TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

তার যন্ত্রণা | রিপন হালদার

প্রচ্ছদ: নাজমুল হোসাইন

সাদা টাটাসুমো গাড়িটাকে আসতে দেখে রাস্তার হালকা ভিড়টা তরলের মত দুই পাশের ধানখেতে ছিটকে পড়তে লাগল। অল্পবয়সি ছেলে-ছোকরাই বেশি। এদের মধ্যে দুজন মহিলাও ছিলেন। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সকাল-সন্ধে তাদের না হাঁটলে দেহযন্ত্র বিকল হবার সম্ভাবনা। তাই পুলিশের কড়া পাহারা এড়িয়ে তাদের বেরতেই হয়। কিন্তু এখন বুঝি আর পার পাওয়া গেল না। মহিলাদুটি ভয়ে শিটিয়ে গিয়ে একজন আরেকজনের গায়ে এমনভাবে লেপ্টে থাকল যে দূর থেকে মনে হচ্ছে দুটি দেহ একসঙ্গে জোড়া লেগে গেছে। 
গাড়িটা থামল তাদের গা ঘেঁষে। গাড়ির দরজা খোলা এবং বন্ধ হবার শব্দ হল। পুলিশ অফিসার নেমে এলেন, “জানেন না এই সময়ে ঘর থেকে বাইরে বেরনো নিষেধ? আর কতভাবে বললে আপনারা শুনবেন! বয়স তো কম হল না! আর মাস্ক কোথায়?” বলা মাত্র মহিলাদুটি শাড়ির আঁচল মুখের সামনে জড়িয়ে নিতে নিতে বলতে সক্ষম হল, “সুগার। ডাক্তার...” “থামুন! একদম ডাক্তারের অজুহাত দেখাবেন না!” শব্দগুলোর ভাইব্রেশন এমন হচ্ছে যে প্রতিটি কথা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠছে মহিলাদুটির পাতলা দেহ। জীবনে প্রথম তারা পুলিশের সামনে পড়ল। “নিন কান ধরে দশবার উঠবোস করুন!” কড়া আদেশ অফিসারের। দ্বিধান্বিত ভাব নিয়ে মহিলাযুগল দাঁড়িয়ে থাকে। চোখেমুখে অসহায় আতঙ্কের ভাব। 
এইসময় দূর থেকে দেখা যায় এক যুবক ঘটনাস্থলের দিকে হনহন করে এগিয়ে আসছে। সামনের বিরুদ্ধ হাওয়াকে ঠেলতে ঠেলতে পিছনের দিকে এলিয়ে পড়ছে তার চেক জামার খোলা হাতা। অফিসারের কাছে এসে রাগের সঙ্গে বলল, “এরা কী এমন অন্যায় করেছে স্যার? কেন বিরক্ত করছেন?” যুবকের স্পর্ধার উপর কয়েক সেকেন্ড চোখ রাখেন অফিসার। মুখের পেশিগুলো অগোছালো ভাব ত্যাগ করে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। চোখের ফোকাস স্থির হয়ে আরো তীক্ষ্ণ হওয়া মুহূর্তের অপেক্ষা। দৃষ্টি তীর হয়ে যুবককে বিদ্ধ করবে করবে এমন সময় একজন মহিলা বলে ওঠে, “যোসেফ, তুই আবার এর মধ্যে এলি কেন? উনি তো ঠিকই বলেছেন!” 
কিন্তু এতে পুলিশ অফিসারের মুখের পেশির জট ছাড়ে না। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উত্তর দেন, “জানতে... চাস... কেন?” বলে গাড়ির পিছনের দিকে গেলেন। ফিরে এলেন হাতের তালুর উপর  লাঠিটা বোলাতে বোলাতে। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই যোসেফের উদ্দেশ্যে শুরু করেন মার। লাঠির আঘাতগুলো প্রথমে দুই-একবার শূন্যে ফসকালে অফিসারের ভারসাম্য হারিয়ে প্রায় রাস্তায় পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। ফলে রাগ বাড়ে চতুর্গুণ। এবার বেছে বেছে শরীরের নির্দিষ্ট একটি স্থানে অর্থাৎ রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা যোসেফের পাছার মাংসল উচ্চভূমিতে বার বার আছড়ে পড়তে থাকে লাঠি। যোসেফ নিজেকে বাঁচানোর কোনো সুযোগই পায় না। ঘন ঘন অবশ্য দুই হাত দিয়ে প্রবল লাঠির তেড়ে আসার সামনে প্রতিরোধের দেয়াল গড়তে ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। হাতের আঙুল ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবার আশংকায় সে পিঠ পেতে দিতে দিতে বলল, “মা, আন্টিকে নিয়ে তুমি চলে যাও!” এই অবস্থায় মা কী করে ঘরে যায়! বারবার অফিসারের কাছে হাতজোড় করে কান্না আর মিনতির সুরে প্রার্থনা করতে থাকে, “ছেড়ে দিন স্যার, দয়া করে!” 
দয়া অবশ্য অফিসারের হয় না। এই অবাধ্য জান্তব পাবলিককে শায়েস্তা করার উপযুক্ত সুযোগ তিনি হাতের সামনে পেয়ে গেছেন। কী করে তা হারান! মিনিট পাঁচেক উন্মত্তের মত প্রহারের শেষে তাঁর লাঠি বিশ্রাম নেয়, “আর যদি কখনো বাইরে বেরতে দেখি... লাঠি একদম পাছায় ঢুকিয়ে দেবো!” বলে তিনি লাঠিটা গাড়ির পিছনের খোলা দিকে ছুঁড়ে ফেলে দেন। ঠং করে শব্দ করে লাঠিটা আগের জায়গায় থিতু হয়। শাস্তি সম্পূর্ণ হয়েছে ভেবে যোসেফ আর তার মা সঙ্গের মহিলা সমেত স্থান থেকে চলে যেতে উদ্যত হলে পুলিশ অফিসার বলে ওঠেন, “দাঁড়ান!” 
মহিলাদের প্রতি তাকিয়ে বলেন, “আপনারা দুজন দশবার কান ধরে উঠবোস করে তারপর এখান থেকে যাবেন!” ততক্ষণে অফিসারের হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উঠতে শুরু করে দিয়েছে।
ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে উঠে দাঁড়িয়ে যোসেফ মায়ের প্রতি বলে, “কক্ষনো না মা!” অফিসার সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দিয়ে গাড়ির পিছন দিকে গেলেন আবার। লাঠিটা এইসময় আবার পরম আদরে অফিসারের হাতে উঠে আসে, “তোর গাঁড়ে খুব রস জমেছে, না!” বলে তিনি পুনরায় রাস্তায় ফেলে যোসেফের গায়ে তীব্র বেগে যথেচ্ছভাবে লাঠিটাকে আছড়ে পড়তে দিলেন। এর মধ্যে অবশ্য মহিলাদুজন কানে হাত উঠিয়ে ফেলেছে। আর বারবার বলছে, “আমরা কান ধরেছি। দয়া করে ওকে ছেড়ে দিন!” এই দিকে অবশ্য অফিসারের কান যায় না। এবার আর বেছে বেছে তিনি তাঁর প্রিয় স্থান পাছায় মারার সুযোগ পেলেন না। ফলে যোসেফের সারা শরীরের উপর চলল অবিরাম লাঠিবর্ষণ। আরো পাঁচ-ছয় মিনিট লাঠিটাকে কর্মক্ষম রাখলেন অফিসার। তারপর তীব্র তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, “যা, ভাগ এখান থেকে! শুয়োরের বাচ্চা যত!” ফস করে দেশলাই কাঠি জ্বলে ওঠে আবার। 
গাড়ির সামনের সিটে বসা সহকর্মির দিকে চেয়ে বললেন, “তোয়ালেটা দাও তো!” তারপর ডান হাতে তোয়ালে দিয়ে তিনি মুখ ও ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে আওড়ান, “শালা, অসভ্যের জাত! শেখাতে শেখাতে জীবন চলে গেল!” 
সিগারেট শেষ করে গাড়ির ভিতরে ঢুকে সহকর্মির দিকে চেয়ে আবার বললেন, “ভিডিওটা কেমন হয়েছে, দেখি! এডিট করে আবার ফেসবুকে ছাড়তে হবে! শালা কাজের আর শেষ নেই!”

যোসেফকে তার মা সঙ্গের মহিলার সাহয্যে ধরে ধরে হাঁটিয়ে এনে ঘরের বিছানায় শুইয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে তার নতুন বিয়ে করা বউ শুশ্রূষায় লেগে গেল। ঘটনাটা বাড়ির গলি থেকে বড় রাস্তা পার করে আরো একটু দূরে ঘটায় বউটি এতক্ষণ এর আঁচ ঠিকভাবে পায়নি। সে অতক্ষণ ব্যস্ত ছিল সিরিয়াল দেখায়। আর যখন কেউ এসে তাকে খবরটা যখন দিল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। হন্তদন্ত হয়ে গলির মুখে এসে দেখে দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে আসছে তার স্বামী। এবার সে হাউমাউ করে কান্নার সুযোগ পেল। 
ব্যথায় যোসেফ নড়তে পারছে না। বিছানার উপর চিত হয়ে শুয়ে থাকল। চোখ আধবোঝা হয়ে তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। তীব্র বেগে সেখানে ঘুরছে সিলিং ফ্যান। এতক্ষণ ধরে ওর শরীরের উপর দিয়ে কী ঘটে গেল বোঝার মত তার ক্ষমতা ছিল না। বোঝার আগেই পুলিশের লাঠি তার উপর হামলে পড়ে। আঘাতের পরিমাপটা কতটুকু তা ওর চেতনায় এতক্ষণ ধরা দিতে পারেনি। আস্তে আস্তে এবার মাথা কাজ করা শুরু করেছে। পিঠ, হাত, ঘাড়, থাই প্রায় অবশ হয়ে আছে। আঙুলও মনে হয় দুইএকটা ভেঙেছে বা মচকে গিয়েছে। সব চেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছে ওর পাছাটা। এক বন্ধু এসে বলল হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কিন্তু ওর মা তাতে সায় দেয় না, “এক রোগ সারাতে গিয়ে আরেক রোগ নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে” বলে চলে যায় পাড়ার হাতুড়ে ডাক্তার মাইকেল মণ্ডলের কাছে। জ্বর পেট মন ব্যথায় সময়ে অসময়ে ইনিই এই এলাকার একমাত্র ভরসা। 
ফোন পেয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই সাইকেল চালিয়ে চকচকে গোলাপি মাস্ক পরিহিত মণ্ডল ডাক্তার এসে হাজির। প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বলেন, “ইস্‌! খুব খারাপভাবে মেরেছে রে! দেখি ডান হাতটা দেখি!” বাঁহাতটা মরা মাছের মত বিছানার উপর ফেলে দিয়ে তিনি ডান হাতটা নিজের হাতে তুলে নেন। “কেন এদের সাথে লাগতে যাও! তোমার মা দশবার কান ধরে উঠবোস করলে জিসাস কী রাগ করতেন! টিভিতে দেখছ না কত লোক প্রতিদিন কান ধরে উঠবোস করছে! ছেলে-বুড়ো, বৃদ্ধা-যুবতী কেউ বাদ যাচ্ছে? পুলিশই বা কী করবে, ভেবে দেখেছে? একটা মানুষও কি শুনছে প্রশাসনের কথা? সভ্য দেশে থাকতে গেলে নিয়ম তো মানতেই হবে! আমাদের সি.এমকে দেখেছ! সব দায়িত্ব একাই দশ হাতে পালন করে চলেছেন অক্লান্তভাবে! গড মে ব্লেস হার! এই সময়ে আমাদের সিস্টেমের কথা শুনে চলতে হবে না! সাবধানে থাকার কিন্তু কোনো বিকল্প নেই! ওষুধ তো বেরয়নি কিছু! আর পুলিশের সামনে মেজাজ দেখানো ঠিক?” ডাক্তারের সহানুভূতির কাঁটাটি রোগীর দিক থেকে ক্রমশ প্রশাসনের দিকে ধাবমান। “তার জন্য এইভাবে মারবে!” যুবকের বন্ধু বলে উঠল পাশ থেকে অসহিষ্ণুভাবে। “পুলিশের আবার ভাব অভাব! তুমিও পারো! মাস্ক না পরে বাইরে বেরনোই এখন ক্রাইম! দেখছ না টিভিতে?” বলে পাতলা রাবারের হাত কভার পরা ডাক্তারের হাত চলে যায় যুবকের ব্যথার স্থানগুলোতে। যেন মাছ টিপছেন এমন ভাব করে চোখ অন্য দিকে চোখ সরিয়ে তিনি বললেন, “টাইম লাগবে। দুই রকমের ওষুধ প্রেসক্রাইব করে দিলাম। আই হোপ সপ্তাহখানেকের মধ্যে উঠে দাঁড়াতে পারবে”। পাছার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভেরি প্যাথেটিক!”   
যোসেফের বন্ধু বাইক হাঁকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যায় ওষুধ আনতে। মা বারে বারে কাপড় দিয়ে চোখ মোছে।
 
ভোর রাতে যোসেফের ঘুম ভেঙে যায় বিকট এক আওয়াজে। খ্রিস্টান পাড়ার ওপাশে আছে আদিবাসী পাড়া। সেখান থেকেই আসছে শব্দটা। এমন নয় যে এই ধরনের শব্দের সাথে যোসেফ পরিচিত নয়, তবু এই যন্ত্রণাদীর্ণ দেহ আর শরীরের কাছে এই শব্দ অচেনাই ঠেকল। 
তীব্র কর্কশ চিৎকারে পুরো পাড়াটাকে একদম কাঁপিয়ে তুলেছে। খাটের পায়াগুলোর জোড় খুলে যাবে মনেহচ্ছে এমন চিকন অথচ জোরালো শব্দ। ভোর রাতের নির্জনতাকে খান খান করে থেকে থেকে জেগে উঠছে সেই ছুরির ধারের মত শব্দ। যোসেফের ক্ষতের উপর সেই শব্দ এসে আছড়ে পড়ে যেন আচড় কেটে চলেছে। পাশের ঘর থেকে যোসেফের মা বলে ওঠে, “ওরা আর সময় পেল না!” 
প্রায় এক-দেড় ঘন্টা চলবে এই শব্দ। ততক্ষণে পাড়ার প্রতিটি মানুষের কানে মাথায় অসম্ভব রকমের বিকট বিরক্তি আর উত্তেজনা সৃষ্টি করে তবে বিশ্রাম নেবে। হ্যাঁ, নীরব হয়ে যাওয়া সেই শব্দ আর হয়ত এই দেহ থেকে বেরিয়ে আসবে না। আসবে অন্য দেহ থেকে। যদিও প্রতিটি শব্দ একই রকমের আর্তনাদ আর চিৎকারপ্রবণ। পার্থক্য যদিও থেকে থাকে তা আমাদের কানে এসে পৌঁছায় না। 
শুয়োর মারা কখনো দেখেনি যোসেফ। বন্ধুদের মুখে বিভিন্ন পদ্ধতি শুনেছে। মনে পড়ল এক বন্ধুর উক্তি, “আরে একটা লাল টকটকে গরম লোহার রড কাঠ বা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে শুয়োরের পাছা দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। যতক্ষণ রড ভিতরে গরম থাকে শুয়োরগুলো ছটফট করতে থাকে। আর সঙ্গে থাকে আকাশ ভাঙা চিৎকার। রড ঠান্ডা হতেই চিৎকার একসময় থেমে যায়। অবশ্য আর কখনই ওদের চিৎকারের ক্ষমতা থাকে না”। 
আরেকজন বাধা দিয়ে বলেছিল, “কী যে আজবাজে বকিস! তুই কোথায় দেখেছিস এসব? আমি ইউটিউবে দেখেছি। প্রথমে শুয়োরটার মুখের চোয়ালদুটো আর পাগুলো শক্ত করে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। তারপর বড় ছুরি দিয়ে ধীরে সুস্থে ওদের গলা কাটা হয়। ব্যাপারটা এত মসৃণভাবে ঘটে যে শুয়োরগুলো টেরই পায় না ওরা মরে যাচ্ছে।” প্রথমজন বাধা দিয়ে বলল, “তুই শুয়োরের আবার গলা পেলি কোথায়?” “শুয়োরের গলা নেই? কী যে ফালতু কথা বলিস! তবে যেভাবেই মারা হোক খেতে কিন্তু দারুণ! ছোট ছোট পিস করে পোলাও করলে আর কথা নেই!” দ্বিতীয়জন বলে।  
ওরা যেদুটো পদ্ধতির কথা বলল তার মধ্যে কোনটা সত্যি যোসেফ জানে না। এমনকি জানার প্রয়োজনবোধও করেনি। পাশের এলাকাতেই যদিও কাটা হয়। একটা আলতায় লেখা পোস্টারও টাঙানো দেখেছে যেতে যেতে একদিন, ‘এখানে জত্ন সহকারে সুওর মারা হয়’। তবুও মারার সময় ও যায়নি কখনো দেখতে। ঠিক নিতে পারে না ব্যাপারটা। সমবেত উল্লাস বৃত্তের মধ্যে অসহায় একটা প্রাণীকে ধরে বেঁধে হত্যা করার মধ্যে যে চরম নিষ্ঠুর উল্লাস আছে তা সবার পক্ষে সহ্য করা কঠিন। ওর জিসাসের মৃত্যদৃশ্যের নিষ্ঠুরতার কথা মনে পড়ে যায়। 
কিন্তু আজ যেন কিছুতেই সহ্য করা যাচ্ছে না। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, শিরা-উপশিরার ছিদ্র দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে শুয়োরটার আর্তনাদ। কতক্ষণ ধরে এই চিৎকার চলছে ও জানে না। জানে না শেষ হবে কখন। আজ মনে হয় রড ঢুকিয়ে মারা হচ্ছে। তাই হয়ত চিৎকার এত বেশি। এর থেকে অবশ্য ছুরি দিয়ে কাটলেই ভালো হয়। চিৎকার তাতে কম হয় আর জীবটা কষ্টও পায় কম। 
ভোর রাতে শুয়োরটার আর্তনাদ নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল যোসেফ। ঘুম ভাঙল বেলা করে।  চিত হয়ে শুয়েছিল ঐ ভাবেই দেখল নিজেকে চোখ খুলে। কিন্তু কানের মধ্যে কীসের যেন আওয়াজ এখনও সমানে বেজে চলেছে। হ্যাঁ, ভোর রাতের সেই শুয়োরটার চিৎকারই তো! কিন্তু ঐ শব্দ তো এখন থেমে যাওয়ার কথা! থামছে না কেন এখনও! এতক্ষণ কেউ বেঁচে থাকে! ভাবনায় পড়ে যায় যোসেফ।
যদি এখনও ওটা না মরে গিয়ে থাকে তবু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কাজকর্মের শব্দের চাপে শব্দের কিছুটা ম্রিয়মান হওয়া উচিত ছিল। তা কিন্তু হয়নি! কেন! শব্দ যত কানে আসছে তত বেড়ে যাচ্ছে ওর যন্ত্রণা। অদ্ভুত ব্যাপার তো! 
পাশ ফেরা সম্ভব কি না পরীক্ষা করার জন্য চেষ্টা করল একবার। শেষে বুঝল হাড়গুলো হয়ত গুঁড়ো হয়ে যাবে আরেকটু ঘুরলে। ব্যথা আর যন্ত্রণা যেন পেরেকের মত গেঁথে রেখেছে ওকে বিছানার সঙ্গে। হিন্দু মাইথোলজির ভীষ্মের শরশয্যা যেন। পাছার উপর এরই  মধ্যে ঘায়ের মত হয়ে গেছে। যন্ত্রণা হচ্ছে খুব। তাই চিত হয়েও থাকা যাচ্ছে না। আবার উপুর হয়ে শোবে তাও অসম্ভব। কী যে সমস্যায় পড়া গেল! কাত হয়ে থাকার চেষ্টাটাও এইমাত্র যোসেফ বাতিল করতে বাধ্য হল। 
বউ এল চা নিয়ে। বহু কষ্টে বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বোতল থেকে জল নিয়ে মুখ ধুলো। চায়ের কাপ নিতে নিতে বউয়ের উদ্দেশে বলল, “চিৎকারটা এখনো বন্ধ হচ্ছে না কেন বলো তো?” “কীসের চিৎকার?” পালটা প্রশ্ন করে বউ। “কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছো না?” “নাতো!” ভাবনা আরো গভীর হল যোসেফের।
চায়ের কাপ ঠোঁট ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধু এসে হাজির। “কী রে, কেমন আছিস এখন?” মৃদু হাসল যুবক। “ঠিক হয়ে যাবি। ভাবিস না”। তারপর বলল, “মাংস খাবি? শরীর পুরো ফিট হয়ে যাবে!” “কিসের মাংস?” “শুনলি না? ভোর রাতে কেটেছে তো! এখন তো মুরগি খাসি খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে! কম দাম বলে সবাই শুয়োর খাচ্ছে!” “থাক!” “কেন? আরে তোর শরীরে এখন তাকত দরকার। আমাদের বাড়িতে এনেছি আজ। একটু পর দিয়ে যাচ্ছি!” “ঠিক আছে। অল্প করে আনিস!” “ওকে! ডান!”  
তারপর দুপুর পর্যন্ত মানুষের কাজকর্ম, রান্না ঘরে বাসন পড়ার শব্দ, তীব্র স্রোতে পড়তে থাকা উঠোনে ট্যাপকলের জলের শব্দ, পুলিশের গাড়ির আওয়াজ, পৌরসভার মাইকের সাবধান বাণী, পাশের ঘরের টিভিতে ঘোষক ঘোষিকার বিচিত্র ঢঙে সংবাদ উচ্চারণ আর যোসেফের ব্যথার শব্দ মাড়িয়ে গুঙিয়ে গুঙিয়ে সমানে চলেছে শুয়োরটার আর্তচিৎকার। যে শব্দ কেউই হয়ত শুনতে পাচ্ছে না, শুধু যোসেফের কানে বাজছে। 
বাটির ঢাকনা খুলতেই গরম ভাপ গন্ধের ঝাপটা মারল ওর মুখচোখে। লাল-হলদে মাংসের টুকরোগুলো আধডোবা হয়ে শুয়ে আছে ঝোলের মধ্যে।
মাংস দেখে যোসেফের মনে পড়ে গেল একটা কথা। ছোটবেলায়, হ্যাঁ, ছোটবেলাতেই কোথায় যেন পড়েছিল অথবা শুনেছিল কথাটা। কিন্তু তখন সেভাবে মানে বোঝেনি। আজ কী মোক্ষম সময়ে মনে পড়ে গেল প্রভুর উদ্দেশ্যে বলা সেই চরম সত্য কথাটা, “তোমার যন্ত্রণা শুশ্রূষা করে আমার!”




রিপন হালদার। কবি ও কথাসাহিত্যিক। লেখালেখির শুরু কবিতা দিয়ে দু’হাজার সালের পর। দুটো কবিতার বই প্রকাশের পরে গদ্যে সরে আসা। আগ্রহ প্রথাবিরোধী গল্প উপন্যাসে। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘বৃষ্টির কথা হচ্ছে’ (কবিতা), ‘অংকফুল’ (কবিতা), ‘এখানে অমল নামে কেউ থাকে না’ (গল্প), ‘আগামীকাল এইসব লিখেছিলাম’ (উপন্যাস ও গল্প)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ