TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

'জাদুবাস্তববাদ সাহিত্যকে কেন উত্তর-আধুনিক আত্মসাৎ করেছে?’ —কবির মুকুল প্রদীপ


মজার ব্যাপার হলো লাতিন আমেরিকায় যখন 'লো রেয়াল মারাভিঝোসে' [আশ্চার্য বাস্তব] রচনারীতি কিংবা মধ্যযুগের বারোকরীতি অবলম্বন করে লেখা হচ্ছে একের পর এক উপন্যাস এবং বিপুল জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বাস্তববাদী ইউরোপ তখন ডাডাইজম, সুররিয়ালিজমে মেতে আছে। কিন্তু বিংশ শতকের সত্তরের দশকে যদি উত্তর-আধুনিক কালপর্বের শুরু হয়, তাহলে বলতে হয় 'ম্যাজিক রিয়ালিজমে'র প্রেক্ষাপট গড়ে উঠেছিলো তারও বহু আগে। জার্মানির চিত্র সমালোচক রোঁ-হ-এর জাদুবাস্তববাদ শব্দের প্রয়োগ থেকেই যদি হিসেব করি, তাহলেও ১৯২০-২২ হবে- মানে উত্তর-আধুনিক কালপর্বের আগে। বলা হয়, জার্মানি হয়ে স্পেন, ফ্রান্স, তারপরে লাতিনে আসে এই জাদুবাস্তববাদ! সমালোচকদের এই মত আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না, কিন্ত এই তত্ত্ব উড়িয়ে দেয়ার মতো তথ্য-তত্ত্ব আমার কাছে অনেক আছে। উদ্দেশ্য আমার তা নয়, তথাপি শেকড় থেকে না হাতড়ালে তল পাওয়া মুশকিল। তাই শেকড় থেকেই এগোনো যাক।

মূলত লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তববাদের প্রথম প্রবক্তা বলা হয় আলেহ কার্পেন্তিয়র, এবং মিগেল আনহেল আস্তুরিয়াসকে। আলেহ কার্পেন্তিয়র (১৯০৪,১৯৮০) একজন কুবান লেখক। ক্যারিবিয়নের একটি বৃহত্তর দ্বীপ এই কুবা, আয়তন ১১৪,৫২৪ বর্গ কিলোমিটার। কুবার ইতিহাস হাতড়াচ্ছি তার কারণ, লাতিন আমেরিকার ইতিহাস এখান থেকেই কিছুটা হলেও স্পষ্ট হবে, আর লাতিনের ইতিহাস না জেনে তাদের সাহিত্য বোঝা প্রায় অসম্ভব। 'ক্রিস্টফার কলম্বাস' প্রথম এই কুবাকে দেখতে পেয়েছিলেন ২৮ অক্টোবর ১৪৯২তে, আর বলেছিলেন, 'আজ অব্দি যত দ্বীপ মানুষ দেখেছে, তার মধ্যে সবচে সুন্দর।' সমৃদ্ধি তার সৌন্দর্যের বর্ণনা থেকেই বুঝেছেন নিশ্চয়ই! আর এই সমৃদ্ধির কারণেই রানি ইসাবেলের নামে দ্বীপটা তিনি দখল করেন, খোলেন বাণিজ্যকেন্দ্র। এই দ্বীপে বসবার যাঁরা করতেন তাদের বলা হতো ইন্ডিয়ান, উৎপাদনে সমৃদ্ধ ছিলো বলেই এই ইন্ডিয়ানদের কাজ ছিলো কেবল সন্তান জন্ম দেয়া। পরে ক্রিস্টফার কলম্বাস চলে গেলে, ১৫১১তে এলেন এম্পানিওল দোন দিয়েগো দে বেলাথকেথ; তার কিছুদিন পরেই এম্পানিওলরা এক শুমারিতে [মানে কত ইন্ডিয়ান আছে গণনা করার জন্য] দশ লক্ষ ইন্ডিয়ানদের গুলি করে হত্যা করেন, এবং পুড়িয়ে মারেন। এক পর্যায়ে এই হত্যা ও পুড়িয়ে মারা তাদের মজার খেলা হয়ে ওঠে, কেননা ইন্ডিয়ানরা সব নাস্তিক; খ্রিস্টান হওয়াতেও তাদের কোন আগ্রহ নেই। এই হত্যার প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ে লাতিনের আরও বহু দেশে, এক পর্যায়ে দেখা যায় আর তেমন ইন্ডিয়ান নেই সেখানে; তখন স্পেনীয়দের মনে হলো তারা একটা ভুল করেছেন! নিকৃষ্ট কাজ করবে কে? স্পেনীয়রা নিশ্চয়ই নয়, তারা যে কোন্কিস্তাদোর, ক্যাথেলিক!

কাজেই সহজ সমাধান হিসেবে তারা আফ্রিকার নিগ্রোদের আনতে শুরু করে দিলো, যেহেতু তাদের মিলতো সস্তায়। এভাবে চলতে চলতে নিগ্রো হয়ে উঠেছিলো প্রায় এম্পানিওলদের সমান, মানে ৫০-৬০%। পরে ইংরেজ এলো, কিন্তু বেশিদিন টিকলো না, ১৭৬৩’র মধ্যেই কুবাকে ফিরিয়ে দিলো এম্পানিওলদের। হঠাৎ কুবায় বসবাসকারীরাই একদিন বুঝলো, দেশের সম্পদ চলে যাচ্ছে এম্পানিয়ায় ও রোমের পোপের কোষাগারে, ফলত ১৮১৯ কুবার এম্পানিওলরা স্পেনের এম্পানিওলদের বিরুদ্ধেই বিপ্লব ঘোষণা করলেন। এই সময়ে এসে লাতিনের প্রায় সব দেশগুলোই এম্পানিওল এবং ফরাসি উপনিবেশ কেটে বেরিয়েছে, কেবল কুবা বাদে, তাই শুরু হলো একের পর এক অভ্যুত্থান: ১৮২৬, ১৮২৮, ১৮৩০, ১৮৪৮, ১৮৫১, ১৮৫৫-তে। সাদা-রা তখন আইনিভাবে কালোদের আন্দোলন জটিল করে তুললো, কোন কালো সাদা বিয়ে করতে পারবে না, পাবে না কোন সরকারি চাকরি, ব্যবসাও গড়তে পারবে না, পাবে না কোন আইনি সহায়তাও। তবুও ১৮৬৮-তে কার্লোস মানুয়েল দে সেস্পেদেসের [ইতিহাসের প্রথম শ্বেতাঙ্গ ধনী ভালো মানুষ] হাতে ইন্ডিয়ান ও কালোরা মুক্ত হলো।

বলে রাখা ভালো, যে পুঁজিবাদ কিংবা শিল্পবিপ্লবের কোলে জন্ম নিয়েছে উত্তর-আধুনিক, লাতিন আমেরিকা উপনিবেশ মুক্ত হলেও তেমন কোন পুঁজি বা শিল্প কখনওই গড়ে ওঠেনি। তথাপি কেন জাদুবাস্তববাদ রচনা উত্তর-আধুনিক? সেটা বোঝার জন্যই ওপরের উদ্ধিতিটুকু দরকার ছিলো, এবং কার্পেন্তিয়রের রচনা বুঝতেও। কেননা আলেহ কার্পেন্তিয়র কখনোই তাঁদের ইতিহাসের বাইরে গিয়ে সাহিত্যের কথা ভাবেননি, এবং নিগ্রো, ইন্ডিয়ানদের বাদ দিয়ে তো নয়ই। কিন্তু ধারণা করা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন তিনি ফ্রান্সের পারীতে গিয়েছিলেন পাড়াশোনা করতে, ফ্রান্সে তখন ডাডাবাদ, নেগ্রিচুড, পরাবাস্তববাদ ব্যাপকভাবে আলোচিত সমালোচিত হচ্ছিলো, সাথে ফ্রয়েড, ইয়ুং এর মনস্তত্ত্বও- ফলত এসব আন্দোলনের প্রভাব তাঁর ওপর ছিলো; এখানে তিনি বন্ধু পেয়েছিলেন মিগেল আনহেল আস্তুরিয়াস, এবং নেগ্রিচুডের প্রধান প্রবক্তা এমে সেজেয়ারকে, ছিলো শেক্সপীয়র অফ কোম্পানি, জেমস জয়েসের মতো জটিল উপন্যাসিক। যদিও এসব আন্দোলনের প্রভাব কার্পেন্তিয়র ও আস্তুরিয়াস দুজনেই অস্বীকার করেছেন।

তারও পরে ১৯৪৯-তে বেরোলো কার্পেন্তিয়রের উপন্যাস 'এই মর্তের রাজত্ব' তখন সমালোচকরা মনে করলেন, পারীতে পড়াশোনার সময়ই কার্পেন্তিয়রের ভেতর 'এই মর্তের রাজত্বে'র প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিলো। আর কার্পেন্তিয়র বললেন 'হাইতিতে গিয়েই তিনি আবিষ্কার করেছিলেন ম্যাজিক রিয়ালিজম, কারণ লাতিন আমেরিকা হচ্ছে সেই পৃথিবী যেখানে স্বপ্ন আর বাস্তবের সীমান্ত কেমন যেন রহস্যসম্ভারে 'চিরস্থায়ীভাবে' অস্পষ্ট হয়ে আছে, কারণ সেখানে বাস্তবই চমৎকার আর চমৎকারই বাস্তব।' এই বক্তব্যের সূত্র থেকে সমালোচকদের দুইটা ধারণা নস্যাৎ করে দেয়া যায়, যেমন জার্মানি থেকে স্পেন, ফ্রান্স হয়ে লাতিন আমেরিকায় এসেছে জাদুবাস্তববাদ, আর উত্তর-আধুনিক দর্শন তো আলোকবর্ষ দূর কি বাত! তবে এখানে আর একটা সত্য আছে, তা হচ্ছে স্পেন ও ফরাসী উপনিবেশ, লাতিনকে এই দুই উপনিবেশই চুষে খেয়েছে, ইচ্ছামতো মেরেছে, আর উপনিবেশের প্রভাবতো থাকেই সাহিত্যের ওপর। কিন্তু আমরা যদি কার্পেন্তিয়রের উপন্যাস 'এই মর্তের রাজত্ব' গল্প 'উৎসের দিকে'র গভীরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি, তাহলে দেখতে পাই, আধুনিক এম্পানিওল ও ইউরোপের মস্তিষ্কসম্বল বাস্তবতা সেখানে ভেঙে চুরমার করে দেয়া হয়েছে।

ইউরোপী আধুনিকতা মূলত চাপিয়ে দেয়া কিছু গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ ধারণা, যেমন সাদা ভালো, কালো নিকৃষ্ট, ধর্ম, মার্ক্সবাদের মতো কিছু আদর্শবাদ। এডওয়ার্ড সাঈদের ওরিয়েন্টালিজম ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট করেছে। আমরা জানি উত্তর-আধুনিক এই কেন্দ্রিয় ধারণাসমূহ ভেঙে দেয়, সমালোচনা করে আদর্শবাদেরও, তৈরি করে আরও কিছু ন্যারেটিভ আর খোঁজ করে অস্তিত্বের। কাকতালিও হলেও লাতিনের সাহিত্যের এই অনুসন্ধান জরুরি হয়ে পড়েছিলো, কারণ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের থেকে কিনে আনা নিগ্রো কৃতদাসদের এম্পানিওল ও ফরসী উপনিবেশের ফলে অস্তিত্বের এক ভয়াবহ সংকট দেখা দিয়েছিলো। তাই নিগ্রোদের পূর্বসূত্রে বহন করা সংস্কৃতি ছিলো কেবল স্মৃতি নির্ভর, আর স্মৃতির তো বিভ্রম হতে পারে, হতে পারে বিলুপ্ত। লক্ষণীয় কার্পেন্তিয়র লাতিনের সাহিত্যকে নিগ্রো ও ইন্ডিয়ানদের বাদ দিয়ে ভাবতে চাননি; পারীতে কার্পেন্তিয়র ও আস্তুরিয়াসের পড়াশোনার বিষয়ও ছিলো পুরাণ এবং প্রাচীন অলংকার।

ফলত কার্পেন্তিয়রের 'এই মর্তের রাজত্ব' উপন্যাসে চরিত্র যেমন ঐতিহাসিক কিন্তু আবার ঐতিহাসিকও নয়, কেননা ইতিহাসকে এখানে ইচ্ছামতো ব্যবহার করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু আবার ফিরে এসেছে বাস্তবে; বাস্তবের সাথে স্বপ্ন মিশে তৈরি হয়েছে এমন এক অস্পষ্ট ধারণা যা অলৌকিক, কুহক। উপন্যাসের মূল ন্যারেটর এক ক্রীতদাস যার নাম তি-নোয়েল- আর গল্পের শুরু ১৭৬০ সালে, যখন মাকান্দাল [সেও এক নিগ্রো ক্রীতদাস] ফরাসিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলো। পরের অংশ ফরাসি বিপ্লবের শুরু থেকে ১৮০২ অব্দি; তারপর ১৮২০-তে আঁরি তিস্তফের পতন এবং তার মৃত্যুর বিবরণ দিয়ে শেষ। এই চারটি অংশ মিলিয়েই হচ্ছে উপন্যাস আর এই চারটি অংশকেই যে এক সূত্রে বেঁধে রেখেছে সে তি-নোয়েল, সে এই চারটি অংশতেই আছে; কেননা সে যেমন কালো জগতের মানুষ, তেমনই সাদাদেরও খুব কাছে থেকে চেনে- কারণ সে একজন সাদার ক্রীতদাস। কার্পেন্তিয়র এই উপন্যাসে কেবল ম্যাজিক রিয়ালিজমের সূত্রগুলোই খুলে দেখাননি, দেখিয়েছেন বিদ্রোহ আর স্বাধীনতার বিভিন্ন রূপ, আর সবগুলো বিদ্রোহই আমরা দেখছি এক ক্রীতদাসের চোখ দিয়ে, সে অশিক্ষিত- বিশ্বাস করে অলৌকিক শক্তির, পৃথিবীর বাইরের কোন অন্য জগতের, তার আছে তুখোড় কল্পনাশক্তি ও অনুভূতি, আছে আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা সংস্কার, বিশ্বাস, পুরাণ ও তাদেরই স্থবির রূপগুলো। ক্রীতদাস ছাড়া কেই-বা বোঝে স্বাধীনতার অর্থ!

মাকান্দালও একজন ক্রীতদাস, তার একটা হাত প্রভুরা কেটে ফেলেছে- তারপর সে একদিন পালিয়ে চলে যায় জঙ্গলে। ক্রীতদাস হিসেবে তার আর কোন দাম নেই বলে প্রথমে কেউ তার কোন খোঁজ করেনি, অথচ একদিন টের পাওয়া যায় তার অস্তিত্ব- যখন পর-পর অজস্র শ্বেতাঙ্গ মারা যায়। কে তবে এই মৃত্যুর জন্য দায়ী? নিশ্চয়ই মাকান্দাল? তাই হঠাৎ তাকে খোঁজার ধুম পড়ে যায়, কিন্তু সেতো পরাশক্তির অধিকারী, জানে জাদু- কেউ তার কোন হাদিশ পায় না।

'একদিন বিকেলে তারা [শ্বেতাঙ্গরা] যখন হুমকি দিলে যে তার পাছায় তারা একতাল বন্দুকের গুলি ঠুশে দেবে, বাঁকা পায়ের সেই ফুলাহ্ শেষ অব্দি সব কথা ফাঁস করে দিলে। মাকান্দাল, সেই যার এক হাত কাটা গেছে, সেই নুলো কি-না এখন হয়ে উঠেছে রাদাদের বিশ্বাস, সংস্কার আর অনুষ্ঠানের এক 'বুনগান', এখন তার মধ্য সঞ্চারিত হয়েছে পরামানুষিক সব শক্তি ও ক্ষমতা, কেননা বেশ কিছুবার তারই ওপর ভর করেছিলো বড়-বড় সব দেবতারা, আর তাই নিজেই এখন সে হয়ে উঠেছে গরলদেব। অন্য জগতের শাসনকর্তাদের চরম কর্তৃত্ব এখন ভর করেছে তার মধ্যে, সে ঘোষণা করেছে উচ্ছেদের জেহাদ, সাদাদের একেবারে নির্মূল করে দেয়ার জন্য এখন সে নির্বাচিত। সেই এখন আদিষ্ট হয়েছে সান্তো দেমিঙ্গোতে স্বাধীন নিগ্রোদের এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য। হাজার হাজার ক্রীতদাস এখন তাকে অন্ধের মতো মানে, বিষের অগ্রগতিকে রোধ করার সাধ্য কারো নেই।
এই উদ্ঘাটন খামারের মধ্যে কষাঘাতের ঘূর্ণিঝড় লেলিয়ে দিলে। আর যখন গনগনে রোষে ছোঁড়া গাদাবন্দুকের জমকালো গুলি কালো খেচরটির নাড়িভুঁড়ি ছিটকে দিলে, এক দূত পাঠানো কাপের উদ্দেশে। চারপাশে যত পুরুষ পাওয়া গেল, সেই দিনই বিকেলে তাদের জড়ো করা হলো মাকান্দালকে খুঁজে বার করতে। সবুজ মাংস, পোড়া খুর, কিলবিলে কীটের দুর্গন্ধেভরা সমভূমি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠলো ডালকুত্তার ঘেউ ঘেউ আর জঘন্য সব খিস্তিতে। 
'[এই মর্তের রাজত্ব, আলেহ কার্পেন্তিয়র]

চরনারীতির এই ধারায় উত্তর-আধুনিক অনেক বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান, যেমন এই উপন্যাসে কোন সুসংলগ্ন কাঠামো নেই, নেই কোন গ্রান্ড ন্যারেটিভ ধারণা, ভাষা এখানে আধুনিক এম্পানিওল নয় বরং এক মূর্খ ক্রীতদাসের। সময়কে ইচ্ছামতো চালাচালি করার ফলে ইতিহাস আর বাস্তব একাকার হয়ে গেছে, খোঁজা হয়েছে লাতিন আমেরিকার মানুষের অস্তিত্ব, বিশেষভাবে ইন্ডিয়ান ও নিগ্রোদের। যা মেটাফিকশনের নমুনা হয়ে ওঠে, আর আমরা জানি উত্তর-আধুনিক রচনার অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য মিলে এই মেটাফিকশন, যার ধারণা আমাদের দিয়েছেন উইলিয়াম এইচ গাস ১৯৭০ সালে, পরে আরও বিস্তারিতভাবে তাত্ত্বিক লিন্ডা হাসিয়েনে। আর এই রচনা জাদুবাস্তববাদ হয়ে ওঠে তখন যখন আমরা জানতে পারি মাকান্দালের কোন অলৌকিক শক্তি নেই, সাদারা তাকে ধরে এনে নিগ্রোদের সামনেই যখন তাকে গুলি করে হত্যা করে, কিন্তু নিগ্রোরা তাতে আনন্দিত হয়, তারা বলে ভালোই হয়েছে, এবার সে আরও পরালৌকিক শক্তির অধিকারী হয়ে ফিরে আসবে।

যেমন:

'রাত্তিরে তাদের ছাউনি আর কুঠুরি থেকে নিগ্রোরা একে অপরের সাথে তথ্যবিনিময় করে, সঙ্গে থাকে প্রবল উল্লাস, আর অদ্ভুত যত খবর: এক সবুজ গিরগিটি নাকি তামাকপাতার গোলার ছাদে তার পিঠ গরম করে শুয়েছিলো; কেউ সেদিন দিনে-দুপুরে দেখেছে যে এক নিশিপোকা উড়ে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়; এক তাগড়াই কুকুর তার সব লোম কাটা দিয়ে উঠেছে, বাড়ির মধ্যে থেকে হুড়মুড় করে ছুটে বেরিয়ে এসেছিলো, মুখে ছিলো হরিণের মাংসের এক রাং; এক গাঙচিল সমুদ্র থেকে এতো দূরে! তাজ্জব! পেছনের বারান্দায় উকুন ঝেড়ে চলে গিয়েছে। তারা সবাই জানতো যে সবুজ গিরগিটি, নিশিপোকা অদ্ভুত কুকুর বা অবিশ্বাস্য গাঙচিল আসলে নানারকম ছদ্মবেশ ছাড়া কিছু নয়। আর মাকান্দাল যেহেতু নানারকম চেহারা নিতে পারে -খুরওয়ালা জন্তু, পাখি, মাছ আর পোকামাকড়ের- অতএব সে রোজ রাতে আসে সমভূমির খামারে, তার বিশ্বাসী অনুচরদের ওপর নজর রাখতে, আর এটাও জেনে নিতে যে, সে যে একদিন ফিরে আসবে, এ-বিষয়ে এখনও তাদের আস্থা আছে কি না। এই-ঐ? রূপান্তর, যাতেই হোক না কেন, এই এক হাতের মানুষটি আছে সবখানে- বিশেষত এমন যখন তার জীবজন্তু ছদ্মবেশ পরার অতিলৌকিক ক্ষমতা আছে। একদিন ডানা নেড়ে, অন্যদিন খুরে ঠকঠক তুলে, কদম-কদম বুকে হেঁটে, সে এবার প্রভু হয়ে উঠেছে পাতালের সব স্রোতগুলির আর এইভাবে সে এখন শাসন করে সারা দ্বীপ। অসীম তার ক্ষমতা। সে যেমন অনায়াসেই পারে কোনো মাদী ঘোড়ার সাথে সঙ্গম করতে, তেমনি পারে কোনো চৌবাচ্চার ঠান্ডায় বিশ্রাম নিতে; যেমন দুলতে পারে কোনো দোদুল ডাল থেকে তেমনি গলে যেতে পারে কোনো চাবকি ফোকর দিয়ে; কুকুর তাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করে না; ইচ্ছে মতো সে বদলে ফেলতে পারে তার ছায়া। এই যে এক নেগ্রো মেয়ে এমন এক ছেলের জন্ম দিলো মুখটা বুনো বরার, সে তো তার জন্য। রাত্তিরে সে দেখা দেয় রাস্তাঘাটে, গায়ে কোনো ছাগলের চামড়া, মাথায় দাউ দাউ শিং। একদিন সে নিশ্চয়ই দেবে মহাবিদ্রোহের সংকেত, আর ঐ দূর অতীতের প্রভুরা- যঁদের পুরোভাগে আছেন পথের দেবতা দম্বোলা আর তলোয়ারের দেবতা ওগুন-তাঁরা নিয়ে আসবেন বজ্র আর বিদ্যুৎ আর লাগাম ছিঁড়ে বার করে দেবেন ঘূর্ণিঝড় যা মানুষের সব হাতের কাজ চুকিয়ে দেবে। সেই মহান লগ্নে- তি নোয়েল বললে- সাদাদের রক্ত বয়ে যাবে ঝরনা দিয়ে আর লোয়ারা-আনন্দ উচ্ছল- সেই ঝরনায় গুজে দেবে তাদের মুখ, আর যতক্ষণ না ফুশফুশ ভরে যবে কানায়-কানায়, পান করেই চলবে একটানা। 
'[এই মর্তের রাজত্ব, আলেহ কার্পেন্তিয়র]

এরপর এই ধারায় লাতিনের অনেক লেখক গল্প-উপন্যাস লেখেন- যেমন, দেমেত্রিও আগিলেরা মালতার, হুয়ান রুলফো, কার্লোস ফুয়েন্তেস, গ্রাবিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, মারিও ভার্গাস ঝোসা, বোর্হেস যেহেতু ফ্যাসিবাদী তাই তার কথা বললাম না। আর হুয়ান রুলফোর 'পেদ্রো পারামো'কে তো মেটাফিকশনের আলোকে অনেক আলোচকই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন, তবে মনে রাখতে হবে উত্তর-আধুনিক তত্ত্ব বিকশিত হওয়ার অনেক আগেই এইসব রচনা লেখা হয়েছে। বলা হয় বিংশ শতকের সত্তরের দশকে উত্তর-আধুনিক তত্ত্ব ডালপালা মেলেছে, তথাপি উত্তর-আধুনিক রচনার অনেক বৈশিষ্ট্য লাতিনের জাদুবাস্তববাদ সাহিত্যে বিদ্যমান বলেই একে উত্তর-আধুনিক আত্মসাৎ করেছে। যেমন 'পেদ্রো পারামো'কে বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টা এখানে আরও স্পষ্ট হবে। এই উপন্যাসের শুরুতেই আমরা দেখি মূল ন্যারেটর তার অসুস্থ মাকে কথা দিচ্ছে যে তার পিতা 'পেদ্রো পারামো' যে কিনা মায়ের ধন-সম্পত্তি আত্মসাৎ করে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে, তার থেকে তা উদ্ধার করবে। এবং কথা দেয়া হতেই মা মারা যাবে। আর মৃত্যু শয্যায় মাকে কথা দিয়েছে বলেই, একদিন সে বেরিয়ে পড়ে পিতার উদ্দেশে কোমালা; [কোমালা লেখকের কল্পিত গ্রাম] যেখানে পিতা পেদ্রো পারামো থাকেন।

উপন্যাস যতই এগোতে থাকে আমরাও ততই পেছাতে থাকি, পথে ন্যারেটরের সাথে যাদেরই দেখা হয়, তারাই গল্পের ন্যারেটর হয়ে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যায়, পরক্ষণেই টের পাই তারা কেউ জীবিত নয়, মানে ভূত- কোমালার পথে দিনে কেবল ধূ ধূ বিরান প্রান্তর, রুক্ষ, কোথাও এতটুকু জল পর্যন্ত নেই, কেবলি ভগ্নস্তূপ। রাতে এখানে জেগে ওঠে মানুষ, চারিদিকে শোনা যায় ফিসফাস, খুরে ঠকঠক তুলে ছোটে এক ঘোড়া- আর আমরা হতবাক হয়ে বুঝতে পারি পেদ্রো পারামো ছিলেন এক লোভী, বর্বর, কামুক শাসক- আর তার বল্গাহীন দুর্নীতির কাহন। ছিলেন! মানে নেই, বহু আগেই সেও খুন হয়েছে- এমনকি গল্পের ন্যারেটরও কবেই মরে ভূত হয়ে গেছে। গল্প যেহেতু বলছে ভূত তাই তার বক্তব্য খাপছাড়া, কোথাও সুসংলগ্ন নয়, তবুও এই খাপছাড়া বক্তব্য আমাদের খুলে দেখায় লাতিনের অণুবিশ্ব, যেখানে খুন, যৌনতা, দখল, বল্গাহীন অজাচার যেন সেখানকার মানুষের নিয়তির মতো।

আর এই উপন্যাস যা কিনা লাতিনের ইতিহাস হয়ে আছে, সেখানে মেটাফিকশনের প্রায় সকল উপকরণই লক্ষণীয়। আগেও বলেছি, মেটাফিকশন হচ্ছে উত্তর-আধুনিক রচনার কিছু প্রবণতার সমষ্টি- যেমন, গল্পের ভেতর তৈরি হবে গল্প, নির্দিষ্ট কাঠামো থাকবে না, চরিত্রেরা এখানে ন্যারেটর হয়ে গল্পে বাঁক বদল করে দেবে, এমনকি পাঠকও হয়ে যেতে পারে ন্যারেটর- তবে তারা সকলেই জানবে যে তারা গল্পের ভেতরেই আছে। যার উৎকৃষ্ট নমুনা গ্রাবিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের একশ বছরের নিঃসঙ্গতা, হোমারের মহাকাব্য ওডিসি, সার্ভেন্তেসের দন কিহোতে রুশদীর মিড নাইট চিলড্রেন। মার্কেসের রচনায় আরও কিছু উত্তর-আধুনিক প্রবণতা আছে, যেমন, প্যারোডি, আয়রনি, প্যারানইয়া তবে সেসবের আর বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না, তাহলে আর শেষ হবে না এই প্রবন্ধ। তথাপি আমার আলোচনার মূল বিষয় নিশ্চয়ই পরিস্কার হয়েছে? শেষ করার আগে একটা কথাই বলি যে, তত্ত্ব কখনই সাহিত্য নয়, উৎকৃষ্ট সাহিত্যই হয়ে যায় তত্ত্ব, সমালোচকদের সমালোচনার বিষয়- যা লাতিনের সাহিত্য হয়েছে, কেননা উত্তর-আধুনিক তত্ত্ব উদ্ভবের আগেই এই সাহিত্য রচিত হয়েছে, লাতিনের বাস্তবতাই সেখনকার সাহিত্যিকদের এই ধারার রচনা লিখতে সহায়তা করেছে। আর উত্তর-আধুনিকদের মনে হয়েছে, এই ধারার রচনা পোস্টমডার্ন, তাই আত্মসাৎ করেছে।

তথ্যসূত্র: 
বাস্তবের কুহক কুহকের বাস্তব (মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)
পাঠে বিশ্লেষণে বিশ্বগল্প (মোজাফফর হোসেন)


কবির মুকুল প্রদীপ। কবি।
একসময় যোগ দিয়েছিলেন নাটকে, সাথে শুরু করেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের তালিম। শেখেন কত্থক, ভরতনাট্যম ও ওয়েস্টার্ন।  
জন্ম: ১৯৮৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশাল জেলার পাকুরিতা গ্রামে। শৈশব , কৈশোর কাটে ওপার বাংলায়। ২০১৪  সাল থেকে বাস করছেন বাংলাদেশের শেরপুর জেলায়।    

প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: অলীক জোছনা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. লাতিন সাহিত্যের ইতিহাস জানলাম৷ লেখককে ধন্যবাদ৷ সেখানকার আদিবাসীদের যেমন পাইকারী হারে খুন করা হয়েছে, তেমন একই কাজ হয়েছে ভারতে৷ সমস্ত মধ্যযুগ ধরে মুসলমান আক্রমণকারীরা ভারতে হিন্দু গণহত্যা চালিয়েছে৷ বাংলাসাহিত্যে এর প্রভাব কিরকম?

    উত্তরমুছুন

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।