TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

বৃষ্টিতে ভেজার গল্প | খোকন দাস

প্রচ্ছদ: নাজমুল হোসাইন 

একদফা ঝুম বৃষ্টি হয়ে গেছে, এখন বিরতি, বিরতি মানে বিরতি; এক ফোঁটা বৃষ্টিও হচ্ছে না। আবার শুরু হবে; জুলাইয়ের শুরু, এই সময় বৃষ্টির ধারাই এমন। ল্যাম্পপোস্টের বাতি আর ইলেকট্রিকের তার বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ঝুলে ঝুলে পড়ছে। সামনের সেবা ফার্মেসির সিঁড়িতে দুইটা কুকুর জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। ঠান্ডাবাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে চোখেমুখে। এইরকম ওয়েদারে সিগারেটে যাদের অভ্যাস তাদের নেশা চেপে ধরবে, আকরামেরও তাই হয়েছে, কিন্তু ঘরে কোনো সিগারেট নেই। মাসখানিক হয়েছে আকরাম সিগারেট ছেড়ে দেয়, আসলে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। সেই কলেজ জীবনে কোন এক ছবিতে উত্তমকুমারের সিগারের ধোঁয়া দিয়ে রিং ছাড়ার দৃশ্যটা মাথায় গেঁথে যায়। বলতে গেলে এই রিং তৈরির কসরত থেকেই আকরামের সিগারেটের নেশা। এখন ইচ্ছা করছে লম্বা করে একটা টান দিয়ে ধোঁয়ার রিং ছাড়তে। ড্রয়ারে, বইয়ের ফাঁকে খুঁজে দেখা যেতে পারে, কিন্তু এতো রাতে অন্ধকারে ড্রয়ার খোঁজাখুঁজি করতে গেলে ঘুমন্ত স্ত্রী সন্তানদের ঘুম ভেঙে যাবে, তবু  নিশ্চিত হলে একটা রিস্ক নেয়া যেত।

বিকট শব্দ করে একটা ট্রাক চলে গেলে প্রচণ্ড ঝাকুনি দিয়ে বিল্ডিংটা কেঁপে উঠে, ঘুমন্ত কুকুর দুইটা চিৎকার করতে থাকে, আরো কয়েকটা কুকুর তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। আকরাম বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে দেখে নুসরাত অনেক জায়গা নিয়ে অর্ধবৃত্ত হয়ে শুয়ে আছে। ধীর পায়ে ভিতরের রুমে গিয়ে মেয়েদের একবার দেখে আসে অন্ধকারে; বড় মেয়েটা শুয়ে আছে হাত পা ছড়িয়ে, ছোটটা মায়ের মতোই গুটিয়ে আছে। বড় মেয়েটা মাত্র সিক্সে পড়ে, কিন্তু দেখতে দেখতে কতো লম্বা হয়ে গেছে, মাকেও ছাড়িয়ে গেছে। চেহারা হয়েছে তার মতোই লম্বাটে আর ছোটটা হয়েছে নুসরাতের মতো, বড়বড় ছোখ। 
 কি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে মেয়ে দুটো, আলো-আধাঁরিতে তাদের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর আবার বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, এর মধ্যে নুসরাত একবার পাশ ফিরে শোয় আরো জায়গা নিয়ে। রাস্তায় জমে থাকা পানি এখনো নামেনি, এর মধ্যে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তবে জোরে নয়। একটা অম্বুলেন্সের আর্তনাদ শোনা গেল, আকরাম বারান্দার শেষ মাথায় গিয়ে মাথাটা গ্রিলের সঙ্গে ঠেকিয়ে অ্যম্বুলেন্সের উপস্থিতি দেখার চেষ্টা করে। গলির একেবারে শেষ মাথায় পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের সামনে অ্যম্বুলেন্সটা, পাশে একটা অক্সিজেনের সিলিন্ডার। থ্রি-কোয়াটার পরা দুই যুবক ধরাধরি করে কাকে যেন উঠিয়ে দিল। আর কিছু দেখা গেল না। যুবকদের বৃদ্ধ বাবা, মা কিংবা অন্য কেউ হবে হয়তো, অন্য সময় হলে এই রকম পরিস্থিতিতে কান্নার শব্দ পাওয়া যেতে, এখন জোরে কান্নার সময় নয়, গুমরে কান্নার সময়, কান্না গিলে ফেলার সময়। 
এর মধ্যে আরো জোরে বৃষ্টি নামলো, বৃষ্টির শব্দের মধ্যে অ্যম্বুলেন্সটা আবার আর্তনাদ করতে করতে চলে গেল। দিনে একটা দুইটা মৃত্যুর খবর ঘোষণা করা হয় মহল্লার মসজিদের মাইক থেকে, সন্ধ্যার দিকে মাইক থেকে যখন সর্বশেষ ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল তখন বৃষ্টির সঙ্গে ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল; ছোট মেয়েটা ভয়ে বুকের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়ে বলে,‘বাবা, ভয় লাগে।’ কিছু দিন থেকে মৃত্যুর ঘোষণা শুনলে মেয়েটা ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। 
আকরাম ঘুমন্ত নুসরাতের পাশে সোফাতে এসে বসে, কী নিশ্চিন্তে সে ঘুমিয়ে আছে। কালও কি নুসরাত এভাবে নিশ্চিন্তে ঘুমাবে? কতোদিন লাগবে তাকে ভুলে যেতে? স্বামী, স্ত্রী কিংবা সন্তানের শোক ভুলতে কতো দিন লাগে? ছাদে লাগানো ফুলগাছগুলো আগের মাতো কি যত্ন করবে? তার বইয়ের আলমারি, ধুলাপড়া বইগুলো, টেবিল-চেয়ার, আলনা, আলনায় ঝুলানো তার প্যান্ট-শার্ট, এই ছোট ছোট দুই রুমের ঘর, ছাদের তোমার শখের বাগান— সবই থেকে যাবে, কেবল সে থাকবে না। চা-এর কাপ নিয়ে মুখোমুখি দুজন আর কোন দিন বসা হবে না। কি অদ্ভূত ব্যাপার— একটা জলজ্যান্ত লোক, লোক কেন বলছি কলেজের অর্থনীতির লেকচারার, হোক না সেটা নন-এমপিওভুক্ত-আকরাম হোসেন থাকবে না, কিন্তু সব কিছু চলবে স্বাভাবিক নিয়মে।   
এলোমেলো চুল এসে মুখটা ঢেকে দিয়েছে, ইচ্ছা করছে আস্তে করে চুলগুলো সরিয়ে দেয়, কিন্তু সাহস হয় না। আকরামের ইচ্ছা নুসরাতকে নিয়ে ঝুম বৃষ্টিতে ভেজা, ‘চলো ছাদে গিয়ে দুজনে ভিজি’— সপ্তাহ খানিক আগে কথাটা প্রায় বলেই ফেলেছিল। শেষমেষ সাহস হয়নি; নুসরাত যদি বলে বসে, ‘একবছর থকে তোমার স্কুলের বেতন বন্ধ, ঘরে বাজার সদাইয়ের ঠিক নাই এমন রোমান্টিকতা আসে কোথা থেকে?’ 
সেদিন দুপুরে নিমগাছটা দেখার ছুতায় ছাদে গিয়ে আকরাম  বৃষ্টিতে ভিজেছিল; নুসরাতের সেই কি রাগ, ‘চারিদিকে পরিস্থিতি ভালো না, অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে তোমাকে কে দেখবে? সামান্য জ্বরা-জ্বরিতে কি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে তুমি জানো না? তোমার কি কাড়ি কাড়ি টাকা আছে যে ..’
 বিয়ের কয়েক বছর পর একবার রমজানের বন্ধে নুসতারকে নিয়ে তার বাপের বাড়ি কিশোরগঞ্জ যায় আকরাম, তখনও আষাঢ় মাস ছিল, সারারাত তুমুল বৃষ্টি, টিনের চালে ঝমঝম শব্দে ঘুম চলে যায়; দুজনে সারারাত জেগে বৃষ্টির শব্দ শোনে। 
এইরকম ঝুম বৃষ্টির স্মুতি তার জীবনে আরো একটা আছে, তবে সেটা সুখের নয়, শোকের, বেদনার। তার পিতা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মৌলবী আব্দুল হাই সেদিন ইন্তেকাল করেছেন। সে তখন কেবল স্কুল ছেড়ে কলেজে উঠেছে, ফজরের নামাজ পড়ার পর পর হঠাৎ তার আব্বা স্টোক করে মারা যায়; সকাল থেকে মাথার ওপর ঘন কালো মেঘ এমনভাবে ঝুলে আছে যেন জোর করে ফুঁ দিলে আকাশ ভেঙে পড়বে;  সেদিন কি বার ছিল মনে করার চেষ্টা করে, শুক্রবার ছিল।  জুম্মার নামাজের পর জানাজা, স্কুলের মাঠটা একেবারে ছোট বলা যাবে না— সেই মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ। জানাজা শেষে আব্বার দাফন হয় স্কুলের পিছনের কবরস্থানে, আব্বার ছোট দুই ভাই কৃষক ফজলু চাচা আর নিজাম চাচা গ্রামের আরো কারা যেন ছিল মনে করতে পারে না; খবর খোঁড়ার কাজে ব্যস্ত; চাচাদের ডেকে আলতাফ মেম্বার বলল, ‘আকাশের পরিস্থিতি ভালো না, যা করার জলদি করেন।’ পাশে দাঁড়ানো সবুর মৌলবি বলেন, ‘ওনি ফরেজগার মানুষ, আল্লা নিশ্চয় ওনাকে কষ্ট দেবেন না।’ জানাজা শেষে যে যার মতো দৌঁড়াতে থাকে আসন্ন ঝড়-বৃষ্টি থেকে বাঁচতে। আকরামের দুই মামা, দুই চাচা আর আকরাম তখনো খেজুরের পাতা দিয়ে ঢেকে দেয়া কাঁচা কবরের পাশে, ছোট মামা মজনু আকরামের একটা বাহু ধরে রাখে। কাঁচা মাটি আর লোবানের গন্ধে মাখামাখি, জেয়ারত শেষ হতে না হতে শুরু হলো বৃষ্টি, এই বৃষ্টি চলল টানা দুই দিন। শরীরে লোবানের গন্ধ নিয়ে আকরাম পুরোটা বেলা  ক্ষেতের আল ধরে হেঁটে হেঁটে বৃষ্টিতে ভিজেছে। সন্ধ্যার একটু আগে বাড়ির উঠানে দাঁড়াতেই ছোট বোন আসমা এসে আকরামের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। ভাই বোনের চোখের জল বৃষ্টিতে ধুয়ে যায়। তার মা আরিফা খাতুন বুকের মধ্যে দুই সন্তানকে জড়িয়ে ধরে বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে ভাঙা ভাঙা শব্দে বলে, ‘তোর আব্বা ফরেজগার মানুষ, কান্না করিস না, তার রুহ কষ্ট পাবে, তাকে যেন জান্নাতবাসী করে সেই দোয়া কর তোরা।’
ছোট বোন আসমার কথা মনে পড়ায় মনটা খারাপ হয়ে যায় আকরামের। তারও টানাটারি সংসার, স্বামী সাইফুলের বেসরকারি চাকরি, এর মধ্যে বেতন অনিয়মিত হয়ে গেছে; কিছু টাকা পাঠিয়েছে আসমা, মন সায় দেয়নি, তবু না নিয়ে উপায় ছিল না তার।  
আকরাম কেমন যেন লোবানের গন্ধ পায়, কালও কি এমন তুমুল বৃষ্টি হবে? মৌলবী সাহেবের কলেজের মাস্টার ছেলের জানাজায় কি মানুষের ঢল নামবে? লোকজন বলবে, এমন একটা ফরেজগার মানুষের ছেলে এমন কাজখান কইরলো ক্যমনে? কয়েকজন অপরিচিত যুবক, গ্রামের নতুন জেনারেশনের যুবকদের সঙ্গে তার পরিচয় নেই-তাদেরই কয়েকজন কবর খুঁড়ছে সামিয়ানার নিচে।  সেই দুই চাচা আর মামা, দুই চাচাতো ভাই ধরাধরি করে তার লাশ নামাচ্ছে কবরে। এর বেশি আর কল্পনা করতে পারে না আকরাম।  
রাত কতো বুঝা যাচ্ছে না, অথচ জানা দরকার। ফজরের আজানের পর পাড়ার কুকুরগুলো চিৎকার শুরু করবে; কুকুরের শব্দে কোন কোন দিন নুসরাতের ঘুম  ভেঙে যায়; নুসরাতের ঘুম ভেঙে গেলেই সর্বনাশ; চিরদিনের শান্তির ঘুম আর হবে না। তবে ফজরের আজানের আগে আগে কাজটা সেরে ঘুমিয়ে পড়তে হবে নুসরাতের পাশে নিঃশব্দে। রাত যদি দুইটা হয় তা হলে আরো কিছুটা সময় পাওয়া যাবে। আকরাম নুসরাতের পায়ের কাছে তোষকটা একটু তুলতেই প্যাকেটটা পেয়ে যায়, প্যাকেটটা যথাস্থানে আছে কি না একটু টেনশন ছিল। টেবিল থেকে কোন রকম শব্দ ছাড়াই পানির বোতলটাও পেয়ে যায়। এইসব কাজ করতে খসখস ঘসঘস শব্দ যে হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু বৃষ্টির শব্দে বুঝা যাচ্ছে না। 
আকরাম প্যাকেট আর পানির বোতলটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে। মোবাইলের সুইচ অন করে সময় দেখে নেয়, রাত তিনটা। এমবি থাকলে সর্বশেষ খবরাখবরটা দেখে নেয়া যেত। এমবি না থাকায় একদিকে ভালোই হয়েছে, খবরাখবর জেনে সে কি করবে? তবে ফেইজবুকে ঘনিষ্ঠরা কে কি লিখছে সেটা অন্তত জানা যেত, বন্ধু রায়হান কি সমাজের অসংগতি নিয়ে কড়াকড়া কথা এখনো লিখে যাচ্ছে, আর সুশান্ত কি একের পর এক বউএর ছবি দিয়ে পোস্ট দিচ্ছে? নাজমুল ভাই কি এখনো কোথায় কোন সম্ভাবনা রয়েছে সমাজ পরিবর্তনের সেসব নিয়ে লিখছে? 
কাঠের চেয়ারে প্যাকেট আর পানির বোতলটা রেখে আকরাম উঠে দাঁড়ায়, একটা জরুরি কাজ এখনো সারা হয়নি। ধীর পারে টেবিলের কাছে গিয়ে আন্তে করে ড্রয়ারটা খুলে একটা প্যাড়-কলম নিয়ে আবার বারান্দায় এসে বসে। চিঠিটা এমনভাবে টেবিলে রাখতে হবে যাতে নুসরাত ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পায়। আচ্ছা, নুসরাত যদি কোন কারণে দেখতে না পায় তা হলে কি করবে? সে কি অন্যদিনের মতোই চা নিয়ে এসে তাকে জাগাবে? সে কি লিখবে? বিদায় নুসরাত— এই জাতীয় সংক্ষিপ্ত কিছু, নাকি বিস্তারিত কিছু। আইটির ফিল্যান্সার ছেলেটা যে লিখেছিল, ‘বেশ কিছু দিন থেকে আমার বাসায় খাদ্যের অভাব, আমি বেঁচে থাকলে ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাবে, তাই চলে গেলাম’— এ রকম কিছু কি লিখবে? সে আবার লিখেছে, আমার বউ-বাচ্চাদের কেউ দেখবেন—
সে কি ফেইজবুকে স্ট্যাটাস দিলে ভালো হতো? সবাইকে জানিয়ে মরতে হবে কেন? তার কথা কে মনে রেখেছে, কতো কতো খবরের ভিড়ে একজন ফ্রিল্যান্সারের এই ধরনের অভিমানী বিদায়ের খবরের কি মূল্য আছে? নাকি এটাও একটা প্রতিবাদের ধরন? সেদিন চায়ের আড্ডায় প্রসঙ্গটা মিনমিন করে তুলতেই সাংবাদিক শহীদ প্রায় তেড়ে আসার মতো বললেন, ‘ছেলেটা একটা কাপুরুষ, এভাবে মরে গিয়ে কি লাভ হলো? বউ-বাচ্চাদের ফেলে রেখে এভাবে কেউ মরে? তোর বউ-বাচ্চাদের এখন কে দেখবে?’
‘এটাও একটা প্রতিবাদ, কি বলেন?’  
সাংবাদিক শহীদ আরো উত্তেজিত, ক্ষেপে গেলে কি বলে হুশ থাকে না— ‘এটা কি ধরনের প্রতিবাদ? বোকাচোদা না হলে কেউ এমন কাণ্ড করে? এখন ঘরে ঘরে খাদ্যের অভাব, তাই বলে সবাই আত্মহত্যা করবে? তোর যদি মরে প্রতিবাদ করতেই হয় ..।’
কথাটা শেষ করার আগেই হুমায়ূন সাহেব শহীদ সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,‘সবাই ভয়ে গর্তে লুকিয়ে থাকলে তো এমন হবেই, সবাই বেরিয়ে আসুক তো, দেখি কে কি করতে পারে?’
এদের কথাবার্তা পছন্দ হয় না আকরামের, কী দরকার এসব কথাবার্তা বলে বিপদে পড়ার, দেশের পরিস্থিতি এমনিতেই ভালো নয়; চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি ঘুরিয়ে ভাবে কথাটা তোলা ঠিক হয়নি, কি করে এখান থেকে সরে পড়া যায় সেই চিন্তা করে।   
বৃষ্টির ঝপটার মধ্যেও আকরামের কানের দুই পাশ দিয়ে ঘাম চুইয়ে পড়ে, কামরুল নিজেকে শাসায়। এই আকরাম হোসেন, এই লেকচারার তুমি তোমার লক্ষ্য থেকে সরে যাচ্ছ। গত একবছরে তোমার ঘাড়ের ওপর যে ঋণ চেপে বসেছে তার হিসাব করেছ? এই ঋণ কবে শোধ হবে? কর্মহীন তুমি কি কোন দিন তা শোধ করতে পারবে? তোমার বাসায় আর বড় জোর তিন দিনের খাবার আছে, তার পর কি হবে? আত্মীয়-স্বজন সবার কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়ে গেছে, আর কে তোমাকে টাকা দেবে? কলেজের বেতন, সেটা কবে পাবে তুমি জানো কিছু? তোমার ছাত্র-ছাত্রী কারা তুমি জানো না? কলেজের প্রিন্সিপাল কি বলেছিল? বলেছিল বেতনের আশা এই বছর করে ফল হবে না। না এইসব ফালতু বিষয়ে চিন্তা করে লক্ষ্যচ্যূত হওয়া ঠিক হবে না। 
আকরাম কি লিখবে? সে কি লিখবে ‘আমার বাসায় আর তিন দিনের খাবার আছে, এর পর কি হবে আমি জানি না, তাই চলে গেলাম’ —এ জাতীয় কিছু? না, এতো কথা লেখা ঠিক হবে না। সে একজন ব্যর্থ, অসফল এই সমাজের একজন পরাজিত মানুষ; ব্যক্তিগত অক্ষমতার কথা পাবলিক করার মধ্যে কোন বাহাদুরি নেই। বরং লোকজন করুণাই করবে, আহাউহ করবে। 
আকরাম অন্ধকারেই লিখল ‘চলে গেলাম.. .. মাফ করে দিও নুসরাত’ 
কাগজটা টেবিলের ওপর দুইটা বইয়ের ভাজে রেখে দেয় যাতে সহজে নুসরাত দেখতে পায়। যাক, একটা কাজ এগিয়ে গেল।  
আকরাম প্যাকেটা খুলে গুনে দেখে বিশটা ট্যাবলেট আছে, পনের দিন ধরে এই ডিসপেনসারি সেই ডিসপেনসারি খুঁজে ট্যাবলেটগুলো সংগ্রহ করেছে। ঘুমের ট্যাবলেট কিনাও যে কতো হ্যাপা। গলির দুইটা ডিসপেনসারিতে বকেয়া, এসব দোকান থেকে দুইটার বেশি ঘুমের ওষুধ কেনা রিস্ক। 
মুদি দোকানের নিয়াজ চাচার কথা কানের মধ্যে এখনো বাজে, ‘আপনি বউ-বাচ্চা নিয়ে ঢাকায় পড়ি রইছেন কিল্যায়? বাড়িত চলি যান, দেশের যে পরিস্থিতি আপনার কলেজ কোনদিন খুলবে তার ঠিক নাই। আপনি শিক্ষিত মানুষ, আপনারে কি কমু, কতো আর বাকী দেয়া যায়।’ 
‘কলেজে অনেক বেতন বকেয়া পড়ে আছে, টাকা পেলেই আপনাকে দিয়ে দেব, আপনি চিন্তা কইরেন না।’
পানের কষে ভেজা দাড়ি মুছে নিয়ে চাচা তার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে হাসে যেন আকরামের মতো তুচ্ছ জিনিস এই দুনিয়াতে আর কিছু নেই। 
‘টাকা পাইলে আপনি দিবেন, এই নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ কইরছিনি? কইতেছি কলেজ এই বছর খুইলবনি? মরার হার যেভাবে বাইড়তেছে আপনার কলেজ এই বছর খুইলবো না।’
পনেরটা ঘুমের বড়ি খেয়ে শান্তির ঘুম, এই ঘুম আর কোন দিন ভাঙবে না। ছাদ থেকে লাফ দিয়ে, ট্রেনের নিছে ঝাপ দিয়ে, সিলিং ফ্যানে ঝুলে, হাতের শিরা কেটে— আরে বাবা এতো বিভৎসভাবে মরতে হবে কেন, এই রকম একটা শান্তির নিরাপদ পথ থাকতে?  
সেদিন দুপুরে সবাই খেতে বসেছে, কলিং বেলের শব্দ শুনে মায়ের নিষেধ উপেক্ষা করে বড় মেয়েটা দৌড়ে নিচে নামে। ‘মেয়েটাকে নিষেধ করলাম তবু গেল, কতোবার বলি ঢাকা শহরে আমাদের কে আছে সময়ে অসমে আসবে? সারা দিন ফকির-মিসকিনরা জ¦ালাচ্ছে। তবু মেয়েটা দৌড় দেয়, নিচে যেতে ওর বোধ হয় ভালো লাগে।’
মেয়েটা উঠে এসে হাঁপাচ্ছে, সেদিকে নুসরাতের খেয়াল নেই, ‘গেলি তো লাফাতে লাফাতে, তোর বাপের কোন আত্মীয় এলো?’
মেয়েটার মুখ অন্ধকার, ‘কি হয়েছে? কে এসেছে?’
‘বাবা,  তোমার মতো একজন শিক্ষক, বলল আমি একজন শিক্ষক মানুষ, আমাকে একটু সাহায্য করা যাবে?’ 
 ঘাড় ঝাঁকিয়ে মুখের ওপর এসেপড়া চুল সরিয়ে নুসরাত আকরামের মুখের দিকে তাকায়; নুসরাতের যে চাহনি তার মানে হচ্ছে তোমারও এই পরিণতি হতে বেশি দেরি নেই। 

আকরাম আবার সময় দেখে, রাত সাড়ে তিনটা। যাক হাতে কিছুটা সময় এখনো আছে। সে ধীর পায়ে মেয়ে দুটোর কাছে যায়, আলতো করে তাদের গালে হাত বুলায়। ছোট মেয়েটা কয়দিন থেকে ড্রাগন ফলের জন্য বায়না ধরেছে; ফলের মিষ্টতার চাইতেও রঙটা তার খুব পছন্দ। এর আগে দুই কেজি কেজি ড্রাগন ফল এনেছে, সারা দুপুর ড্রাগন ফলের রঙ দিয়ে দুই বোন মিলে ছবি একেছে; তারা চারজন বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে গ্রামীণ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, বড় মেয়েটা তার মায়ের হাত ধরে আছে আর ছোটটা তার। আকরাম দেয়ালে সাঁটানো ছবিটা খুলে নিয়ে আবার বারান্দায় এসে বসে; আবছা আলোতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এভাবে বৃষ্টিতে আর কোন দিন ভেজা হবে না। বৃষ্টির তোপ এর মধ্যে কিছুটা কমে এসেছে। আজানের সময় হয়ে এসেছে অনুমান করে সে। আর সময় নেয়া ঠিক হবে না, সর্বশেষ নুসরাতকে একবার দেখে নেয়। 
আকরাম ট্যাবলেটগুলো একে একে খুলে একটা কাগজে রাখে, পানির বোতলটা কাছে এনে রাখে; ফজরের আজান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবগুলো ট্যাবলেট ভিতরে চালান করে দিয়ে নুসরাতের পাশে ঘুমিয়ে পড়বে। রাত জাগার ক্লান্তিতে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে, মাথার পিছনে ঘাড়ের শিরাউপশিরায় টান অনুভূত হতে থাকে। 
‘বাবা..’
পাশের রুম থেকে ছোট মেয়ের আতঙ্কিত ক্ষিণ কণ্ঠের ডাক, মনে হচ্ছে মেয়েটা ডাকছে অনেক দূর থেকে। আকরাম কাছে যেতেই মেয়েটা বুকের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়ে— ‘বাবা, ভয় করছে।’ আকরাম মেয়েকে বুকে চেপে জড়িয়ে ধরে রাখে কিছুক্ষণ। ফজরের আজানের শব্দ বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে মিলেমিলে ঘুমরে কান্নার মতো কানে এসে লাগে। আকরাম মেয়েটাকে শুইয়ে দিয়ে নিশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে। 
ছপছপ শব্দে গলির রাস্তা পেরিয়ে মাঠের দিকে হাঁটতে থাকে, মাঠের কোণে পুকুরপাড়ে বৃহৎ ছাতার মতো কদম গাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। ভোরের হালকা আলোয় পুকুরে বৃষ্টি দেখে আকরাম, আর তুমুল বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে ...।




খোকন দাস। গল্পকার, তার জন্ম ফেনি জেলার দাগনভূঞা উপজেলার চাঁদপুর গ্রামে, ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর। প্রকাশিত বই: ‘কাক ও অন্যান্য গল্প’ (দেবদারু প্রকাশনী, ২০১৮ ), ‘খড়ের মানুষ’ (দেবদারু প্রকাশনী , ২০২০ )।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. গল্পটা পড়তে পড়তে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম। লেখকের সফলতা বোধহয় এখানেই। ধন্যবাদ ভাই

    উত্তরমুছুন

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।