত, ভয় নেই। অনেক অনেকদিন পর, একদিন, এইসব সুর আর ধুলোর ইতিহাস তার জন্মের ভেতর লোহার গন্ধে মিশে গেলে মনে হয়, তার উঠোনেই তো পৃথিবীর সকল আকাশ, তার গৃহেই তার ছেলেমেয়ের হৃদয়ে গুঞ্জন করে গ্রামের সকল পাখি, আর তার বউয়ের চোখে নদীর সকল মাছের লাফালাফি। অথবা সে গিয়েছিল পৃথিবীর সকল শস্যভ্রমণে, গিয়েছিল পাখির সকল গানে, গিয়েছিল মেঘের নিরুদ্দেশে। যখন, সে তার বউকে জাপটে ধরে, আঁধার মাটির গভীরে ঢুকিয়ে দেয় লাঙলের কঠিন হল—বউয়ের বুক চিরে বৃষ্টির অন্যতম গন্ধে আলো হয়ে আসে শস্য—যেমন পাখির বাক্য নিয়ে তার সন্তানেরা, যেমন বৃক্ষের সকল ফুল ছুঁয়ে তারা—দৃশ্যত এ জন্মবৃত্তান্ত শস্যের অবারিত মুদ্রিত সবুজ গ্রন্থ। ইমাদুল কামার বউ-ছেলেমেয়েকে পৃথিবীর গল্প বলে, শস্যের গল্প বলে, সবুজ গ্রন্থের গল্প বলে। বলে, পৃথিবীর সকল শস্যে লেগে আছে লোহার লাবণ্য, লোহার ধারালো প্রতিভা। ছেলেমেয়েরা ভাবে, তবে, পৃথিবীর সকল শস্য তার বাবার—তারা সকল শস্যের উত্তরাধিকার। পৃথিবীর সকল মাছ তার বাবার—তারা সকল নদীর উত্তরাধিকার। পৃথিবীর সকল বৃক্ষ তার বাবার—তারা সকল বৃক্ষের উত্তরাধিকার। পৃথিবীর সকল মেঘ তার বাবার—তারা আকাশের উত্তরাধিকার। পৃথিবীর সকল গান তার বাবার—তারা সুরের উত্তরাধিকার। তখন, তারা তাদের বাবার কামারশালার ছোটবড়ো হাতুড়ির শব্দে গান শোনে, সুর শোনে; পানির চৌবাচ্চায় লাল লোহা চুবানোর শব্দে গান শোনে, সুর শোনে; হাপরে বাতাসের লুকোচুরির ভেতর গান শোনে, সুর শোনে; আগুনের নীল শিসের ভেতর গান শোনে, সুর শোনে। গানের সুরে তাদের হয়ত তখন আনন্দ পায়, ঘুম পায়; ঘুম ভেঙে জেগে তাদের, তখন, ক্ষুধা পায়। কিন্তু তারা দেখে তাদের গৃহে শস্য নেই, মাছ নেই। তারা তাদের বাবাকে জিজ্ঞেস করে—শস্য কোথায়? মাছ কোথায়? কোন গৃহে? কোন মাঠে, কোন নদীতে, কোন আকাশে? ছেলেমেয়েরা তাদের চারপাশে নদী মাঠ আকাশ দেখতে পায় না। তখন, পৃথিবীর সকল শস্য উড়ে উড়ে হারায়; তাদের বাবার কামারশালার গান গভীর শূন্যতার ভেতর স্তব্ধ হয়ে যায়। গান হারিয়ে শস্য হারিয়ে মাছ হারিয়ে তাদের, তখন, কান্না পেলে বাবা বলে,—চল, হারিয়ে যাওয়া নদী খুঁজে আনি। তারা তিনজনে যায় নদীর সন্ধানে, দেখে নদী চলে গেছে ধূসর দিগন্তের ছায়ার ভেতর। তারা ছায়ার ভেতর দৌড়ে গেলে দেখে ঝুরঝুর বালির রাষ্ট্র। তারা বালির রাষ্ট্রে ঘর কাটে, চাঁদ আঁকে, অংক লেখে, শস্য ফোটায়, পাখি উড়ায়, গান আঁকে। কতকাল থাকে বালির রাষ্ট্রে এইসব চাঁদ, অংক, শস্য, গান, পাখি। কতকাল থাকে বালির রাষ্ট্রে এইসব তাদের প্রতিভা। বিকেলগোধূলির ভেতর এইসব বালির রাষ্ট্র মুছে গেলে হারিয়ে গেলে, তারা, কামারের ছেলেমেয়ে কত কত দিন পর শৈশব হারিয়ে বালির রাষ্ট্রে এসেছে, তারা শস্য নদী মাছ পাখি হারানোর কান্না ভুলে বালি মাখে শরীরে। কামারের মনে হয়, তার ছেলেমেয়ের বালিমাখা শরীর যেন লোহার ধারালো ঝিকমিক। বালির ঝিকমিক তাদের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, শরীরকে মনে হয় নদী—হৃদয়ে জলের গন্ধ নিয়ে। তাদের শরীরে বালির চিকচিক, শরীরকে মনে হয় নক্ষত্রের উজ্জ্বল—হৃদয়ে মেঘের গান নিয়ে, পাখির উড়াল নিয়ে। শরীরে বালির ঝিকমিক রোদের লাফ—লোহার গন্ধ নিয়ে শরীরে নদীর জলস্রোত রোমাঞ্চিত হয়ে এলে তারা বালির ভেতর লাফায়, গড়াগড়ি করে। তাদের লাফে বালির ঝুরঝুর ভেঙে উঠে আসে দুটি সেনালি মাছের মৃত পাখনা, কানকোর কাঁটা—যেন আধখানা কাস্তে। 
অনেক অনেকদিন পর, তখন, ঝুরঝুর বালির ভেতর একটি সোনালি মাছের কশেরুকাকাঁটায় লোহার গন্ধ পেলে ইমাদুল তার জন্মের দিকে ফেরে, মানুষের জীবনের দিকে তাকায়, শস্যের অঙ্কুরের দিকে দেখে। তখন, হয়ত পৃথিবীর সকল জন্ম ও মৃত্যুর গন্ধের ভেতর তার অনুভূতির ঝুরঝুর বালি ভেঙে পড়ে।
শরীরে বালির অনুভূতি নিয়ে কামারের ছেলেমেয়ে গৃহে ফেরে। তাদের শরীরের ভেতর মাছের মৃত পাখনা খেলা করে, কানকোর কাঁটার আধখানা কাস্তে খেলা করে। মৃত পাখনা আর কানকোর কাঁটার কাস্তে তারা পাঠ্যপুস্তকের ভেতর জমিয়ে রাখে, যেন ময়ূরের ঝরা পালক। সকল রাতে ভাইবোনের তন্দ্রার ভেতর মৃত মাছের পাখনা আর কানকো লাফিয়ে বেড়ায়, তাদের ঘুম আসে না। তন্দ্রার ভেতর তারা দেখে ঝুরঝুর বালির রাষ্ট্রে আঁকা তাদের গৃহ মুছে যাচ্ছে, চাঁদ মুছে যাচ্ছে, অংক মুছে যাচ্ছে, পাখির উড়াল মুছে যাচ্ছে, শস্য মুছে যাচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকের ভেতর তারা দেখে নদীর যুদ্ধ, নদীর রক্তপাত, নদীর মৃত্যু। নদীর মৃত্যু হলে মাছ কোথায় পাবে তারা; তারা এই কথা মনে করে অন্ধকারের ভেতর কাঁদে। অথবা তারা কাঁদে না, তারা কাঁদে হয়ত হারিয়ে যাওয়া নদীর দুঃখে; নদী হারিয়ে গেছে তাদের বাবার জন্মের গন্ধ নিয়ে, তাদের বাবার জন্মের মাছ নিয়ে। তখন, অনেক অনেকদিন পর, তাদের মনে হয়, হয়ত মাত্র দুটি মাছের প্রয়োজন তাদের। তাদের চারজনের সংসারে কত মাছের প্রয়োজন, অথবা কতটুকু প্রয়োজন শস্যের, অথবা কতটুকু পাখির, কতটুকু জ্যোৎস্নার, কতটুকু গানের? তখন, হয়ত, অনেক অনেকদিন গত হয়ে গেলে, তারা তাদের বাবাকে বলে, লোহার শিকল গড়ে দিতে। তারা বলে কী যে, তারা শিকলে বেঁধে রাখবে নদী—মাছের নিরুদ্দেশ ঠেকাতে। তারা হয়ত বলে যে কী, শিকলে আটকে রাখবে আকাশ—তবে, তখন, মেঘ জমুক বৃষ্টির গন্ধে। তারা বলে হয়ত এই যে, শিকলে মাঠ বেঁধে রাখবে—কিছু শস্য তাদের ক্ষুধার জন্য, তবে, তখন। তাদের বাবা তথাপি নীরব, বাবার নীরবতা দীর্ঘ স্বেচ্ছাচারিতা পেলে তাদের ক্ষুধা পায়, নিদ্রা পায়। অথবা নিদ্রা নয়, তন্দ্রার ঘোর; ক্ষুধা নয়, ক্ষুধার লাফ। এইসব তন্দ্রা তাদের ভালো লাগে না—ক্ষুধা ভুলে যায়। গভীর কান্নার ভেতর তাদের তন্দ্রা ভেঙে গেলে বাবা বলে, মানুষ না থাকলে কী প্রয়োজন শিকলের, পাঠ্যপুস্তকের—বিদ্যালয় ভুলে যায় তারা। 
গ্রামের লোকেরা, তখন, অনেক অনেকদিন পর, ইমাদুল কামারের শিশুকালের স্মৃতির ভেতর ঢোকে, এবং তারা বলে কী যে, সে যেমন লেখাপড়া না শিখে নাটবল্টু কুড়িয়ে শিশুকাল পার করে; অথবা গ্রামের লোকেরা কিছু বলে না, হয়ত বলে, গিরামে একখান কামার দরকার ছিল। গ্রামের লোকেরা এইসব বলাবলি করলে ইমাদুল কামারের ছেলেমেয়ে পৃথিবীর প্রান্তে তাদের গৃহকোণে বাবার জমানো লোহার পেরেক নাটবল্টু সাইকেলের স্পোক ছোট ছোট চাকতি বোঝায় একটা চটের বড় বস্তার মুখ খোলে, এবং তারা, তখন, তাদের বাবার শিশুকালের এইসব লোহালক্কড়ের ভেতর প্রাচীন গন্ধ অনুভব করে। তারা এইসব নাটবল্টু ছোট ছোট চাকতি সাইকেলের স্পোক পেরেক স্ক্রু গজাল ক্ষয়া দা বটি ভাঙা কাস্তে শিক ইত্যাদির ভেতর কত প্রাচীন গন্ধ পায় যে, তাদের সামনে লোহার একটা সাম্রাজ্য। তখন, তারা ভাবে পাঠ্যপুস্তক ফেলে শিখবে লোহার বিদ্যা; পৃথিবীর কত কত প্রাচীন সভ্যতার ছায়ায় লোহার আবিষ্কার। তন্দ্রার আচ্ছন্নতা আর কান্নার ভেতর তারা দেখে—কত কত প্রাচীন সভ্যতার পাতায় পাতায় রক্তাক্ত তরবারি, বল্লম; দেখে কত কত প্রাচীন নারী শস্যপ্রান্তরে লাঙলের হল হাতে নিয়ে বৃষ্টির প্রতীক্ষায়। নারীদের মনে হয় মা, মনে হয় সহোদরা। তারা তরবারি আর বল্লম ভেঙে কাস্তে বানায়, হল বানায়, কোদাল বানায়, পেরেক বানায়, গজাল বানায়। তারা দেখে এইসব অস্ত্রের হৃদয়ে লেগে আছে লাউফুলের রেণু। দেখে ক্ষেতের সকল শস্যপুষ্পরেণু পাহারায় পৃথিবীর সকল নগর আর রাষ্ট্রের নিঃসঙ্কোচ তরবারি আর অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র। তারা পাঠ্যপুস্তক খুলে তাদের বাবাকে আর গ্রামের লোকদের দেখায় এইসব মারণাস্ত্র, মাকে আর গ্রামের নারীদের দেখায় এইসব রাষ্ট্রের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা। তখন, যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা দেখতে গেলে পাঠ্যপুস্তকের ভেতর জমানো মাছের কানকোর কাঁটার কাস্তে হারিয়ে যায়; অনেক অনেকদিন পর, তখন, তারা চটের বস্তার ভেতর বাবার জমানো নাটবল্টু স্পোক স্ক্রু চাকতি বের করে, এবং ফেলে দেয়া পাঠ্যপুস্তকের এসো নিজে করি অধ্যায় পড়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার অস্ত্র গড়তে শেখে। গ্রামের লোকেরা, তখন, ইমাদুল কামারকে বলে, কিরে তর পোলামাইয়া দেখি এঞ্জিনিয়ার হবে! অথবা তারা কিছুই বলে না; তাদের এইসব বলাবলির ভেতর রগড় হলে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার অগ্নিরক্ত ভাইবোনের স্নায়ুর ভেতর ক্ষুধার ভেতর তন্দ্রার ভেতর ফুটে থাকা প্রেম দ্বিখণ্ডিত করে ছুটে যায় স্ফুলিঙ্গ। তাদের বাবা বলে, এইসব খেলার ভেতর মানুষ কোথায়? নদী কোথায়, মাছ কোথায়, নৌকা কোথায়? তাদের বাবা হয়ত বলে, এইসব খেলার চাইতে মাছের খেলা জানা ভালো, মাছের লাফ জানা ভালো। অথবা বলে, এইসব খেলার চাইতে লোহার গন্ধের ভেতর জন্মের খেলা জানা ভালো। তখন, ভাইবোনের খেলার ভেতর হয়ত একটি স্মৃতির অবলম্বন ফিরে আসে, এবং তারা তাদের বাবার জন্মের গন্ধের ভেতর প্রবেশ করে; তখন, তারা দেখে এমন যে কী, তাদের বাবার জন্মের ভেতর লোহার গন্ধ বুকে নিয়ে একটি শিশু ক্ষুধা নিয়ে ঘুরছে ধুলোর ভেতর, বিষণ্ণ হাটের ভেতর, অথবা নদীর বিকেলগোধূলির ভেতর; তখন, গ্রামের লোকেরা শিশুটিকে বলে, কিরে আইজ কতগুলা নাটবল্টু পেইলি।
অনেক অনেকদিন পর, গ্রামের লোকদের এইসব বলাবলি গোপন হাসির রগড় হলে ভাইবোনের ক্ষুধার ভেতর কান্না জমে। তারা, তখন, গোপনে কাঁদে, অথবা মাথার ভেতর অজানা ভয় দৌড়ে বেড়ায়, এবং তারা তাদের গৃহকোণে চটের বস্তায় রাখা পেরেক নাটবল্টু স্পোক হাতে নিয়ে অপেক্ষা করে, হয়ত অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ ছিল; তারা ক্ষুধার ভেতর ঘুমিয়ে পড়ে, এবং ঘুমের ভেতর মা কোথায়—গেছে প্রাচীন শস্যপ্রান্তরে বৃষ্টির প্রতীক্ষায়। বাবা কোথায়? তখন, তাদের, এতদিন পর এতকাল পর, এতদিন এতকাল পর এইসব তীব্র তীক্ষ্ণ তমোহর ছন্দলিখিত লোহা আশ্চর্য বিদারক মনে হয়, ভয়ঙ্কর আঁধাররচিত কঠোর কঠিন নিষ্ঠুর অনাত্মীয়। বাবা বাড়ি এলে তারা ঘুমের গন্ধের ভেতর বলে, ভয়। বৃষ্টির প্রতীক্ষায় শূন্য হাতে মা বাড়ি এলে তারা ঘুমের গন্ধের ভেতর বলে, ক্ষুধা। গ্রামের লোকেরা বলে, অমোঘ স্তব্ধ ভয়ে নিরাপত্তাহীন শূন্যতার ভেতর, শূন্যতাবোধের ধাতব বিলাপের ভেতর ইমাদুল কামার, তখন, যখন, যুদ্ধস্রোতের অচেনা ছায়াদৃশ্য দৃশ্যশূন্য ভয়, হৃদয়ের অনুতাপে জমা রাখা গৃহের নিরাপত্তা পেরেকগুলো ছুঁয়ে থাকে, আর তাকে জড়িয়ে থাকে তার বউ, তার ছেলেমেয়ে। জড়াজড়ি শুয়ে দেখে তাদের শস্যশূন্য গৃহের চালে জ্যোৎস্নার বিনীত পুরস্কার, চালের জ্যোৎস্নায় চন্দ্রালি মেঘ ছুঁয়ে রাতের সকল শিশির তাদের শরীরে। সকল ক্ষুধা তাদের শরীরে। তারা শরীরে শিশিরের গন্ধ নিয়ে জড়াজড়ি শরীরে ঘুমিয়ে পড়ে।
শরীরে শিশিরের গন্ধ নিয়ে, ইমাদুল কামার, গ্রামের সকল শস্যের প্রতিশ্রুতি আর গভীর বিশ্বাস তার কণ্ঠস্বরে শিশুর সারল্যে আঁকা ছিল, সে ফিরে আসে কামারশালায়; তখন সকাল আশ্চর্য সুন্দর সূর্যালোক স্বপ্নযামিনির দিকে আহ্বান করে। দেখে কামারশালার সকালে জমে আছে মুঠো মুঠো কয়লা—নিরীহ, নির্বিরোধী। সকালের নিদ্রাবিবিক্ত সোনাবর্ণ, বিলাসিতায় যার নিরীহ শ্লেষ, তীক্ষ্ণ রৌদ্রে স্তূপীকৃত কয়লা পাণ্ডুর; লোহার অলঙ্কারের তারতম্যে বিবসিত,—এই অনুভূতি তাকে চঞ্চল করে, সকাল ধ্বনিপ্রতিধ্বনির মর্মবিদারক। সে হাসে, আর কয়লার স্তূপ শিকের খোঁচায় ছায়া করে দেয়। অস্ফুট খিস্তি করে, যেন তা কোনো মনোহর গানের উক্তি, অথবা কণ্ঠস্বরে সকালের প্রার্থনার ছবি চিত্রিত। এইসব চিত্রপটে গ্রামের লোকেরা হাসি হাসি মুখে কামারশালায় আসে, তারা পোড়াতে দেয়া অস্ত্র নিয়ে ক্ষেতে যাবে। তখন, গ্রামের লোকেরা ব্যস্ততম অপেক্ষার ভেতর দেখে ইমাদুল কামার নীরব হাসি নিয়ে গুনগুন গান করে, অথবা ইমাদুল কামার অস্ফুট খিস্তি করে বলে, টেকা দিবা না! কি কইচ্চ কামার বিটা, টেকা যাওয়ার পথে দেবানি। সকালবেলা টেকা না দিলি মইরি যাব! মইরবিনি, মইরবিনি। মইরলি আমার জানাজায় যেয়ু কিন্তু। অথবা তারা কিছুই বলে না। তারা ইমাদুল কামারকে একটা ডারবি অথবা হলিউড ফিল্টার সিগারেট এগিয়ে দিলে সে গানমুখে সিগারেটে আগুন জ্বালায়। সকালবেলার কয়লায় কালো আলোছায়ার ভেতর সিগারেট পোড়াতে পোড়াতে ইমাদুল কামার বলে, সকালবেলা এট্টু পাত্থনা করা লাগে না! অতঃপর নিঃশেষিত আগরবাতির প্যাঁচ খাওয়া ধোঁওয়ার গন্ধের ভেতর সে বলে, বইসো। অথবা সে কিছুই বলে না; তথাপি, এখন, অকস্মাৎ ইমাদুল কামার স্বেচ্ছাচারী, ছায়া করে দেয়া কয়লার স্তূপে দৃশ্য দিয়ে সে স্থির। নিশ্চুপে পোড়ানো অস্ত্র দিয়ে দেয়, অন্তরঙ্গ উজ্জ্বল ধারের ভেতর থেকে বিকিরিত হয় লোহার ক্ষমতা আর মনীষার জ্যোতির্ময় জঙ্গম। 

অতঃপর, অনেক অনেকদিন পর, আমরা দলে দলে খণ্ড খণ্ড লোহা নিয়ে যায় কামারশালায়—কোনো খণ্ড প্রজ্জ্বলিত, কোনোটি আততায়ী, কোনোটি রক্তপাত, কোনো খণ্ড হলোকাস্ট, কোনোটি ক্যামোফ্লেজ, একটি খণ্ড ডেমক্র্যাটিক ভায়োলেন্স, একটি খণ্ড ডিপ্লোম্যাটিক, কোনো খণ্ড কুণ্ডলিত কালো কুজ্ঝটিকা, কোনো খণ্ড স্বৈরতন্ত্রী লোভ, একটি খণ্ড রোদনের ভেতর শ্মশানের নিরুদ্ধ বাতাসের আর্তনাদ। আমরা কামারকে বলি, সে আমাদের প্রাণের ভাই, আমাদের হৃদয়ের বন্ধু। বন্ধুর অস্ত্র গড়া যেন খেলা, ভাইয়ের অস্ত্র গড়া যেন হাসি। আমরা খেলতে খেলতে হাসতে হাসতে খেলার মহড়া করি। খেলার নাম দিই যুদ্ধ, হাসির নাম দিই মৃত্যু। এইসব খেলাধুলার জন্য ট্রাক ট্রাক কয়লা আমদানি করে জমা রাখি কামারশালার শস্যপ্রান্তরে, বনভূমির ছায়ায়, নদীর করোটির ভেতর, পাখির ডানায়, মাছের লাফে, বাতাসের গন্ধে। আমরা চাই এসব কয়লার জ্বলন্ত অগ্নিগর্ভে পুড়ে পুড়ে পুড়ে পুড়ে তৈরি লোহার অস্ত্রে জ্বলে উঠুক সহস্র বিদ্যুৎ।
কয়লার কালো আঁধার কামারশালা থেকে শস্যপ্রান্তরে ছড়িয়ে পড়লে ইমাদুল কামার বৃদ্ধ উটের মতো কয়লার কাঁটা গাছ খেতে খেতে চোয়াল রক্তাক্ত করে ফেলে, আমরা চোয়ালের রক্তে মৃত শিশুর আত্মা ঝুলিয়ে দিই। ইমাদুল কামার এইসব মৃত্যু জয় করতে পারে না। এইসব মৃত্যু ও হত্যা জয় করতে না পারলে সে দেখে তার জন্মের ভেতর লোহার গন্ধে মানুষের জন্ম ও মৃত্যুর গন্ধ মেঘ হয়ে আছে। তখন, সকল মৃত্যু দূরত্বে রাখার ইচ্ছায় সে তার কামারশালার ছোট্ট চৌবাচ্চার পাশে রেললাইনের খণ্ডের উপর হাতুড়ি পিটায়। জ্বলন্ত গনগনে কয়লার ভেতর থেকে তাতানো লাল লোহাগুলো পিটিয়ে পিটিয়ে চৌবাচ্চার ঠান্ডা কালো পানিতে চুবিয়ে টেম্পার দিতেই আমাদের যুদ্ধ-খেলার অস্ত্রগুলো মৃত হরিণের মুখ হয়ে গেল। অস্ত্রগুলো মৃত মাছ হয়ে, মৃত পাখি হয়ে, মৃত বাঘ হয়ে, মৃত শাখামৃগ হয়ে, মৃত সাপ হয়ে, মৃত বৃক্ষ হয়ে, মৃত মেঘ হয়ে, মৃত নক্ষত্র হয়ে ভেসে ওঠে চৌবাচ্চার নিস্তব্ধ প্রতিবিম্বে। আমরা ইমাদুল কামারের এইসব ইন্দ্রজালের ধন্দে পড়ি, তাকে হত্যার ভয় দেখাই। সে এইসব মৃত্যু এবং হত্যা জয় করতে পারে না, তথাপি তার রক্তে হাপরের আওয়াজ আকাশ হয়ে ধ্বনিময় ছিল—সে কোথায়, যে রৌদ্রের নীলের প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় ছিল—নির্বাক নিঃশব্দ প্রশ্নে সে হাতুড়ির দিকে তাকায়, তার পায়ের দিকে দেখে। তার পা হাতুড়ি যেন। পা বিষয়ক এই আবিষ্কারে তার আশ্চর্য বিস্ময় বোধ হয়, এবং তখন সে মানুষের পৃথিবীর দিকে ফেরে; মানুষের গ্রামের দিকে, মানুষের জন্মের দিকে, শস্যের অঙ্কুরের দিকে তাকায়। পৃথিবীর সকল গ্রামের ধুলো, পৃথিবীর সকল জন্মের ধুলো, পৃথিবীর সকল শস্যের গন্ধ তার হাতুড়িপায়ে জড়িয়ে গেলে সে বয়ে চলেছে মানুষের সকল ভবিষ্যৎ, সকল সৃষ্টির গোপন কান্না। তখন অশ্রুশুষ্ক তীক্ষ্ণ রৌদ্রকর্মা চোখে আঁধার ঘনিয়ে এলে সে পুনর্বার রেললাইনের খণ্ডে উপর হাতুড়িপা পিটায়। ক্রমাগত হাতুড়িপায়ের আঘাতে রেললাইনের খণ্ডটি লম্বা হতে হতে লম্বা হতে হতে স্তব্ধ সন্ধ্যার আঁধার ফেড়ে কামারশালার লোহালক্কড় পেরিয়ে চলে যায় দিগন্তপ্রান্তরের দিকে। স্তূপীকৃত কয়লার বুক চিরে উজ্জ্বল রেলপথ নির্জন নিঃশব্দ নিবিড় সবুজের অন্তহীন অপ্রতিরোধ্য আশ্চর্যের ভেতর বয়ে চলে, আর লোহার সমান্তরাল তীক্ষ্ণ তীব্র চিকন বিদ্যুতের উপর রাতের সহস্র নক্ষত্রের নির্বাক জাগরণ ঘটে। রেলপথের হৃদয়ের ভেতর একটানা হু হু কণ্ঠস্বর আর্তনাদ করে, আবার হয়ত সুগভীর নিস্তব্ধতা, নৈরাশ্য চন্দ্রালোকে অস্ফুট প্রতিধ্বনি তুললে ইমাদুল কামার চৌবাচ্চা, হাপর, সাঁড়াশি, হাতুড়ি, রেতি, ছেনি নিয়ে উঠে আসে দিগন্তপ্রান্তরে নিরুদ্দেশ রেলপথের উপর। রেলপথের লোহার কঠিন, নিচে পাথরের ভয়ঙ্কর ও অদৃশ্য সহিষ্ণু এবং আকাশের নক্ষত্রনিচয় তাকে শিশু করে তোলে। তখন ইমাদুল মাছের রক্তমাংসের গন্ধ নিয়ে কামারশালায় চৌবাচ্চার পানির তলায় ঢুকে পড়ে, লোহার গন্ধ নিয়ে সে লাফিয়ে ওঠে শূন্যে। সে হাপরের পৃষ্ঠা খুলে পড়ে বায়ুর অক্ষর, হাতুড়ির খাঁজ খুলে পড়ে লোহার বর্ণমালা, সাঁড়াশির দাঁত খুলে পড়ে ক্ষমতার ভাষা, চৌবাচ্চার জল ভেঙে পাঠ করে হারিয়ে যাওয়া নদীর জীবন—মৃদু, প্রায় দৃশ্যহীন, কুয়াশার নির্লিপ্ত নৈশজোনাকিদের হাড়ে ছায়াগুঞ্জরিত আলোর স্পন্দনে এইসব অক্ষরমালা নিস্তব্ধ জংশনের সজীব স্বরলিপি হয়ে ওঠে। অক্ষরগুলো গ্লেসিয়ার, অক্ষরগুলো কামারশালার ধূসর পৃষ্ঠা থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে তার করোটির ভেতর রেটিনার ভেতর নিঃশ্বাসের চঞ্চলতায় জিহ্বার রক্তে দ্বিধালুপ্ত গ্রীবার হাড়ে আর রক্তের স্ফুলিঙ্গে নিঃশব্দে গুঞ্জন ছড়ায়। নক্ষত্রনীলাভ্রের এইসব অক্ষরগুঞ্জনে সে উন্মুখ হয়ে ওঠে, প্রতীক্ষা করে একটি ঝকঝকে সোনালি ট্রেনের। হয়ত, অনেক অনেকদিন পর, সোনালি মাছের মতো ট্রেন লাফাতে লাফাতে এসে তার প্রতীক্ষার তন্দ্রা ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে আসে। শিশিরের নদীর ভেতর থেকে ট্রেনের বগির মতো সোনালি মাছের কশেরুকা লাফাতে লাফাতে সমস্ত কয়লা তুলে নেয়, মাছকশেরুকার ট্রেনমাছটি কয়লা নিয়ে ডুবে যায় শুকনো নদীর ঝিকমিক বালির ভেতর। এরূপ, এমত, অসংখ্য নিঃশব্দ লোহার গজালবিদ্ধ মাছকশেরুকা রক্তের ছায়ামর্মরিত উল্লাসে নির্লিপ্ত, নিদারুণ প্রহেলিকায় আনন্দিত হয়ে উঠলে ঝিঁঝিঁর ডাক, কোথাও নৈঃশব্দ্য বৃক্ষপত্রের নিশ্চুপ, কোথাও নিশিপতঙ্গের বিস্ময়ভ্রমণের ভেতর অবিরাম শিশির ঝরে পড়ে।

ভোর ভোর আঁধারে শিশিরের গন্ধ ছুঁয়ে ইমাদুল কামারের ছেলেমেয়ে ঘুম থেকে জেগে দেখে তাদের বাবা নেই। মা আর তারা কামারশালায় আসে তাদের সংসারের লোহাকামারের সন্ধানে। গ্রামের লোকেরা আসে পোড়াতে দেয়া অস্ত্রের খোঁজে। মৃদু চন্দ্রালোক তাদের নিয়ে যায় দিগন্তপ্রান্তরে নিরুদ্দেশ রেললাইনের উপর। তারা দেখে চন্দ্রালোকে ঝরে পড়া রাতের সকল শিশিরবিন্দু লোহার উজ্জ্বল হৃদয়ে সপ্রতিভ মরিচার রাজ্যপাট বিস্তার করে চলেছে, আর রেললাইনের প্রস্তরখণ্ড এবং দূরের বৃক্ষপত্রের ভেতর বিচরণশীল ধ্বনিমুখরিত কীটপতঙ্গের সঙ্গে আসন্ন সকালের আলোয় লাউফুলের মতো শুভ্র একটি শিশু মরিচাজর্জর খণ্ড খণ্ড লোহার ভেতর থেকে তুলে নিচ্ছে উঠোনের কোরাস সংগীতময় ঝকঝকে পেরেক।




আবু হেনা মোস্তফা এনাম। কথাসাহিত্যিক, সাহিত্যসমালোচক। জন্ম ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে, মেহেরপুর শহরে। লেখাপড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে। ‘ক্রুশকাঠের খণ্ডচিত্র অথবা অভাবিত শিল্পপ্রণালী’ (২০০৫) প্রথম গল্পগ্রন্থ। ২০১০ সালে প্রকাশ হয় দ্বিতীয় গল্প সংকলন ‘নির্জন প্রতিধ্বনিগণ’। তারপর ‘প্রাণেশ্বরের নিরুদ্দেশ ও কতিপয় গল্প’ (২০১১), ‘জোনাকিবাবুই’ (২০১৮) এবং উপন্যাস: ‘ক্রনিক আঁধারের দিনগুলো’ (২০১৪)। ২০১০ সালে সম্পাদনা করেন ‘অগ্রন্থিত গল্প: মাহমুদুল হক’, ‘আলোছায়ার যুগলবন্দি’, ‘মাহমুদুল হক স্মরণে’। তাঁর সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি ২০২০ থেকে প্রকাশ করছে ‘মাহমুদুল হক রচনাবলি’, ২০১৬ সালে মুদ্রিত হয় জীবনীগ্রন্থ: ‘কথাশিল্পী মাহমুদুল হক’। ২০২১-এর বইমেলায় বেরিয়েছে সমালোচনামূলক বই: ‘মাহমুদুল হক: সৃষ্টি ও শিল্প।’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ