TopTime

আজ বঙ্গাব্দ

দীর্ঘ নামের মেয়েরা | নাজমুল হোসাইন

প্রচ্ছদ: নাজমুল হোসাইন

একবার মনে হলো প্যান্টের চেইন অর্ধেক খোলা, পরক্ষণেই ভাবলো না অর্ধেক লাগানো। দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতর ঘুরপাক খেতে খেতে যখন প্রস্রাবের চাপ টের পাচ্ছিল তখন ঠিকটা মনে পড়লো। কিন্তু এতেও দ্বিধামুক্ত হতে পারলো না। নুনুটা বের করতে করতে খেয়াল করলো, সে এভাবেও কয়েকবার প্রস্রাব করেছে মাঠে বা নদীর ধারে কিন্তু ভিজে গেছে বিছানা এবং প্রত্যেকবারই সে এভাবেই নুনু বের করতো। তার এই দ্বিধার অবসান হওয়ার আগেই আঙিনা থেকে কয়েকজন তার পড়ার ঘরে গিয়ে বইপত্র ঘেটে নাম জেনে আসতে পারে এবং বেশ ধীরগতিতে সেটা বানান করে শোনাতে পারে। গ্যারি বানানের সময়কালের চেয়েও দীর্ঘস্থায়ী তার দ্বিধা, ওম্বীর প্রজিত গ্যারি উচ্চারণের অধিক লম্বা তার বিস্ময়। গ্যারির দ্বিধা ও বিস্ময় সম্পর্কে প্রথম জানতে পারে পাড়ার দীর্ঘতম নামধারী মেয়েটি। পরবর্তীতে তার থেকে এবং তার মতো অন্য অনেক পাড়ার দীর্ঘতম নামধারী মেয়েদের থেকে পাড়ায় পাড়ায় রটে যাওয়া গ্যারির দ্বিধা বিস্ময়ের কথা থেকে এখন অনেকেই জানে। গ্যারি যেমন প্রথমে মেয়েটির এবং মেয়েদের নাম জানার পর মেয়েটির এবং মেয়েদের দীর্ঘাঙ্গ সম্পর্কে জেনেছে তেমনি মেয়েটি এবং মেয়েরা প্রথমে গ্যারির বিস্ময় সম্পর্কে জেনে তারপর জেনেছে গ্যারির দ্বিধা। এবং এসব জানাজানির পালাবদলের মাধ্যমে মেয়েটি এবং মেয়েরা যখন গ্যারির প্রধান অভ্যাসটি পুনরায় ভাবার সুযোগ পেল তখন তার এবং তাদের বিস্ময় তাকে ও তাদেরকে হতবাক করে দেয়।

ওম্বীর প্রজিত গ্যারির বাড়ির দক্ষিণ দিকে গাছপালা থাকার বদলে আছে সারিবদ্ধ বাড়ি। ফলে অন্যকোথাও হাওয়া বইলেও এই বাড়িটির দক্ষিণ থেকে কোনো হাওয়া এবং হাওয়ায় ভাসা শব্দভাণ্ডার আসে না জন্য এই বাড়িটিতে আজ পর্যন্ত কোনো উড়ো খবর ঢোকেনি। ব্যাপারটা গ্যারি এবং গ্যারির বন্ধুমহল ভালোভাবেই জানতো। কোনো একদিন গ্যারি যখন তার রুমে বসে জানতে পেরেছিল তাদের পাড়ার মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ নামটি ‘শুচিস্মিতা গীতালি কল্লোলিনী নীড়া শুচি’ তখন সে ক্যালেন্ডারের উল্টোপাতায় বাদামের খোসা ছড়াচ্ছিলো। দীর্ঘতম নামটির সংবাদ এনেছিল তার যে-বন্ধু সেই বন্ধুটি তখন জানালায় মুখ রেখে এসব দেখেছিলো জন্য পরবর্তীতে গ্যারিকে বলতে পেরেছিলো সেদিন ক্যালেন্ডারের পাতাসমেত বাদামের খোসা ফেলে দেয়ায় গ্যারি কোনোদিন মনে করতে পারেনি দিনটির তারিখ কত ছিল। এতে অবশ্য গ্যারির কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। যারা তার সাথে গভীরভাবে মিশেছে তারা জানে সামনের দিনগুলোতেও গ্যারি এমনই প্রতিক্রিয়াহীন থাকবে। তারা এটাও জানে যে শুচিস্মিতা গীতালি কল্লোলিনী নীড়া শুচিও এখন গভীরভাবে মিশছে। গ্যারির বন্ধুদের যখনই এই নামটি মনে পড়ে তখন তারা বিস্মিত হয়ে ভাবে, গ্যারি কেন মেয়েদের মধ্যে দীর্ঘ নামধারীদের সাথেই মিশতে চায়। তাদের বিস্ময়ের মাত্রা বেড়ে যায় যখন তারা জেনেছে তাদের বিস্ময়ের চেয়ে গ্যারির কয়েকটি ব্যাপারের বিস্ময় আরো অধিক দীর্ঘস্থায়ী।

আধাঘণ্টা আগে ঘুম ভেঙেছে গ্যারির। প্রস্রাবের চাপও টের পাচ্ছে বেশ কিছুক্ষণ থেকে। কিন্তু তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে শৈশবে বিছানায় প্রস্রাব করার স্মৃতিগুলো। সে মনে করতে পারে না, শৈশবের স্বপ্নে প্রস্রাব ব্যতীত অন্যকোনো দৃশ্য ছিল কি না! বিছানায় প্রস্রাব করার পর যখন সে জেগে উঠতো তখন ভয় ও লজ্জা তাকে যেভাবে পাইথনের মতো প্যাঁচিয়ে ধরে ঘাম বের করে ফেলতো যৌবনে সেইসব স্মৃতি তাকে নিয়ে যায় দীর্ঘতম নামে, দীর্ঘাঙ্গে এবং দীর্ঘ সময় জুড়ে থাকা শৌচকর্মের ধ্বনির ভেতর। গ্যারি যেদিন প্রথম প্রস্রাবের পর শৌচকর্ম শিখেছে, সেদিন রাত্রে সে স্বপ্নে দেখেছিল— একজন দীর্ঘদেহী এক বদনা পানি হাতে তার পেছনে দাঁড়িয়ে আর সে মনের আনন্দে দীর্ঘদেহীর একটু সামনে— দীর্ঘদেহীর ছায়ার আশ্রয়ে প্রস্রাব শুরু করে। স্বপ্ন ভাঙার পর তার মায়ের বকুনি ও পিটুনি আজো সে ভুলতে পারেনি। তার মা ইশিতা বেঁটে ছিলেন, যার নামে কোনো পদবি নেই, যুক্তবর্ণ নেই, উচ্চারণে শ্বাসাঘাত নেই। অথচ এই নামটিতেই তার শ্বাস আটকে যেত। গ্যারি মনে করতে পারছে— নাতিদীর্ঘ নামের প্রতি শৈশবে তার মনে যে ঘৃণা জমা ছিল আজ সেই ঘৃণার দ্বিগুণ ভালোবাসা দীর্ঘ নামধারীদের প্রতি, দীর্ঘদেহের প্রতি। সেদিনের স্বপ্নে, তারপর আরো কয়েকদিনের স্বপ্নে দেখা দীর্ঘদেহীর ছায়ার প্রতি তার মনে বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে যে, এই দীর্ঘ ছায়া ও এইরকম দীর্ঘছায়া তাকে কখনো আঘাত করবে না। সে ওই ছায়ার কাছ থেকেই শৌচকর্ম শিখতে চেয়েছিল কিন্তু সেটা স্বপ্ন ছিল মনে পড়ার পর, শৈশব থেকেই গ্যারি দীর্ঘনামধারী মেয়েদের প্রতি টান অনুভব করে। টান থেকেই গ্যারির মনে প্রেম জাগে। প্রেম জেগে উঠলে গ্যারির মনে পড়ে স্বপ্নের দীর্ঘদেহীর কথা। গ্যারি জানে না সেই দীর্ঘদেহী নারী ছিলেন নাকি পুরুষ। তবে গ্যারি যে তাকেও ভালোবেসেছিল, এটা বুঝতে পারে। কিন্তু তার তো প্রথম প্রেম ছিল এই পাড়ায় আসার আগে যে-পাড়ায় ছিল সেই পাড়ার দীর্ঘতম নামের মেয়েটি। গ্যারি ভাবে— তাহলে কি অতীতের স্বপ্ন অতীত নয়, বর্তমানের স্বপ্ন বর্তমান নয়, ভবিষ্যতের স্বপ্ন ভবিষ্যৎ নয়? স্বপ্ন অতীত নয়, বর্তমান নয়, ভবিষ্যতও নয়, তাহলে—? গ্যারি বুঝতে পারে এই ভাবনাটিই তাকে প্রথমবারের মতো গ্রাস করেছিল, যেভাবে আয়না প্রতিবিম্বকে খেয়ে ফেলে— এই বিস্ময় এমন এক স্বচ্ছতা যা দেখা যায় কিন্তু ছোঁয়া যায় না, নিজের ধ্বংস ব্যতীত তারও ধ্বংস নেই।

শুচিস্মিতা গীতালি কল্লোলিনী নীড়া শুচিকে গ্যারি ব্যতীত সবাই শুচি বা নীড়া নামে ডাকে। গ্যারিই শুধু ধীরে ধীরে এমনভাবে পুরো নাম ধরে ডাকে যেন তার উচ্চারণের ছুরি শুচির নিশ্বাসকে কেটে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখছে। সেক্সের সময়ও গ্যারি নেতিয়ে যাওয়ার আগে পুরো নাম ধরে ডাকে। শুচির চি যখন তার কণ্ঠ থেকে মিলিয়ে যেতে থাকে তখন গ্যারি শেষবারের মতো কেঁপে ওঠে। যেকয়েকবার তারা মিলিত হয়েছে প্রতিবারই এমনটা ঘটেছে এবং শুচি এটা ভালোভাবেই খেয়াল করেছে। যেমন প্রতিবার সেক্সের পর শুচি যখন বাথরুমে ঢোকে, গ্যারি তখন দরজায় কান লাগিয়ে শৌচকর্মের ধ্বনি শোনে এবং শুচি বেরিয়ে আসার পর বিস্মিত গ্যারিকে আবিষ্কার করে। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় গ্যারি ভুলে যায় সমস্তকিছু এবং তার এই আড়িপাতার ব্যাপারটাও শুচির থেকে লুকাতে ভুলে যায়। প্রথমবার শুচি তাকে কিছুই বলেনি বরং শুচি বিস্মিতই হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয়বারও একই ঘটনা ঘটায় শুচি তাকে কারণ জিগ্যেস করলে গ্যারি বলে ওঠে, প্রত্যেক মানুষের শৌচকর্মের ধ্বনি আলাদা আলাদা। এমনকি একই ব্যক্তির শৌচকর্মের ধ্বনি প্রত্যেকবার এক নয়। গ্যারি এই কথাগুলো যখন বলেছিল তখনও সে পুরোপুরি বিস্মিত ছিল, চোখ ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বড়, স্বচ্ছ এবং উজ্জ্বল। তার এই অবস্থা দেখে দ্বিতীয়বারের মতো আর কখনো প্রশ্নটা তোলেনি। তবে সে বুঝতে পেরেছিল, এই অভ্যাসটি গ্যারির নেশার মতো হয়ে গেছে।

শুচি গ্যারির জীবনের দ্বিতীয় মেয়ে যার সাথে সে সেক্স করেছে। শুচি গ্যারির জীবনের নবম মেয়ে যার বাথরুমের দরজায় সে কান পেতেছিল। যাদের দরজায় কান পেতেছিল তারা অনেকেই বিষয়টাকে সহজভাবে নেয়নি। এদের মধ্যে গ্যারির আত্মীয়ও আছে কয়েকজন। তারা আরো কঠোরভাবে নিয়েছিল। তাদের কঠোরতার প্রতি গ্যারি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি জন্য এবং দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমাপ্রার্থনা করেনি জন্য তাকে পাড়ান্তর করেছে। এতেও গ্যারির কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তবে তার বন্ধুরা কয়েকদিন পরই বিষয়টিকে গ্যারির জন্য শাপে বর মনে করতে শুরু করলো যখন গ্যারি প্রথম শুচির নাম শুনেছিল।
—মন ভাষা বোঝে না। শরীর তাকে ভাষা দিয়ে কিছু বোঝাতে চাইলে, সেটা হবে ভাষার শাসন।
সুরঞ্জিত বললো: বলতে চাচ্ছো তোমার শরীরের সুখ মনকে স্পর্শ করেনি?
—মনকে যা স্পর্শ করেছে তা আনন্দ। নির্মল আনন্দের স্পর্শে শরীর সুখ পেলেও এই সুখের উৎস আনন্দ।
প্রীতম বললো: ভাষা না বুঝলে মনকে কীভাবে পাঠ করলে?
—সরলতা। যেই সত্যটি আমরা সকলেই জানি কিন্তু স্বীকার করতে চাই না সেই সত্য ভয়ঙ্কর সংক্রামক।

এইসব বিতর্কের পর গ্যারি ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখন ভোর ৬টা। পৌনে এক ঘণ্টা আগে ঘুম ভেঙেছে গ্যারির। হালকা প্রস্রাবের চাপ নিয়ে হাঁটতে বেরুলো। এখন একটু বেশিই চাপ অনুভব করছে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চেইন অর্ধেক খুলেছে, বাকিটা খোলার আগেই সেখানে কিছু আপেলের ছাল পড়ে থাকতে দেখলো। সাথে সাথে তার মনে পড়লো শৈশবের বিছানা, বিছানার রঙ আপেলের রঙের মতো।



নাজমুল হোসাইন। সম্পাদনা করছেন ‘আর কে রোড’ লিটলম্যাগ। জন্ম ২৯ আগস্ট লালমনিরহাট জেলায়। দর্শন বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। প্রকাশিত কবিতার বই: ‘গুহামুখে ব্রহ্মাণ্ডসমেত’ (ঘোড়াউত্রা, ২০২১)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. নাহিদা নাজনীন১৫ আগস্ট, ২০২১ এ ৮:১০ PM

    প্রথাগত চিন্তা ভেঙে পড়ছে গল্পের কাছে। তোমার আগের গল্পগুলো যেমন মনস্তত্ত্বকে নির্ভর করে বেড়ে ওঠেছে এ গল্পটিও তেমনি। তোমার লেখায় কবিতা গল্পে ম্যাচুরিটি অনেক বেশী। যৌনতা আছে কিন্তু যৌনতাকে এমন ভাবে অন্যান্য বিষয়গুলো ঘিরে ধরে যে যৌনতা গৌন হয়ে উঠে। এ জন্য ওইসব জায়গা অশ্লীল লাগে না। খুব প্রিয় গল্পকার হয়ে উঠছ।

    উত্তরমুছুন

মন্তব্যের যাবতীয় দায়ভার মন্তব্যকারীর। সম্পাদক কোন দায় নেবে না।