TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

জাফর সাদেকের আটটি কবিতা


পাহাড় নও

পাঁচ বা দশ টাকায় ভীষণ খুশি থাকে এক ভিক্ষুক
একদিন একশত দিয়ে তার খুশিতে পেয়েছিলাম
সমুদ্র কেনার আনন্দ

রাতের শহরে দাঁড়িয়ে দেখছি আধাসেদ্ধ মানুষ-- এক
তরুণী রিক্সা থেকে নেমে মলিন একহাজার টাকার নোট
এগিয়ে বললো- ক্যান ইউ হেল্প মি টু হাভ চেঞ্জ
তার কাছ থেকে আঁধি হবার ইঙ্গিতটা স্পষ্ট
সেই তো একই মুখ যা পৃথিবীময় একসুরে রাতের গান
তাকে এটিএম কার্ড আর পিন নম্বর দিয়ে বললাম--
ঘুরে এসো নীলগিরি আলুটিলা, তুমি বহুদিন পাহাড় নও

চৈত্রের দাবদাহে মোড়ের ডাব-বিক্রেতাকে বললাম--
চাচা মানুষের কাছে দেবতারা কেন হেরে যায় বারবার জানেন
সে ভুবনজয়ী হাসিতে কচিডাব আমার দিকে এগিয়ে
সূর্যকে করলো আড়াল


মানুষ জানে

ডেলফি মন্দির থেকে দেবীর কণ্ঠস্বরের রেষ তখনও গ্রিসের রাস্তায়

আনন্দিত জনতা সক্রেটিসের কাছে গিয়ে বললো-
গির্জা বলেছে আপনিই পৃথিবীর মহাজ্ঞানী
তিনি যথারীতি অস্বীকারে বললেন-
আমি নই অন্য কেউ-- ক্ষুদ্রকে একা থাকতে দাও

দিশাহারা মানুষ ছুটলো আবার ডেলফির সত্যের কাছে
কিছু বিষণ্ণ পণ্ডিতও ছিলো এই আমজনতার মিছিলে
তারা গিয়ে দেখে বন্ধ গির্জার দুয়ার

কয়েকদিন অপেক্ষার পর আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টির সাথে
খুলে গেলো প্রার্থনালয়-- সেই গায়েবি কণ্ঠস্বর
স-ক্রে-টি-স

বৃষ্টিমেখে মানুষগুলো খুশিতে কম্পিত হলো আবার
কিন্তু পণ্ডিতদের বিষণ্ণমুখ হলো আরও অন্ধকার


পরিণত ছায়া

আসলে কেউ থাকে না কোথাও
জন্মটাই আমাদের অকারণ-- খোঁজাখুঁজি তার দাসবৃত্ত
কেউকেউ জন্ম নেয় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকবার জন্য
অনেকটা বটবৃক্ষের মতো
আমরাই খুঁজে নিই সেই ছায়া-- হয়ত মনে করি মায়াবন


আসলে কেউ থাকে না কোথাও-- আকাশ ছাড়া
বসন্তে এলে তাই শিমুলের বনে নও একার ছায়া
পাখিদের প্রচ্ছদ আঁকা বিকেল যেন আমুদে জন্মাতর


আসলে কেউ বসে থাকে কোথাও-- জানি না হয়তো
যেমন ভাঙনের নদীকূলে বসে আছে দত্তবাড়ির বিধবা বউ
এমন বসে থাকার কাছেই এক ছায়া, সেটা তালগাছের
দৃশ্যটা প্রতিদিনই পরিণত হয়-- দুজনা দুজনকে ছোঁয়


পাপের ছন্দ

বারান্দায় পাশাপাশি দুটি স্নানের পোশাক
পাপ আর পুণ্য-- দুটোও মাঝেমধ্যে উগ্র হতে চায়
হঠাৎ একদিন এক সন্ত এই দৃশ্য দেখে উদাস হয়
ভালোবাসে ফেলে ওই পথ-- প্রতিদিন যায় বারবার


সন্তর বেশি চোখাচোখি হতো পাপের পোশাকের সাথে
ফলাফলে তার হৃদয়ের ক্ষরণে জন্মালো গভীর অরণ্য
অথচ তার না ছিলো বনের ছায়াপথ, না পাখিদের রাজ্য


অযথাই একটি বিষয় তার ভেতর প্রকটভাবে এলো
তা হচ্ছে খাঁচা বুননের প্রবণতা
সাঁওতাল রমণীর মতো দক্ষহাতে বুনে চলে নকশি খাঁচা
বনের পাখি আসে যায়-- খাঁচা ঘিরে পাখিরা গায় গান


এখন সন্তর রোববারের প্রার্থনায় হয় অনেক ভুল
কাউকে কাউকে এমনকিছু বলে যার কোন মানে নেই
এইতো সেদিন গির্জায় এক স্কার্ট তরুণীকে বললো--
প্রার্থনায় কেন স্নানের পোশাক


বউব্যথা

বাল্যে নানী আমার ছায়াপথ দেখিয়ে বলতেন
ওই দেখ অনেক পরির চোখ-- ওখানেই আছে তোর বউ
তখন বউ শব্দটায় বেশ দোল খেতাম-- কিছু না বুঝেই

কৈশোরে গ্যালাক্সির দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে ভাবতাম-
গ্যালিলিওর নিশ্চয় ওইসব তারাদের রাজ্যে বসবাস
অন্ধকার থেকে নিক্ষেপ করলো বলে একটা রাঙা বউ

শ্রাবণ ঝরছে অবিরাম-- সৈকতে নির্ঘুম রাত জন্মময়
প্রসবী ব্যথায় সাগর থেকে উঠে আসছে অনেক ঝিনুক
মা-ঝিনুকদের ঘিরে এক তরুণী প্রথম অনুভব করে ব্যথা
বুঝতে পারে এটা বউব্যথা

যৌবনে মাত্র একবার মনে হয়েছিলো দূরের এই দৃশ্যে
তারারাও বৃষ্টির স্বাদ নেয় পতন ভালোবাসে
গ্যালিলিওকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম সেই রাতে


সক্রেটিস ও ভেজা-চাদর

সক্রেটিস প্রতিদিনের পাঠদান শেষে বিদায় নিলেও
তার সঙ্গ ছাড়তো না ভক্তদল
তারা ঘর পর্যন্ত এসেও দাঁড়িয়ে থাকতো অনেকক্ষণ

শিষ্যরা দেখতো-- তিনি আঙিনায় প্রবেশের আগমুহূর্তে
আলখাল্লা, কাঁধের চাদর কিছুটা জলে ভিজিয়ে নিচ্ছেন
আর বৃষ্টি হলে তো কথাই ছিলোনা-- ভিজতে ভিজতে
ঘরে ফিরতেন

এ নিয়ে শিষ্যদের মাঝে আলোচনা হতো প্রায়শই
কিন্তু নির্লিপ্ত থাকতো সবাই
প্রধানশিষ্য প্লেটো একদিন বিনয়ে জানতে চাইলে
তিনি হেসে বললেন--
ঘরেই আগুন লাগে প্রথম-- তারপর ছড়ায়


রিয়েলিটি শো ও হরিণীভ্রমণ

তরুণী প্রমাণ করতে চেয়েছিলো--
মানুষ বিশ্বাস করে উপাসনালয় ও ঈশ্বর
নিজে হরিণী সাজলো তাই কয়েক ঘণ্টার নগ্নতায়

সে ভেবেছিলো-- এক তেজি-যুবক তার নগ্ন-শরীরের দিকে
ঘর্মান্ত জিন্সের পিরান ছুঁড়ে-- স্টেজে তার পাশে দাঁড়িয়ে
দেবে হুংকার-- যেন বনরাজ সিংহ শক্তিধর
তার এই অর্জুন রূপ দেখে স্টেজের সামনের কিছু বাঘ
নখ গুটিয়ে চলে যাবে পানশালায়- কিছু বাঘ প্রার্থনায়

তারপর সিংহ তার হাত ধরে বলবে-- কাছেই অরণ্য
চলো জোছনায় হাঁটি ঝরাপাতার মচমচ শব্দে
কিছুদূর হেঁটে গেলে নদীপারে আছে এক কুঁড়েঘর

সব কল্পনা ভুল প্রমাণ করে সেই দুখি তরুণী দেখলো
একজন মানুষ শুধু একটি প্রাণী নয়-- তার নিজস্ব বনে
বাঘ, শেয়াল, শুকুর, বুনোকুকুর ও শকুনের বসবাস


ধূন-জুয়াড়ির ঘুমভাঁজ

একটা বৃত্ত এঁকে বললে- এটা সম্পর্কের জাগ্রত টান
দেখো ময়ূরী নাচবে ঘুরে ঘুরে আজ
অথচ আকাশ দেখা দিলো না মেঘেদের জলফুল

ধূপ-সম্পর্কও বৃত্ত নেয়- ছুঁয়ে যায় দিগন্তে অলীক দাগ
সে-রেখায় বিকেলের সূর্য হাসতে হাসতে দেয় ঘুম
তখনও অনেক পাখিই খুঁজে পায় না সান্ধ্যঘর

জুয়াড়ির ঠোঁটে নটীপেগ- ব্রোথেল থেকে বেরিয়ে বোঝে
কেউ নয় কারো সম্পর্কের ঘরে
ঝুঁকে পড়ে সে ম্যারিকান রোটেটে- জাগ্রত নৃত্যরাত
স্টেজ-নর্তকীর ক্লান্ত-ঘাম- শেষপ্রহরে সম্পর্কের টান
রাতের ঊরুতে ভোর-- ধূন-জুয়াড়ির চোখে ঘুমভাঁজ


জাফর সাদেক। কবি।
জন্ম ২৮ নভেম্বর ১৯৬২ সালে, পাকশীতে।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: 'তাঁকে ছোঁয়া যেন ঈশ্বর ছুঁয়ে থাকা', 'হাজং যুবতীর চুরুট', 'দম-যোগিনীর তাল', 'মন্ত্র নই তৃষার আঙুল'।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ